অতঃপর_তুমি পর্ব-৩৮

0
5186

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৩৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

৪৬.
আয়নায় নিজেকে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।কতোটা বদলে গেছি আমি।মনে হচ্ছে এ এক অন্য আমি।আমি কি আগেও কারো সাথে এতোটা দুষ্টুমি করতাম।যতোটা আমি অভ্র’র সাথে করি।বেশ তো ছিলাম আমি শান্ত শিষ্ট, চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে।দুষ্টও ছিলাম তবে এতোটা কখনোই না।আগের কেউ যদি এখন আমায় দেখে নির্ঘাত চমকে উঠবে।মাঝে মাঝে মনে হয় আমার ভেতর একটি সুপ্ত বাচ্চা লুকিয়ে ছিলো যা অভ্র’র সান্নিধ্যে এসে বের হয়ে এসেছে।আনমনে হেঁসে উঠে আমি আবার টাওয়েল দিয়ে ভেজা চুল মুছতে লাগলাম।

‘হাসছো কেনো?’

হুট করে আমার কানের কাছে অভ্র’র ভ্রু কুঞ্চিত মুখ দেখে আমি চমকে উঠলাম।বললাম,
‘আপনাকে কেনো বলবো?আমার মুখ আমার যখন ইচ্ছা হাসবো।’

কথাটা বলে আমি ড্রেসিং টেবিল থেকে হেয়ার ড্রায়ার তুলতেই উনি জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘এই একি করছো?’

তার চিৎকার শুনে আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,
‘কেনো কি হয়েছে?চুল শুকাচ্ছি।’

‘তুমি জানো এভাবে ভেজা চুলে তোমাকে কি মারাত্মক সুন্দর লাগছে!’

আমি মনে মনে খুশি হয়ে ঈষৎ মুখ ফুলানোর ভাণ করে বললাম,
‘কেনো আপনিই তো বিয়ের পরের দিন সকালে ধমক দিয়ে বলেছিলেন কখনো যেনো আপনার সামনে ভেজা চুলে না আসি।’

‘সে তো রাগের মাথায় এমনি এমনি বলেছিলাম।আর তুমি সেই স্টুপিড কথার জন্য এতোদিন আমায় এই সৌন্দর্য্য দেখার থেকে বঞ্চিত করেছো!’

‘এখন স্টুপিড কথা বলছেন আর তখন তো এমনভাবে বলেছিলেন যেনো দ্বিতীয়বার আপনার সামনে আর ভেজা চুলে গেলে আপনি আমায় টুকরো টুকরোই করে ফেলবেন।জানেন!এখন একটু বাইরে এসে চুল শুকাই আর প্রথম প্রথম তো বাথরুমে গিয়ে চুল শুকাতে হতো।’

‘তখন তো আমি এই কথাটা বলেছিলাম কারণ যখন সকালে ঘুম ঘুম চোখে হঠাৎ দেখলাম আমার সামনে এক অনিন্দ্য সুন্দরী কন্যা দাঁড়িয়ে আছে, যাকে ভেজা চুলে অসম্ভব সুন্দর লাগছে।তখনই ঘাবড়ে গেলাম যে মেয়েকে জ্বালাবো বলে নিয়ে এসেছি তার প্রেমেই না শেষমেশ পড়ে যাই। এখন তো আমি প্রেমে পড়েই গেছি।বউয়ের প্রেমে বারবার পড়তে তো আর দোষ নেই।’

‘মামা প্রেমে পড়ে কিভাবে?বাবা একবার যে কাঁদায় পড়ে গিয়ে ভুতের মতো হয়ে গিয়েছিল তেমনভাবেই?’

আমরা দুজনেই চমকে উঠলাম।দেখলাম আমাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তুতুল মাথা উঁচু করে একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার উনার দিকে।অভ্র তুতুলকে কোলে নিয়ে সুরসুরি দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ওরে বাঁদর!তোর সব কথাই কান পেতে শুনতে হবে?’

ব্রেকফাস্ট করে আমরা দুজনেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।আমি ভার্সিটির জন্য আর উনি অফিসের জন্য।আমি একটা হাই তুলে বললাম,
‘কেমন যেনো ঘুম ঘুম পাচ্ছে।’
‘এই একদম না।আমি এখন অফিসে যাচ্ছি।এই শার্ট নষ্ট করতে পারবো না।গাড়িতে ঘুমালে তোমার মুখ দিয়ে আবার যা বেরোয়!’

অভ্র হাসতে লাগলো।উনি আবারো আমাকে সেদিনের কথা নিয়ে ক্ষ্যাপাতে বসেছেন বলে আমি রেগে বললাম,
‘একদমই না।আপনি সেদিন মিথ্যা কথা বলেছেন।’
উনি হাসতে হাসতে বললেন,
‘হ্যাঁ কতো মিথ্যা!’
উনার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলো।মুখ ঘুরিয়ে বললাম,
‘হাসবেন না তো।আপনাকে দেখতে অসহ্য লাগছে।’
উনি আমার দিকে মুখ এনে বললেন,
‘তাই!কিন্তু বান্দরবানে মিস সাবিহা যে বলল আমাকে হাসলে নাকি খুব সুন্দর দেখায়।’
উনার মুখে সাবিহার নাম শুনে আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।
‘আপনি আবারো সাবিহার নাম নিয়েছেন!’
‘কেনো জেলাস?’
আমি চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
‘হ্যাঁ জেলাস।অনেক অনেক জেলাস।আপনি বুঝি হন না?’
উনি ঠোঁটে হাসি চেঁপে সামনে তাকিয়ে বললেন,
‘মোটেও না।’
‘আচ্ছা তাই!’
গাড়ি ভার্সিটির সামনে এসে পড়ার পর আমি দেখলাম পাশ দিয়ে আসিফ স্যার যাচ্ছেন।আমি জোরে তাকে ডেকে উঠলাম।অভ্র ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।আমি ঝটপট গাড়ি থেকে নেমে বললাম,
‘স্যার আজকে আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে।’
‘ও থ্যাংকস অরু।’
‘কালো রঙের শার্টে আপনাকে সবসময়ই একটু বেশি সুন্দর লাগে।’

অভ্র হুট করে জোরে স্পিড দিয়ে আমাদের পাশ থেকে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো।আমি জিভে কামড় দিয়ে বিরবির করে বললাম,
‘একটু বেশি করে ফেললাম না তো!’

যা ভেবেছিলাম তাই।আমি বেশি করেছি কিনা জানি না তবে উনি খুব বেশি মুখ ভার করে আছেন।অফিস থেকে ফিরে এসে আমার সাথে কোনো কথাই বলছেন না।আর আমিও চেষ্টায় লেগে আছি কিভাবে তার মান ভাঙাবো।তুতুল আর আরিশা আপুকে আজ রাতেও থেকে যাবার কথা বলতেই আপু বললেন,

‘না না অরু,তোমার দুলাভাইকে একদিনের কথা বলে এসে দু দিন থেকে গেলাম।আজও যদি না যাই তাহলে নির্ঘাত রাগ করবে।’

আমি বললাম,’ঠিকাছে আপু আমি দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলছি।কিন্তু আপনারা আজ রাতে কিছুতেই যেতে পারবেন না।’

আমি দুলাভাইকে ফোন দিলাম।দুলাভাই ফোন রিসিভ করে বললেন,
‘কি…হানিমুন কাপলরা খবর কি?’
‘দুলাভাই এক মাস হলো আমরা এসে পড়েছি আর আপনি এখনো আমাদের এই নামে ডাকা ছাড়লেন না।’
দুলাভাই হাসতে লাগলেন।আমি বললাম,
‘দুলাভাই আজ কিন্তু তুতুল আর আরিশা আপু এখানে থাকবে।কাল সকালে চলে যাবে ঠিকাছে।’
‘কি বলো!তোমরা ওদিকে সুইট হানিমুন কাপল হয়ে বসে থেকে এদিকে আমাকে বউলেস করার প্লানে আছো!’
দুলাভাইয়ের কথায় আমি হেঁসে দিয়ে বললাম,
‘কেনো দুলাভাই আপনার কি হিংসা হচ্ছে।হিংসা হলে অভ্রকেও আপনার কাছে পাঠিয়ে দেই।তারপর সেও বউলেস হয়ে যাবে।’

আমার কথা শুনে সোফায় বসে থাকা অভ্র গলা খাঁকারি দিতে লাগলো।আমি তাকে চুপ করার ইশারা করতেই আবারো অন্যদিকে মুখটা ভার করে রাখলো।

রাতে আমরা সবাই একসাথেই খেতে বসলাম।আমার মুখোমুখি বসেছে অভ্র।নিচে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন।আমার দিকে একবার দেখছেনও না।আমার মাথায় হঠাৎ দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো।টেবিলের নিচ দিয়ে আমার পা দিয়ে উনার পায়ে খোঁচা দিতে লাগলাম।উনি হঠাৎ চমকে উঠে কেঁশে উঠলেন।আমি আরো দিতে লাগলাম।উনি পা সরিয়ে ফেললেন।আমি কিছুতেই আর উনার পা খুঁজে পেলাম না।অবশেষে অনেক তন্নতন্ন করে খুঁজে পেয়ে দিলাম আবারো খোঁচা।কিন্তু পা হঠাৎ এতো ছোটো হয়ে গেলো কেনো বুঝলাম না।একেবারে চেয়ারের পায়ায় তুলে রেখেছেন।আমার ভাবনার মাঝে তুতুল হঠাৎ লাফিয়ে উঠে আরিশা আপুকে বললো,
‘মা,টেবিলের নিচে ভূত আছে।’
‘ভূত!কি বলো?’
‘হ্যাঁ সত্যি।আমার পায়ে গুঁতাগুঁতি করছে।’

তুতুলের কথা শুনে এবার আমার কাশি উঠে গেলো।উনি বললেন,
‘পা উঠিয়ে বসো তুতুল সোনা।বলা তো যায় না আমাদের আশেপাশে কতোধরণের ভূত বসে আছে!’

আমাকে ভূত বলা!ভূত হয়ে থাকলে আপনার ঘাড়েই প্রথম চেঁপে বসবো মিস্টার অভ্র আহমেদ।

রুমে গিয়ে দেখলাম আমার উনি আমি আসার আগেই লাইট বন্ধ করে গায়ে চাদর টেনে শুয়ে আছে আর ঘুমিয়ে থাকার ভাণ করছে।আমি মুচকি হেসে তার চাদরের মধ্যে ঢুকে পড়ে তার বুকে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লাম।অভ্র বলে উঠলো,
‘এখানে শুয়েছো কেনো?তোমার তো আসিফ স্যারকেই ভালো লাগে।কোন কালারে কোন শার্টে ভালো লাগে তাও একেবারে মুখস্থ করে রেখেছো।’

‘আমি তো আপনাকে রাগাতে ওসব বলেছি।কিন্তু আপনি রাগ হলেন কেনো? আপনি তো আর জেলাস ফিল করেন না।আমি আসিফ স্যারকে হ্যান্ডসাম বা গুড লুকিং যা ইচ্ছাই বলি না কেনো।’

‘একদম ঐ আসিফ স্যারের নাম মুখে নিবে না।’

‘কেনো নেবো না?’

‘জানি না।তুমি এখান থেকে নামো।’

‘আমি আমার বরের বুকে শুয়েছি তাতে আপনার কি?’
উনি হঠাৎ আমাকে জাপটে ধরে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে নিচের ঠোঁট আলতো করে কামড়ে দুষ্ট হাসি দিয়ে বললেন,
‘আমার কি!দেখাচ্ছি আমার কি।’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে