#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
৩০.
শাড়ি পরে বাসের ছাদ থেকে নামতে আমার বেশ কসরত করতে হলো।আঁচলটাকে একহাতে সামলাতে হচ্ছে,আবার সামনের কুঁচিগুলোও বারবার পায়ে বেজে বেজে আসছে।তবুও মনে একফোঁটাও বিরক্তি আসছে না।
জায়গা টাই এমন।পৌষ মাসের শুরু।ঢাকার ঐদিকটায় কুয়াশার কোনো ছিটেফোঁটা না থাকলেও এদিকে হালকা হালকা ভেসে উঠেছে।পাশে একপলক তাকিয়ে দেখলাম যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ ক্ষেত।কৃষকরা দু তিনজন ইতিমধ্যে ক্ষেতে আসা যাওয়া শুরু করে দিয়েছে।হালকা একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেলো।কিন্তু তাতে মোটেও শীত করছে না বরং ভালো লাগছে।ছোট্ট সরু পাকা রাস্তা।কতদিন ধরে মেরামত করা হয় না তার ঠিক নেই।রাস্তার জায়গায় জায়গায় ছোট্ট ছোট্ট গর্ত হয়ে আছে।রাস্তার পিচগুলো বেশিরভাগই উঠে গিয়ে মাটি ধূলো জমে রয়েছে।এই গর্তগুলোই যে বাসের এতো ঝাঁকুনির কারণ ছিলো তা তখন ছাঁদে বসে টের
পাই নি।
বাসের পশ্চাতে দন্ডায়মান লোহার মরিচা ধরা সিঁড়ির দু তিন ধাপ পেরোতেই আমার অনেক সময় লেগে গেলো।উপরের বাকি যাত্রীরা বিরক্ত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।তাদের অহেতুক ই যে দেরি করিয়ে দিচ্ছে ধীর পদক্ষেপে নামা সবুজ সুতি শাড়ি পরা মেয়েটি।সিঁড়ির মাঝ বরাবর আসতেই অভ্র আমাকে হাত ধরে নামতে সাহায্য করলো।অভ্র আগেই নেমে গিয়েছিলো।উনার হাত ধরে পরবর্তী ধাপগুলো একটু জলদিই পার করতে পেরে বাস থেকে নেমে আমি একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো বাসের উপরের মানুষগুলোও।তারা হয়তো ভেবেই নিয়েছিলো আজ অর্ধেক বেলা পর্যন্ত মেয়েটা তাদের এখানেই আটকে রাখবে আর নিজেও আটকে থাকবে।আমি নামতেই তারা ব্যস্ত ভঙ্গিতে নামা শুরু করে দিলো।অভ্র একটু এগিয়ে বাসের কন্ট্রাক্টরের সাথে কি যেন কথা বলতে লাগলো।তাকে ধরার জন্য আমি সামনে এগোতে লাগলাম।বাসে জানালার পাশে বসা একজন মধ্যবয়স্ক লোক বোতলের পানি মুখে গরগর করে ঢেলে কুলকচি করে জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে মারলেন।সেই এঁটো পানি থেকে বাঁচতে আমি দু কদম পেছনে ছিটকে এলাম।তারপর আবারো তাড়াহুড়ো করে তার কাছে যেতেই লোকাল বাসটা শোঁ করে আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেঁসে বললো,
‘চলো।’
সে দু কদম এগিয়ে যেতেই গাঢ় নিল রঙের শার্ট পড়া অভ্র’র দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আমি দ্রুত তার পিছে তাকে পুনরায় ধরার জন্য জোড়া জোরে পা চালালাম।রাত চারটা বাজে হঠাৎ ই অভ্র যখন আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ঘুরতে যাবে বলে শাড়ি পড়তে বললো তখন আমি বরাবরই বেশ অবাক হলাম।কিন্তু কোনো প্রশ্ন করতে পারলাম না।কারণ তার শর্তই ছিলো কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।শাড়ি পরা হয়ে গেলে সেই অন্ধকারের মধ্যেই অভ্র আমাকে নিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।এমনকি সাথে করে গাড়িটিও নিলো না।আস্তে আস্তে পায়ে হেঁটে আমরা বাড়ির কাছেই বাস স্ট্যান্ডে চলে এলাম।বাসের সিটগুলো অতিরিক্ত ছোটো আর ঘুপছি ধরণের হওয়ায় উনি আমাকে নিয়ে ছাদে চলে এলেন।ছাদে গিয়ে দেখলাম আমাদের মতো অনেকেই আছেন।তবে সবাই কেমন মলিন জামাকাপড় পরনে।বাস যখন যাত্রা শুরু করলো তখন অন্ধকার সবে কাটতে শুরু করেছে।তার চল্লিশ মিনিট পরই চলে এলাম ঢাকার বাইরে এই অঞ্চলটিতে।ছোট্ট একটি নদীর দু পাড় ঘেঁষে গড়া উঠা ছোট্ট বসতি।এমনিতে খুব নিরিবিলি।অনেক দূরত্ব নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ছোট্ট ছোট্ট টিনের ঘরগুলো।
বেলা বাড়তে লাগলো।সুপারি গাছের ডাল নিয়ে কিছু ছোটো ছোটো বাচ্চারা মাটির রাস্তায় খেলতে নেমে গেছে।পালা বদল করে এবার খালি গায়ে ধূসর পুরনো প্যান্ট পরা একটি ছোট্ট ছোলো সুপারি গাছের ডালের উপর উঠে বসেছে।আর ঐ ছেলের থেকে অপেক্ষাকৃত আরেকটু বড় ছেলে দু হাত দিয়ে ডাল শক্ত করে চেঁপে ধরে সম্মুখে মুখ করেই জোর খাটিয়ে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু ডাল ধরে একটু টানতেই ডালের উপর বসে থাকা ছোট বাচ্চাটা বারবার পেছনে পড়ে যাচ্ছে।যতবারই টানছে ততবারই একই কান্ড।এতে ডাল ধরে টানা ছেলেটি ঈষৎ ধমকের সুরে ছোট ছেলেটিকে শক্ত করে ডাল ধরে রাখতে বলল।এবার আর ছোট ছেলেটি পড়ে যাচ্ছে না।ছোট্ট ছোট্ট দুই হাত দিয়ে ডালটি শক্ত করে আঁকড়ে ধরায় এবার সে সানন্দেই হিঁচড়ে টানা গাড়ির মজা উপভোগ করতে পারছে।পড়ে যাওয়া সমস্যাটাকে সমাধান করতে পেরে বাচ্চাটি মহা খুশি।খুশিতে তার মুখের সবকটি দাঁত ই বের হয়ে রইলো।
আমাদের সাথে কোনো ব্যাগপত্রই নেই।এমনকি ফোনও।শূন্য হাতে মাটির কাঁচা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আমি বাচ্চা গুলোর কান্ড উপভোগ করতে লাগলাম।অভ্র গেছে রাস্তার পাশের টং দোকান থেকে কিছু কিনে আনতে।ঝোপের পাশ থেকে আরো একটি ছোটো বাচ্চা ছেলে বেড়িয়ে এলো।ছেলেটির কোমড়ে কালো মোটা সুতা বাদে আর কিচ্ছু নেই।এ দেখে তার সমবয়সী আরেকটি ছেলে তাকে নেংটা নেংটা বলে ক্ষ্যাপাতে লাগলো।কারণ তার পরনে প্যান্ট আছে সে আর বাচ্চাদের মতো নেংটো থাকে না এই গর্বে সে গর্বিত।তবে তার প্যান্টের অবস্থাও শোচনীয়।খালি গায়ে ঢিলা ময়লা প্যান্টটি বারবার খুলে খুলে পড়ছে।আর তাকে বারবার হাত দিয়ে সামলিয়ে ঠিক করে পরতে হচ্ছে।বারবার ক্ষ্যাপানোয় নেংটো ছেলেটির অপমানে মুখ ফুলে চোখে পানি চলে আসার উপক্রম হলো।সে হুট করে একটা কান্ড করে বসলো।সামনের ছেলেটির প্যান্ট ঝট করে হাত দিয়ে টেনে পা অব্দি নামিয়ে দৌড় লাগালো।আমি ফিক করে হেঁসে দিলাম।তাড়াতাড়ি প্যান্ট হাত দিয়ে টেনে ধরে সেই ছেলেটিও নেংটা ছেলেটার পিছে পিছে ক্ষোভ নিয়ে দৌড়াতে লাগলো।
অভ্র আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।আমি হাসিমুখেই তার দিকে তাকালাম।তার হাতে কলা আর পাউরুটি।উনি আমার দিকে তা বাড়িয়ে দিলেন।কলা দেখে আমি একটু করুণ চোখে তার দিকে তাকালাম।তিনি চোখ রাঙিয়ে আমাকে তাড়াতাড়ি খেতে বললেন।আমি করুণ মুখ নিয়েই জোর করে কলায় কামড় বসালাম।উনি বললেন,
‘এর থেকে বেশি এখানে আর পাওয়া যাবে না।’
খাওয়া শেষে আমরা সেই মেঠো পথ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম।জায়গাটা এতো সুন্দর,আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।এতো ভালো লাগছে সব কিছু!মনটাই ফুরফুরে হয়ে গেলো।রাস্তার পাশেই ধানক্ষেত গুলো।কৃষকরা ব্যস্ত ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।কিছু কিছু মহিলাদেরও দেখতে পাওয়া গেলো।তারা হয়তো তাদের স্বামীকে সাহায্য করতে এসেছে।একটি কৃষক পাশের ডোবার পানি থেকে মুখ ধুয়ে এলো।সামনে থাকা কৃষক বধু তার মলিন শাড়ির আঁচল বাড়িয়ে স্বামীকে মুখ মুছতে দিলো।গিন্নির আঁচলে মুখ মুছে কৃষকটি পুনরায় কাজে নেমে গেলেন।
অভ্র বললো,
‘হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’
‘উঁহু।’
পাশ দিয়ে কিছু রাজহাঁস যেতে লাগলো।আমি ভয়ে অভ্র’র হাতের শার্টের এক কোনা আঙ্গুল দিয়ে চেঁপে ধরলাম।যদি কামড় দেয়।কিন্তু না কিছু বললো না।শান্ত ভঙ্গিতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
‘শুনুন।’
‘হুম।’
‘বাবা মাকে তো বলে আসে নি।সাথে ফোনও আনি নি।তারা চিন্তা করবে না?’
‘বাড়ির বউ যদি একা গায়েব হতো তাহলে চিন্তা করতো।যেহেতু ছেলেকে নিয়ে গায়েব হয়েছে তাই চিন্তা করবে না।ভেবে নিবে সেই অধমই একটা না একটা ব্যবস্থা করেই নিয়েছে।আর এখন এতো কিছু ভাবতে হবে না। একদিনের জন্য সব ভুলে যাও।’
আমি বাচ্চাদের মতো করে হেঁসে বললাম,
‘আচ্ছা।’
সামনের রাস্তার ডানদিক থেকে ছাগলের পাল এসে পড়লো।একটি খুব ছোট ছাগলের বাচ্চাকে দেখা যাচ্ছে।পুরো ধবধবে সাদা গায়ের রং।ছাগলের বাচ্চাটি কেমন যেনো বারবার লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে।এদের মধ্যে কতগুলো রামছাগলও আছে।মাথায় ইয়া বড় বড় শিং।একদম আমার গা ঘেঁষে যাচ্ছে।আমি চমকে উঠে অভ্র’র দিকে ঘেঁষে দাঁড়ালাম।অভ্র বলল,
‘ভয় পাচ্ছো কেনো?এরা কিছুই বলবে না।’
আমি ঐ সাদা ছাগলের বাচ্চাটিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে অভ্রকে বললাম,
‘আচ্ছা,ঐ ছাগলের বাচ্চাটি এমন করছে কেনো?’
‘এই বাচ্চাটি একদম ছোটো।সম্ভবত দু একদিন আগেই জন্ম নিয়েছে।গরু,ছাগলের সদ্য জন্ম নেওয়া ছোটে বাচ্চাগুলো কিছুদিন এভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটে।ছাগলের বাচ্চাটি দেখতে সুন্দর না?’
‘হুম।’
‘ধরবে?’
আমি চমকে উঠে বললাম,
‘না।’
‘আরে ভয় পাচ্ছো কেনো!কিচ্ছু করবে না।’
অভ্র নিচু হয়ে ছাগলের বাচ্চাটির পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে দেখাতে লাগলো।আমিও নিচু হয়ে ভয়ে ভয়ে ছাগলের বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়াতে লাগলাম।আমি হাত নিতেই বাচ্চাটি আবারো লাফিয়ে উঠলো।ভয়ে আমি হাত সরিয়ে নিলাম।এটা দেখে রাস্তার পাশের কিছু বাচ্চা ছেলে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো।আমি মুখ ফুলিয়ে অভ্র’র দিকে তাকালাম।অভ্র মৃদু হেঁসে আমার হাত ধরে ছাগলের বাচ্চাটির পিঠে রাখলো।আর আমার হাত ধরেই পিঠে হাত বুলাতে লাগলো।প্রথম প্রথম ভয় পাচ্ছিলাম পরে দেখলাম না বাচ্চাটি এখন শান্ত হয়ে গেছে।অভ্র ধীরে ধীরে তার হাত সরিয়ে নিলো।ছাগলের বাচ্চাটির পিঠে হাত বুলাতে আমার খুব ভালো লাগছিলো।অভ্র বললো,
‘কি এখন ভালো লাগছে না?’
আমি খুশি হয়ে বললাম,
‘হুম।’
কিছুক্ষণ পর বললাম,
‘খুব সফট সফট লাগছে।’
উনি হেঁসে ফেললেন।বললেন,
‘কোলে নিবে?’
‘কোলে!’
‘হ্যাঁ কিচ্ছু করবে না।খুব শান্ত হয়ে থাকবে।’
হালকা একটু ভয় লাগলেও আমি না করলাম না।হয়তো এবারো অভ্র’র কথা অনুযায়ী কাজ করে আনন্দ পাবো।অভ্র ছাগলের বাচ্চাটিকে উঠিয়ে আস্তে আস্তে আমার কোলে উঠিয়ে দিলো।একটা আস্ত ছাগলের বাচ্চাকে কোলে নিয়েছি,আমার এতো আনন্দ লাগলো!ছাগলের বাচ্চাটি আমার ঘাড়ের কাছে তার মুখটি নিয়ে নাড়াচাড়া করায় সুরসুরি লাগছিলো।আমি আনন্দে খিলখিল করে হাসতে লাগলাম।আমাদের চারপাশে বাচ্চা ছেলেগুলো এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে।তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি বললাম,
‘দেখেছো,আমি ছাগলের বাচ্চা কোলে নিয়েছি।আমাকে নিয়ে আর হাসবে?’
আমার কান্ড দেখে অভ্র হেঁসে ফেললো।
অভ্র একটি নৌকা ভাড়া করেছে।আজ সারাদিন আমরা নৌকা করেই ঘুরবো।হাত ধরে আমাকে উনি নৌকায় উঠালেন।আমি নৌকার গুলুইয়ের উপর গুটিশুটি মেরে বসলাম।অভ্রও উঠে এলো।অথৈ পানিতে নৌকা চলতে শুরু করেছে।আমার কি যে ভালো লাগছে তা বলে বোঝাতে পারবো না।আজকের দিনটি এতো ভালো কেনো?
নৌকার কোনার উঁচু কাঠের পাটাতনে বসে অভ্র বলল,
‘অরু,তুমি কি সাঁতার পারো?’
‘না।’
‘ভয় পাচ্ছো না তো?’
‘না।’
উনার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম।সত্যিই তো চারদিকে থৈ থৈ করছে পানি।আমি তো সাঁতার পারি না।যদি নৌকা ডুবে যায় তখন কি হবে?কিন্তু ভয় লাগছে না। কারণ অভ্র আছেন।তিনি আমাকে নিশ্চয়ই বাঁচাবেন।আচ্ছা অভ্রও যদি সাঁতার না পেরে থাকে?
ভেতর থেকে আওয়াজ এলো,অভ্র সাঁতার যদি নাও পেরে থাকে তবুও অরু তোর কিচ্ছুটি হতে দিবে না।একটা না একটা ব্যবস্থা করবেই।আমি অবাক হলাম।এতো বিশ্বাস!
আমি হাত দিয়ে নদীর পানি ছুঁতে লাগলাম।অভ্র বললো,
‘সাবধানে দেখো,নয়তো পানিতে পড়ে টরে গেলে সবাই ভাববে আমি একা একা বউকে মারতে নিয়ে এসেছি।’
তার উদ্ভট মজার জন্য আমি তাকে চোখ রাঙানি দিলাম।সে হাসতে লাগলো।
আমি বললাম,
‘জায়গাটা খুব সুন্দর।’
‘হুম।এখানে অনেকেই আসে।নৌকা ভাড়া করে সারাদিন ঘুরতে।তোমার গরম লাগলে ছইয়ের মধ্যে গিয়ে বসো।’
আমি গেলাম না সেখানেই বসে রইলাম।রোদ থাকলেও রোদের প্রখরতা তেমন নেই।আর সাথে বাতাস থাকায় একদমই গরম লাগছে না।চারপাশে এতো সুন্দর।এসব ছেড়ে ছইয়ের ভেতর কি বসে থাকা যায়।
চারদিকে শুধু পানি আর পানি।নদীর পানি খুবই স্বচ্ছ।এমনিতে কোনো ঢেউ নেই।নদী শান্ত হয়েই আছে তবে মাঝে মাঝে হালকা ঢেউ ভেসে আসছে।মাথার উপর খোলা আকাশ।মাঝে মাঝে একটা দুটো গাঙচিল চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।অভ্র ছইয়ের ভেতরে ঢুকে একটা স্টোভ নিয়ে এলো।আমি বললাম,
‘এটা দিয়ে কি করবেন?’
‘দুপুরে খাওয়া দাওয়া করা লাগবে না?সৌন্দর্য্য দিয়েই কি পেট ভরবে!পেটের দিকটাও তো দেখতে হবে।’
সত্যিই তো খাওয়া দাওয়ার কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।কিন্তু তাই বলে নৌকার মধ্যে রান্না হবে শুনে বেশ অবাক হলাম।বললাম,
‘নৌকার মধ্যে রান্না হবে কিভাবে?’
‘এই যে এর জন্যই তো এই স্টোভ চুলা।কেরোসিনে চলবে।যদিও বাতাসে জ্বলতে একটু অসুবিধা হবে।তবুও আমরা তিন অধম মিলে কিছু একটা খাওয়ার উপযোগী বানিয়েই ফেলবো।কি চাচা!’
নৌকার মাঝি একজন আধবুড়ো চাচা।অভ্র’র কথা শুনে দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন।আমি বললাম,
‘কি রান্না হবে?’
‘ভাত,আলু ভর্তা,বেগুন ভাঁজা আর ভুনা ডাল।’
এই অথৈ পানিতে নৌকার মধ্যে বসে এই ভাত,ডাল,আলু ভর্তা,বেগুন ভাঁজা কেই অনেক বেশি কিছু বলে মনে হলো।আমি বললাম,
‘এতো কিছুর ব্যবস্থা আপনি করলেন কিভাবে?’
‘স্টোভ,পাতিল এসব তো নৌকার মধ্যেই ছিলো।আমি তো শুধু বাজার করে এনেছি।’
‘রান্না কে করবে?’
‘কেনো আমি।’
‘আপনি রান্না করতে পারেন?’
‘সব পারি না।এগুলো পারি।’
‘আমি রাঁধি?’
‘তুমি পিচ্চি মেয়ে,তুমি আবার রান্না করতে পারো!’
আমার মুখ ফুলে গেলো।উনি সবসময় আমাকে এতো পিচ্চি পিচ্চি করেন কেনো!
আমি রান্না করতে নেমে তাকে দেখিয়ে দিলাম আমিও রাঁধতে পারি।তবে উনিও খুব করলেন।দুজনে মিলেমিশেই রান্না করলাম।ভাতটা যখন ফুটে এলো তখন অভ্র বটি নিয়ে পেঁয়াজ মরিচ কুচি কুচি করে কাটতে লাগলেন।আমি বললাম,
‘এগুলো দিয়ে আবার কি করবেন?’
‘আলু ভর্তায় দিতে হবে না।’
ও তাইতো!আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।আলু ভর্তা করতে গিয়ে দেখা গেলো সরিষার তেল নেই।অতঃপর তেল ছাড়াই আলু ভর্তা করতে হলো।সম্পূর্ণ রান্না শেষে এবার খাওয়ার পালা।খাওয়ার আগে অভ্র নদীর পানিতে হাত মুখ ধুয়ে নিলেন।আমি উঠে দাঁড়ালাম।উনি বললেন,
‘আস্তে,পড়ে যেও না আবার।’
হাত মুখ ধুয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ মোছার জন্য অভ্র কোনো কাপড় বা গামছা পেলো না।আমি লাজুক ভঙ্গিতে সেই ক্ষেতের কৃষক বধূর মতো পেছনে থেকে শাড়ির আঁচল টেনে তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম।অভ্র স্মিত হেঁসে ঝুঁকে আমার শাড়ির আঁচল দিয়ে তার মুখ মুছে নিলো।
মাটির থালায় করে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত বাড়া হলো।নদীর খোলা বাতাসে খিদেটা যেনো জম্পেশ চড়ে উঠেছে।মাঝ নদীতে খিদে পেটে আলু ভর্তা আর বেগুন ভাঁজা দিয়ে গরম ধোঁয়া উঠা ভাত খেতে সেই মুহুর্তে অমৃতের মতো লাগলো।
খাওয়া শেষে আবারো আমরা চুপচাপ গুলুইয়ের উপর বসে রইলাম।এই প্রথম মাটির থালায় ভাত খেলাম।প্রথম অভিজ্ঞতাটা দারুন লাগছে।সবকিছু মিলিয়ে এতো ভালো লাগছে।খুশিতে মনটা প্রফুল্লিত হয়ে আছে।সবকিছু দারুন ভাবে উপভোগ করতে লাগলাম।আমার মনে হলো আমার আনন্দটা বোধ হয় স্পষ্ট ভাবে আমার চেহারায় ফুটে উঠেছে।অভ্র জিজ্ঞাসা করলো,
‘মনটা ভালো হয়েছে?’
আমি খুশি হয়ে বললাম,
‘হুম।’
উদ্যম বাতাসে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলোকে আমার কানে গুঁজে দিয়ে অভ্র বললো,
‘এভাবেই সবসময় হাসিখুশি থাকবে।মুখের এই হাসিটা তোমায় স্যুট করে।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে মুখ ভার করে বললাম,
‘তার মানে হাসি ছাড়া অন্য ভাবে দেখতে আমায় ভালো লাগে না।’
আমার হঠাৎ পরিবর্তনে অভ্র থতমত খেয়ে গেলো।বলল,
‘না আমি এটা বলতে চাই নি।’
‘কি বলতে চাইছেন?না হাসলে আমায় পেত্নীর মতো লাগে?’
অভ্র ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো।আমি হঠাৎ জোরে জোরে হাসতে শুরু করে দিলাম।আমার ফাজলামি বুঝতে পেরে অভ্রও হেঁসে দিলো।
আকাশটা আজ একদম নীল হয়ে আছে।তার মাঝে মাঝে সাদা পেজোর মতো তুলো ভেসে বেড়াচ্ছে।বৈঠা বাওয়ায় নদীর পানিতে ছলাৎছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া হালকা শীতল বাতাস আমার খোলা চুলগুলোকে বারবার কপালে এনে ফেলছে।অভ্র এখন মাথার নিচে এক হাত দিয়ে নৌকার পাটাতনের উপর শুয়ে আছে আর আকাশ দেখছে।আমার হঠাৎ মনে হলো,
ইশ!তার হাতের উপর শুয়ে যদি একটু আকাশ দেখতে পারতাম!
পরক্ষণেই মনে মনে জিভ কেটে মুচকি হেসে বললাম,ধুর!কি ভাবছি।
চারিদিকেই সুন্দরের ছড়াছড়ি।আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।সেই সকাল থেকেই ক্ষণে ক্ষণে অভ্র’র জন্য আমি শুধু মুগ্ধ হয়েই যাচ্ছি।আচ্ছা!আজ কি মুগ্ধ হওয়া দিবস?
নৌকা থেকে আমরা বিকেলের একটু আগে নামলাম।এই জায়গাটা মনে হচ্ছে আরো সুন্দর।নদীর চরের উপর দু তিনজন ফেরিওয়ালা এসে বসেছে।বিকেলের দিকে অনেকেই ঘুরতে এসেছে।একঝাঁক পাতিহাস দেখে আমি ওদের পিছু দৌঁড়ে ধাওয়া করতে লাগলাম।ওরা ঝাঁপ দিয়ে পাশে থাকা একটি ডোবার পানিতে নেমে গেলো।পানিতে মুহুর্তের জন্য মনে হলো ঘূর্ণিঝড় হয়ে গেছে কি সুন্দর!কি সুন্দর! সবকিছু এতো সুন্দর কেনো?অভ্র আমাকে নিয়ে একটি ভ্যানগাড়িতে উঠে পড়লো।গাড়িতে আরো দু তিনজন বসে আছে।আমরা দুজন পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লাম।ছোট্ট মাটির কাঁচা রাস্তায় গাড়ি খুব আস্তে আস্তেই চলতে লাগলো।হঠাৎ একটি ফেরিওয়ালা হরেক রঙের চড়কি লম্বা বাশের মধ্যে করে নিয়ে যেতে লাগলেম।তা দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে হাত দিয়ে অভ্রকে দেখিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,
‘চড়কি!’
অভ্র হঠাৎ চলমান গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দৌঁড়ে ফেরিওয়ালার কাছে যেতে লাগলেন।আমি ঘাবড়ে উঠলাম।কারণ গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছেে।উনি চড়কি কিনে আবারো সেভাবেই দ্রুত দৌঁড়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন।আমি খুশিতে হাত তালি দিয়ে ফেললাম।অভ্র আমার হাতে চড়কি দিলে আমি খুশি হয়ে সেটা ধরে রাখলাম।বাতাসে রঙ বেরঙের চড়কি ঘূর্ণায়মান আকারে ঘুরতে লাগলো।
নদীর পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে রইলাম।অভ্র গেছে আমার কথামতো গ্যাসবেলুন কিনে আনতে।শাড়ির আঁচল টি কোলের কাছে রেখে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে আমি আজ সম্পূর্ন দিনের কথা ভাবতে লাগলাম।এতো আনন্দ আমি আমার জীবনে আর কখনো পাই নি।মনে হচ্ছে আমার খুশি বাঁধ ছাড়া হয়ে গেছে।ভেতর থেকে বাইরে উপচে পড়ছে।আনন্দে আজ নাচতে ইচ্ছে করছে,গাইতে ইচ্ছে করছে।নদীর পানিতে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আমি খুশিতে ছোটোবেলার একটি প্রিয় গান হঠাৎ গাইতে লাগলাম,
আকাশে বাতাসে চল সাথি
উড়ে যাই চল,ডানা মেলে রে
ময়না রে ময়না রে যাবো তোর
পিছু পিছু,ডানা মেলে রে।
এতটুকু গাইতেই পাশে তাকিয়ে দেখি অভ্র একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাড়িয়ে আছে।মুখে আছে সেই নজরকাড়া মিষ্টি হাসি।আমি সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম।লাজুক হেঁসে মাথা নিচু করলাম।উনিও আমার পাশে বসে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বললেন,
‘থেমে গেলে কেনো?ভালোই তো লাগছিলো।
গাও।’
আমি একটু থেমে লাজুক হেঁসে আবারো গাইতে লাগলাম,
আকাশে বাতাসে চল সাথি
উড়ে যাই চল,ডানা মেলে রে…
অভ্র আমার দিকে ঈষৎ ঝুঁকে মুখ এনে গাইলো,
ময়না রে ময়না রে যাবো তোর
পিছু পিছু,ডানা মেলে রে…
আমি তার দিকে তাকিয়ে গাইলাম,
আকাশে ভেসে চল
রূপকথার দেশে চল।
অভ্র আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে ইশারা করে চোখ ছোটো ছোটো করে গাইলো,
ঐ দেশে বাঁধবো ঘর
পার হয়ে তেপান্তর।
তারপর আমরা দুজনেই গেয়ে উঠলাম,
সাত সাগর তেরো নদী
পেছনে ফেলে রে…..
রিমঝিম ঝিম বৃষ্টি শেষে
সূর্য আবার উঠবে হেঁসে
সে আমার এ দু চোখে
স্বপ্ন ছড়াবে……. (অভ্র)
নেই তো দু চোখ ঘুমের ঘোরে
স্বপ্ন তবু দু চোখ জুড়ে
সেই সুখে মন পাখি
যে পাখা উড়াবে….(আমি)
সুরে সুরে….(অভ্র)
গানে গানে…খুশিতে
আজ মন যে দোলে…(আমি)
আকাশে বাতাসে চল সাথি
উড়ে যাই চল,ডানা মেলে রে
ময়না রে ময়না রে যাবো
তোর পিছু পিছু,ডানা মেলে রে
আকাশে ভেসে চল
রূপকথার দেশে চল।
ঐ দেশে বাঁধবো ঘর
পার হয়ে তেপান্তর,
সাত সাগর তেরো নদী
পেছনে ফেলে রে………..
ধীরে ধীরে জড়তা কাটিয়ে আমি স্বাচ্ছন্দ্যে গান গাইতে লাগলাম।আর আমার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে অভ্রও।ধীরে ধীরে পানিতে দুলতে থাকা আমাদের পায়ের তালের সাথে সাথে গলার স্বরও বাড়তে লাগলো।আমরা দুজন নির্জন নদীর পাড়ে বসে গলা ছেড়ে গান গাইতে লাগলাম।একসময় হাঁফিয়ে উঠে দু জন সবুজ ঘাসের উপরেই শুয়ে পড়লাম।হাঁফাতে হাঁফাতে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দুজনেই হেঁসে ফেললাম।ঘাসে শুয়ে থেকে মাথার উপরের খোলা আকাশ দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে।পাশে থাকা আগাছা ধরণের গাছের সাথে অভ্র’র বেঁধে রাখা গ্যাসবেলুন গুলো আমি হাত বাড়িয়ে খুলে ছেড়ে দিলাম।আমাদের গানের ন্যায় গ্যাসবেলুন গুলো আকাশে উড়ে যেতে লাগলো।
আমি একবার অভ্র’র দিকে তাকিয়ে দেখলাম অভ্র মুখে মিষ্টি একটি হাসির রেখা টেনে একদৃষ্টিতে আকাশ দেখছে।মুচকি হেঁসে এই নীল অভ্র’র থেকে চোখ সরিয়ে মাথার উপরের ঐ নীল অভ্র’র দিকে তাকিয়ে আমি ভাবলাম,
আমাদের সবার জীবনেই এমন একটি মানুষ থাকা দরকার যে হুট করে আমাদের মন ভালো করে দিতে পারবে।যার কাছে থাকবে আমাদের মন ভালো করে দেওয়ার রহস্যময়ী ঔষধ।অন্য কিছু না থাকলেও চলবে।কিন্তু মন ভালো করে দেওয়া ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ থাকতেই হবে।এটি প্রয়োজন।খুব খুব প্রয়োজন।
চলবে,