#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৩৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
৪১.
বাস থেকে নেমে অভ্র আমাদের ব্যাগপত্র গুলো নিয়ে সামনে এগোতে লাগলো।ব্যাগপত্র বলতে বেশি কিছু নেই।একটা ছোট্ট লাগেজ।আরেকটা হাতে করে নেওয়ার মতো ব্যাগ।আমরা এখন যাচ্ছি হোটেলে যাবার জন্য গাড়ি রিজার্ভ করতে।আমি অভ্র’র পাশে পাশে হাঁটছি আর চোখ পিটপিট করে আশেপাশে দেখছি।এখনো ভ্রমণ স্পটগুলোতেই যাই নি অথচ আমার এসব দেখেই কি ভীষণ ভালো লাগছে।সেখানে গেলে কি করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না।গাড়ি করে হোটেলের সামনে নামলাম।ড্রাইভার ছেলেটিকে অভ্র দুটি বেশি টাকা দিয়ে ব্যাগপত্র পৌছে দিতে বলল।আমরা হেঁটে সামনে এগোতে লাগলাম।হঠাৎ একটি ছিপছিপে গড়নের সুন্দরী মেয়ে অভ্র’র সাথে পেছন থেকে ধাক্কা খেলো।ধাক্কা খাওয়ার পরপরই স্যরি স্যরি শব্দের জপ শুরু করে দিলো।মেয়েটির পড়নে হলুদ স্কার্টের উপর নীল জামা।মাথায় গোলাপি রঙের গোল ক্যাপ।গায়ের রং ভারী ফর্সা।আরেকটু হলেই যেনো বিদেশী টাইটেল ধারণ করে ফেলতো।মেয়েটি একদম অভ্র’র কাঁধ বরাবর হোঁচট খেয়ে পড়েছে।আমার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো।পুরো পৃথিবী জুড়ে মেয়েটি আর কোনো জায়গা পেলো না।আমার বরের উপর এসেই পড়তে হলো।আজ পর্যন্ত আমিও কিনা তার উপর এভাবে পড়ে যাই নি।বারবার মেয়েটির স্যরি বলায় অভ্র বলল,
‘ইট’স ওকে।নো প্রবলেম।’
আমি মনে মনে বললাম,
‘নো প্রবলেম মানে!আমার অনেক অনেক প্রবলেম আছে।’
মেয়েটি বলল,
‘আসলে হুট করে পায়ে পায়ে বারি খেলাম তাই।তার উপর ব্যাগটাও এতো ভারী।আচ্ছা,আপনি শাহাদাত আংকেলের ছেলে মিস্টার অভ্র আহমেদ না?’
‘জ্বি।আপনি আমাকে চিনেন?’
‘হ্যাঁ,আপনাকে বিজনেসের জগতে কে না চেনে।অল্প দিনেই যে নাম কামিয়ে ফেলেছেন।টপ বিজনেসম্যানদের ছেলে মেয়ে যারাও বিজনেসে নাম কামিয়েছেন তাদের নিয়ে ম্যগাজিনে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম।তার ফ্রন্ট পেজ কভারে ছিলেন আপনি।বাংলাদেশর মোস্ট ইলেজেবল ব্যাচেলরদের একজন।আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারেন নি।শাহাদাত আংকেলের সাথে আমার বাবা মোফাজ্জল করিম একটি প্রজেক্টের সাথে যুক্ত হয়ে একসাথে কাজ করেছিলেন।আমিও টুকটাক কন্ট্রিবিউট করেছি।সেখান থেকেই আংকেলকে চিনি।’
‘ও…আপনি মোফাজ্জল আংকেলের মেয়ে।আংকেলকে তো আমিও চিনি।তা আপনি এখানে ট্যুরে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ একাই চলে এলাম ঘুরতে।ঘুরতে আমি ভীষণ পছন্দ করি।কিন্তু কখনো সময় করা হয় না।তাই এইবার ঝটপট প্লান করে চলে এলাম।আপনাকে আমার নামটাই তো বলা হলো না।হাই!আমি সাবিহা।’
এই বলে মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিলো।অভ্রও হাত মিলিয়ে বললো,
‘নাইস নেম।’
মেয়েটা যেভাবে হেঁসে হেঁসে অভ্র’র সাথে কথা বলছিলো তাতেই আমার জাস্ট অসহ্য লাগছিলো।আর অভ্রও আছে তারও এতো হেঁসে কথা বলার কি দরকার।আর এখন তাদের হ্যান্ডশেক করা দেখে আমার মনে হলো কেউ আমার সারা শরীরে এক কৌটা মরিচের গুঁড়া ঢেলে দিয়েছে।এই অতিরিক্ত সুন্দরী মেয়েগুলোর আমার বরের সাথে এসেই এতো কথা বলতে হবে কেনো।আবার অভ্র এখন কি বললো!
নাইস নেম!এমন একেবারে কি নাইস।কই আমার নাম শুনে তো একবারো কখনো বলে নি নাইস নেম।দুজনে দুজনে কথায় কথায় এতো মেতে উঠেছে যে তাদের মধ্যে অরু নামের তৃতীয় একজন প্রাণীও আছে তা হয়তো ভুলে গেছে।
আমি অভ্রকে পেছন থেকে খোঁচা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘যাবেন না।’
সাবিহা নামের মেয়েটি একটু কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকালো।অভ্র বললো,
‘আমার ওয়াইফ,অরু।’
‘আপনার ওয়াইফ!মেয়েটাতো বেশ মিষ্টি দেখতে।স্যরি আমি প্রথমে বুঝতে পারি নি।আপনার ওয়াইফকে বেশ ছোটো লাগছিলো তো তাই।হাই অরু!’
আমি বললাম,’হাই,আমি কিন্তু অতও ছোটো না।আর কয়েক মাস পরই আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠে যাবো।’
অভ্র আমার কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
সাবিহা হেঁসে বললো,’তাই।মিস্টার অভ্র আপনাকে ম্যাগাজিনে মোস্ট ইলেজেবল ব্যাচেলর হিসেবে দেখার পর সামনাসামনি সাক্ষাৎকারে দেরি করে ফেললাম।এখন তো আর আপনি ব্যাচলর নন।ম্যারিড হয়ে গেছেন।’
অভ্র প্রতিউত্তরে মৃদু হাঁসলো।মেয়েটি বললো,
‘আপনারাও কি এই হোটেলেই উঠেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ও তাহলে তো ভালোই হলো।চলুন,একসাথেই যাওয়া যাক।’
এরপর মেয়েটি আমাদের সাথেই হাঁটতে লাগলো।আর ইশারায় ব্যাগ ভারি হওয়ার সমস্যা বোঝাতে লাগলো।অভ্র বলল,
‘আপনার বোধ হয় সমস্যা হচ্ছে আমার কাছে দিন।’
‘না না ঠিক আছে।’
‘ইট’স ওকে দিন।’
মেয়েটি দিয়ে দিলো।হাঁটার সময় আমি ফিসফিস করে অভ্রকে বললাম,’মেয়েটার কি টাকা নেই।ড্রাইভার কে দিয়ে আনালো না কেনো!’
অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় চুপ করতে বললো।আমি চুপ হলাম।কিন্তু আমার মন চুপ হলো না।আমার বরের কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই।অন্য মেয়েদের ব্যাগ উঠাতে যাবে।আর এই মেয়েটা আমাদের সাথে সাথে এভাবে হাঁটছে কেনো।কাপলদের যে একটু প্রাইভেট স্পেস দিবে সেই কান্ড জ্ঞান নেই।হোটেলে ঢুকে রিসিপশনে গিয়ে আমরা চাবির জন্য ওয়েট করতে লাগলাম।রুম আগের থেকেই বুকিং করে রাখা।তবুও কিছু ফর্মালিটি পূরণ করতে হবে।সাবিহা নামের অতি সুন্দর মেয়েটি আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আপনারাও কি এই প্রথম ঘুরতে এসেছেন?’
উনি বললেন,
‘হুম।’
রিসিপশনিস্ট অভ্রকে আরেকটি কাগজে সাইন করতে বলায় তিনি পাশে সরে গেলে আমি সাবিহাকে বললাম,
‘আসলে আমরা হানিমুনে এসেছি।নতুন বিয়ে হয়েছে তো!’
সাবিহা মেয়েটি আমার কথার প্রতিউত্তরে একটু ঠোঁট টেনে হেঁসে ফোন টিপতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ইশ!এখন আমার সাথে ফোন টেপা দেখাচ্ছে।আর অভ্র থাকলে তো কথার পর কথা বলতেই থাকে।
রুমে ঢুকে একপলক দেখেই আমার চোখ জুড়ে গেলো।হোটেলটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর।রুমগুলো যেনো এখন মনে হচ্ছে আরো সুন্দর।মাঝখানে সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা একটি বড় বিছানা।পাশে ছোট্ট মতন একটি কাঠের টেবিল,আলমারী,একটি দু বেডের সোফা,টিভি আর এটাচড বাথরুমও আছে।দেয়ালগুলোতে হালকা আকাশী রঙ করা।ধবধবে সাদা নরম বিছানা দেখতেই সারা রাত্রির ক্লান্তি কাঁধে চেঁপে বসলো।আমি শুতে চাইলাম আর তক্ষুণি উনি বাঁধা দিয়ে বললেন,
‘এখন না।আগে ফ্রেশ হও নাস্তা করো তারপর।’
তার কথামতো ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নরম তুলতুলে বিছানায় গা এলিয়ে দেবার দু সেকেন্ডের মাথায় আমার চোখে গভীর ঘুম ভর করলো।ক্লান্তি মাখা এই ঘুমটি আমার মনে হলো এতো শান্তিময় আমি আর কখনো দেই নি।কিন্তু ঘুমানোর কিছুক্ষণ পরই মনে হলো অভ্র আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে লাগলো।আমি শুধু একবার ঘুমের ঘোরে বিরক্তি নিয়ে উঁহু করে উঠলাম।অভ্র বললো,
‘অরু,এই লাস্ট আমি আর ডাকছি না।এবার আমি একা একাই ঘুরতে চলে যাবো কিন্তু।’
তার ঘুরতে যাবার কথা শুনে আমি লাফ দিয়ে উঠে পরলাম।আমি তো ঘুরতে যেতেই চাই।
‘আপনি না বললেন এক, দেঢ়ঘন্টা পর যাবেন।’
‘তো কখন যাচ্ছি।তুমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছো তার কোনো হিসাব আছে!’
‘কতক্ষণ?’
‘দুই ঘন্টা।’
‘দুই ঘন্টা!কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে দু মিনিটও হলো না।’
‘এখন কি শুধু কথাই বলবে নাকি রেডি হবে।নাকি আমি একা একাই ঘুরতে যাবো?’
‘না!’
তার কথা শুনে দ্বিতীয় বার আমি লাফ দিয়ে উঠে বাথরুমে চলে গেলাম।রেডি হয়ে আমরা দুজন হোটেল থেকে বেড়িয়ে পড়লাম।আজ আমি পড়েছি একটি লাল-কালো রঙের থ্রি পিছ।অভ্র’র পরণে ধূসর রঙের শার্ট আর সাদা জিন্স প্যান্ট।
‘শুনুন আমরা কি দশদিন এই হোটেলেই থাকবো?’
‘না।দুলাভাই হোটেলে দশদিনের বুকিং করেই রেখেছেন।কিন্তু আমরা হোটেলে কিছুদিন থাকবো।এই দুইদিন বান্দরবান শহরের আশেপাশে যা আছে দেখবো আর এর ফাঁকে বান্দরবান শহরটাও তোমার দেখা হয়ে যাবে।এরপর আমরা বান্দরবান শহর ছাড়িয়ে আরো ভেতরের দিকে রিসোর্টে থাকবো।ভাগ্য ভালো হলে কটেজও পেয়ে যেতে পারি।’
‘আপনি প্লিজ কটেজে থাকার চেষ্টাই করবেন।আমার কটেজে থাকার খুব ইচ্ছা।’
‘আচ্ছা বেশ,দেখবো।’
‘আপনি কি এর আগেও বান্দরবানে এসেছেন?’
‘হুম।অনেকবার।’
‘আপনি এতো বার দেখেছেন তাহলে আপনার কি এখন আমার অতো একটা ভালো লাগছে না?’
‘লাগবে না কেনো?প্রকৃতি এমন একটা জিনিস যার সৌন্দর্য্যে কখনো একঘেয়েমি ব্যাপারটা আসে না।যত দেখবে ততই মুগ্ধ হবে।’
‘হাই মিস্টার অভ্র!’
ঐ মিসেস সাবিহা না ফাবিহাকে দেখে আবারো আমার চোখ সরু হয়ে গেলো।অভ্র বললেন,
‘হ্যালো মিস সাবিহা!’
‘আপনারা কি এখন ঘুরতে বের হচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ,অরুকে নিয়ে একটু স্বর্ণমন্দির দেখিয়ে আনার কথা ভাবছি।’
‘ও গ্রেট।আপনারা যদি কিছু মনে না করেন আমি কি আপনাদের সাথে জয়েন করতে পারি।আসলে আমি একা এসেছি আর আমার এখানকার ভ্রমণ স্পট সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাও নেই।’
অভ্র কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বলে দিলো,
‘নো প্রবলেম।আপনি আসতে পারেন।আমাদের অসুবিধা নেই।’
আবারো বলে দিলো নো প্রবলেম!আমার যে মেনি মেনি প্রবলেম।ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠে আমি ভাড়া করে রাখা জীপ গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
তারা দুজনে উঠলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
আমি উনার কানে ফিসফিস করে বললাম,
‘আপনার তাকে সাথে নেওয়ার কি দরকার ছিলো?’
উনিও ফিসফিস করে বললেন,
‘এখন মুখ সেঁধে বললে না করে কিভাবে।’
‘অসহ্য!’
গাড়ির মধ্যে সাবিহা সাথে একটু পরপরই একেকটা টপিক উঠিয়ে কথা বলতে লাগলো।আর আমি স্বভাবমতো জ্বলতে লাগলাম।ইচ্ছে করছিলো মেয়েটাকে গাড়ি থেকে গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে আমি আমার অভ্র’র হাতে হাত রেখে একটা ভেংচি দেখিয়ে যাই।
স্বর্ণমন্দিরে গিয়ে পৌছাতেই আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে গেলাম।সাবিহা হঠাৎ তার গলায় পেচানো হলুদ নীল মিশ্রণের স্কার্ফ দেখিয়ে অভ্রকে বলল,
‘মিস্টার অভ্র এই স্কার্ফটা আমি জার্মান থেকে কিনেছিলাম।বলুন তো আজকে আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?’
‘আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগছে।’
সাবিহা খুশি হয়ে স্বর্ণমন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলো।আমি অভ্র’র দিকে তাকিয়ে রাগে ফস ফস করে বললাম,
‘আপনার তাকে সুন্দর লাগছে!নিজের বউকে তো একবারও বললেন না।আর অন্য মেয়েদের সুন্দর লাগছে!’
অভ্র ঘাবড়ে গিয়ে বলল,
‘এখন আমি কি বলবো,নিজের থেকে যদি জিজ্ঞাসা করে কিছু তো একটা বলতেই হবে বলো।আর আমার অরুকে তো সবার থেকে বেশি সুন্দর লাগে, সবসময়।মিস সাবিহার থেকেও।কি সুন্দর গভীর কালো চোখ।আর মিস সাবিহার চোখটা কেমন বাদামী বাদামী।’
আমি মুখটা আরো ফুলিয়ে বললাম,
‘আপনি তার চোখটাও এতো খেয়াল করে দেখেছেন!বাদামী,লাল না ছাই!’
কথাটা বলে আমি রাগে গজগজ করে সামনে হেঁটে গেলাম।আর অভ্র’র মুখটা হয়ে গেছে দেখার মতন।মেয়েদের মন বোঝার মতো কঠিন ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালিয়ে সে এখন বিপর্যস্ত।বেচারা সত্যিই বুঝতে পারছে না বউয়ের প্রশংসা করাতেও তার কি ভুল হয়ে গেলো।’
চলবে,