অতঃপর_তুমি পর্ব-২৯

0
5309

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

৩১.
নিস্তব্ধ রাতের নিরবতার মাঝে মাঝে এক দু বার রাতের অচেনা পাখিরা ডেকে ডেকে উঠছে।জানালার সাদা পর্দাকে স্বচ্ছ কাঁচের উপর মৃদু দুলিয়ে উঠে বাইরে থেকে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করছে হালকা হিমেল হাওয়া।শুধু কি বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করেছে!সাথে করে চাঁদের শুভ্র মায়াবী আলোকে টেনে এনে পরিবেশটাকে আরো মোহনীয় বানিয়ে রেখেছে।সারা দিনের ক্লান্তির পর পাশের বালিশেই সোজা হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে অভ্র।গভীর রাত তবুও চোখে একবিন্দুও ঘুম আসছে না আমার।আজ যেনো ঘুমেরা আমার থেকে ছুটি নিয়েছে,আমায় আজ তার স্বপ্নের পৃথিবীতে নিয়ে যাবে না সে।বলে গেছে তুমি এখন স্বপ্নেই আছো।বাস্তব স্বপ্ন।ঘুমাচ্ছন্ন স্বপ্নের তোমার আজ প্রয়োজন নেই।আজ সারাদিনের ভালোলাগার আবেশ আমার এখনো কাটে নি।মনে হচ্ছে অভ্র আজ আমাকে একটা স্বপ্নের পৃথিবী থেকেই ঘুরিয়ে নিয়ে আসলো।এতো সুন্দর দিন আমি আমার জীবনে আর কখনো পাই নি।দিন শেষ হয়ে গেছে।কিন্তু আমার মনে সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে।কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।এমন একটা অনুভূতি প্রবলভাবে মনের মধ্যে আজ নাড়া দিয়ে উঠছে যার সাথে এই উনিশ বছরের অরুর আজ অব্দি পরিচয় ঘটে নি।
বাতাসে আজ যেনো সুরেরা ভেসে বেড়াচ্ছে।ছন্দেরা গান গাইছে।বুকের নিচে দু হাত রেখে সেসবই সম্মোহিত দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছি আমি।হঠাৎ করেই জীবনটা এতো অন্যরকম লাগছে কেনো?আমি তো ঘুমিয়ে নেই তবুও স্বপ্নের মতো লাগছে কেনো?
কেনো?কেনো?কেনো?…….

এটা কি এই ছেলেটির জন্য?আমার পাশে ঘুমানো অভ্র নামের ছেলেটির জন্য?তার দিকে আস্তে করে ঘুরে মাথার নিচে এক হাত দিয়ে বালিশের উপর ভর করে সেই ছেলেটাকে আমি দেখতে লাগলাম।
আমার মন শুধু ভালো না,চরম ভালো করে দিয়ে সে এখন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে।কিন্তু আমি তো ঘুমাতে পারছি না।বাতাসের সুরেলা ছন্দের সাথে তাল মিলিয়ে আমি হঠাৎ মৃদু স্বরে গাইতে লাগলাম,

তোমাকে না লেখা চিঠিটা
ডাকবাক্সের এক কোণে,
সাদা খামের না লেখা
নাম এঁকেছে তার গানে।
সেই চিঠি যত লেখা
থাকে একা একা,
সেই গানের আ শোনা সুর
আঁকা একা একা
ছুঁয়ে যায় তবুও কখন এসে…
যদি বলি সেসবই তোমারই,
একা চিঠি,একা একা মন।
যদি বলি সেসবই তোমারই
একা চিঠি,একা একা মন,
সাঈয়া…সাঈয়া…সাঈয়া
সাঈয়া…….সাঈয়া♪♪♪♪

নিশাচর পাখিটার স্বর আবারও দূর থেকে ভেসে এলো।হাওয়ার শীতলতাও যেন ক্রমশ বাড়ছে।ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগলো আর তার সাথে সাথে
স্পষ্ট হতে লাগলো আমার মনের ভাষা।

৩২.
‘অরু,তাড়াতাড়ি করো।বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!আমার একটা ইম্পর্টেন্ট মিটিং আছে।আর এক মিনিটও দেরি করা যাবে না।’

আমি শান্ত ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম।ভার্সিটির জন্য আমি তৈরি হয়েই গেছি।কিন্তু অভ্রই এখনো তৈরি হতে পারেন নি।কালো ফরমাল শার্টের উপর সাদা চেকেচেক টাই টা তাড়াহুড়োয় বাঁধতে বাঁধতে আমাকে তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন।উনি আজ বড্ড ব্যস্ত।মূলত তাড়াহুড়োর জন্যই গলার টাই টা ঠিক মতো বাঁধতে পারছেন না।বারংবার ভুল হয়ে যাচ্ছে।আর আরো দেরি করিয়ে দিচ্ছে।
লাজুক ভঙ্গিতে মনে মনে মুচকি হেঁসে আমি তার সামনে গিয়ে চুপচাপ তার টাই বাঁধতে লাগলাম।এই প্রথম কেমন যেনো নিজেকে সত্যিই তার বউ বউ মনে হচ্ছে।গলার টাই বাঁধা শেষ হলে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে মুখে একটা দুষ্টু হাসি টেনে আমার কান্ড দেখছে।
উনি বললেন,
‘পিচ্চিটা আবার গলার টাই ও বাঁধতে পারে!’

আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘আমি মোটেও পিচ্চি না।আমি একজন এডাল্ট।’

‘আচ্ছা! অরু,তোমার কি আঠারো বছর হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ।আমার বয়স তো এখন উনিশ।কেনো?’

অভ্র বুকে হাত দিয়ে বলল,
‘যাক!বাঁচা গেলো।আমি তো ভেবেছিলাম না জানি আবার বাল্য বিবাহ করে ফেললাম।আর এর দায়ে পুলিশ আবার আমাকে ধরতে না আসে।’

আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,
‘এখন আর দেরি হচ্ছে না!’

তিনি দ্রুত হাতের ঘড়ি দেখে ‘তাড়াতাড়ি চলো’ বলেই আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন।

ভার্সিটির গেইটের সামনে গাড়ি থামাতেই আমি বের হয়ে গেলাম।অভ্রও বেড়িয়ে এলো।হঠাৎ পেছন থেকে ইরা আপুর গলার স্বর শুনে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম।ইরা আপু বলল,
‘কিরে অরু,ভালো আছিস?’
‘হ্যাঁ।তুমি ভালো আছো?বাবা মা ভালো আছে?’
ইরা আপু হেঁসে বলল,
‘হ্যাঁ সবাই ভালো আছে।’

তারপর অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলল,
‘অভ্র,তুমি ভালো আছো?’

অভ্র নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলো।ইরা আপুর কথায় মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে বললো,
‘হু।তুমি হঠাৎ এখানে।?’

‘এই তো একটু ঘুরতে এলাম।আগের সংস্পর্শে এসে যদি মনটা একটু ভালো হয়।তোমার মনে আছে অভ্র এই ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে আমরা কতো মজা করতাম।’

অভ্র ছোট্ট করে ‘হু’ বলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘অরু,আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।আমি যাই।ভার্সিটি যখনই ছুটি হোক আমাকে ফোনে বলবে।আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।’

কথাগুলো বলে আর কোনোদিকে না তাকিয়ে উনি চলে গেলেন।ইরা আপুও কিছুক্ষণ পর চলে গেলো।কিন্তু আমার কেনো যেনো আবারো বুকটা হু হু করতে লাগলো।

সন্ধ্যার পর আমি,মা আর চম্পা হলরুমের সোফায় বসে ছিলাম।আমি বসে একটি ম্যাগাজিন পড়ছিলাম।আর সামনের সোফাতেই চম্পা গভীর আগ্রহ সহকারে মাকে তাদের গ্রামের কারো জ্বীনে ধরার গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে।মাকেও দেখলাম আজ চম্পার গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছেন।আমি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে একটু কান পেতে আবার মনোযোগ অন্য দিকে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।কি সাংঘাতিক গল্প!মেয়েটাকে জ্বীনে ধরায় মাঝ রাতে একদম গাছের ডালে উঠিয়ে নিলো!

এমন সময় মেইন গেইট দিয়ে ধূসর প্যান্টের সাথে নেবি ব্লু কালারের শার্ট পরে অভ্র’র বয়সী একটি লম্বা মতো ছেলে প্রবেশ করলো।এসেই জোড়ে চেঁচিয়ে বললো,
‘হ্যালো গাইস!মিসিং মি?’

তার হঠাৎ চিৎকার করে উঠায় আমি চমকে দাঁড়িয়ে উঠে হাত থেকে ম্যাগাজিন পড়ে গেলো।মা উঠে একগাল হেঁসে বললেন,
‘নাহিদ!এতোদিন পর মনে পড়লো ফুফুর কথা।’

‘না ফুফু কি বলো!মনে পড়লো বলেই তো এতো তাড়াতাড়ি আসলাম।’

নাহিদ নামের ছেলেটির গলার স্বর শুনতে পেয়ে দেখলাম অভ্র উপর থেকে উৎফুল্ল হয়ে নেমে আসছে।এসেই লাফ দিয়ে দুজন দুজনকে জাপটে ধরলো।পেছন থেকে মা আমার কানের কাছে আস্তে আস্ত বললেন,
‘আমার বড় ভাইয়ের ছেলে।অভ্র’র সাথে সম্পর্ক বেশ ভালো। মামাতো ভাইয়ের থেকে বন্ধু বেশি।’

মা চম্পাকে ডেকে রান্নাঘরে চলে গেলেন নাস্তার কোনো ব্যবস্থা করতে।আর আমি অবাক হয়ে তাদের দুজনকে দেখতে লাগলাম।এতোদিন পর কাছে পেয়ে তারা দুজনই চরম খুশি।তাদের মধ্যকার বাকবিনিময় শেষ হলে নাহিদ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বললেন,
‘এই কি আমাদের পিচ্চি ভাবী?’

আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলাম।নাহিদ ভাইয়া বলতে লাগলেন,
‘পিচ্চি ভাবী তো দেখছি অনেক ভীতু।আমার ফার্স্ট ইম্প্রেশন দেখে হাত থেকে বেচারা ম্যাগাজিন টাকেই ফেলে দিলো।’

অভ্র পেছন থেকে আমাকে ভ্রু উঁচু করে ইশারা করলো।আমি তার দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে চোখ রাঙালাম।নাহিদ ভাইয়া বললেন,

‘অরু,আজকে কিন্তু তোমার হাতের চা খেয়েই যাবো।অরু বললাম বলে আবার কিছু মনে করো না।আসলে তুমি আমার থেকে অনেক ছোটো তো তাই ভাবী বলতে একটু অন্যরকম লাগে।’

আমি বললাম,
‘ইট’স ওকে ভাইয়া।আপনি বলতে পারেন।’

আরো কিছু কথার পর আমি রান্নাঘরে চলে এলাম।চা বানিয়ে মার বানানো কিছু নাস্তা ট্রে তে করে আমি তাদের দেওয়ার উদ্দেশ্য হলরুমের দিকে পা বাড়ালাম।হলরুমের কাছে যেতেই একটি পিলারের আড়ালে থমকে গেলাম।শুনতে পেলাম নাহিদ ভাইয়া সোফায় বসে অভ্রকে বলছে,
‘অভ্র,তুই ফোনে যা বললি তা কি সত্যি!ইরা ফিরে এসেছে।’
অভ্র বললেন,
‘হুম।’
‘তারপর,তোর সাথে কি ও’র কোনো কথা হয়েছে?’
‘একদিন অফিসে এসেছিলো।’
‘কি বললো?’
‘এমনিই ক্ষমা চাইছিলো।কাঁদছিলো।মাসুদ ও’র সাথে কি কি খারাপ করেছে বলছিলো।’
‘এখন খারাপ লাগছে কেনো?তখন তো হুর হুর করে মাসুদের হাত ধরে পালিয়ে গেলো।যেমন কর্ম তেমন ফল।তারপর…তুই কি বললি।’
‘বাদ দে তো।এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে