#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৩০
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
৩২.
ভেবে ভেবে বলি,
বন্ধ দু চোখের
নিভু নিভু কালোয়
যে আলো হয়ে
ভেসে আসো তুমি
মনে হয় মিশে যাই
তোমার আরো কাছে
যদি যাও চলে তুমি
জড়িয়ে বলবো যেয়ো না……
বাম চোখ বেঁয়ে অজান্তেই গড়িয়ে পড়া অশ্রুর শীতল স্পর্শ গালে অনুভব হতেই আমি বন্ধ দু চোখ আস্তে আস্তে খুলে দেখলাম সন্ধ্যের লাল আভা এখন নিকষ কালো অন্ধকারে রূপ নিয়েছে।কিন্তু আমার ভেতর এর জন্য কোনো ভাবান্তর প্রকাশ পেলাম না।বেতের রকিং চেয়ারটির উপর হেলান দিয়ে আমি সেভাবেই নিথর ভঙ্গিতে পড়ে রইলাম।ফোনের মিউজিক প্লেয়ারে করুণ সুর তুলে অনবরত গানটি বেঁজেই চলেছে।আমার বুক জুড়ে শুধু ভেসে বেরাচ্ছে হাহাকার।মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু একটাই প্রশ্ন,’অভ্র কি এখনও ইরা আপুকে ভালোবাসে?’
তাকে আমি চিনেছিলামই তার তীব্র ভালোবাসার স্বভাবে।এতোটা প্রবল ভালোবেসে কি কেউ আদৌও তাকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে।খোঁচা খোঁচা দাড়ির মলিন মুখ করে থাকা অভ্র একবার আমাকে বলেছিলো ভালোবাসা নাকি একবারই হয়।এক মন এক ভালোবাসা।
সেই অভ্র আজ বদলে গেছে।কিন্তু সেই মন কি সত্যি বদলেছে?ইরা আপুকে কি সে তার মন থেকে মুছে ফেলতে পেরেছে?কাল বিকেলে যা হলো তার কি কোনো মানে আছে?
কাল বিকেলে নাহিদ ভাইয়া হুট করে অভ্রকে বললো বাইরে থেকে বেড়িয়ে আসার কথা।বাসার মধ্যে তার বোরিং লাগছে।সাথে আমাকেও নিতে বললো।আমরা তিনজন ঢাকার একটি চিরচেনা কফি শপে গিয়ে বসলাম।অভ্র আজ একটি সাদা প্যান্টের উপরে ধূসর রঙের শার্ট পড়েছিলো।আর শার্টের হাতাটি সবসময়ের মতো ফোল্ড করে রাখায় তাকে দেখতে বরাবরের মতোই ভীষণ ভালো লাগছিলো।আমার পরনে ছিলো সাদা রঙের জামা।আর বাম কাঁধে ফেলে রাখা কালো শাল চাদর।অভ্র তিন মগ কফি অর্ডার করলো।হালকা হাসি ঠাট্টা খোশ গল্পের মাঝে মাঝে কফির মগে চুমুক দিয়ে আমরা সময় পার করছিলাম।নাহিদ ভাই গানের মানুষ।একটু পরপরই গুনগুনিয়ে উঠেন।সবসময় সাথে গিটার রাখেন।আজ নেই তবে তিনি বললেন,আজ নাকি তার ভেতর ভালো সুর আসছে।ফোনের রেকর্ড প্লেয়ার অন করে তিনি গুনগুনিয়ে ‘আমার ভিনদেশী তারা’ গানটি গাইতে লাগলেন।ধোঁয়া উঠা গরম কফির সাথে সাথে আমরা তা উপভোগ করতে লাগলাম।
কফিশপের স্বচ্ছ গ্লাসের ওপাড়ে হঠাৎ একজনকে চোখে পড়ায় আমার নজর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠলো।খেয়াল করলাম শুধু আমি না অভ্র আর নাহিদ ভাইও দেখছে।মাসুদ ভাই একটি কালো রঙের গাড়ি থেকে নেমে কানে ফোন ধরে পাশের শপিং মলে হেঁটে যাচ্ছে।সে যে দেশে ব্যাক করেছে এটাই আমরা জানতাম না।নোংরা একটি লোক।দেখতে পেয়েই মেজাজটা বিগড়ে গেলো।খুব করে চাইলাম যেনো তার চোখ আমাদের উপর না পড়ে কিন্তু আফসোস যেটা চাওয়া হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার উল্টোটাই হয়।মাসুদ ভাই অভ্রকে দেখে ফেললো।এবং মুখে একটা বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে আমাদের দিকেই এগিয়ে এলো।আমাদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে বলল,
‘কিরে দোস্ত,কেমন আছিস?কতদিন পর দেখা হলো!’
অভ্র মুখটা শক্ত করে সামনে তাকিয়ে রইলো।মাসুদ ভাই বলতে লাগলেন,
‘কাম অন অভ্র।এতোদিন পর দেখা হলো একটা হাগ তো অন্তত করবি।’
অভ্র বলল,
‘ভালো চাস তো এখান থেকে চলে যা।’
‘আমি তো তোর ভালোই চাই অভ্র।এজন্যই তো তোরজন্য তোর ইরাকে ছেড়ে দিলাম।’
নাহদি ভাই বললেন,
‘সেমলেস হওয়ার একটা সীমা থাকে মাসুদ।এতোকিছুর পরও অভ্র’র সামনে দাঁড়াতে তোমার বাঁধে না।অভ্র তোমাকে কতো ভালো বন্ধু মনে করতো আর তুমি….।কেনো করলে তুমি এমন?’
‘জেলাস নাহিদ,জেলাস!খুব জ্বলতো ও’র জন্য।ভার্সিটির বেস্ট স্টুডেন্ট,মোস্ট হ্যান্ডসাম বয়,স্যারদের প্রিয়,স্পোর্টসে সেরা।সহ্য হচ্ছিলো না আর।আমিও তো কোনো অংশে কম ছিলাম না তবুও আমার নামটা চাপা পরে থাকতো শুধু এর জন্য।খুব ইচ্ছে ছিলো একে একবার টপকে আমি আগে যাবো।আর অভ্র’র গার্লফ্রেন্ড ইরাও সুযোগটা করেই দিলো।প্রচন্ড সুবিধাভোগী মেয়ে বুঝলে।এরা আবার ভদ্র ছেলেগুলোকে অতো পছন্দ করে না।এদের সাথে ফ্লার্ট করতে হয়।আমার বন্ধু অভ্র একটু বেশিই ভালো ছেলে তো তাই এতোকিছু বুঝতো না।ও’র চোখের আড়ালেই একটু একটু করে পটিয়ে রেখেছিলাম।তারপর সুযোগ বুঝেই কোপ।কিন্তু বন্ধুত্বের মধ্যে কি আর এসব মনে রাখলে চলে বল অভ্র।পেছনের কথা পেছনে চলে গেছে।আমরা তো এখনও ভালো বন্ধু।’
আমি দেখলাম টেবিলের উপর রাখা অভ্র’র হাতটি মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছে।আমি বললাম,
‘আপনার লজ্জা করে না এতোকিছুর পরও নিজেকে বন্ধু বলতে।’
মাসুদ ভাই এবার আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তুমি আমার এক্স শালিকা না?তোমাকে তো আগে খেয়ালই করি নি আমার এতো সুন্দর একটা শালিকা আছে।এখন তো মনে হচ্ছে এতো সুন্দর এক্স শালিকাকে প্রেজেন্ট রাখার জন্য হলেও আমার এতো তাড়াতাড়ি ইরাকে ছাড়া ঠিক হয় নি।দুই দিন একটু শালিকার আদর যত্ন নিতাম।’
অভ্র দাঁতে দাঁত চেঁপে বললেন,
‘নাহিদ ওঁকে বল এখান থেকে চলে যেতে।’
নাহিদ ভাই বললেন,
‘মাসুদ তুমি প্লিজ এখান থেকে যাও।পাবলিক প্লেসে সিন ক্রিয়েট করো না।’
মাসুদ ভাইয়ের ফোনেও একটি কল আসায় তিনি একটি বাঁকা হাসি দিয়ে চলে গেলেন।
অভ্র’র মুখটা থমথমে হয়ে গেছে।পরিবেশটাই কেমন ভারী হয়ে উঠলো।কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে নাহিদ ভাই বলে উঠলেন,
‘তোমরা আর কিছু খাবে?’
আমি ঘাড় নাড়িয়ে না বলে দু মিনিট সময় চেয়ে ওয়াশরুমে চলে এলাম।কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে দূর থেকে দেখলাম মাসুদ ভাই আবারো এসেছেন।এবং তার শয়তানী ভঙ্গিতে আবারো অভ্রকে কিছু একটা বলছেন।স্পষ্ট শুনতে পেলাম না তবে এতটুকু বুঝতে পারলাম ইরা আপুকে নিয়ে কিছু বলছেন।অভ্র পেছনে ঘুরে বসেছে তার মুখটা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না।আমার রাগ চেঁপে গেলো।ইচ্ছে করছে এই লোকটাকে একটা থাপ্পড় মেরে আসি।আরো কিছু কথা হলো আমি শুনতে পেলাম না।একসময় হুট করে অভ্র রেগে উঠে মাসুদ ভাইয়ের শার্টের কলার চেঁপে ধরলো।তিনি প্রচন্ড ক্ষেপে গেছেন।কফি শপের সবাই উঠে দাঁড়িয়ে দেখছে।নাহিদ ভাই শত চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছেন না।আমি দৌঁড়ে গেলাম।তাদের দুজনের হাত ধরে ছাড়াবার চেষ্টা করলাম।কানে এলো শুধু অভ্র’র বারবার বলা একটি কথাই,
‘বলেছিলাম না ও’র সম্পর্কে আর একটা কথাও না বলতে।বলেছিলাম না!’
আমি তাদের দুজনের হাত ধরে ছাড়াতে চাওয়ায় অভ্র আমাকে বলল,
‘অরু তুমি এখান থেকে যাও।’
আমি শুনলাম না।এবার অভ্র প্রচন্ড জোরে চেঁচিয়ে বললো,
‘বলেছিনা এখান থেকে যাও!’
আমি চমকে উঠে স্থির হয়ে গেলাম।অভ্র আমার সাথে এর আগেও রাগ করেছে,ধমক দিয়েছে কিন্তু এমনভাবে এতোটা রেগে চেঁচিয়ে কখনো কথা বলে নি।আমার চোখ মুহুর্তে পানিতে ভরে উঠলো।
আকাশের বাঁকা চাঁদ টির দিকে তাকিয়ে আরো একবার মনটি কেঁপে উঠে প্রশ্ন করে উঠলো,
‘অভ্র কি এখনো ইরা আপুকে ভালোবাসে?’
নয়তো ইরা আপু সম্পর্কে কিছু বলায় তার এতো রাগ কেনো উঠলো।রাগ তো আমারো উঠেছিলো কারণ ইরা আপু আমার বোন।কিন্তু আমার রাগ আর তার রাগ কি একরকম ছিলো?তিনি এতোটা ক্ষেপে কেনো গেছিলেন?একটি মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়েছে বলে?নাকি একটা বিশেষ মেয়ের সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়েছে বলে?
মনের একটি অংশ বারবার এই প্রশ্নগুলো তুলছে আবার আরেকটি অংশ প্রবল বেগে ঠেকিয়ে রাখছে।খুব করে চাইছে যে এসবকিছু মিথ্যে হোক।আচ্ছা! যদি মিথ্যাও হয় তবেও কি!
অভ্র’র মনে কি আমার জন্য কখনো একটু ভালোবাসা জন্মাবে না?তিনি আমার জন্য যা কিছু করেন তা কি শুধুই দায়িত্ববোধ?আমি আর আমার দায়িত্ব কি তার ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছি?
না ভাববো না।আর কিছু আন্দাজে ভাববো না।
কিন্তু ভাবতে চাইছি না।সত্যের মুখোমুখি হতে কি আমি ভয় পাচ্ছি!
এতোসব ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে দিলো ফোনটি।
কর্কশ শব্দ করে বেঁজে উঠে জানান দিলো ইরা আপু ফোন করেছে।ফোনটা হাতে নিয়ে তার নাম দেখে আবারো রেখে দিলাম।ধরলাম না।ফোন করলেই অভ্র কি করছে?অভ্র খেয়েছে কি না?অফিসে গিয়েছে কি না?এইসব প্রশ্নগুলো শুনতে আমার ভালো লাগে না।রাতে অভ্র একটু দেরি করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরলো।গায়ে থেকে নেবি ব্লু রঙের ব্লেজার খুলে সাদা শার্টের হাতাটি ফোল্ড করে হাতের রোলাক্স ঘড়িটির ফিতা খুলতে লাগলেন।আমি একটু দূরত্ব রেখেই তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে অপলক ভাবে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র ঘড়ির ফিতা থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘অরু,কিছু বলবে?’
আমি আস্তে করে ডানে বামে মাথা নাড়ালাম।অভ্র আবারো ঘড়ির ফিতা খোলায় মনোযোগ দিলো।চোখে টলমল করা অনাহূত অশ্রুকে গড়িয়ে পড়া থেকে আটকানোর জন্য নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আমি মনে মনে বললাম,
‘আমায় একটু ভালোবাসলে কি হয় অভ্র!’
৩৩.
চম্পা এসে যখন জানালো ইরা আপু বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন করেছে তখন আমি শুধু অবাক না বেশ অবাক হলাম।কিছুদিন ধরে তার ফোন ধরছি না,বেশিরভাগ সময় বন্ধই করে রেখেছি।তাই বলে আপু ল্যান্ড লাইনে ফোন করবে!এমন কি জরুরী কথা থাকতে পারে আপুর!তবুও ভাগ্যিস বাবা ধরেছিলো যদি মা ফোন ধরতো তবে একটা তুলকালাম কান্ড বানিয়ে ফেলতেন।আমি নিচে গিয়ে ফোন ধরলাম।আপু খুব করে বললেন,
আজ যেনো বিকেলে একবার ও বাড়ি যাই।আপুর কিছু কথা আছে।আমি আচ্ছা বলে রেখে দিলাম।ফোন রাখতেই চম্পা মুখ ফসকে বলে ফেললো,
‘কেমন বেশরইম্মা মাইয়া আল্লা গো!এত্তোকিছু হইয়া যাওনের পরও আবার হেনে ফোন দেয়।’
বাবার সামনেই চম্পার নিজের বোন সম্পর্কে এমন কথা বলায় আমি একটু বিব্রত বোধ করলাম।বাবা চম্পা বলে একটা ধমক দিয়ে চম্পাকে থামালেন।চম্পা জিভ কামড়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লো।আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিকেলে গিয়ে আবার আপুর মুখে কোন কথা শুনতে হবে সে নিয়েই ভাবতে লাগলাম।
চলবে,