অদ্ভুত কান্না ৩য় পর্ব

0
1687

অদ্ভুত কান্না ৩য় পর্ব

.
বিজ্ঞানমনষ্ক হাবিব ক’দিন আগেও ভুতপ্রেতে বিশ্বাস করতো না ! অথচ নাদিয়ার অস্বাভাবিক কার্যকলাপে সে আজ ভুতপ্রেত নিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি বসবাস করছে, হাবিবের শাশুড়ি রেহানা বেগমের উদ্যোগে আজ তারা রওয়ানা দিচ্ছে হরিপুর, উদ্দেশ্যে ভুতপ্রেত-আত্মা তাড়ানোর কবিরাজ নির্মুল বিশ্বাসের কাছে নাদিয়াকে নিয়ে যাওয়া।
রেহানা বেগমের মাথায় কবিরাজ ঢুকছে, আর হাবিবের মাথায় ক’দিন যাবত ঢুকে আছে, যেদিন রাতে নাদিয়া রান্নাঘরে কান্নার শব্দ শুনতে পেলো, সেদিন সন্ধ্যায় রান্নাঘরে নাদিয়া একা ছিলো, তখন চৈতালী তাকে ফোন করে জবিদাসের ফাস লেগে মরে যাবার কথা বলেছিল, আমি যখন রান্নাঘরে গেলাম, গিয়ে দেখলাম নাদিয়াকে অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে, যেটাকে তখন আমি মন খারাপ ধরেছিলাম, মন খারাপ দেখে আমি নাদিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ফোন দিয়েছিল ? নাদিয়া তখন চৈতালীর কথা আড়াল রেখে বললো, ‘বাড়ি থেকে কল আসছে’। তখন তাকে এতো অস্বাভাবিক দেখাচ্ছিল যে, আমি উল্টা জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি, ‘কি কথা হলো যার কারণে তোমার মন খারাপ ?’
এদিকে রেহানা বেগম এবং চৈতালীকে যখন আমি জিজ্ঞেস করলাম অল্পবয়সী জবিদাস কিভাবে মারা গেলো ? তারা তখন গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়ার ব্যাপারটা আড়াল রাখার জন্য প্রশ্নটাই এড়িয়ে গেলো, কিন্তু হরিপুর গিয়ে জানলাম জবিদাস গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করছে, জবিদাস কেন আত্মহত্যা করলো সেটা এখনও জানা হয়নি, সেটা আমার জানতে হবে,
হরিপুর যাবার জন্য তারা একটা সিএনজি ভাড়া নিলো, নাদিয়া এখন খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে, দেখে কেউ বলতে পারবেনা নাদিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ।
কবিরাজ নির্মুল বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে গাড়ী থামলো, রেহানা বেগম গিয়ে দরজার কড়া নাড়াচ্ছেন, একজন খাটো করে কালো লোক দরজাটা খুলে দিলেন, উনার গায়ে কোনো কাপড় নেই পরনে শুধু একটা সাদা ধবধবে লুঙ্গী আছে, মাথার মধ্যে একটা লাল সুতো বাধা।
উনি দরজা খুলে বললেন, আপনারা ঐ ঘরটায় গিয়ে বসেন।’
হাবিব বুঝতে পারলো, এই ঘরে নির্মুল বিশ্বাস রুগী দেখেন।
ঘরের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত অদ্ভুত গাছ ।
হাবিব রেহানা বেগমকে বলল, ‘কবিরাজ কই ?’
রেহানা বেগম মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ‘আরে যে দরজা খুলে দিলো উনিই কবিরাজ নির্মুল বিশ্বাস ।’
হাবিবের এখানে একদম ভালো লাগছেনা, কিরকম অন্য গ্রহে চলে আসছে মনে হচ্ছে।
এতক্ষণে নির্মুল বিশ্বাস আসলেন, আসার পর উনার বসার একপাশে আতর জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন, ‘আপনারা ‘খাঁন’ বাড়ি থেকে এসছেন মনে হয়।’
-রেহানা বেগম বললেন, ‘হ্যা আমরা খাঁন বাড়ি থেকে এসছি।’
-‘খান সাহেব নিশ্চয় জানেন না আপনারা একজন হিন্দু কবিরাজের কাছে আসছেন।’
– ‘জ্বী উনি জানেন না।’
হুম জানলে আপনাদের আসতে দিতেন না, এখন বলেন কেন এসছেন ?
-রেহানা বেগম বলতে শুরু করলেন ‘আমার মেয়েটা কিছুদিন যাবত মাঝরাতে কান্না শুনে ঘুম থেকে উঠে, মাঝেমাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, রান্নাঘরে গেলে নাকি শুনতে পায় কে ছাদে পা টেনে টেনে হাটছে, জ্বামাই বাবাকে কাছে যেতে দেয়না, গেলে নাকি জ্বামাইকে মেরে ফেলবে, কিছুদিন যাবত সে এরকম অবস্থা করছে।
-নির্মুল বিশ্বাস মুচকি হেসে বললেন, ‘রেহানা বেগম, আমার ধারণা, আপনি জানেন আপনার মেয়েটার কেন এমন হচ্ছে, না হলে আপনি আমার কাছে নিয়ে আসতেন না, আপনার মেয়ের নাম নাদিয়া, তাই তো ?’
– ‘ হ্যাঁ ওর নাম নাদিয়া ।’
-‘জবিদাস যেদিন আত্মহত্যা করছে সেদিন থেকে আপনার মেয়ে এরকম করছে, এটা যে আত্মার প্রতিশোধ সেটা তো স্পষ্ট বুঝতে পারছেন রেহানা বেগম, জবিদাস কেন মারা গেছে এলাকার সবাই এখন কমবেশি জানে।’
-‘রেহানা বেগম কিছুটা বিব্রতবোধ করলেন, তারপর বললেন, ‘কবিরাজ সাহেব, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি, ওর নাম হাবিব, আমার মেয়ের জামাই।’
হাবিবের মাথাটা ঝিমঝিম করা শুরু হয়ে গেলো, একটু আগে সে কি শুনলো, কবিরাজ কি বলতে চাইলেন, ‘জবিদাস যেদিন আত্মহত্যা করছে, সেদিন থেকে নাদিয়ার সমস্যা দেখা দিছে, সেটা তিনি বলছেন আত্মার প্রতিশোধ , সাথে সাথে শাশুড়ি আম্মু বিষয়টা আমার কাছ থেকে আড়াল রাখার জন্য কৌশলে কবিরাজকে জানিয়ে দিলেন আমাদের জামাই সাথে আছে। রহস্যটা কি ? তাছাড়া জবিদাসের আত্মা কেন নাদিয়ার উপর প্রতিশোধ নিবে! হাবিব অন্যমনষ্ক হয়ে এসব ভাবছে।
রেহানা বেগম কবিরাজকে বললেন আপনার নাম্বারটা দেন, প্রয়োজনে কল দেবো, এখন আমরা উঠছি।
তারা বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো, হাবিব তাকিয়ে দেখলো, নাদিয়ার চোখমুখে ভয়ের ছাপ ভেসে উঠছে।
নাদিয়া কি এমন করলো, যার কারণে জবিদাসের আত্মা নাদিয়ার উপর শাস্তি নিচ্ছে, তাছাড়া মৃত মানুষের আত্মা আবার প্রতিশোধ নিতে পারে নাকি ? কীসব আজগুবি কথাবার্তা এসব ! নাদিয়া কবিরাজের কথাটা নিজ কানে শুনেছে আত্মা তার উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে, এরপর থেকে নাদিয়াকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, আশেপাশের বাতির আলো নাদিয়ার মুখে এসে পড়ছে, অসম্ভব সুন্দর একটা মুখ, দেখলে শুধু দেখার ইচ্ছে করে।
এতক্ষণে তারা বাসায় পৌছে গেলো, নাদিয়াকে নিয়ে রেহানা বেগম নামলেন, হাবিব সিএনজির ভাড়া দিয়ে তাদের পেছন পেছন যাচ্ছে, ভাবছে আজ রাত সে নাদিয়ার সাথে থাকবে।
রাতের খাবার খেতে সবাই একসাথে বসলো, কবিরাজের কথা শুনার পর থেকে নাদিয়া কিরকম নিরব হয়ে গেছে, হাবিব মোটেও বিশ্বাস করছে না আত্মা প্রতিশোধ নিবে, কিন্তু নাদিয়া হয়তো সেটা বিশ্বাস করে বসে আছে, আচ্ছা জবিদাস যেদিন আত্মহত্যা করছে সেদিন কি নাদিয়াকে কেউ বলেছে জবিদাসের আত্মা তোকে ক্ষমা করবেনা, কবিরাজের কথায় যতটুকু বুঝা গেলো, জবিদাসের আত্মা কিসের একটা প্রতিশোধ নিবে নাদিয়ার উপর, নিশ্চয় নাদিয়া জবিদাসের সাথে এমন কোনো অপরাধ করেছে, আর সেটা এলাকার কমবেশি মানুষ জানে, তাহলে চৈতালী বা অনুপম রায় নাদিয়াকে ঐদিন সন্ধ্যার সময় বলতে ও পারে, ‘তোকে জবিদাসের আত্মা ক্ষমা করবেনা, জবিদাসের আত্মা তার প্রতিশোধ নিবে।’
কিন্তু চৈতালীর সাথে আমার কথা হইছে, অনুপমের সাথে হয়নি।
হঠাৎ হাবিবের বিষম লেগে যাওয়ায় বলল, ‘পানি পানি’।
নাদিয়া হাবিবের চোখমুখ লাল দেখে অস্থির হয়ে গেলো, পানি এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছো হাবিব, কি হইছে তোমার ? রীতিমতো কান্না শুরু করে দিলো নাদিয়া।’
-হাবিব ভাবছে নাদিয়া এতো অস্থির হলো কেন ? অন্যমনষ্ক হয়ে খাবার খেলে বিষম লাগা স্বাভাবিক, কিন্তু নাদিয়া এই বিষম লাগাতে কি আত্মার প্রতিশোধের কিছু দেখছিলো নাকি ?
হাবিব নাদিয়াকে মুচকি হেসে বলল, ‘বিষম লাগছিলো, এখন আমি ঠিক আছি, কিন্তু তুমি ঠিক নেই নাদিয়া, তুমি আত্মার প্রতিশোধ খুজে বেরাচ্ছ ?’
খাবার শেষে হাবিব রেহানা বেগমকে বলল, ‘আম্মু আজকে আমি নাদিয়ার সাথে থাকবো।’
-‘কিন্তু নাদিয়া যদি ভয় পায়।’
-‘তখন না হয় আপনাকে ডাকবো।’
নাদিয়া এবং হাবিব ঘুমোতে গেলো, ঘুমে নাদিয়ার চোখ বন্ধ হয়ে আসলো, হাবিব ঘুমোতে পারছেনা এলোমেলো চিন্তায়, ভাবছে নাদিয়াকে জবিদাসের কথা জিজ্ঞেস করবে, জবিদাস কেন মারা গেলো, জবিদাস কেন তার উপর প্রতিশোধ নিবে ? সে কি অপরাধ করেছে ?
তবে হাবিব তার জায়গা থেকে নিশ্চিত আত্মা কখনো প্রতিশোধ নিতে পারেনা, ইসলাম বা বিজ্ঞান কোনোকিছু এটা গ্রহণ করেনা, এই ধারণাটা হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে, কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান সবসময় হিন্দুদের সংস্পর্শে ছিলো, তাই কিছু সংখ্যক মুসলমান হয়তো মনে করে মৃত ব্যাক্তির আত্মা তার উপর প্রতিশোধ নিতে পারে, নাদিয়া ও তাদের দলের একজন। কিন্তু নাদিয়ার সাথে যা ঘটছে তা তো আমি নিজেই দেখছি, সেটা কেন হচ্ছে নাদিয়ার সাথে, নাদিয়াকে কি ডাক্তার দেখাবো ? নাকি আমি একা গিয়ে কোনো সাইকোলজিস্টের কাছ থেকে পরামর্শ নেবো, হুম তা করা যেতে পারে। তার আগে আমার জানতে হবে নাদিয়া আর জবিদাসের কি সম্পর্ক ছিল ? জবিদাসের সাথে কি এমন করেছিল নাদিয়া, যার জন্য নাদিয়া এবং ওর আম্মু বিশ্বাস করছেন নাদিয়ার উপর জবিদাসের আত্মা প্রতিশোধ নিতেই পারে।
হঠাৎ নাদিয়া ঘুমের মধ্য হাবিবকে খামচে ধরলো, তারপর ঘুম থেকে উঠলো, হাবিব নিরব দর্শকের মতো দেখছে নাদিয়ার আচরণ। নাদিয়া একদম ঘেমে গেছে, হাবিব নাদিয়াকে মুচকি হেসে বলল, ‘ জবিদাসের আত্মা বুঝি স্বপ্নে প্রতিশোধ নিতে আসছিলো ?’
-নাদিয়া কাপা গলায় বলল, ‘ হ্যাঁ, এসছিল প্রতিশোধ নিতে, তোমাকে বেধে রেখে আমাকে এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে কাপড়-চোপর টেনেটুনে ছিড়তে শুরু করলো, কিন্তু
তুমি কি করে জানলে হাবিব ?’
-‘আরও অনেক কিছু জানতে পারতাম আমি, যদি জবিদাসের বিষয়টা আমাকে স্পষ্টভাবে বলতে, কবিরাজের কথায় যতটুকু বুঝলাম তুমি জবিদাসের কোনো ক্ষতি করেছো, তাই ওর আত্মা তোমার উপর প্রতিশোধ নেবে।
-হাবিব আমি ক’দিন যাবত ভাবছি তোমাকে জবিদাসের বিষয়ে সবকিছু বলবো, কাল ডায়েরিতে আমি সব লিখে রেখেছি, আমার খুব বেশি অপরাধবোধ হচ্ছে, তোমাকে না জানালে আমি শান্তি পাবো না। ডায়েরি টেবিলে রাখছি, আমি ঘুমিয়ে গেলে তুমি পড়ে নিও ।’
-চলবে
লেখকঃ jobrul islam habib

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে