অতঃপর_তুমি পর্ব-৪০

0
4948

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৪০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

৪৯.
‘এই গ্রে ডট টা দেখতো পাচ্ছো অরু?’
আমি মাথা নাড়ালাম।ডাক্তার রাজিয়া অ্যান্টি বললেন,
‘দিস ইজ ইওর বেবী।একটা সাউন্ড আসছে না?এটা তোমার বাচ্চার হার্টবিট।কতো সুন্দর একটা অনুভূতি না!তোমার ভেতর এখন আরেকটি প্রাণ রয়েছে,তার হার্টবিট হচ্ছে।’

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সামনের মনিটরে ভেসে উঠা আবছা আবছা ছাই রঙা প্রতিবিম্বটাকে স্পর্শ করলাম।সত্যিই কেমন যেনো লাগছে।আমার ভেতর আরেকটি প্রাণ।আমার বাবু।’

‘একি অরু,তুমি কাঁদছো!’
রাজিয়া অ্যান্টির কথায় আমি চমকে উঠলাম।চোখের কোণে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যিই পানি চলে এসেছে।বুঝতেই পারি নি।আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসলাম।রাজিয়া অ্যান্টি বললেন,
‘বুঝতে পারছি।লজ্জা পেতে হবে না।বাচ্চার হার্টবিট শুনে সবারই এমনটা হয়।অভ্র কোথায়?’

‘এখানেই তো ছিলো।একটা নার্স ডেকে নিয়ে গেলো কি একটা দরকারে।’

‘যা!মিস করলো।এই মুহুর্তটা সব হাসবেন্ডদেরও দেখানো হয়।জানো তো এরপর ইমোশনাল হয়ে তারা ওয়াইফের আরো বেশি করে খেয়াল রাখে।’

আমি মাথা নিচু করে লাজুক হেঁসে বললাম,
‘উনি এমনিতেই আমার খুব খেয়াল রাখেন।অনেক বেশি।’

রাজিয়া অ্যান্টি স্মিত হেঁসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
‘রাখবেই তো।ভাগ্নেটা কার দেখতে হবে না!’
আমরা দুজনেই হেঁসে দিলাম।
‘তোমার শ্বাশুড়ি তো আমাকে ফোন করে করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।শুধু বলছে ভালো করে চেকআপ করিস।ভালো করে চেকআপ করিস।এখন তুমিই বলো বোনের ছেলের বউকে আমি কি খারাপ ভাবে চেকআপ করবো।’
আমি হেঁসে দিলাম।রাজিয়া অ্যান্টি অভ্র’র মায়ের দূরসম্পর্কের বোন।তিনি একজন গাইনী ডাক্তার।আমি প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকেই সম্পূর্ণ তার অবজারভেশনেই আছি।

‘ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে জানতে চাও।’

আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম।বললাম,
‘এসবে আমার কিছু যায় আসে না।আমি যতদূর জানি উনার আর বাবা মায়েরও এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই।তারা তো শুধু দাদা দাদী হতে পারলেই খুশি।আপনি শুধু এতোটুকু বলেন অ্যান্টি,আমার বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?’

‘একদম ঠিক।এতো ভালো বাবা মায়ের বাচ্চার আবার কি হবে?’

আমি আবারো হেঁসে দিলাম।আজ আমি কারণে অকারণে এতো হাসছি কেনো কে জানে!আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট হাতে নিয়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম।হাসপাতালের করিডোরে আমার পাশ দিয়েই একটি মহিলা গেলো কোলে একটি নিষ্পাপ নবজাতক শিশু নিয়ে।আমি অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম।কিছুদিন পর আমার কোলেও থাকবে এমন একটি ফুটফুটে শিশু।আর মাত্র তিন মাস।অথচ এই তিন মাসটাকে হুট করে খুব দীর্ঘ লাগছে।কবে কাটবে এই তিনমাস?অভ্র হন্তদন্ত হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বলল,
‘চেকআপ হয়ে গেছে?সব ঠিক আছে তো?তোমার কোনো অসুবিধা হবে না তো?’

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘আমার না বলুন আমার বাচ্চার সব ঠিক আছে তো?আল্ট্রাস্নোগ্রাফির পর সবাই এটাই জিজ্ঞাসা করে।’
‘সবাই করলে করুক।আমার জন্য তুমি আগে।’

আমি তার হাত চেঁপে বললাম,
‘সব ঠিক আছে।আমারও,আমাদের বাচ্চারও।’

উনি চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।
আমরা বাসায় চলে এলে অভ্র আমাকে সোফায় বসিয়ে দিলো।সঙ্গে সঙ্গে আমার পাশে বাবা,মা,চম্পা বুঁদ হয়ে পড়ে রইলেন।আমি প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে শুধু অভ্রই পাগল হন নি।বাবা মাও পাগল হয়ে গেছেন।সারাদিন আমার পেছনেই লেগে থাকেন।আমার কি লাগবে না লাগবে,কখন কি খেতে ইচ্ছে করছে সব কিছুর খেয়াল রাখেন।আমার প্রেগন্যান্সির শুরু থেকেই কোনো কাজ তো দূরের কথা হাত থেকে নিচে কিছু পড়ে গেলে ঝুঁকতে অব্দি দেন নি।তাদের বংশে নাতি নাতনি আসতে চলেছে এতে তারা মহাখুশি।

মা এসে আমার হাতে তরমুজের শরবতে ভরা একটা গ্লাস দিয়ে বললেন,
‘অরু মা।এই শরবতটা পুরো খেয়ে ফেলে তো।’

‘এখন আবার!মা যাওয়ার আগেই না কমলার জুস খেয়ে গেলাম।’

‘সে তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে।তা কি এখনো পেটে আছে নাকি।এটা পুরো খেয়ে ফেলো দেখবে ভালো লাগবে।’

জানি, না বলে কোনো লাভ নেই।তাই গ্লাসে চুমুক দিয়ে পুরোটা খেয়ে ফেললাম।মা হেঁসে বললেন,
‘তুমি নাকি রাজিয়ার কাছে অভ্র’র অনেক প্রশংসা করেছো?অভ্র তোমার খুব খেয়াল রাখে।’

অভ্র স্মিত হেঁসে আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।আমি মাথা নিচু করে মুচকি হাসলাম।বাবা বলে উঠলেন,
‘খেয়াল রাখবেই তো।বাপের বেটা না!’
মা মুখটা বাঁকা করে বললেন,
‘ইহ!বাপের বেটা!তুমি কবে আমার এতো খেয়াল রেখেছো?এখন আমার ছেলের ক্রেডিটটা নিজে নিতে চাইছো।আমার ছেলে সবার থেকে সেরা।’

বাবা আমতা আমতা করে বললেন,
‘হ্যাঁ সালেহা আমি তো সেটাই বলছিলাম।’
চম্পা বলল,
‘হ খালাম্মা এক্কারে হাছা কতা কইছেন।আমগো অভরো ভাইজানের মতন মানুষ হয় না।আমি তো আমার উনারেও বইলা রাখছি আমাগোও যহন একটা বেইবি হইবো তহন জানি এমনেই আমার যতনো করেন।ভাইজানের তন শিইখা রাখতে কইছি।’

কথাটা বলে চম্পা তার স্বভাব বশত মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতে লাগলো।মা মজার ছলে বললেন,
‘তোর উনাটা আবার কে রে?’
চম্পা লজ্জা পেয়ে বলল,
‘খালাম্মা আপনে বোঝেন না!’
‘কি বুঝবো?আগে তো দেখতাম মফিজ কাইল্লা বলে ডাকতি।এখন আবার উনা হয়ে হয়ে গেলো।’

আমরা সবাই মায়ের কথা শুনে হেঁসে দিলাম।আর চম্পা দেবদাস মুভির পারুলের মতো বিখ্যাত দৌঁড় দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।

রুমে এসে আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার পেট দেখতে লাগলাম।কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে!মনে হচ্ছে আস্তো একটা বালিশ ঢুকিয়ে রেখেছি।মনে মনে তাই ভেবে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলাম। হঠাৎ পেছন থেকে অভ্র আমার পেটে হাত রেখে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো।কাঁধে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে থুতনি রেখে বললো,
‘আমার বউটাকে সবকিছুতেই এতো সুন্দর লাগে কেনো?একদম আস্তো একটা কিউটের ডিব্বা।’

আমি লজ্জা পেয়ে তার পেটে কনুই দিয়ে আস্তে করে গুতা দিলাম।তিনি আমার হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে আমার পেছনে বেডের সাথে বালিশ ঠিক করে দিলেন।বালিশে ঠেস দিয়ে আরাম করে বসে আমি পাশ থেকে একটি উপন্যাসের বই হাতে নিলাম।অভ্র চেঁচিয়ে উঠে বললো,
‘একদম না। এই উপন্যাসের বই রাখো।আমি কালকে দেখেছি তুমি এই উপন্যাসের বইটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে পুরো হেঁচকি উঠিয়ে ফেলেছিলে।এই সময় তোমার কান্না করা একদম ঠিক না।’

‘আর একটুই বাকি আছে।একটু পড়েই রেখে দেবো।’
‘না।যে বই পড়ে কান্না আসে সেই বই পড়ার কি দরকার।রাখো।’
‘না আমি রাখবো না।আমি পড়বো।আপনার যা ইচ্ছা করুন।’
‘যা ইচ্ছা করবো?’
‘হুম।’
‘আচ্ছা তাহলে আমি বরং মিস সাবিহার সাথে একটু ফোনে গল্প করি।’
উনি ফোন হাতে নিতেই আমি বই রেখে ফোন কেড়ে নিয়ে বললাম,
‘একদম না।’
উনি হাসতে লাগলেন।আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘কথায় কথায় শুধু সাবিহা সাবিহা করেন কেনো?এখনো কি ছোকরা স্বভাব যায় নি?বিয়ের পরেও এতো কিছু না জানি বিয়ের আগে কি করেছেন!’

উনি হাসি চেঁপে বললেন,
‘ম্যাম,আপনি ভুল মানুষ নিয়ে কথা বলছেন।বিয়ের আগেও আমি অসম্ভব ভদ্র ছেলে ছিলাম।’

‘কতোটা ভদ্র ছিলেন জানি!সায়মা আপুর বিয়েতে কি করেছিলেন আপনি!আমাকে অন্ধকার রুমে টেনে নিয়ে গিয়ে যে কিস করে দিলেন মনে নেই?আমি না থাকলে তো আপুকেই করতেন।’

‘ও ঐটা।ওটা তো তোমার বোনের জেদের কারণে করতে হয়েছিলো।বিয়ের আগে কোনো ধরণের স্পর্শ আমিও পছন্দ করতাম না।হাত ধরা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকাই ভালো।কিন্তু তোমার বোনের মতে রিলেশনে এক বছরের পরও লিপকিস না করলে তা ব্যাকডেটেড দেখায়।তাই তার লিপকিসই চাই।একদম নাছোড়বান্দা।এ নিয়ে ঝগড়া হয়ে তিন দিন কথা বলাও অফ করে রেখেছিলে।তাই তো বাধ্য হয়ে ভেবেছিলাম গালে কিস করেই চালিয়ে নেবো কিন্তু তাও ভাগ্যের জোরে হয়ে গেলো উলটপালট।’

এরপর উনি আমার গালের কাছে ঝুঁকে এসে বললেন,
‘ভুলতো করছিলামই তাই হয়তো আল্লাহ আমার চুমুটাকে সঠিক গালেই পৌঁছে দিয়েছিলো।’
কথাটা বলে উনি আমার গালে আবারো একটা চুমু দিয়ে দিলেন।আমি মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়ে বাইরে প্রকাশ না করে ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।কিন্তু এতে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো বলে মনে হলো না।কারণ তিনি আবারো আমার অন্য গালে তার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন।

৫০.
মাঝরাত্রিতে অভ্র হঠাৎ অস্থির হয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলো।প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর থেকে আমার ঘুম প্রচন্ড হালকা হয়ে গেছে।তাই আমিও টের পেয়ে গেলাম।অভ্র’র পাশে বসে হাত ধরে বললাম,
‘কি হয়েছে আপনার।এতো ভয় পেয়ে আছেন কেনো?’
উনি আমার ছোঁয়া পেয়ে হুট করে আমায় জড়িয়ে ধরলেন।আর বললেন,
‘অরু,তুমি ঠিক আছে তো?’
‘হ্যাঁ আমি তো ঠিকই আছি।ইশ!আপনি এমন ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন কেনো?দেখি।’
আমার ওড়না দিয়ে তার মুখ মুছে দিতে চাইলাম।কিন্তু উনি দিলেন না।আবারো আমায় জড়িয়ে ধরে রাখলেন।যেনো ছেড়ে দিলেই আমি কোথাও হারিয়ে যাবো।অবশেষে অনেক জিজ্ঞাসার পর জানতে পারলাম উনি একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছেন।উনি নাকি দেখেছেন আমি কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছি।উনি শত দৌঁড়েও আমার নাগাল পাচ্ছেন না।আর ব্যস এতোটুকু দেখেই উনার হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম হয়ে গেছে।আমি হেঁসে বললাম,
‘পাগল!এসব দেখবেন না তো কি করবেন!সারাদিন তো এগুলো নিয়েই ভাবতে থাকেন।তাই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে ফেলেছেন।’

কিন্তু উনি শান্ত হলেন না।বললেন,
‘আমার খুব ভয় লাগছে অরু।কেনো জানি না কিচ্ছু ভালো লাগছে না।যতই ডেলিভারির টাইমটা এগিয়ে আসছে ততই ভয়টা যেনো বাড়ছে।’
আমি উনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললাম,
‘আমার কিচ্ছু হবে না।আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।আর কারো কি বাচ্চা হয় না!’

অনেক বুঝিয়েও কিছু হলো না।অভ্র ভয় পেতেই লাগলো।আমার প্রেগন্যান্সি নয়মাসে পড়ার পর থেকেই তার এই অবস্থা শুরু হয়ে গেছে।সারাক্ষণ আমায় নিয়ে চিন্তা করেন।সে কারণেই হয়তো স্বপ্নটা দেখে ফেলেছে কিন্তু এটা আর তাকে বোঝায় কে।অভ্র আর ঘুমুতে গেলো না।জায়নামাজ নিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে বসে গেলো।উনি সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গেছেন।আমি শুয়ে শুয়ে তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,সত্যিই কি এটা শুধু তার মনে হুট করে আসা একটা ছোট্ট আশঙ্কা না অন্যকিছু?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে