অতঃপর_তুমি পর্ব-২৬

0
5253

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-২৬
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

২৮.
ফার্স্ট সেমিস্টারের ইনকোর্স পরিক্ষা দিয়ে রেজাল্টও হাতে পেয়ে গেছি।আলহামদুলিল্লাহ!অভ্র’র প্রচেষ্টায় ভালো রেজাল্টই করেছি।প্রশান্তিতে ভরা মনটা নিয়ে রাতে মেঝেতে বসে আছি।অভ্র একটি তেলের বাটি নিয়ে আমার মাথার কাছে বসেছে।আমার সিল্কি সিল্কি চুলগুলোকে আলগোছে ফাঁকে ফাঁকে সিঁথি করে তাতে তেল চুপচুপ করে লাগিয়ে ভরিয়ে তুলছেন।আমি একবার মাথায় হাত দিয়ে বললাম,
‘আপনি দেখছি আজ আমার মাথাকে তেলের খনি না বানিয়ে ছাড়বেন না।’

উনি একটু শাসনের সুরে উহু! করে উঠলেন।

‘এতো তেল এখন কেউ দেয়?’

‘চুলে তেল না দিলে চুল ভালো থাকে না।’

‘ভালো না থাকলেও ভালো দেখাতে তো হবে।সব মেয়েরা সিল্কি চুল নিয়ে কতো সুন্দর স্টাইল করে ভার্সিটিতে আসে জানেন!’

‘পিচ্চি মেয়ে তুমি,আবার এতো স্টাইল কিসের?আর তুমি ভার্সিটিতে গিয়ে ভালো টা কাকে দেখাতে যাবে শুনি!চুপচাপ করে বসে থাকো না হলে চুলে টান খাবে।’

আমি একটু আহ্লাদি ভাবে ঠোঁট ফুলিয়ে চোখ তুলে তাকে দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না।অভ্র এখন খুব যত্ন করে আমার চুল তিন ভাগ করে এক ভাগের উপর আরেক ভাগ গুছিয়ে বিনুনি করে যাচ্ছে।আমার অসুস্থতার সময় উনি ইউটিউব দেখে দেখে চুলে এই এক বিনুনি করে দিতেন।এখন একা একাই পারেন তবে মাঝে মাঝে তিন ভাগটাকে পাটে পাটে রাখতে গুলিয়ে ফেলেন।তাই এই সময় তিনি পুরো মনোযোগ নিয়ে রাখেন চুলের উপর।আমি একটু স্মিত হেঁসে হাতের কাগজটায় মনোযোগ দিলাম।অভ্র বিনুনি করতে করতে বললেন,
‘খাতায় কি দাগাদাগি করছো?’

‘দাগাদাগি করছি না।ছবি আঁকছি।’

‘কার ছবি?’

‘আপনার।’

‘আল্লাহ্!চেহারাটা রক্ষে পাবে তো!’

আমি হাতের কনুই দিয়ে তার পায়ে একটা গুঁতো দিলাম।উনি হেঁসে উঠলেন।কিছুক্ষণ পর আমার সম্মুখ কাঁধে বিনুনিটি রেখে বললেন,
‘নাও!তোমার বিনুনি হয়ে গেছে।’

‘আমারও হয়ে গেছে।’

‘কই দেখি!’

‘এক সেকেন্ড।’

মাথার উপর দু হাত উঁচু করে খাতা সহ আলাদা পৃষ্ঠাটি তার চোখের সামনে ধরলাম।উনি হাত বাড়িয়ে খাতাটি নিলে আমি মুচকি হেঁসে তার কিছু বলার অপেক্ষা করতে লাগলাম।
অভ্র পেন্সিলে স্কেচ করা ছবিটিতে দেখলো,একটি সরু গলির মাঝখানে একটি ছেলে মেয়ে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গলির দু পাশের দেয়ালের ভেতর থেকে একটি দুটি কদম গাছের ডালপালার অংশবিশেষ বাইরে বেড়িয়ে এসেছে।ডালগুলোতে কিছু সংখ্যাক কদম ফুলও দেখা যাচ্ছে।একটি দাঁড়কাক দেয়ালের উপর বসে রয়েছে।খাঁ খাঁ শূণ্য গলির মাঝে সেই অবস্থায় দুই বিনুনি করা কাঁধে ব্যাগ ঝুলানো স্কুল ড্রেস পরিহিতা মেয়েটি সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে খুব অবাক হয়ে গোল গোল চোখ করে দাঁড়িয়ে সামনের ছেলেটিকে দেখছে।আর চেকচেক শার্ট গায়ের ছেলেটি মাথা চুলকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হেঁসে বা হাতটি বাড়িয়ে মেয়েটিকে কিছু দিচ্ছে।

অভ্র আনমনেই হেঁসে উঠলো।এতো সুন্দর করে মধ্য দুপুরের দৃশ্যটি ফুটিয়েছে অরু!সব….সব ঠিক সেরকম।গলির সাইডে থাকা ডাস্টবিন আর তার উপর আধ খোলা ঢাকনাটা ঠিক সেভাবেই আছে।এমনকি তার চারপাশে ঘুর ঘুর করা হুলো বেড়ালটাও।

অভ্র মুগ্ধ হয়ে বলে উঠলো,
‘তুমি এতো সুন্দর ছবি আঁকতে পারো অরু!’

আমি লাজুক হেঁসে তাকে বললাম,
‘বলেন তো এটা কোন দৃশ্য?’

‘এটা সেই দৃশ্য যেদিন মধ্যদুপুরের সরু গলিতে আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম।’

আমি বললাম,
‘উহু!এটা সেই দৃশ্য যেদিন মধ্য দুপুরের সরু গলিতে আমি আপনাকে প্রথম দেখেছিলাম।’

অভ্র ছবির দিক থেকে আর চোখ ফেরাচ্ছে না।স্মিত হেঁসে বললো,
‘হুম একই।তুমি কিন্তু দেখতে তখন খুব কিউট ছিলে।আর তোমার চাহনিটাও।আচ্ছা!তুমি সেদিন এমন সঙ্কুচিত হয়ে ছিলে কেনো?কেমন গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে ছিলে!’

‘তো কি করবো!এর আগে তো আর এমন ফাঁকা শুন্য গলিতে কোনো ছেলে আমাকে পেছন থেকে নাম ধরে ডেকে কথা বলেনি।তাই একটু অন্য রকম লাগছিলো।’

অভ্র মৃদু হেঁসে উঠলো।আমি একটু মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘আর আপনি কি করছিলেন!লাজুকতায় তো মুখ তুলে ঠিকমতো তাকাতেও পারছিলেন না।’

উনি বললেন,
‘আর যাই বলো দুই বিনুনিতে সেদিন কিশোরি অরুকে দেখতে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছিলো।ইউটিউব দেখে আমি এই দুই বিনুনি করাটাও শিখে নেবো।তারপর তোমাকে সবসময় দুই বেনুনি করিয়ে এমন কিউট বানিয়ে দেখবো।’

আমাকে আবার সবসময় এমন বাচ্চাদের মতো দুই বিনুনি করে রাখবে শুনে আমি দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললাম,
‘আপনাকে এই ছবিটা দেখানোই ভুল হয়েছে।দিন ওটা।’

অভ্র বিছানায় ছবিসহ ছিটকে দূরে সরে বলল,
‘অসম্ভব!এই ছবি আর তুমি পাচ্ছো না।আমি তো ছবি থেকে এক সেকেন্ডের জন্যও চোখ সরাতে পারছি না আর দিয়ে দেব!এই ছবিটা আমি ফ্রেমে আটকে আমাদের রুমের এই দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখবো।’

কথাটি বলে অভ্র দ্রুত বিছানা থেকে নেমে রুমের বাইরে চলে গেলো।তার কান্ড দেখে আমি মাথা নেড়ে মুচকি হাসলাম।

বিছানায় থাকা আমার ফোনটা হঠাৎ কর্কশ শব্দ করে বাজতে শুরু করলো।মা ফোন করেছে।রিসিভ করে বললাম,
‘হ্যালো মা,ভালো আছো?’

মা ফোনের ওদিক থেকে চিন্তিত গলায় বললো,
‘আমি ভালো আছি।অরু একটা কথা বলার ছিলো।’

‘হ্যাঁ,বলো।’

‘ইরা…ইরা ফিরে এসেছে।’

মায়ের কথায় আমি পুরো থ হয়ে গেলাম।মুখ দিয়ে আর কিছু বেরোলো না।মা কালকে একবার আমাকে ও বাড়ি যাওয়ার কথা বলে রেখে দিলেন।আমি এখনো স্তম্ভিত হয়ে আছি।কেমন যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না।আপু এতোদিন পর ফিরে এসেছেন।কি ব্যাপার?কেনো? নানান চিন্তা মাথায় ঘুরতে লাগলো।সেদিন রাতে আমি আর একফোঁটাও ঘুমাতে পারলাম না।পরদিন সকালে অভ্র অফিসে যেতেই আমি আমাদের বাড়ি গেলাম।মা আমাকে দেখে কেঁদে দিলেন।তারপর মায়ের মুখ থেকে যা শুনলাম তাতে আরো স্তম্ভ হয়ে গেলাম।মায়ের থেকে জানতে পারলাম,
ইরা আপু অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর মাসুদ ভাইকে বিয়ে করে ফেলে।কিন্তু কিছুদিন যাবার পরই মাসুদ ভাইয়া ইরা আপুর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে থাকে।বাসায় নেশা করে ফিরতো,ঝামেলা করতো।এরপর আপু জানতে পারে মাসুদ ভাইয়ার আরো অনেক মেয়ের সাথেই সম্পর্ক আছে।এ নিয়ে অনেক ঝামেলা হয় এবং কিছুদিন আগেই মাসুদ ভাইয়া আপুকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।আপু খুব কষ্ট করে এরপর বাংলাদেশে ব্যাক করেছে।

মা খুব কাঁদতে লাগলেন।বাবা এখনো আপুর সাথে কোনো কথা বলেননি।সন্তান যতো খারাপই হোক না কেনো কোনো বাবা মা তাকে ফেলে দিতে পারেন না।ইরা আপু রুমের দরজা ভিড়িয়ে শুয়ে আছে।আমি আস্তে আস্তে গিয়ে আপু বলে ডাকতেই আমাকে ধরে খুব কাঁদলেন।আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না।
আপুকে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে আর কেউ কিছু বলতে পারলো না।কিভাবে বলবে!আপু নিজেই এখন খুব ভেঙে পড়েছে।

দুপুরে অভ্র ফিরে আসার আগেই আমি বাড়ি ফিরে আসলাম।সবকিছু হুট করে কেমন যেনো অন্যরকম লাগছে।হয়তো এমন কিছু একটা কখনো ঘটবে কখনো ভাবি নি।বাড়ি ফিরতেই চম্পা দৌঁড়ে এসে বললো,
‘আফামনি দেইখা যান বাগানের পেছনের গাছগুলায় কি সুন্দর সাদা সাদা দেখতে কয়খান ফুল ফুটছে।’

আমি কিছু বলার আগেই চম্পা হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে বাগানের পেছনের দিকে নিয়ে গেলো।আমি দেখলাম সত্যিই নাম না জানা এক শুভ্র ফুল সবুজ পাতার ঝোপের মাঝে খুব সুন্দর ভাবে ফুটে আছে।আমি হাত বাড়িয়ে সেগুলোকে ধরতে চাইলাম।কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে চম্পা বলে মফিজ ভাইয়ের লাজুক কন্ঠস্বর শুনে আমরা দুজনই পেছনে ফিরে তাকালাম।চম্পা এগিয়ে গিয়ে আমার সামনে ডাকার জন্য একটা ধমক দিলো।মফিজ ভাই আর কিছু বললেন না।একজোড়া জরি লাগানো লাল চুড়ি এগিয়ে দিলেন।চম্পা লাজুক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালো।হয়তো ভেবেছিলো সবসময়ের মতোই চম্পাকে আমি এ নিয়ে ক্ষ্যাপাবো।কিন্তু আমাকে কিছু বলতে না দেখে কিঞ্চিৎ অবাকই বোধহয় হলো।আমি তাদের দুজনকে দেখে মৃদু হেঁসে ভেতরে চলে আসলাম।চম্পাও আমার পেছন পেছন চলে এলো।
রান্নাঘরের সামনে এসে অভ্র’র মাকে দেখলাম।প্রফুল্ল মনে কিছু একটা বানাচ্ছেন।চম্পা দেখেই বললো,
‘খালাম্মা আপনে আবার খিচুড়ির মতন ফিরনি আর ফল একলগে সব মিশাইয়া হেগুলা বানাইতাছেন।জানেন আফামনি খালাম্মা জম্মের মজা কইরা এইডা বানায়।’

চম্পার কথাশুনে আমি মৃদু হেঁসে দিলাম।মা ধমকের সুরে চম্পাকে বললেন,
‘চুপ কর!তোর প্রশংসা আমার কোনো কানেই লাগলো না।আমার ফ্রুট কাস্টার্ড কে তুই যেই নাম দিয়ে দিলি সেই অপরাধে এই মুহুর্তে তোর মাথার সব চুল ফেলে ন্যাড়া বানিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’

চম্পা ঢোক গিলে সেখান থেকে সরে পড়লো।মা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘অরু,তোমাকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।’

‘না মা।তেমন কিছু না।’

‘তুমি যাও রুমে গিয়ে রেস্ট নাও।কাস্টার্ড বানানো হয়ে গেলে কেমন হয়েছে জানার জন্য তোমাকে আগে টেস্ট করাবো।তখন বলবে।’

আমি স্মিত হেঁসে মাথা নেড়ে রুমে চলে আসলাম।রুমে আসতেই সব চিন্তাগুলো আবার এসে জেঁকে ধরলো।আচ্ছা অভ্র তো এখনো জানে না ইরা আপুর ফিরে আসার কথা।যদি জানতে পারে তাহলে কি হবে?
কথাটি ভাবতেই পেছন থেকে অভ্র’র গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম।

‘অরু!’

আমি ঘাবড়ে গিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পেছনে তাকালাম।অভ্র’র কপাল ভাঁজ হয়ে মুখটা গম্ভীর দেখাচ্ছে।উনি আরেক কদম আমার দিকে এগিয়ে এলো।আমি একটা ঢোক গিললাম।তাহলে…অভ্র কি সব জেনে গেছে?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে