অতন্দ্রিলার_রোদ (পর্ব:৫ – রাগ করা যাবে না))

0
1604

#অতন্দ্রিলার_রোদ
পর্ব : ৫ – (রাগ করা যাবে না)

লেখা : শঙ্খিনী

“কাজটা কিন্তু তুমি মোটেও ঠিক করলে না মা।”
হতাশ গলায় বলল রোদ।
ফিরোজা বললেন, “কেন? কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা কি তোর কাছ থেকে শিখতে হবে নাকি?”
“পৃথিবীর অন্য যেকোনো ব্যাপারে শিখতে হবে না। কিন্তু আমার ব্যাপারে শিখতে হবে।”
“বেশ তো, বল না কি শেখাবি আমায়?”
“মা তুমি কিন্তু বলেছিলে শুধু দেখতে গেলেই চলবে। এখন এই বিয়ের কথা আসলো কোত্থেকে?”
“একটা মেয়েকে দেখে আসলাম, তাকে খুব পছন্দও করলাম। এখন তার সাথে তোর বিয়ের কথা আগাবো না?”
“না আগাবে না। তুমি খুব ভালো করে জানো আমি বিয়ে করতে পারবো না।”
“কেন পারবি না? বাবা একটু বোঝার চেষ্টা কর, তুই যার কথা ভেবে বিয়ে করতে চাচ্ছিস না সে তোর আর নেই এ পৃথিবীতে।”
“মা প্লিজ! ভালো লাগছে না আর এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে ভালো লাগছে না।”
আহত গলায় কথাগুলো বলে নিজের ঘরে চলে এল রোদ।

কাছের মানুষের মৃত্যুতে হ্যালুসিনেশন ব্যাপারটা স্বাভাবিক। কারো ক্ষেত্রে এর মাত্রা হয় বেশি, আবার কারো ক্ষেত্রে কম।
রোদের ক্ষেত্রে এই হ্যালুসিনেশনের মাত্রাটা তীব্র। শুধু তীব্র বললে ভুল হবে,ভয়ংকর তীব্র।
চার বছর হয়েছে ইরার মৃত্যুর, কিন্তু আজও রোদ বাড়ির প্রতিটি কোণায়, প্রতিটি কনায় অনুভব করে ইরাকে। ইরার হাসির শব্দ, কান্নায় শব্দ, নূপুরের শব্দ, গুনগুন করে গাওয়া গানের শব্দ এখনো কানে আসে রোদের।
এই ব্যাপারটা রোদের ভালোই লাগে। রোদ মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভুলতে চায় না ইরাকে।

ঘরে আসতেই মনে হলো ইরা যেন কথা বলছে। কঠিন গলায় ইরা বলছে, “এই তুমি কেমন মানুষ বলো তো! আমি চলে যাওয়ার আগে না তোমাকে বলে গেলাম, চমৎকার একটা মেয়েকে বিয়ে করতে। তুমি বিয়ে করতে রাজি না কেন সত্যি করে বলতো? আমার কথার কোনোই মূল্য নেই না?”

রোদ ভড়কে উঠে আশেপাশে তাকায়। না, ইরা তো কোথায় নেই!
কথাগুলো তাহলে কে বলল? ইরা নাকি রোদের অবচেতন মন?
রোদকে বেশ বিপর্যস্ত মনে হচ্ছে।

কিছুক্ষণ কাটতেই রোদ আবার মায়ের কাছে গেল। তার চোখভর্তি পানি। মনে হচ্ছে কয়েক মুহূর্ত আগে প্রচুর কান্নাকাটি করেছে।

রোদ ফিরোজার কোলে মাথা রাখতে রাখতে বলল, “ইরা যাওয়ার আগে তোমাকে আমার আবার বিয়ে করা নিয়ে কি বলেছে মা?”
ফিরোজা আহত গলায় বললেন, “বলেছে, অনেক কথাই বলেছে। সেগুলো আমি তোকে বলবো না। তুই কষ্ট পাবি।”
“আমার জীবনের সব কষ্ট আমি সেদিনই পেয়ে গেছি মা।”
“তোর কষ্ট আর বাড়াতে চাই না বাবা। শুধু এতটুকু বলতে পারি ইরা আমার বৌমা ছিল না ও ছিল আমার মেয়ে। অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা আগে ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে মেয়েটা আমাকে বলেছিল তোকে আবার বিয়ে দিতে। আমি শুধু ইরার ওই কথাগুলো ভেবেই তোকে বিয়ে দিতে চাচ্ছি।”

রোদ এবার উঠে বসল।
মাকে জড়িয়ে ধরে, কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ইরা আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেল মা? কেন?”

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত কোনো ভাষা ফিরোজার জানা নেই। তিনি কেবল অসহায়ের মতো ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন।

আজ বুধবার।
অতন্দ্রিলাদের বাড়িতে আসবেন ফিরোজা ও রোদের চাচা, বিয়ের কথা পাকা করতে। সকাল থেকেই মহা উৎসাহের সঙ্গে রান্না বান্না সহ বাড়ির যাবতীয় কাজ করছেন শায়লা।
কেউ তাকে দেখলে ধারনাই করতে পারবে না, দুদিন আগে বাড়ি থেকে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিলেন।
শায়লার একটা বিশেষত্ব হল, যখন তার কারো উপর রাগ হয় তখন সেই রাগের পরিমাণটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। তবে যত দ্রুত রাগটা বাড়ে, তত দ্রুতই আবার কমে যায়। উনি বেশি দিন কারো উপর রাগ করে থাকতে পারেন না।
হামিদ সাহেবের উপর রাগটা ১৯ বছর ধরেও কমেনি। কিন্তু অতন্দ্রিলার বিশ্বাস, এই রাগ একদিন কমবে। কমতেই হবে।

নিচে বসার ঘরে চলছে অতিথি আপ্যায়নের দীর্ঘ পর্ব। বিয়ের দিন ক্ষণ ঠিক করার সময় অতন্দ্রিলাকে সেখানে ডাকা হবে। আপাতত
সে নিজ ঘরে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

তখনি সন্ধ্যা অতন্দ্রিলার ঘরে এলো।
হতাশ গলায় বলল, “আমার কিন্তু এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুই এ বিয়েতে রাজি!”
অতন্দ্রিলা বলল, “আর আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি এ বিয়েতে রাজি নও! বাবা, মা, দাদি সবাই যখন রাজি তখন তোমার এত আপত্তির কি হলো আপা?”
সন্ধ্যা বসতে বসতে বলল, “যাই বল না কেন, তুই কিন্তু অস্বীকার করতে পারবি না যে তোর বিয়ে হয়েছে একজন ত্রুটিপূর্ণ মানুষের সাথে!”
“আপা দেখো, আমি একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে। সেই অর্থে আমিও ত্রুটিপূর্ণ। তো ত্রুটিতে ত্রুটিতে কাটাকাটি!”
“আচ্ছা, তুই ব্রোকেন ফ্যামিলির মেয়ে হলে আমি কি? মধুর হাড়ি? আমার কি ভালো ঘরে বিয়ে হয়নি?”
“আপা তুমি তো প্রেম করে বিয়ে করেছো!”
“তাহলে তুইও প্রেম কর!”
“আপা আমি প্রেম করতে পারি না আর পারবোও না। তাইতো বাবার পছন্দের পাত্রের সাথে খুশি মনে বিয়ে করতে যাচ্ছি!
আর আপা শোনো, পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই কম বেশি ত্রুটি আছে। এটা কোনো বিষয় না।”
“আচ্ছা? তোর জাভেদ ভাইয়ের মধ্যে কি ত্রুটি আছে শুনি?”
“আপা জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটির খাতা একবার খুললে তা বন্ধ করতে করতে রাত বারোটা বেজে যাবে।”
“বাজুক বারোটা! আমি শুনতে চাই, খোল তোর খাতা!”
“তাহলে শোনো। জাভেদ ভাইয়ের ত্রুটিগুলোর মধ্যে প্রধান এবং বিরক্তিকর ত্রুটিটি হলো, সে প্রতিটা কথা দুবার করে বলে। যেটা একটা সুস্থ মানুষকে মানসিক অসস্তিতে ফেলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়া তিনি ভয়ংকর অগোছালো। একটা টুথপেস্ট জায়গা মত রাখতে পারেন না।”
“এগুলো তোর কাছে ত্রুটি?”
“অবশ্যই ত্রুটি! মানুষের স্বভাবগত ত্রুটিগুলো সমাজগত ত্রুটির থেকে বড়।”
সন্ধ্যা রাগে অভিভূত হয়ে বলল, “যা খুশি ভাব!”

ঘন্টাখানেক পর নিচে অতন্দ্রিলার ডাক পরল। বিয়ে ঠিক করা হয়েছে, দেড় মাস পর। ১৮ অক্টোবর। অতন্দ্রিলা কিছুটা শান্তির নিশ্বাস ফেলল, তার ধারনা ছিল হয়তো আগামী সপ্তাহেই বিয়ে ঠিক করা হবে।

ফিরোজা হাসি মুখে এত অতন্দ্রিলাকে বললেন, “মা, তুমি কিছু বলতে চাও?”
অতন্দ্রিলা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আপনাদের বাড়িতে কয়জন কাজের লোক?”
শায়লা ইতস্তত হয়ে বললেন, “আহ্ অত! কি বলছিস এসব?”
ফিরোজা বললেন, “না, না ঠিক আছে। আ আমাদের বাড়িতে আটজন কাজের লোক আছে। কেন বলো তো মা?”
“বিয়ে হওয়ার পর সেই আটজনের মধ্যে থেকে একজন যদি আমাদের বাড়িতে আসে এবং আমাদের জরিনা যদি আমার সাথে আপনাদের বাড়িতে যায় তাহলে কি আপনাদের কোনো অসুবিধা আছে?
“না, না মা কোনো অসুবিধা নেই। একজন কেন, প্রয়োজন হলে আরও আটজন পাঠিয়ে দেব এ বাড়িতে!”
“আমার বাবা এবং দাদীর জন্যে একজনই যথেষ্ট, আটজন এসে পরলে তারা নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়ে ফেলবেন।”

বিকেলের দিকে অতিথি চলে গেলে, জরিনা অতন্দ্রিলার ঘরে যায়।
গম্ভীর গলায় অতন্দ্রিলাকে বলল, “আফা আমি আপনের লগে ওই বাড়িতে যামু না!”
“কেন?”
“ওইটা মরা বাড়ি আফা! মরা বাড়িতে ভূত থাকবো না তা কি হয়?”
“ভূত থাকবে ভূতের মতো, আর তুমি থাকবে তোমার মত! অসুবিধাটা কোথায়?”
“আফা কম বয়সী মাইয়ার ভূত! ভোর রাইতে আমার চুল ছিরা নিয়া যাইবে।”
“তুমি খালি ক্ষতিটাই দেখলে, সেখানে গেলে যে তোমার কত লাভ তা আর দেখলে না?”
জরিনা চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “কি লাভ আফা?”
“দেখো, এখানে তোমাকে সব কাজ করতে হয়। ঘর মোছা, ঘর গোছানো, বাসন পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া, রান্না করা – সব!
আমি চলে যাওয়ার পর তুমি পরবে আরেক বিপদে। সেটা হলো দাদীকে ওষুধ খাওয়ানো, দাদীর উদ্ভট সব শখ মেটানো।
কিন্তু ভেবে দেখো, আমার সাথে যদি তুমি ওই বাড়িতে যাও তাহলে কিন্তু তোমাকে তেমন কোনো কাজই করতে হবে না। তোমার প্রধান কাজ হবে আমার কাজে আমাকে হাতে হাতে সাহায্য করা।
আমি তোমাকে জোর করছি না, কিন্তু সিন্ধান্ত তোমার। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে ওই বাড়িতে নিয়ে যাবো না আমি।”
জরিনা কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আফা আফনে না অনেক ভালা মানুষ। সত্যই তো আমি এই কথা ভাইবা দেখি নাই!”
“এখন তো ভাবলে! এবার যাও বেশি কথা না বাড়িয়ে আমার জন্য কফি বানিয়ে আনো।”
“অক্ষণি আনতেসি আফা!”
ঘর থেকে হড়বড় করে বেরিয়ে গেল জরিনা।

মানুষকে এমন ছোটখাটো লোভ দেখাতে ভালোই লাগে অতন্দ্রিলার।‌
অতন্দ্রিলার কোনো বন্ধু নেই। স্কুল কলেজে অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবী থাকেলও তাদেরকে কখনোই ভরসাযোগ্য বন্ধু বলে মনে করেনি সে।
অতন্দ্রিলার দরকার এমন একজন বন্ধু, যাকে সে নির্বিকারে সকল সমস্যার কথা বলতে পারবে।
জরিনাকে অতন্দ্রিলা বন্ধু মনে করে না। কিন্তু জরিনার অযৌক্তিক কথাগুলো মন ভালো করে দেয় তার। তাই জরিনাকে সাথে নিয়ে যাওয়া।

কিছুদিন পরের ঘটনা।
সন্ধ্যা এবং শায়লা অতন্দ্রিলাকে নিয়ে বিয়ের শপিং করতে এসেছেন। হামিদ সাহেব তাদের সঙ্গে আসেননি। তার কথা, “শপিং-টপিং হচ্ছে মেয়েলি কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে আমি জড়িয়ে নিজের সময় নষ্ট করতে চাই না।”
ওদিকে ফিরোজাও রোদকে এসেছেন বিয়ের শপিং করতে।
দুই পরিবার একসঙ্গে বিয়ের শাড়ি পছন্দ করছে। এসব কেনাকাটা অতন্দ্রিলার তেমন একটা পছন্দের না হলেও, আজ সে আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহন করছে।

কেনাকাটার পুরো সময়টায় রোদ সকলকে একটু এড়িয়ে চলে। অতন্দ্রিলার দিকে একবার তাকিয়েছিল, তাও আবার তিন সেকেন্ডের জন্যে।

রোদ চাইছে অতন্দ্রিলাকে রাগাতে। রোদের ধারনা এই মুহুর্তে মেয়েটাকে এড়িয়ে চললে, সে ভীষন রেগে যেতে পারে। রাগটা এতটাই তীব্র হবে যে মেয়েটা বিয়ে পর্যন্ত ভেঙে দিতে পারে।
এতে অতন্দ্রিলা মোটেও রাগ করেছে না। স্বাভাবিক ভাবেই দেখছে বিষয়টাকে।
কারন রোদের এই ধারনার কথাটা বুঝে গেছে অতন্দ্রিলা।
তাই আর যাই হোক, রাগ করা যাবে না।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে