অদৃশ্য দেয়াল পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
11

#অদৃশ্য_দেয়াল।
পর্ব:- ছয়।(শেষ)
লেখা: সিহাব হোসেন।

নাহিদ যে আসলে কোনো সরকারি চাকরি করে না, এই সত্যটা জানার পর আরিশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, এত বড় একটা প্রতারণা তার সাথে হতে পারে। সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাহিদকে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন তোমরা আমাকে এভাবে ঠকালে?”
– “এখানে ঠকানোর কী আছে? চাকরি সরকারি হোক বা বেসরকারি, তোমাকে খাওয়ানোর মতো সামর্থ্য তো আমার আছে।”
– “তাই বলে এত বড় একটা মিথ্যা?”
– “মানুষ তো মিথ্যা বলতেই পারে। তোমাদের তো উচিত ছিল বিয়ের আগে সবকিছু ভালোভাবে যাচাই করা। তা না করে সরকারি চাকরির কথা শুনেই তোমাদের মতো লোভী পরিবারগুলো মেয়েদের ছেলের হাতে গছিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। আর এই লোভের কারণেই শেষ পর্যন্ত তোমাদের কপালে এমন মুলাই জোটে।”
নাহিদের কটু কথায় আরিশা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তার বলার মতো আর কোনো ভাষা ছিল না।

ওদিকে, আফজাল সাহেব যেদিন এনজিও থেকে টাকা ফেরত পাওয়ার কথা, তার আগেই সংবাদপত্রে খবর এল যে, পুরো কোম্পানিটাই ছিল এক প্রতারক চক্র। তারা প্রথমে মানুষকে দ্বিগুণ টাকার লোভ দেখিয়ে বিশ্বাস অর্জন করত, আর পরে যখন মানুষ লোভে পড়ে বড় অঙ্কের টাকা রাখত, তখনই সব নিয়ে উধাও হয়ে যেত। এই খবরটা আফজাল সাহেবকে একেবারে ভেঙে দিল। এক মাস পরেই সমিতির টাকাগুলো মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে। জমানো গয়না আর গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে সব মিলিয়ে বড়জোর দশ-বারো লাখ টাকা জোগাড় হবে। এখন একমাত্র উপায় হলো বাড়ি বিক্রি করা, কিন্তু এত অল্প সময়ে ভালো দামে বাড়ি বিক্রি করাও প্রায় অসম্ভব।

এত বড় মানসিক চাপের মধ্যেও তার উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে না দেখে তিনি নিজেই অবাক হচ্ছিলেন। হয়তো আল্লাহ তাকে তার কর্মফল ভোগ করানোর জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি তার পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছে টাকার জন্য ধরনা দিলেন, কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করতে রাজি হলো না। অবশেষে দোকানের মালপত্র সব বিক্রি করে কোনোমতে পনেরো লাখ টাকা জোগাড় হলো। কিন্তু এখনো অনেক টাকা বাকি। তিনি যখন বাড়ি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন সুযোগসন্ধানী ক্রেতারা এমন দাম বলতে লাগল যা শুনলে কান্না পায়। তিনি তার বড় মেয়ের স্বামীকে টাকার জন্য অনুরোধ করলেন, কিন্তু সে সাফ মানা করে দিল। নাহিদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য থাকলেও তারা যে এক পয়সাও দেবেন না, তা তিনি ভালো করেই জানতেন।

এরই মধ্যে নাহিদ আরিশাকে বাবার বাড়ি থেকে টাকার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। আরিশা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,
– “আব্বুর যে অবস্থা, এই মুহূর্তে তিনি এতগুলো টাকা কীভাবে দেবেন, বলো?”
– “টাকা দিতে পারবে না, তাহলে এত টাকা মোহরানা বেঁধেছিলে কেন? হয় টাকা দেবে, নয়তো মোহরানা পরিবর্তন করে আমি যা দিতে চেয়েছিলাম, সেটাই লিখবে। নইলে আমার বাড়ি বিক্রি করে হলেও তোমার মতো মেয়েকে আমি রাখব না। আর যদি মনে করো, টাকা পেয়ে নিজের রূপ-যৌবন দেখিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে, তাহলে মনে রেখো, সেটা আর সম্ভব হবে না। কারণ সবাই ততদিনে জেনে যাবে তোমরা কেমন লোভী আর প্রতারক। তখন তোমাকে সবাই ভোগ করতে চাইবে, কিন্তু বিয়ে কেউ করবে না।”

নাহিদের কথায় আরিশা দুলে উঠল। সে কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছিল না। অবশেষে সে বাধ্য হয়েই মোহরানা দুই লাখ টাকা নিতে রাজি হলো। নাহিদ তৎক্ষণাৎ সেই টাকা পরিশোধ করে দিল, কিন্তু এরপর থেকে আরিশার জীবনটা যেন ন*রকে পরিণত হলো। নাহিদ তাকে আর আগের মতো দেখতে পারে না, সামান্য ভুলেই অকথ্য ভাষায় গা*লিগা*লাজ করে, বাজে ব্যবহার করে। আরিশা তার সব দুঃখের কথা লিমার সাথে ভাগ করে নিল। সব শুনে লিমা শুধু বলল,
– “দেখলি তো, এজন্যই বলি, মানুষকে কখনো অবহেলা করতে নেই। কখন কার অবস্থা কেমন হয়, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।”

রিফাতের বিয়ের তারিখটা কিছু কারণে চার মাস পিছিয়ে গিয়েছিল। সেই বিয়ে উপলক্ষে লিমাকেও দাওয়াত করা হয়েছিল। সায়ন নিজেই তাকে বাড়ি থেকে নিয়ে এল। রাবেয়া বেগম লিমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। সায়ন দুদিন আগেই তার বাবা-মাকে লিমার কথা সব খুলে বলেছে।

বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে লিমা সায়নের ঘরে এসে তার বিছানায় বসল। সায়নের বাবা-মা তখনো অনুষ্ঠানেই ছিলেন। এমন সময় সায়ন ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্তের জন্য লিমার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। কিন্তু সায়ন তাকে অবাক করে দিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তার কোলে মাথা রাখল। লিমা বেশ অবাক হয়ে গেল। সায়ন আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলতে লাগল,
– “আমি তোমাকে সেই স্কুলজীবন থেকেই পছন্দ করতাম, কিন্তু কখনো বলার সাহস হয়ে ওঠেনি। আমি সবসময় তোমাকে নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু যখন আমার পড়াশোনাটা আর হলো না, তখন ধরে নিয়েছিলাম, তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখাটা আমার জন্য মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তোমার মতো ধনী পরিবারের মেয়েকে আমার মতো ছেলের হাতে কেউ তুলে দেবে না। তাই তো মা-বাবা যার সাথেই বিয়ে ঠিক করতে চাইত, আমি রাজি হয়ে যেতাম। কিন্তু জানো, যেদিন আমি তোমাকে আবার দেখলাম, আর জানলাম যে তোমার জীবনে আজ পর্যন্ত কেউ আসেনি, সেদিন থেকে আমি আবার নতুন করে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি। বিশ্বাস করো লিমা, আমি জানি, তোমার মতো করে আমাকে আর কেউ কোনোদিন বুঝবে না, ভরসা দিতে পারবে না। আজ আমি তোমাকে আমার সারাজীবনের জন্য চাইছি। প্লিজ, আমাকে ফিরিয়ে দিও না।”

সায়নের কথায় লিমার চোখ ছলছল করে উঠল। সে আলতো করে সায়নের মাথাটা কোল থেকে তুলে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। দুই হাতে সায়নের মুখটা ধরে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক স্নিগ্ধ হাসি। যে হাসি তার না বলা সমস্ত কথাই যেন এক নিমিষে বলে দিল, ভালোবাসার এক নীরব, কিন্তু শক্তিশালী অঙ্গীকার।

সায়ন উঠে দাঁড়াল। লিমার হাত ধরে সে তাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তাদের ভাড়া বাড়ির সামনেই বিশাল এক জায়গা, উঁচু দেয়ালে ঘেরা। সায়ন সেই ঘেরা জায়গার দরজা খুলে লিমাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। লিমা ভেতরে ঢুকে অবাক হয়ে দেখল, একপাশে ফুলে ফুলে ভরা এক মনোরম বাগান। গোলাপ, গাঁদা, জবা, সব ধরনের ফুলের গাছ সেখানে লাগানো। আর এক কোণে রয়েছে ছোট্ট এক বেলি ফুলের ঝাড়, যার মিষ্টি সুবাস বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সায়ন স্নিগ্ধ গলায় বলতে লাগল,
– “যেদিন থেকে আমি জেনেছি তুমি ফুল অনেক ভালোবাসো, সেদিন থেকেই মনে মনে ঠিক করেছি, তোমাকে আমি এমন একটা ফুল বাগানের মালিক বানাব। কী, হবে আমার এই ফুল বাগানের মালিক?”
লিমা হেসে উঠে উত্তর দিল,
– “মালিক কেন, তুমি যদি আমাকে এই বাগানের মালিও বানাতে চাও, আমি তাতেই রাজি।”
– “আমার মহারানি কখনো মালি হতে পারে না।”
লিমা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “কিন্তু এই জায়গাটা কার?”
– “কেন, আমার।”

লিমা এবার পুরোপুরি বিস্মিত। যার নিজের বাড়ি নেই বলে এত অবহেলা, এত অপমান, সে কি না এত বড় একটা জায়গার মালিক! সায়ন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,
– “কী, বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই তো? একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, আল্লাহ চাইলে ফকিরকে বাদশাহ বানাতে এক মুহূর্তও সময় নেন না।”
– “হুম। কিন্তু এখন তোমার আরিশার বাবার পাশে দাঁড়ানো উচিত।”
– “হ্যাঁ, আমি দাঁড়াব, চিন্তা করো না। তুমি আজ বাসায় গিয়ে কথা বলো। আমি আর দেরি করতে চাই না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাকে আমার বউ করে আনতে চাই।”
– “ভেবো না। আমার বাবা-মা তোমার কথা সবকিছুই জানেন।”

সায়ন তার কথা রেখেছিল। সে আফজাল সাহেবের পাশে এসে দাঁড়াল, তবে শর্ত হিসেবে তার পুরো বাড়িটা কিনে নিল। আফজাল সাহেব হতবাক হয়ে গেলেন। যে ছেলেকে তিনি বাড়ি নেই বলে এত অপমান করেছেন, আজ সে শুধু তার বাড়িই কিনে নিল না, এর চেয়েও বড় এক জায়গার মালিক সে, এই বাস্তবতা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিল। তিনি সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলেন, অহংকারের প*তন অনিবার্য আর কোনো মানুষকে ছোট করে দেখার পরিণাম কতটা ভয়াবহ হতে পারে।

অনেক দিন পর। আরিশা রাতের বেলা বেলকনিতে একা বসে আছে। আজ সায়ন আর লিমার বিয়ে হয়েছে। নাহিদ নিঃশব্দে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর শান্ত গলায় বলল,
– “আজ ওদের বিয়েতে গিয়েছিলাম। লিমা অনেক ধনী আর সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। অথচ তোমরা একদিন বলতে, সায়নের কপালে কেউ জুটবে না। কিন্তু দেখো, ভাগ্যের কী পরিহাস! আজ ওর মনের মতো মানুষ, নিজের বাড়ি, সহায়-সম্পদ, সবই হয়েছে। আর তোমার, সবকিছু থেকেও যেন কিছুই নেই। সামান্য একটু টাকা-পয়সা হলেই আমরা অহংকারী হয়ে উঠি, সাধারণ মানুষের সাথে অদৃশ্য এক দেয়াল তুলে দিই। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এই অহংকার একদিন ঠিকই শেষ হয়ে যায়।”

এই বলে নাহিদ সেখান থেকে চলে গেল। আরিশার মনে পড়ল, কয়েকদিন আগে সায়ন তাকে বলেছিল:
– “তোকে অনেক ধন্যবাদ। তুই সেদিন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করলে হয়তো আমি কোনোদিন লিমাকে পেতাম না। আসলে, কিছু খারাপ ঘটনার পেছনেও অনেক ভালো কিছু লুকিয়ে থাকে। প্রয়োজন শুধু একটুখানি ধৈর্যের। আর ভালোবাসা কখনো শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিবের ভেদাভেদ মানে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শিক্ষিত হওয়ার আগে একজন ভালো মানুষ হওয়া আর মনুষ্যত্ববোধ থাকাটা অনেক বেশি জরুরি।”

সায়নের কথাগুলো আরিশার কানে বাজতে লাগল। সে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে হয়তো জল ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরটা পুড়ছিল এক গভীর অনুশোচনার আগুনে। যে সুখ সে একদিন পায়ে ঠেলেছিল, আজ তা অন্যের হয়ে গেছে, আর সে রয়ে গেছে এক শূন্যতার মাঝে, যেখানে অহংকারের ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই নেই।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে