অতন্দ্রিলার রোদ (পর্ব:৭ – বাসর)

2
1680

#অতন্দ্রিলার_রোদ
লেখা : শঙ্খিনী

পর্ব ৭ : (বাসর)

বাসর হবে রোদের বাড়িতে। বাসর নিয়ে কম বয়সী মেয়েদের উৎসাহের সীমা নেই। এগার-বারো‌ বছর বয়সী একটা মেয়ে বাসর ঘরের খুঁটিনাটি সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

অবশেষে অতন্দ্রিলাকে বাসর ঘরে রেখে যাওয়া হলো। ঘরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। খাটে গাঢ় নীল রঙের চাদর বিছানো, গোলাপ এবং বেলি ফুল দিয়ে সাজানো।
খাটের ডান পাশের টেবিলে ফুলদানি, ফুলদানিতেও গোলাপের গুচ্ছ। লাল রঙের গোলাপ অতন্দ্রিলার পছন্দ নয়। তার পছন্দ কালো গোলাপ।
খাটের বাম পাশে আরেক টেবিল। সেখানে, পেস্তা বাদাম দেওয়া দুধের এক অদ্ভুত শরবত। শরবতটা যে রেখেছে তাকে এখন অতন্দ্রিলার প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, “এক গ্লাস শরবত রেখেছেন কেন? জানেন যে ঘরে দুজন মানুষ থাকবে! দু গ্লাস রাখলে কি ক্ষতি হতো?”
অতন্দ্রিলার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, কিন্তু শরবতটা কার জন্যে রাখা ব্যাপারটা নিশ্চিত না হয়ে খাওয়া যাচ্ছে না।
শরবতের পাশে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। এই জিনিসটাও অতন্দ্রিলার ভীষন অপছন্দের।
যে মিষ্টি রেখেছে তার উচিত ছিল মিষ্টির পাশাপাশি ঝাল কিছুও রাখা।

অতন্দ্রিলার তৃষ্ণা বেড়ে গেল। তাই সে এবার খাট থেকে উঠলো। ঘরের কোনায় প্রকাণ্ড এক উঁচু ধরনের টেবিল। এই টেবিলে অবশেষে পাওয়া গেল পানির জগ। অতন্দ্রিলা পানি খেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেল।
অতন্দ্রিলার চোখ পড়ল এক বিশাল বুকশেলফের দিকে। এত বই এক জীবনে পড়ে শেষ করা যাবে কিনা এ ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সন্দেহ হচ্ছে তার।

বুকশেলফের বইগুলো সুন্দর করে সাজানো। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলো একদিকে, রবীন্দ্রনাথের বইগুলো একদিকে এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বইগুলো একদিকে। মজার ব্যাপার হলো বুকফেলফে এই তিনজন লেখক ছাড়া আর কারো বই নেই।
হয়তো এনারা রোদের প্রিয় লেখক। ইরার প্রিয় লেখকও হতে পারে।

বুকফেলফটা খোলাই ছিল। অতন্দ্রিলা একটা বই নিল, হুমায়ূন আহমেদের ‘আজ হিমুর বিয়ে’। বইটি অতন্দ্রিলা সারা জীবনে ২৩ বার পড়েছে। কিন্তু প্রতিবারই পড়ার সময় নতুন মনে হয়।
অতন্দ্রিলা বইটা খাটে রাখল।

হঠাৎ চোখ পরল খাটের পেছনের দেয়ালে। ইনিই তাহলে ইরাবতী! তিনি দেখতে কিছুটা রাজারানীদের মত। অতন্দ্রিলা আরো ভালো করে দেখল। কে ইনি? বাংলা সিনেমার নায়িকা নন তো? না, না। বাংলা সিনেমার নায়িকারা এত রূপবতী হয় না!

এ বাড়িতে অতন্দ্রিলার বন্ধু হতে পারে এমন মানুষ নেই। ফিরোজা সুন্দর মনের মানুষ, তবে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে কিনা এ বিষয়ে ক্ষীণ সন্দেহ আছে অতন্দ্রিলার। আর রোদ! রোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে বলে মনে হয় না।
বন্ধুত্ব হতে পারে এমন একজন মানুষকেই খুঁজে পেল অতন্দ্রিলা, সে হলো ইরা।

অতন্দ্রিলা ইরার ছবিটার সামনে দাড়িয়ে বলল, “বুবু, এতদিনে আমার নাম নিশ্চই শুনেছেন। তারপরও আবার বলছি, আমার নাম অতন্দ্রিলা। আমার সঙ্গে আপনার রোদের বিয়ে হয়েছে। তবে আপনি কিন্তু একদম চিন্তা করবেন না! আপনার রোদ আজীবন আপনারই থাকবে। তাকে আপনার থেকে কেড়ে নেওয়ার কোনো শখ আমার নেই। আর আমি কিন্তু আপনাকে বুবু ডাকবো। সিনেমায় দেখেছি, নায়কের দ্বিতীয় স্ত্রীরা প্রথম স্ত্রীকে বুবু বলে সম্বোধন করে।”

রোদ অতন্দ্রিলাকে বিয়ে করেছে অনিচ্ছায়, মায়ের কথা রাখতে। তাই বাসর ঘরেও খানিকটা দেরি করে আসবে। প্রথমে সে চাইবে অন্য ঘরে ঘুমাতে, পরে ফিরোজা অনেকক্ষণ ধরে অনুরোধ  করবেন। প্রথমে রাজি না থাকলেও পরে রাজি হয়ে আসবে বাসর ঘরে। 
অনেকটা সময়ের মামলা। অতন্দ্রিলার ইচ্ছে করছে ঘুমিয়ে পরতে, কিন্তু সেটা অভদ্রতা হবে। তাই ঘাপটি মেরে বসে বইটা পরছে। বইয়ের প্রথম পাতায় কলম দিয়ে গোটা গোটা করে লেখা, “রোদের মত ঝলমল রোদকে, ইরা”।
তারমানে বই পড়ার নেশাটা রোদের।

ঘন্টাখানেক পর দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। অতন্দ্রিলার নাকে এলো এক পারফিউমের গন্ধ। গন্ধটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
এই একই গন্ধটা পেয়েছিল যখন রোদকে তার পাশে বসানো হয়েছিল। তাহলে অবশেষে মহাশয় এলেন।

রোদ কিছু বলতে যাবে, তার আগেই
         অতন্দ্রিলা বইয়ের দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, “আপনি কিছু বলার আগে জানিয়ে রাখি, এ ঘরে কিন্তু গোপন ক্যামেরা লাগানো আছে!”
         রোদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “গোপন ক্যামেরা?”
          “শুধু ক্যামেরাই না সাউন্ড রেকর্ডারও আছে।”
           “তুমি জানলে কি করে?”
           “ওইযে একটা বাচ্চা মেয়ে ছোটাছুটি করতে, ওর মুখে শুনেছি। ক্যামেরা খাটের পেছনে, ফুলের আড়ালে। আর সাউন্ড রেকর্ডার খাটের নিচে। আপনি প্লিজ এগুলো বন্ধ করে দেবেন? আমি এখন বইটা রেখে উঠতে পারবো না।”
          রোদ ক্যামেরা, সাউন্ড রেকর্ডার বন্ধ করতে করতে কিছুটা বিরক্তি নিয়ে অতন্দ্রিলাকে বলল, “তুমি যখন আগে থেকেই জানতে তখন বন্ধ করলে না কেন?”
           “ইচ্ছে করেই বন্ধ করিনি। আপনাকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আপনার বোনেরা কতটা অভদ্র।”
রোদ খানিকটা অবাক হলো। বাহ্! মেয়েটা তো বেশ ভালোই সত্য কথা বলতে পারে।
           
রোদ অতন্দ্রিলার সামনে এসে বসল। অতন্দ্রিলা মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।
            রোদ শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে একটা জরুরী কথা বলার আছে।”
             “বলুন শুনছি।”
             “দেখো, আমাকে আমার মা জোড় করে বিয়ে দিয়েছেন। আমি নিজের ইচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করিনি। তোমাকে কোনো রকম আশায় রাখতে চাই না বলে আগেই বলে দিচ্ছি, আমি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসতে পারবো না।”
             অতন্দ্রিলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি কি আপনাকে বলেছি যে আপনার ভালোবাসা না পেলে আমি অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবো?”

রোদ চেয়েছিল অতন্দ্রিলাকে চমকে দিতে। অতন্দ্রিলা বেশ ভালোই চমকে ওঠে। কিন্তু ১ ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে রোদের সামনে চমকে না ওঠার অভিনয় করে। এটা অতন্দ্রিলার এক ধরনের খেলা।
চমকে ওঠার পাশাপাশি অতন্দ্রিলার বেশ রাগও হয়েছে। রাগ হওয়ার পেছনে যুক্তি আছে। অতন্দ্রিলা তার বাবার বাড়ি ছেড়ে, আজ প্রথম এ বাড়িতে এসেছ। প্রথম দিনেই রোদের উচিৎ হয়নি এত বড় একটা কথা তাকে বলা। দু তিন দিন সময় নিয়ে বলতে পারতো। এটা সাধারন ভদ্রতা।
অতন্দ্রিলার এত বড় একটা কথা স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করা মেনে নিতে পারছে না রোদ।
রোদ আশা করেছিল অতন্দ্রিলা কাঁদবে কিংবা হয়তো ভাঙচুর করবে।

        রোদ অস্পষ্ট গলায় বলল, “না বলোনি।”
        “তাহলে?”
        “তাহলে কি?
         অতন্দ্রিলা বলল, “তাহলে আপনি এত চিন্তিত হচ্ছেন কেন? আমি জানি আপনি আপনার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসেন। আপনি তাকে আজীবন ভালো বেসে যাবেন। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই কিংবা আপত্তি থাকা উচিত নয়।”
         রোদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “উচিত নয়? তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো তো?”
          “বুঝতে না পারার কি আছে? বাংলাতেই  তো বললেন! আপনি ঘুমিয়ে পরতে পারেন, আমার জন্যে অপেক্ষা করে লাভ হবে না। আমি বইটা শেষ করেই ঘুমাবো।”

রোদ হতভম্ব হয়ে গেল। একটা মেয়ের বাসর ঘরে এমন কথা শুনে, এত সহজে কি করে তা মেনে নিলো! ইরা হলে তো এতক্ষণে কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়ত।

(চলবে)

2 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে