অষ্টম পর্ব
তুমি এখানে?
আমি ভূত দেখার মতন চমকে উঠলাম। সাধারণত ছুটির দিনে আমি দুপুরের খাবার পর একটু বিশ্রাম নেই। পরীক্ষা এসে গেছে তাই খাওয়া শেষ করে রুমে এসে তৈরি করে নিচ্ছিলাম একটু লাইব্রেরী যাব বলে। দরজার কাছে এসেই যেন বিদ্যুৎপৃষ্ট হলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল বোধহয় স্বপ্ন দেখছি। আমার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে অনিমা। মুখে ক্লান্তির ছাপ, চুল এলোমেলো; বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘ যাত্রার ধকল ওকে পেয়ে বসেছে। আমার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে ও ফ্যকাসে একটু হাসলো। তারপর বলল
ভেতরে আসতে বলবেনা?
আমি ওর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলাম। বললাম
তুমি এখানে কেমন করে এলে? একাই এসেছো?
ও চারিদিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। মানে একাই এসেছে। আমি আবারও বললাম
ঢাকা থেকে একা এসেছো? আমাকে একবার ফোন করতে পারতে। এভাবে একা একা এখানে আসাটা তোমার একেবারেই উচিত হয়নি। তোমাকে এই পর্যন্ত পৌঁছে দিল কে?
মুহূর্তেই ওর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ও থমথমে কণ্ঠে বললো
আমি তোমার রুম নাম্বার জানি।
আমি অসম্ভব ঠান্ডা মাথার মানুষ, চট করে বিচলিত হয়ে যাই না; তবুও আমার মাথা কাজ করছিল না। অনেক রকম চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বারবার মনে হচ্ছিল। কি হতো যদি আমি রুমে না থাকতাম, যদি ও অন্য কারো খপ্পরে পড়ে যেত। কত রকম বিপদ হতে পারতো ঢাকা থেকে এখানে আসার পথে। আমি গম্ভীর গলায় বললাম
তোমার এভাবে রুমে চলে আসাটা উচিত হয়নি, নিচে থেকে ফোন করতে পারতে বা কাউকে পাঠাতে পারতে
আমি ওর নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই বিচলিত ছিলাম যে একবারের জন্যও মনে হলো না যে ওইভাবে ও এখানে ছুটে এসেছে নিশ্চয়ই বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে। আমার মাথায় তখন অন্য সব দুশ্চিন্তা ঘুরছিল মনে হচ্ছিল যদি কোন বিপদ হতো। আমার কথা শুনে ও কেমন কেঁপে উঠলো,
কাঁধে ব্যাগ তুলে নিয়ে অভিমানী কন্ঠে বলল
ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। তোমাকে একবার দেখতে ইচ্ছা করছিল এজন্য এসেছিলাম। তোমাকে বিপদে ফেলতে আসিনি
তারপর আর এক মুহূর্ত দাড়াল না, দরজার দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল। আমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করলাম। ও দরজার কাছে চলে এসেছে। চোখের দিকে তাকাচ্ছে না। মুখ নামিয়ে রেখেছে তবুও আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর চোখ ভর্তি হয়ে আছে জলে।
ও দরজার কাছে এসে বলল
দরজা ছাড়ো, আমি বের হব
কোথায় যাবে এখন?
ফিরে যাব
এখন কি করে যাবে, এ সময় তো কোন বাস ট্রেন কিছুই নেই
তোমাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি যেভাবে একা এসেছি সেভাবে একাই যেতে পারবো।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি রাগ রে বাবা! একটুখানি কথা বলেছি তাতেই এত অভিমান? আমি কি এমনি এমনি বলেছি ওর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল বলেই তো বললাম। ও দরজার আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে আবারো বলল
দরজা ছাড়ো
এত কাছে থেকে আমি ওকে আগে কখনো দেখিনি। ওর গোলাপী গাল অভিমানে লাল হয়ে আছে, চোখের পাতা ভেজা আর নিচের ঠোঁটটা তির তির করে কাঁপছে। আমি হঠাৎই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারালাম, দুই হাতে ওকে নিটোল মুখটা তুলে ধরে বললাম
আমাকে দেখতে এসেছ, না দেখেই চলে যাবে?
ও জবাব দিলো না একবার চোখ তুলে চাইল না পর্যন্ত। আমি আর একটু এগিয়ে এসে ও টুল্টুলে মুখটা দু চোখ ভরে দেখতে লাগলাম। চোখের পাতার কাঁপন, অভিমানী ফুলে ওঠা ঠোঁট । আমার ভিতরে কি করে যেন হঠাৎ সব কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। আমি ওকে বুকের মধ্যে মিশিয়ে নিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলাম।
আচমকা আমার এমন আচরণে ও কেমন একটু কেঁপে উঠল, তবে বাধা দিল না। আমি জীবনে কখনো কোন মেয়ের এত কাছে আসিনি। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে আমি যে এমন কিছু করতে পারি আমার ধারনাতেও ছিল না। যে সময়কার কথা বলছি তখন এটা খুব সাধারণ কোন ঘটনা ছিল না। এই কারণে আমি অনেক সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছি। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তাঁর চেয়েও বড় যেটা, আমি ওর শরীরে সমর্পণের ভাষা টের পাচ্ছিলাম। ও আমার বুকের কাছে শার্টের অংশটা খামচে ধরেছে এত জোরে যে মনে হচ্ছে ছিড়েই ফেলবে।
আমি কতটা সময় ওর মধ্যে ডুবে ছিলাম নিজেও জানিনা, এক সময় টের পেলাম ওর ভেজা গাল। মুহূর্তেই আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। এটা কি করছি আমি? একটা বন্ধ ঘরে এইভাবে একটা অসহায় মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছি। কতটা ভরসা করে ও আমার কাছে এসেছে। কতটা ভালবাসলে, কতটা নির্ভর করলেই এভাবে আসা যায়, আর আমি তার এই প্রতিদান দিচ্ছি। তীব্র অপরাধবোধে আমি কেমন কুঁকড়ে গেলাম। ওকে ছেড়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললাম
অনিমা আই এম সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে।
ও কিছু বলছে না, মুখ নামিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওর চোখের ভাষা পড়তে পারছি না। ও কি রেগে আছে নাকি এই মুহূর্তে আমাকে ভীষণভাবে ঘৃণা করছে। যেটাই হোক না কেন দুটোর কোনটাই নেয়ার মতন ক্ষমতা আমার নেই। আমি আবারো বললাম
অনিমা এদিকে দেখো, একবার তাকাও আমার দিকে। ও মুখ তুলে চাইল। ওর চোখে কি ছিল আমি জানিনা তবে সেই দৃষ্টি দেখে আমি শিউরে উঠলাম। সাহস সঞ্চয় করে বললাম
তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?
ও মুখ নামিয়ে দুই দিকে মাথা নাড়লো
ভয়ে উৎকন্ঠায় আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, বারবার মনে হচ্ছে এই বোধহয় ও চোখ তুলে আমার দিকে তীব্র ঘৃণা নিয়ে তাকাবে। আমি আবারো বললাম
বিশ্বাস করো আমি এমন কিছু চাইনি।
ও কোন জবাব দিচ্ছে না। আমি মরিয়া হয়ে বললাম
কিছু একটা বলো প্লিজ
ও আচমকাই দুই হাতে আমার গলার জড়িয়ে ধরে বলল
আমাকে কোনদিন ছেড়ে যেওনা মুনির, কোনদিনও ছেড়ে যেও না
আমার এতক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে জমাট বাধা ভয়, উৎকণ্ঠা, দ্বিধা সব কোথায় উধাও হয়ে গেল নিজেও জানিনা। আমি দুই হাতে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে বললাম
কোনদিনও যাবো না, কোনদিন ও না।
আমি টের পাচ্ছি ওর শরীরটা কেপে কেঁপে উঠছে। আমার ঘাড়ে মুখ খুঁজে ও কাঁদছে নিঃশব্দে। আমি বাধা দিলাম না, ওকে কাঁদতে দিলাম; নিশ্চয়ই এতটা পথ ধরে অনেক কষ্ট, অভিমান, যন্ত্রণা বুকে করে নিয়ে এসেছে আমার কাছে। এই চোখের জলের সঙ্গে ধুয়ে মুছে যাক ওর সমস্ত কষ্ট। আমি ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বললাম
কি হয়েছে আমাকে বলবেনা
ও চোখ মুছে সরে দাঁড়ালো। ম্লান একটু হেসে বলল
আমি এখন যাই
কেন ভয় করছে?
ও অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, যেন আমার কথার মানে বুঝতে পারেনি। আমি ওর হাত দুটো আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম
আমাকে ভয় করছে?
ও এতক্ষণে আমার কথার মানে বুঝল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি। ও নিজের হাত দুটো ছাড়িয়ে দিল তারপর খুব আস্তে আস্তে আমার বুকের মধ্যে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করল, ধীরে ধীরে বলল
এখানে আসার আগ পর্যন্ত খুব ভয় করছিল জানো, ভীষণ ভয় করছিল, এখন আর করছে না।
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। আমার মতো নগন্য একজন মানুষকে কি এতখানি ভরসা করা উচিত? আমি কি একজন রক্ত মাংসের মানুষ নই? আমার মধ্যে কি কামনা বাসনা বলে কিছু নেই? আমি ওর চিবুকটা তুলে ধরে বললাম
সত্যি?
ও অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর থেমে থেমে বলল
তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি?
চলবে………