অতঃপর_তুমি পর্ব-২৭

0
5170

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অভ্র গম্ভীরমুখে বললেন,
‘অরু,তোমার থেকে আমি এটা আশা করি নি।’

আমার গলা শুকিয়ে গেলো।আমতা আমতা করে বললাম,
‘আমি আসলে….আপনাকে…

‘আমাকে কি অরু? এখন নতুন ক্লারিফিকেশন দিয়ে তো লাভ নেই।সকাল বেলা তুমি বললে তোমার শরীর ভালো লাগছে না তাই ভার্সিটিতে আজ যাবে না।আমিও তাই তোমাকে কোনো জোর করি নি।কিন্তু সেই তুমি আবার বাইরে কেনো বেরোতে গেলে!মাত্রই একটা দূর্ঘটনা থেকে সেরে উঠলে এখন দেখছি আবার নতুন আরেকটা বাঁধিয়েই ছাড়বে।’

আমি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম।যাক!অভ্র কিছু জানে না।অভ্র বলতে থাকলো,
‘কি এমন জরুরী কোথায় যাওয়ার ছিলো শুনি!শরীর ভালো না লাগা সত্ত্বেও না যেয়ে পারলে না?’

আমি আবারো ঘাবড়ে গেলাম।কিছু বলতে পারছি না।উনি সেই কতক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।কিছু বলতে যাবো তার আগেই নিচ থেকে মায়ের গলা ভেসে এলো।তিনি অভ্রকে ডাকছেন।উনি একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিচে চলে গেলেন।আমি হাফ ছেড়ে বিছানায় বসে পড়লাম।
আমি বুঝতে পারছি না কি করবো?অভ্রকে কি সব বলে দিবো?সব জানার পর তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?প্রথম প্রথম তো দেখেছিলাম অভ্র আপুর উপর প্রচন্ড ক্ষেপে আছেন।কিন্তু এখন আপু প্রসঙ্গে তিনি কোনো কথাই বলেন না।আপুর ফিরে আসা প্রসঙ্গে অভ্র ঠিক কি করতে পারে?

নাহ!আমি আর ভাবতে পারছি না।মাথা ঘুরছে।আল্লাহ সাহায্য করো!

এভাবেই কেটে গেলো কিছু দিন।মাঝে এক দুবার ও বাড়ি গিয়েছিলাম।ইরা আপু এখন কিছুটা শান্ত হয়েছে।অভ্রকে কিছু বলি নি।একদিন দেখলাম অভ্রও সবটা জেনে গেছে।আপুর ফিরে আসা আর আপুর সাথে কি হয়েছে সব।আমি যা ভেবেছিলাম তেমন কিছুই হলো না।উনি আমার সাথে এ নিয়ে কিছু বললেন না।উনি পুরো চুপচাপ ছিলেন তার মনের ভাবভঙ্গি আমি বুঝতে পারলাম না।তাই আমিও আর এ নিয়ে তার সাথে কোনো কথা তুলি নি।তাছাড়াও অভ্র আমার সাথে পুরো স্বাভাবিকই ছিলো।তিনি জেনে গেছেন শুনে আমার মনে একটু খচখচ করলেও তার দিক থেকে কোনো ভিন্নতা খুঁজে পাই নি।
একদিন ভার্সিটি থেকে ঠিক করলাম অভ্র’র অফিসে গিয়ে অভ্রকে চমকে দিবো।সাথে করে দুটো কোন আইসক্রিম নিয়ে যাবো।একসাথে খাবো।যেই ভাবা সেই কাজ।গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পরনের জামাটি দেখতে ভালো লাগছে কি না।সবুজের ওপর হলুদ ফুলতোলা জামাটি দেখতে খারাপ লাগছে না।প্রসন্ন মনেই তার অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম।জানি,তিনি রাগ করবেন ভার্সিটি থেকে একা একা এতোটা পথ এলাম কেনো!তবুও রাগ করুক যাই করুক তা পরে দেখবো।এখন আমার তাকে দেখতে ইচ্ছে করছে এটাই গুরুত্বপূর্ণ।অফিসে গিয়ে দেখলাম সবাই ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজ করে যাচ্ছে।সবার নজর কম্পিউটার মনিটরের দিকে আবদ্ধ।কি বোর্ডের উপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে উদ্যম নেচে চলছে তাদের আঙ্গুলগুলো।হাতে ফাইলের বোঝা নিয়ে পিয়ন দ্রুত গতিতে কোথায় যেনো ছুটে চলছেন।
রিসিপশনে মেরুন রঙের শাড়ি পড়া সুন্দরী মেয়েটা ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছে।রিসিপশনে থাকা মেয়েগুলো কি সবসময় সুন্দরই হয়।

আমি সোজা অভ্র’র কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলাম।এর আগেও একবার অভ্র’র সাথে এখানে এসেছিলাম।আর আজ আমি একা আসলাম।আফসোস লাগছে পরিকল্পনা মাফিক আইসক্রিমটা সাথে আনা হয় নি।অফিসের কাছে এসে একটা দোকানও খোলা পেলাম না।অভ্র’র কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে দরজাটা একটু খুলতেই দেখলাম ইরা আপু ভেতরে অভ্রকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে।আমার হাত আঁটকে গেলো।দরজাটা আর খুলতে পারলাম না।কয়েক সেকেন্ড দৃশ্যটি দেখতেই আমি দরজা ভিরিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম।কেমন যেনো স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম।নিঃশ্বাস নিতেও যেনো অদ্ভুত লাগছে।সবকিছু কেমন যেনো অন্যরকম লাগতে লাগলো।আমি বুঝতে পারলাম না আমার কি হয়েছে।হঠাৎ কেমন যেনো স্থির হয়ে গেলাম।সেখান থেকে সোজা বাসায় চলে আসলাম।বাসায় গিয়েই ওয়াশরুমে গিয়ে সোজা শাওয়ারের নিচে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।কিছু ভাবতেও পারছি না।টানা দু ঘন্টা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ভিজলাম।তারপর কোনো মতে জামা পাল্টে বাইরে চলে আসলাম।অনেকক্ষণ ধরে পানিতে ভেজায় চোখ লাল হয়ে গেছে।টপটপ করে ভেজা চুল থেকে পানি ঘাড়ে পড়ছে।ওয়াশরুমের দরজা খুলে বেরোতেই দেখলাম অভ্র ফিরে এসেছে।আমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন,
‘এত বড় হয়ে মাথাটাও ঠিকমতো মুছতে শিখলে না।এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে যে অরু!’

কথাগুলো বলতে বলতে উনি আমার হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে আমার মাথা মুছতে লাগলেন।আমি নিশ্চুপ হয়ে রইলাম।উনি বলতে লাগলেন,
‘ভার্সিটি থেকে না বলে চলে এসেছো কেনো?আমি ভার্সিটি গিয়ে ফেরত আসলাম।বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন করে জানতে পারলাম তুমি বাসায় চলে এসেছো।আজ কি ভার্সিটি তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিলো?’

আমি চোখের পলক ফেলে হুম বললাম।হঠাৎ চোখে পড়লো রুমের মাঝখানের বড় দেয়ালটিতে আমার আঁকা আমাদের নিয়ে পেন্সিলের সেই স্কেচটা।অভ্র একটি সোনালি ফ্রেমে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রেখেছেন।আমি এগিয়ে গিয়ে একদৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম।অভ্র পেছন থেকে আমার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
‘খুব সুন্দর লাগছে না!’

আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘হুম।’

সেদিনের পর থেকে আমি একটু বিষন্ন হয়ে পড়লাম।কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না।অভ্র’র সাথে স্বাভাবিকই আছি।কিন্তু আগের মতো তার সাথে আর তেমন দুষ্টুমি করা হয় না।আমি যে এমন বিষন্ন হয়ে কেনো পড়েছি সেই কারণটা আমি নিজেই ধরতে পারছি না।শুধু জানি আমার কিছু ভালো লাগছে না।কিচ্ছু না।

২৯.
অারিশা আপু এসেছেন তুতুলকে নিয়ে।বিকেলে মার্কেটে গিয়েছিলেন সেখান থেকে ভাবলেন দেখা করেই যাবেন।আমি তুতুলকে কোলে করে সোফায় বসে খেলতে লাগলাম।
তুতুল একটি নতুন ভিডিও গেমস কিনেছে।আমাকে সেটাই হাতে করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে।রান্নাঘর থেকে মায়ের চম্পাকে বকাবকি করার আওয়াজ কানে ভেসে এলো।নিশ্চয়ই আবার কোনো উদ্ভট কথা বলেছে মায়ের সামনে।
কিছুক্ষণ পর আরিশা আপু অভ্রকে ডেকে এনে সোফায় বসে বললেন,

‘অভ্র,অরুর ইনকোর্স পরিক্ষা তো হয়েই গেছে এখন হানিমুনে যাবি কবে?তোর দুলাভাই ওদিকে আমাকে বলে বলে পাগল বানিয়ে ফেলছে।’

আরিশা আপুর কথায় উনি একটু বিরক্তিসূচক শব্দ করলেন।আপু বললেন,

‘আচ্ছা,তুই এমন করছিস কেনো?তোর দুলাভাইকে তো চিনিস একটা জিনিস মাথায় ঢুকেছে তো সেটা না করে ছাড়বে না।আর কাজ কি অন্য মানুষের থাকে না।দশ দিনের জন্য গেলে কি হয়।বান্দরবান এতো সুন্দর একটা জায়গা।ঘুরে দেখতেও তো কতো ভালো লাগে।অরু,তুমি কখনো গিয়েছো বান্দরবান?’

আমি আস্তে মাথা নাড়িয়ে না বললাম।অভ্র আমার দিকে তাকালো।আরিশা আপু আবারো বললেন,

‘দেখ!অরু বান্দরবান যায় নি।ওঁকে একটু সেখানে ঘুরিয়েও তো নিয়ে আসতে পারিস।ভালো লাগবে।’

আমি কখনো বান্দরবান যাই নি শুনে আরিশা আপুর কথায় এবার অভ্র রাজী হয়ে গেলো।বলল,

‘আচ্ছা বেশ,যাবো।কিন্তু আপু এখন না।আমাকে আর কিছু দিন সময় দিতে হবে।অফিসে একটা ইম্পর্টেন্ট প্রজেক্ট চলছে।সেটা শেষ না করা অব্দি দশদিনের জন্য যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।’

‘আচ্ছা বেশ!তোর সুবিধা মতো যাস।কিন্তু এরপর কিন্তু আর কোনো বাহানা শুনবো না।এবার যেতেই হবে।’

আরিশা আপু চলে যাওয়ার পর চম্পা সোফার সামনে মেঝেতে আমার পাশে বসে থালা করে কিছু মটর দানা ছিলতে নিয়ে এলো।

হালকা সবুজ সবুজ মটরদানার কয়েকটি দানা আমি হাতে তুলে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম।
চম্পা বলল,
‘আফা আমগো গেরামে না এই ছোলা দিয়া একধরনের লাউয়ের ডাইল রান্না করে খাইতে খুব স্বাদ হয়।’

আমি বললাম,
‘মটরশুঁটি দিয়ে ডাল,কি বলো!’

‘হ আফা।তয় হেয়া মটরশুঁটি না।উডি রে কয় কলুই।হিতকাল আইলেই সবাই নিজেগো ক্ষেতে লাগায়।হেগুলি দেখতেও এমনি তয় দানাগুলা আরেকটু ছোটো ছোটো থাকে।হেই কলুই বাইট্টা ডাইলের মধ্যে দিয়া লাউ দিয়া রান্না করে।হেই ডাইল আর বেগুন ভাঁজা দিয়া ভাত খাইয়া দেইখেন অনেক ভালো লাগে।আপনেরে একদিন দেহামু নি রাইন্ধা।কলুই শাকও খায় জানেন।ঐডাও অনেক মজার।’

‘কলুই শাক!ঐ যে খুব ঝিরিঝিরি করে কেটে রান্না করে ঐটা না?’

‘হ হ ঐডাই।’

‘ছোটোবেলায় যখন মাঝে মাঝে গ্রামে যেতাম তখন কয়েকবার খেয়েছিলাম।এমনিতে শাকপাতা আমি বেশি খাই না।তবে ঐ শাকটা খেতে খুব পছন্দের ছিলো।’

‘ঐ শাকটা আরো মজার হয় যদি একটুখানি আদা কুঁচি আর শুকনা মরিচ গুড়া কইরা দেওয়া যায়।’

‘আর বলো না চম্পা আমার তো খেতে ইচ্ছে করছে।’

‘আফামনি আপনার যে পছন্দ আগে কইবেন না।এই বার মোসুম ডা আইতে দেন।আপনেরে আমগো গেরাম থিকা আইনা খাওয়ামু।’

চম্পার সাথে কথা বলা শেষ হতেই আমি আবার অন্যমনষ্ক হয়ে পড়লাম।রাতে খাবার টেবিলে চুপচাপ খাবার খাচ্ছিলাম।বাবা আর মা অনেক কথাই বলছেন।চম্পাও বোকার মতো তাদের কথার মাঝখানে কথা বলে অলরেডি বকা খেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।অভ্র খাওয়ার মাঝে ডকুমেন্টস নিয়ে কার সাথে যেনো ফোনে কথা বলায় মা আপত্তি প্রকাশ করলেন।তাই উনি ফোন রেখে দিলেন।অনেক কথাই হচ্ছে কিন্তু কোনোটাতেই আমি যোগ নিলাম না।চুপচাপ খেতে লাগলাম।মা হঠাৎ আমাকে নরম স্বরে ডেকে বললেন,

‘অরু।’

‘আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম।মা বললেন,
‘তুমি আজকাল কেমন চুপচাপ হয়ে থাকো।তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,’না মা,এমনিই।’

মা পুনরায় খাবারে মনোযোগ দিলেন।আমিও মাথা নিচু করে খাবার খাওয়ার আগে দেখলাম অভ্র ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমি তার থেকে নজর আড়াল করে মাথা নিচু করলাম।

এভাবেই চলতে লাগলো আমার দিনকাল।একদিন হঠাৎ রাত চারটা বাজে অভ্র আমাকে ঘুম থেকে ডেকে বললো,
‘অরু আমার একটি কথা রাখবে?’

আমার বুকটি ধ্বক করে উঠলো।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে