অনির পর্ব-০৯

0
18

নবম পর্ব

এই পুকুরটা তোমাকে দেখানোর খুব শখ ছিল আমার
ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। বলল
আমারও দেখার খুব শখ ছিল
আমরা বসে আছি আমার ক্যাম্পাসের লেকের ধারে। শরৎ শেষ হয়ে হেমন্ত শুরু হয়েছে কেবল। এবার বৃষ্টি ভালো হওয়াতে গাছের পাতায় ধুলোর আস্তরণ নেই। গরম ও অপেক্ষাকৃত কম। দিনের দৈর্ঘ্য ছোট হতে শুরু করেছে। পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে পুকুরের পানিতে।
আমার রুম থেকে বেরিয়ে ওকে নিয়ে এসেছি আমার ক্যাম্পাসে। ওর সহজ হতে অনেকটা সময় লেগেছে। আমি জানি ও খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। হুট করে সবকিছু বলতে পারবে না, তাই ওকে বাইরে নিয়ে গেছি। নিঃসন্দেহে ও পথে কিছুই খায়নি। ওকে বাইরে নিয়ে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। অগত্যা এখানে নিয়ে এসেছি, যদি কিছু বলে।

এই পুকুরের কথা একবার ওকে লিখেছিলাম চিঠিতে, বলেছিলাম এই পুকুরের জলে তাকিয়ে থাকলে তোমাকে দেখতে পাই। ক্লাসের ফাঁকে আমরা প্রায়ই এখানে এসে বসতাম। সে সময় আমি ওকে দেখিনি। তখন আকাশের মেঘে, পুকুরের জলে রাতের আকাশের তারায় শুধু ওর মুখ খুঁজতাম। আর যখন ওকে দেখলাম আমার সব কল্পনা হারিয়ে গেল; মনে হল মনের মধ্যে যে শূন্যস্থানটা ছিল তা যেন পুরোপুরি ওর মাপেরই। এই কথাটা কোন একটা বইতে পড়েছিলাম।বাস্তবে এমন ভাবে তা সত্যি হতে পারে সে সময় অনুভূব করতে পারিনি।
ও আনমনা হয়ে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম
এবার বলতো সত্যি করে, কি হয়েছে?
ও আমার দিকে তাকালো। আমার বুক কাঁপছে। মনে হচ্ছে এই বোধ হয় ও ভয়ানক কোন কথা বলবে আর আমার জীবনটা পুরোপুরি বদলে যাবে॥
আমি ভীষণ ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করি না। ও একটু দম নিল। বোধ হয় মনে মনে গুছিয়ে নিল কি বলবে। তারপর বলল

একটু পেছন থেকে বলতে হবে তা নাহলে সবটা বোঝানো যাবে না
বলতে থাকো, আই এম এ গুড লিসেনার
ও একটু দম নিয়ে বলা শুরু করল
বাবার অসুস্থতার কথা তো তোমাকে আগেই বলেছি। এবার যে স্ট্রোকটা করেছে এটা সেকেন্ড স্ট্রোক ছিল। এর আগে বাবা আরেকটা স্ট্রোক করেছিল। সেই সময় আমার পরীক্ষা চলছিল বলে কেউ আমাকে জানায়নি। সে সময় অবশ্য জাহিদ ভাই বাসায় ছিলেন। জাহিদ ভাই আমার ফুফাতো ভাই । বড় পুকুর বড় ছেলে।

তোমাকে বলা হয়নি, আমরা যে বাড়িটাতে থাকি এটা আমার দাদার বাড়ি। আমাদের ছোটবেলায় একতলা বাড়ি ছিল। পরবর্তীতে গ্রামের অন্য সব সম্পত্তি বিক্রি করে এই চার তলা বাড়িটা তৈরি করা হয়। দাদাভাই বেঁচে থাকতেই বাবা আমাদের গ্রামের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে এই বাড়িটা চারতলা বানিয়েছেন। দাদাভাই চাইতেন ভাই বোনের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকুক তাই মৃত্যুর আগে এই বাড়িটা আমার দুই ফুফু আর বাবাকে লিখে দিয়ে যান। বাবার কোন ভাই নেই তাই তিন তলা চারতলা নিয়ে আমরা থাকতাম দোতলায় আমার বড় ফুফু থাকে। একতলাটা ছোট ফুফুর নামে। ছোট ফুপু এখানেই থাকে চট্টগ্রামে।
যেটা বলছিলাম, এবার যখন বাবা অসুস্থ হয় তখন রাতুল মানে বড়ফুফুর ছোট ছেলেই সব করেছে। রাতুল আমার সমবয়সী। শাহজালাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। আমি যেদিন সিলেটে পৌঁছাই সেদিন জাহিদ ভাইও এসে পৌঁছলো। তারও এক সপ্তাহ পর আমরা বাবাকে বাড়িতে নিয়ে গেলাম।

বাবা শারীরিকভাবে যতটা না, তার চাইতে বেশি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। এমনিতেই মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা অসুস্থ থাকতেন। বাড়ি ফেরার পর সব আত্মীয় স্বজনেরা বাবাকে দেখতে আসে। সেসময়য় ছোট ফুফু সেখানে আসে।

এতোটুকু বলে ও একটু থামলো। আমি বললাম

তারপর কি হল? সবাই চাইছে জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক?

ও চট করে একবার আমার দিকে তাকালো। বলল
তুমি কি করে বুঝলে?

এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ক্যালকুলেশন। তারপর কি হল বল।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না তাই রাতুলের সঙ্গে কথা বললাম। রাতুলের পরামর্শ মতই জাহিদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম। জাহিদ ভাই যেটা বলল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না
কি বলল?
বলল, যেটা হচ্ছে হতে দে। এখন এসব বলে মামাকে আর টেনশনের মধ্যে ফেলিস না
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। আমি যতদূর জানতাম জাহিদ ভাইয়ের পছন্দের কেউ আছে। আবারো বললাম, জাহিদ ভাই আমি একজনকে ভালোবাসি আমাদের সম্পর্ক প্রায় এক বছরেরও বেশি।
জাহিদ ভাই বলল এটা কোন ব্যাপারই না। বিয়ের আগে এরকম একটা দুইটা সম্পর্ক থাকেই। আমি ওসব নিয়ে পরবর্তীতে তোকে কিছু বলবো না। বড়দের কথা শুনে এতটা ভয় পাইনি কিন্তু….
তোমার এই জাহিদ ভাই কি করেন?
বিসিএস ক্যাডার, রাজশাহীতে পোস্টেড
ও আচ্ছা, তারপর কি হল বল
আমি রাতুলকে দিয়েও তাকে বলালা্‌ লাভ হলো না। শেষমেশ উপায়ান্তর না দেখে আমি বাবার সঙ্গে কথা বলি। বাবা সব শুনে তোমার ব্যাপারে জানতে চাইলো
তুমি কি বললে
সেটা সত্যি তাঁর সবই বলেছি।
উনি কি বললেন?
অনিমা জবাব দিল না, চুপ করে রইল। আমি একটু হাসলাম। বললাম
উনি রাজি হয়নি তাই তো?
হু
ঠিক কি বলেছেন কোথায় আপত্তি?
বাবার কথা হচ্ছে এই মুহূর্তে এত দায়িত্ব নেওয়া তোমার পক্ষে সম্ভব না তাছাড়া তোমার ফ্যামিলি ও মেনে নেবে না।
বিয়ে কবে?
ও চমকে আমার দিকে তাকালো। বলল
মানে?
মানে, বিয়ের তারিখ কবে ঠিক হয়েছে?
ও খুব আস্তে আস্তে বলল
জানুয়ারিতে। যেদিন সব ঠিক হয় আমি তারপর দিনই ফিরে যাই॥ এসব চিঠি লিখে তোমাকে জানাতে পারতাম কিন্তু আমার একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছা করছিল। কিছু ভাবতে পারছিলাম না তাই চলে এসেছে
ভালো করেছো। এখন চলো
কোথায় যাব
আজ তারটা তুমি হলে থাকবে হিয়ার সঙ্গে\
হিয়া কে?
আমার ক্লাসমেট। সমস্যা হবে না ও তোমার কথা জানে
আমার কথা ?
হ্যাঁ আমি ওকে দিয়ে তোমার বাড়িতে ফোন করিয়েছিলাম
ও অবাক হয়ে বলল, কবে?
পরশুদিন। এখন চলো তো কাল সকালে রওনা দিতে হবে।
কোথায় রওনা দেব?
ঢাকায়
কাল ঢাকা আর পরশুদিন আমরা সিলেট যাব । আমি ওনার সঙ্গে কথা বলব।
কি কথা বলবে
এক বছর সময় চাইবো।
তোমার বাসায় জানাবে না ?
এই মুহূর্তে না। এখন ওঠো তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ও আমার একটা হাত ধরে বলল
মুনির
বল
বাবা রাজি হবে না
আমারও সেরকম ধারনা। তবু আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই ; যদি রাজি না হন তাহলে আমি বাসায় কথা বলব।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে