#অনপেখিত
#পর্ব_৩
লিখা: Sidratul Muntaz
তিশা মেহেককে নিয়ে রান্নাঘরে চলে এলো। এখনও তেমন কেউ ঘুম থেকে উঠেনি। লিয়া শুধু সিংকের উপর পিড়ি রেখে রুটি বেলছে। মেয়েটির বয়স বারো বছর। সে এই বাড়ির স্থায়ী কাজের লোক না। লিয়ার মা এই বাড়িতে কাজ করেন। তিনি আপাতত অসুস্থ আছেন। তাই লিয়াকে প্রক্সি দিতে পাঠিয়েছেন। বাচ্চা মেয়ে হলেও লিয়া কাজ ভালোই পারে। সুন্দর করে গোল গোল রুটি বেলতে পারে। এদিকে মেহেক জীবনে কখনও রান্নাঘরেই পা রাখেনি। সে গ্রামের মেয়ে হলেও তার আব্বা হচ্ছেন গ্রামের জমিদার। জমিদারের মেয়ে হিসেবে খুব আদর-যত্নেই লালিত-পালিত হয়েছে মেহেক। ছোটবেলা থেকে খুব উড়নচণ্ডী হওয়ায় লেখাপড়াটাও ঠিকমতো করা হয়নি তার। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল মেহেক। তার পেছনে ছেলেরা লাইন লাগিয়ে রাখতো। ক্লাস এইটে পড়া অবস্থায় বখাটেদের যন্ত্রণায় তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া মেহেকেরও লেখাপড়ায় তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই মেহেকের বাবা মোজাম্মেল শাহ ঠিক করলেন লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে এবার মেয়েকে বিয়ে দিবেন। তবে শুধুমাত্র এই কারণেই যে মোজাম্মেল সাহেব মেহেককে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা কিন্তু না। এর পেছনে আরও একটা বড় কারণ ছিল। সেটাই মূল কারণ। কিন্তু সেই মূল কারণের কথা মেহেকের বাবা-মা ছাড়া অন্যকেউ জানে না। মেহেক যতই সুন্দরী হোক, ক্লাস এইট পাশটাও করেনি সে। সেভেন পাশ একটি মেয়ের জন্য ভালো পাত্র পাওয়া খুব সহজ কথা নয়। মেহেকের জন্য কোনো ভালো ঘর থেকে প্রস্তাব আসে না। আর যারা প্রস্তাব দেয় তারা হয় হতদরিদ্র, নাহলে পাত্রের বয়স পঞ্চাশোর্ধ, মাথায় টাক, নতুবা পাত্র গন্ডমুর্খ। আর যার সবদিক দিয়ে মোটামুটি ঠিকাছে, তাকে আবার মেহেকের পছন্দ হয় না। তো সব মিলিয়ে ব্যাটে বলে মিলছিল না। শেষমেষ পাওয়া গেল আমেরিকা ফেরত, ডিগ্রীধারী ব্রিলিয়ান্ট, সুদর্শন, বড়লোকের নাতি ফারদিন হাসানকে। ফারদিনকে একবার দেখেই মেহেক বিয়েতে মত দিয়ে ফেললো। মোজাম্মেল সাহেবও আকাশের তারার মতো জামাই পেয়ে বেজায় খুশি। কোনোমতে মেয়েকে এই ছেলের ঘাড়ে গছিয়ে দিতে পারলেই ল্যাঠা চুকে যায়। সেটাই করলেন তিনি। যত সংক্ষিপ্ত উপায়ে সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেললেন। ফারদিন এখনও মেহেকের সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। মেহেক যে লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা সেটাও ফারদিনের অজানা। সে মেহেককে একটা বিশেষ কারণে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু যেদিন সে আসল সত্যি জানবে সেদিন হয়তো বুঝবে, তাকে ঠকানো হয়েছিল। আর যারা তাকে ঠকিয়েছে, তারা ফারদিনের অত্যন্ত কাছের মানুষ। তিশা চপিং বোর্ডে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ কাটছিল। মেহেক এই জিনিস টিভি ছাড়া অন্যকোথাও দেখেনি। তার মা-চাচীরা তো বটি দিয়েই সব কাজ করে৷ মেহেক জানে সে কিছু করতে পারবে না৷ তাও ভদ্রতার খাতিরে বলল,” ভাবী, দিন আমি কেটে দেই।”
” আরে না, না, তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো তো। আমাদের সাথে গল্প করো তাহলেই হবে। কাজ করার দরকার নেই।”
” কি গল্প করবো?”
” তোমার বাড়ির কথা বলো। কয় ভাই-বোন যেনো তোমরা?”
” আমার কোনো ভাই-বোন নেই। আমি একা।”
” তাই? তাহলে নিশ্চয়ই খুব আদরের মেয়ে।”
” হুম। কিন্তু আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বাবা আমার চেয়ে আমার চাচীর ছেলেদের বেশি আদর করে। আসলে বাবার ছেলের খুব শখ ছিল তো।”
” আহারে, থাক কষ্ট পেয়ো না। বাবা আদর করেনি তো কি হয়েছে? আমার দেবর কিন্তু তোমাকে অনেক আদর করবে।”
এই কথা শুনে পেছন থেকে লিয়া ফিক করে হেসে দিল। আর মেহেকের মুখ লজ্জায় লাল টুকটুকে হয়ে উঠলো। যেনো গালে কেউ আলতা ঘষে দিয়েছে তার। তিশা পেছনে তাকিয়ে লিয়াকে ধমক দিল,
” এই বড়দের কথা তুই শুনছিস কেন? কাজ কর মন দিয়ে।”
গল্প-গুজব করতে করতে সময় কেটে গেল। ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে। শুধু ফারদিন নেই। এটা নিত্যদিনের ঘটনা। সে কারো সাথে ব্রেকফাস্ট করে না৷ তার খাবার উপরে দিয়ে আসা হয়। আজকে ফারদিনের দাদু আরশাদ সাহেব আদেশ করলেন,” বিলেতিয়ানা এখানে চলবে না। তিশা,ওকে বলো নিচে এসে আমাদের সাথে খেতে। কোনো ভদ্রবাড়ির ছেলে কি বারোটা পর্যন্ত ঘুমায়? এটা কোনো কথা?”
তিশা নরম সুরে বলল,” দাদাজান, আমি এখনি মেহেককে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ও গিয়ে ফারদিনকে ডেকে নিয়ে আসবে।”
” হুম।”
তিশার কথা বলার ধরণ শুনে মনে হলো দাদাশ্বশুরকে সে ভালোই সমীহ করে। আর কালকে ফারদিনের ভাব-গতিক দেখে মনে হলো দাদুকে সে ভালোই ভয় পায়। সুতরাং, এই দাদুমশাই হলো মেহেকের প্রধান অস্ত্র। ফারদিনকে বাঘে আনতে হলে আগে এই দাদুমশাইকে হাত করতে হবে। মেহেক ব্যাপারটা ভালো মতো মগজে ঢুকিয়ে নিল। তিশা মেহেকের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
” যাও তো মেহেক, যেভাবে পারো ফারদিনকে ডেকে আনো। ও কিন্তু সহজে বিছানা ছেঁড়ে উঠবে না। তুমি প্রয়োজনে ওর বিছানায় পানি ঢেলে দিবে।”
” পানি ঢালবো?”
” হ্যাঁ! তোমার ভাই ঘুম থেকে না উঠলে আমি তো এটাই করি।”
মেহেক মুখ টিপে হাসতে হাসতে ফারদিনের ঘরে গেল। না, সে ফারদিনকে পানি ঢেলে উঠাবে না। তার এতো সুন্দর দেখতে একটা মাত্র বর। সে কিছুতেই তার এই বরকে কষ্ট দিতে পারে না। আদর করে ডাকবে, প্রয়োজনে গালে চুমু দিবে। মেহেকের একটা চুমু খেলেই ফারদিন ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠবে। মেহেক জানে সেটা। যেই ভাবা সেই কাজ। ফারদিনের কাছে গিয়ে বেশ শক্ত করে তার গালে চুমু বসিয়ে দিল মেহেক। ফারদিন সত্যি সত্যি ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠলো। যেনো চুমু নয়,তার গালে কেউ সুঁচ গেঁথে দিয়েছে। অথবা সাপের ছোবল খেয়েছে এমনভাবেই লাফিয়ে উঠলো। ফারদিনের আকস্মিক লাফিয়ে উঠা দেখে মেহেক নিজেও কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। ফারদিন গালে হাত রেখে চোখ কপালে তুলে প্রায় বজ্রকণ্ঠে বলল,
” এইটা কি হলো?”
মেহেক দুইহাত মুখে ঠেকিয়ে হাসতে হাসতে বলল,” কি আবার হবে? চুমু হলো!”
এই কথা বলেই এক চোখ টিপল মেহেক।
” কি?”
ফারদিনের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এতো জোরে সে ‘কি’ উচ্চারণ করল যে মেহেক কান চেপে ধরতে বাধ্য হলো। এরপর ভ্রু কুচকে বলল,” উফফ, এতো জোরে কি, কি করছেন কেন? আপনি চুমু বোঝেন না? চুমু মানে কিস।”
ফারদিন তার জীবদ্দশায় এতোটা বিচলিত আর হতবাক কখনও হয়নি। সে বিস্মায়াবিষ্ট দৃষ্টিতে চেয়েই রইল ষোল বছরের পুচকী মেয়েটির দিকে। মেহেক একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল,
” দাদু আপনাকে নিচে যেতে বলেছে।”
দাদুর কথা শুনে মনে হয় একটু নরম হলো ফারদিন। কিন্তু তার চেহারায় এখনও রাগের স্ফুলিঙ্গ দপদপ করছে। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটাকে শীল-নোড়ায় পিষতে ইচ্ছে করছে। গালে ম্যাসাজ করতে করতে ফারদিন বলল,
” নিচে পরে যাবো। আগে বলো তুমি এইটা কেনো করলে? কোন সাহসে?”
” কোনটা করলাম আমি?” বেশ ইনোসেন্ট শোনালো মেহেকের গলা। ফারদিন মনে মনে মেহেককে ইচ্ছেমতো গালি দিয়ে বলল,” মানে এই কি..”
‘ কিস’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েও থেমে গেল ফারদিন। ছি, শব্দটা মুখে আনতেও তার কেমন যেনো লাগছে। মেহেক ঠোঁট টিপে হাসি আটকালো। ফারদিন আগুন গরম দৃষ্টিতে বলল,” এই, এই, তুমি হাসছো কেন?”
” স্যরি, আর হাসবো না। আসলে কি হয়েছে, আপনার গালে মশা বসেছিল। আমি তো শুধু মশাটা তাড়ানোর জন্য ওই কাজটা করেছি। আপনি আবার আমাকে ভুল বুঝবেন না।”
” তুমি মশা তাড়ানোর জন্য করেছো? আমাকে শেখাও? মশা এইভাবে তাড়ায়?”
” হ্যাঁ, তাড়ায় তো। এটাই মশা তাড়ানোর উৎকৃষ্ট টেকনিক। কেনো আপনি জানতেন না? আচ্ছা, এরপর থেকে যদি আমার গালে কখনও মশা বসে আপনিও এইভাবে ট্রাই করে দেইখেন! তাহলেই বুঝবেন।”
মেহেক কথা শেষ করে শয়তানি হাসি দিল।ফারদিন রাগে গজগজ করে কিছু বলতে যাচ্ছিল তখনি মেহেক তার সুরে বলল,” দাদু ডাকছে, দাদু ডাকছে, দাদু ডাকছে!”
এভাবে বলতে বলতে মেহেক রুম থেকে বের হয়ে গেল। ফারদিন মনে মনে কম হলেও দশবার মেহেককে অসভ্য বলে সম্বোধন করল। এতো নির্লজ্জ মেয়ে সে কখনও দেখেনি। কখনও না!
চলবে