#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৪২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
ডাক্তার রাজিয়া অ্যান্টি আমার কপালে আলতো করে একটি চুমু দিয়ে বললেন,
‘আজকালকার হুটহাট এবোরশনের যুগে তুমি একটি মহৎ নিদর্শন দেখিয়ে দিলে অরু।সত্যি বলতে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে মানুষ যতোটা করে গর্ভের বাচ্চার জন্য কেউ এতো বড় রিস্ক নেয় না।
এমন কেস আমি অনেক দেখেছি যেখানে বাচ্চা আর মায়ের মধ্যে যেকেনো একজনকে বাঁচাতে হয়।সবাই কষ্ট পায়,পাগলের মতো কান্না করে কিন্তু কেউ শুধু বাচ্চাকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেয় না।আর তুমি এতোটুকু মেয়ে হয়ে নিজের জীবন দিয়ে বাচ্চাকে বাঁচাতে চাইছো।সত্যিই তুমি আজ আমাদের সব মায়েদের হারিয়ে বড় হয়ে গেলে।একটি মেয়ে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর একজন মা হয়।আর তুমি বাচ্চা জন্ম দেওয়ার আগেই একজন মা হয়ে গেছো।সেই মা যে তার বাচ্চার জন্য সব করতে পারে।আমি আমার সমগ্রটা দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করবো তোমাদের দুজনকেই বাঁচাতে।বাকিটা আল্লাহর হাতে।’
আমার চিন্তা চেতনা তখন পারিপার্শ্বিক সব বাদ দিয়ে এককেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছিলো।শুধু আমার বাচ্চাকে ঘিরেই।আর কোনো কিছুই আমার মাথায় ছিলো না।শীঘ্রই আমাকে মেডিসিন দিয়ে লেবার পেইন আনা হলো।অভ্র হাজার চেষ্টা করেও আমার উপর রাগ করে দূরে সরে থাকতে পারলেন না।কিছুতেই আমাকে একা ছাড়বেন না।আমার সাথে ডেলিভারির সময়ও থাকার জন্য পাগল হয়ে গেলেন।চিৎকার,চেচাঁমেচি শুরু করে দিলেন।অবশেষে পাশ্চাত্য দেশের মতো উনাকে আমার সাথে ভেতরে থাকার পারমিশন দেওয়া হলো।তার হাত ধরে আমি প্রসব বেদনার অসহ্য যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেঁপে সহ্য করতে লাগলাম।কিন্তু এই কষ্ট যে সহ্য করার মতন নয়।এতোটা যন্ত্রণা!মনে হচ্ছিলো মৃত্যুর যন্ত্রণাও এর থেকে সহনীয়।যন্ত্রণায় অভ্র’র হাত খামছে ধরে আমি শুধু পাগলের মতো বিছানায় দাপরাতে লাগলাম।উনি আমাকে সাহস দিবেন কি উনার নিজরই হাত থরথর করে কাঁপতে লাগলো।আমার হাতটা তার মুখের কাছে চেঁপে তিনি ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগলেন।এতো এতো যন্ত্রণার মাঝেও আমাকে একটি চিন্তা,একটি ভয় গ্রাস করে যাচ্ছিলো ‘আমার বাচ্চাটা বাঁচবে তো!’যন্ত্রণায় নিচের ঠোঁট জোরে কামড়ে ধরে আমি দোয়া করলাম,
‘আল্লাহ আমার সমগ্র জীবনের পরিবর্তে তুমি আমার বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে দিও।’
ডাক্তাররা হঠাৎ একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলেন।তাদের মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।আর সেই আতঙ্ক যে আমার বাচ্চাকে নিয়েই তা বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না।সেই আতঙ্ক মুহুর্তেই আমার মধ্যেও ছেঁয়ে গেলো।এতোকিছুর পরও কি আমার বাচ্চাটা বাঁচবে না!অসহ্য নিদারুণ যন্ত্রণায় আমার হঠাৎ মনে হতে লাগলো আমি কোন এক অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি।কোনো এক সুদূর অজানায়।যেই অজানাকে পুরোপুরি জানতে পারার পর কেউ আর ফিরে আসে না।সেই অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আমার হঠাৎ মনে হলো আমার বাচ্চার জীবনের জন্য আমাকে কোনো কিছু ত্যাগ করতে হবে।ত্যাগ ছাড়া জীবনের এই বড় প্রাপ্তি আমি পাবো না।কিছু একটা ত্যাগ করতেই হবে।অনেক বড় একটা কিছু…………
এতোটুকু পড়তেই দূর থেকে বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে আয়াশ ঝটপট হাতের নীল রঙের ডায়েরিটা বিছানার চাদরের নিচে লুকিয়ে ফেলে একটা গল্পের বই হাতে নিলো।তার ছোটো ছোটো ধবধবে ফর্সা হাত দিয়ে চোখে থাকা গোল ফ্রেমের চশমার ডাট ধরে ঠিক করলো।ব্যস্ত ভঙ্গিতে অভ্র রুমে এসেই ছেলেকে দেখে থমকে গেলো।
বাবার মতোই সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট পড়ে একদম রেডি হয়ে বসে আছে সে।তেমনি হাতে কালো মোটা ফিতার ঘড়ি।শার্টের হাতাটা একদম হাত পর্যন্ত বোতাম দিয়ে আটকানো।সিল্কি কালো চুলগুলো কপালে এসে আড়াআড়ি হয়ে পড়ে রয়েছে।গোল ফ্রেমের চশমা চোখে নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে সে গল্পের বইয়ে।দেখে মনে হচ্ছে একজন সাক্ষাৎ দেবদূত।রূপকথার রাজ্যের পথ হারিয়ে ভুল করে এখানে এসে পড়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে।ছোট্ট গোলাপি ঠোঁট আলতো করে চেঁপে একবার বাবার দিকে আড় চোখে তাকানোর চেষ্টা করেই আবার বইয়ের পাতায় দৃষ্টি নিয়ে গেলো আয়াশ।কিছুক্ষণ ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে অভ্র মিষ্টি করে হাসলো।এতোটুকু বয়সেই অসম্ভব ধরণের ম্যাচিউরিটি ধারণ করে আছে এই ছেলে।মাত্র ছয় বছর বয়সেই কি সাংঘাতিক রিডিং পড়তে পারে।সারাক্ষণ গল্পের বই নিয়ে পড়ে থাকে।এখন আবার কারো সাহায্য ছাড়াই একা একা রেডি হয়ে গেছে।ছেলের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেঁসে অভ্র বললো,
‘একা একাই রেডি হতে গেলে কেনো সোনা?বাবা এসে করে দিতো।’
আয়াশ মুচকি হেঁসে বললো,
‘বাবা তুমি তো আমার সবকিছুই করে দাও।তাই আমি একটু করলাম।আমি এখন একা একা রেডি হতে পারি।’
‘বাব্বাহ!আমার বাবাটা আজ দেখছি হুট করে অনেক বড় হয়ে গেছে।’
আয়াশ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ঠোঁট চেঁপে হাসলো।
‘তুমি তাহলে একটু বসো আয়াশ।আমি ঝটপট হাতের কাজটা সেরে নেই।’
বাবার কথায় আয়াশ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।হাতের ওয়ালেট টা বিছানায় রেখে অভ্র একবার টেবিলের উপর অগোছালো হয়ে পড়ে থাকা কাগজগুলোর দিকে তাকিয়ে আলামরির একটি কবাট খুললো।সেখান থেকে একটি ফাইল বের করে কি যেনো দেখতে লাগলো।
আয়াশ আস্তে করে তার পাশ থেকে বাবার রাখা ওয়ালেট টা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো।সেখানে নিল শাড়ি পড়া একটা মেয়ের ছোট্ট ছবি।মেয়েটির চুলগুলো কানে গুঁজে রাখা।মাথাটা হালকা নিচু করে মেয়েটি সামনের দিকে হঠাৎ চোখ তুলে তাকিয়ে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।মেয়েটির মুখে যেনো এক সমুদ্র মায়া।কি সুন্দর ছবিটা!
এটি সেই ছবি যেটা অভ্র অরুকে প্রথম নিল শাড়ি পড়া দেখে ঝট করে ক্যামেরা দিয়ে তুলে নিয়েছিলো।অভ্র’র মতোই মুগ্ধ চোখে আয়াশ ছবির মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো।তার ভাবতেই অবাক লাগছে এই মেয়েটিরই সেই নীল রঙের ডায়েরি,যার দুঃখে সুখে ভরা জীবন গাথা সে এতক্ষণ ধরে পড়েছে।তার চাইতেও যেই জিনিসটা তার অবাক লাগে তা হলো এই মেয়েটিই তার মা।আয়াশ তার বাবাকে খুব ভালোবাসে,আয়াশের বাবা খুব ভালো।আয়াশ বড় হয়ে ঠিক তার বাবার মতোই হতে চায়।তবে আয়াশ আরেকজনকেও খুব ভালোবাসে।এই কথাটা আয়াশ কখনো কাউকে বলে নি।এমনকি তার বাবাকেও না।শুধু একবার ক্লাসে বলেছে।আয়াশদের স্কুলে মাদার্স ডে তে যখন সব বাচ্চাদের তাদের মা নিয়ে কিছু বলতে বলা হলো তখন আয়াশ পুরো ক্লাসের সামনে লাজুক মুখে বলেছিলো,
‘আমার মা একজন চমৎকার মানুষ।আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি।’
আয়াশ আর কিছু বলতে পারে নি।হঠাৎ তার গলায় কিছু একটা দলা পাকিয়ে এসেছিলো।বাবা ছাড়া সে কখনো কারো সামনে কাঁদে না।তার ভীষণ লজ্জা লাগে।অভ্র আলমারির কবাট লাগাতেই আয়াশ তাড়াতাড়ি করে ওয়ালেট আগের জায়গায় রেখে দিয়ে পুনরায় গল্পের বইয়ে চোখ দিলো।অভ্র একপলক ছেলের দিকে তাকিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা কাগজপত্র তাড়াহুড়ো করে গোছাতে লাগলো।
চম্পা একটা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করেই গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
‘ও মাগো!আমগো আয়াশ সোনারে কি সুন্দর দেহা যাইতাছে!আয়াশ সোনা এই দুধ টা এহন এক চুমুক দিয়া খাইয়া ফেলো দেহি।’
আয়াশ দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে মুখের সামনে ধরে নাক কুঁচকে খেয়ে ফেললো।দুধ খেতে তার একদমই ভালো লাগে না।কিন্তু তবুও সে কখনো মানা করে না।কারণ আয়াশ গুড বয় হতে চায়।বাবা বলেছে গুড বয় রা বড়দের সব কথা শুনে।ব্যস্ততার মাঝেই হাতে ফাইল নিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটি দেখলো অভ্র।অরুও ঠিক এভাবেই দুধ খাবার সময় নাক কুঁচকে ফেলতো।
এরপর কিছু একটা ভেবে দ্রুত চোখের পলক ফেলে আয়াশকে দু হাত দিয়ে সোফার উপরে উঠিয়ে বসিয়ে অভ্র তাড়াতাড়ি করে জুতো পড়িয়ে ফিতা লাগিয়ে দিতে লাগলো।আর বললো,
‘দেরি হয়ে যাচ্ছে রে বাবা।আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে হবে।’
ঝটপট জুতার ফিতা লাগিয়ে অভ্র আয়াশের হাত ধরে হাঁটতে চাইলো।কিন্তু আয়াশ হঠাৎ তার বাবার হাত টেনে ধরে আস্তে করে ডাকলো,
‘বাবা।’
অভ্র থেমে পাশে ঘুরে দাঁড়াতেই আয়াশ নিচু হয়ে ঝুঁকে অভ্র’র জুতোর ফিতা লাগিয়ে দিতে লাগলো।তাড়াহুড়োয় নিজের একপায়ের জুতোর ফিতা লাগাতেই যে ভুলে গেছে সে।ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে খুব সুন্দর করে আয়াশ তার বাবার জুতোর ফিতা লাগিয়ে দিলো।মুচকি হেঁসে অভ্র তার ছোট্ট ছেলের কান্ড দেখলো।ফিতা লাগানো হয়ে গেলে আয়াশ উঠে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে আবারো চশমার ডাট ঠিক করে মিষ্টি করে হেঁসে দিলো।অভ্র হাঁটু গেড়ে হঠাৎ ছেলের সামনে বসে পড়লো।দু হাতে ছেলের মুখ ধরে কপালে একটি চুমু দিয়ে বললো,
‘শুভ জন্মদিন সোনা।’
আয়াশও প্রতিউত্তরে মিষ্টি করে হেঁসে বললো,
‘ধন্যবাদ বাবা।’
অভ্র কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তার ছেলের নিষ্পাপ মুখটির দিকে তাকিয়ে রইলো।অরুর বড় সাধের ছেলে এই আয়াশ।এই ছেলের জন্যই মেয়েটা সেদিন কি ভয়ানক যন্ত্রণাই না হাসি মুখে গ্রহণ করেছিলো।অভ্র শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো।মেয়েটা হুট করেই যেনো অনেক বড় হয়ে গিয়েছিলো সেদিন।সবার থেকে বড়।বাচ্চার জন্য এক আকাশ কষ্ট বুকে ধারণ করতেও একবিন্দুও ভাবে নি।সেই রাতের কথা মনে পড়লে আজও অভ্র’র গা কেঁপে উঠে।অরুর এতো কষ্টের এই ছেলের গায়ে অভ্র কোনো আঁচ লাগতে দেয় নি কখনো।খুব যত্নে ছোটো থেকে বড় করেছে।
চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আয়াশ তার বাবার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে তার ধ্যান ভাঙালো।অভ্র মৃদু চমকে উঠে হেঁসে বললো,
‘আজ আমরা একটা বিশেষ জায়গায় যাবো।তোমার মনে আছে তো?’
আয়াশ হেঁসে মাথা নাড়ালো।
পুনরায় ছেলের হাত ধরে অভ্র উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘চলো।’
যাওয়ার আগে একবার পাশের দেয়ালে অরুর হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা ছবির দিকে তাকিয়ে অভ্র ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।তার চোখ হঠাৎ করেই ছলছল করে উঠলো।
চলবে,