#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
১৪.
আমার হাতে আছে এখন একটি দড়ি।আর আমি দাঁড়িয়ে আছি অভ্রদের বাড়ির বাগানের সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটির তলায়।গাছের কোন ডালটি শক্ত আর মজবুত হবে তা অনুমান করার চেষ্টায় এখন আমি মহা ব্যস্ত।অবশেষে বহু পরীক্ষণ নিরীক্ষণ শেষে যে ডালটি পছন্দ হলো সে ডালটিতে বহু চেষ্টা করেও আমি আমার হাতের দড়িটা ছোঁয়াতে পারলাম না বাঁধা তো আরো অনেক দূরের ব্যাপার।অতঃপর সেই ডালের আশা ত্যাগ করে সবথেকে নিচু ডালটায় বাঁধতে চাইলাম কিন্তু তাতেও কোনো সুবিধা পেলাম না।লাফিয়ে ছাপিয়ে কোনো ভাবেই দড়িটাকে ডালের মধ্যে নিতে পারলাম না।বিরক্তিতে রেগে মেগে হাত থেকে দড়িটা মাটিতে ফেলে দিলাম।তারপর রাগটা ঠান্ডা হলে আবার পুনরায় প্রচেষ্টায় লেগে গেলাম।এতক্ষণে আমি একবার আড়চোখে দোতলার বারান্দায় তাকিয়ে দেখে নিয়েছি যে অভ্র খুবই কৌতুহলী দৃষ্টিতে আমার কান্ড দেখছে।তিনি প্রথমে কোল ড্রিংক খেতে খেতে বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন তারপর হঠাৎ-ই আমার দিকে চোখ পড়ায় চমকে উঠে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।আর বেশিকিছু দেখিনি।আমি এখন আমার কাজে ব্যস্ত।আবারও শুরু করে দিলাম দড়ি নিয়ে লাফালাফি।এবার একটা প্লাস্টিকের চেয়ার জোগার করে এনেছি।তারপরও কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
আচমকা অভ্র এসে আমার হাত ধরে ধমক দিয়ে চেয়ার থেকে নামিয়ে দিলেন।আমি কিছু বোঝে ওঠার আগেই রাগান্বিত হয়ে বলতে লাগলেন,
‘তোমার মাথার ঠিক আছে।মানুষের জীবনে আরো কতো কিছু হয় জানো?আর এতোটুকুর জন্য তুমি সুইসাইড করতে চাইছো।আত্মহত্যা মহাপাপ তুমি জানো না।’
তার কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।উনি এসব কি বলছেন!উনি ভেবেছেন উনার দেওয়া কষ্টের জন্য আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি!আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললাম,
‘আপনাকে কে বললো আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি।আমি তো জাস্ট একটা ডালের সাথে দড়িটা বেঁধে দোলনা বানানোর চেষ্টায় আছি।মফিজ ভাই বাড়িতে নেই।নয়তো উনিই বেঁধে দিতেন।আগেরবার যে বেঁধে দিয়েছিলেন সেই ডালটা কাল রাতের ঝড়ে ভেঙে গিয়েছে।তাই তো আমিই বাঁধতে এসেছি।আর আপনি কিনা মনে করেছেন আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি!’
‘হয়েছে আর হাসতে হবে না।এই সময়ে কেউ দোলনা বাঁধতে আসে?এই ভরদুপুরে এভাবে গাছের তলায় দড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ এটাই ভাববে।’
‘যে কেউ ভাববে না।আপনি ভেবেছেন সেটাই বলেন।’
‘আমি একটা কথা আগেও বলেছি এখনো বলছি, তুমি কথা একটু বেশি বলো।’
আমি মুখ ফুলিয়ে ফেললাম।অভ্র বুঝতে পেরে বলল,
‘এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে একজনম পার করে ফেললেও তুমি দোলনা বানাতে পারবে না।এই দড়ি বাঁধতে হলে গাছে উঠে বাঁধতে হবে।দেখি, আমার হাতে দড়ি দাও।আমি গাছে উঠছি।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘আপনি গাছে উঠবেন?’
‘হ্যাঁ,এতে এতো অবাক হবার কি আছে?’
‘না মানে,বড়লোকের ছেলেরাও আবার গাছে উঠতে পারে!’
‘বড়লোকের ছেলেরা গাছে উঠতে পারে না কোথাও লেখা আছে।’
আমার হাত থেকে দড়ি নিয়ে তিনি গাছে উঠে পড়লেন।গাছ ভরে কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটে পুরো লাল রঙে ভরে গেছে।জ্যেষ্ঠ্য মাসের প্রখর রোদে মনে হচ্ছে কেউ গাছটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।অভ্র’র একটি ডালে উঠে দড়ি বাঁধার ফলে ডালটি সহ আশেপাশের আরো কিছু ডাল নড়ে উঠে সেই লাল আগুন মতন ফুলগুলো ঝরঝর করে ঝরে আমার মাথার উপর পড়ছে।আমার এতো যে ভালো লাগছে!অভ্র’র দড়ি বাঁধা শেষ হলে আমি আবারো তাকে ডেকে বললাম ডালগুলো আরেকটু নাড়িয়ে ফুল ঝরাতে।কিন্তু তিনি বিরক্তি নিয়ে বললেন,
‘কি গরম দেখেছো!এই গরমে বসে বসে আমি এখন ডাল নাড়াবো!’
আমি মুখ ভার করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার মাথার উপরে যেনো লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে।মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি অভ্র মৃদু হেসে ডাল প্রবলবেগে নাড়িয়ে যাচ্ছে।আমিও মিষ্টি করে হেঁসে দিয়ে হাত দিয়ে ফুলগুলো ছুঁতে লাগলাম।
আমি এখন আর নিচে ঘুমাই না।অভ্র শুতে দেয় না।এই অস্বাভাবিক কান্ডটা কিভাবে ঘটেছে তা না বললেই নয়।আমি সেদিন ডিনার শেষ করে আয়নার সামনে বসে চুল বাঁধছিলাম।অভ্র বারান্দায় ছিলো।চুল বাঁধা শেষ হলে মেঝেতে বিছানা করে ওয়াশরুমে গেলাম।আমার পায়ে তখনও ব্যাথা রয়ে গেছে।হাঁটতে কষ্ট হয়।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দরজার মুখে আসতেই অভ্র এসে ‘সাবধাবে হাঁটতে বলে’ আমার হাত ধরে এগিয়ে নিলো।আমার পাতানো বিছানার কাছে আসতেই আমি বললাম,
‘আর এগিয়ে দিতে হবে না।আমি ঠিক আছি।’
অভ্র হাত ছেড়ে দিলে আমি বিছানায় গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে যেই না শুতে যাবো তখনই অভ্র বলে উঠলো,
‘অরু উঠো,তোমাকে নিচে ঘুমাতে হবে না।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘নিচে না ঘুমালে কোথায় ঘুমাবো?’
‘আমার বিছানায়…আই মিন তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও আমি সোফায় ঘুমাবো।’
‘না থাক।আমার অসুবিধা হচ্ছে না।’
‘কথা কম।আমি যা বলছি তা শুনো।উঠো।’
এই বলে তিনি আমার বালিশ,চাদর নিয়ে বিছানায় রেখে আমাকে উঠিয়ে বসালেন।আর তিনি তার বালিশ নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আমিও শুয়ে পড়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।উনি লম্বা মানুষ।সোফায় ঘুমাতে নিশ্চয়ই অসুবিধা হচ্ছে।কিন্তু এছাড়া আর উপায় কি?আমি বিছানায় ঘুমালে তাকে তো সোফাতেই ঘুমাতে হবে।অভ্র এখন আর আগের মতন নেই।আমার সাথে ভালো ব্যবহার করে,খেয়াল রাখে কিন্তু তবুও আমাদের সম্পর্কের তো কোনো পরিবর্তন হয়নি।অভ্র’র বিছানায় ঘুমাতেও একটু অন্যরকম লাগছিলো।একদিন তিনি আমাকে এই বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন আর আজ নিজেই নিয়ে এলেন।
১৫.
আমি ঠিক করে ফেলেছি অভ্রকে যেভাবেই হোক অফিসে পাঠাতে হবে।তার এই দেবদাসগিরি অবশ্যই বন্ধ করাতে হবে।অভ্র’র বাবার কতো কষ্ট হয় একা একা এতোকিছু সামলাতে!একটা যোগ্য ছেলে ঘরে থাকতে তিনি এতো কষ্ট করবেন কেনো?এর একটা উপায় আমি বের করবোই।
অভ্র রুমে যখন প্রবেশ করলো তখন আমি বারান্দায় গভীর চিন্তায় ব্যস্ত।হঠাৎ আমার ফোনে লোন এজেন্সি থেকে কল এলো।আমি এমন ভাব করলাম যে আমি তাকে দেখতে পাইনি।সেই ভঙ্গিমাতেই আমি ফোন রিসিভ করে তৎক্ষণাৎ একজন কাল্পনিক রুনা বানিয়ে একটু চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম,
‘হ্যালো রুনা!শুনলাম তোর এনগেজমেন্ট হয় গেছে।কি ছেলে ইঞ্জিনিয়ার?দু বছর পর দেশে ফিরলে বিয়ে হবে।ওয়াও গ্রেট!হ্যালো কি বললি?আমার হাজবেন্ড কি করে?’
আমি বুঝে গিয়েছি অভ্র আমার পেছনেই দাড়িয়ে আছে।এই পর্যায়ে আমি একটু আফসোসের ভঙ্গিতে আরো জোড়ে জোড়ে বলতে লাগলাম,’আমার হাজবেন্ড তো কিছুই করেনা।সারাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করে নয়তো ঘরে চুপচাপ বসে থাকে।কি বললি?’এমনি আর কিছু করে কিনা?’
তা তো আমি জানি না কি করে!আমি আসার পর থেকে তো এসবই করতে দেখে আসছি।আর অন্য কিছু করতে পারে বলে তো মনে হয় না।
কি?…তুই আমার হাজবেন্ডকে এখনও দেখিসনি?
ও সমস্যা নেই আমাদের বাসার আশে পাশে দিয়ে যদি কখনো যাস তাহলে খেয়াল করে দেখবি,শুকনো মুখে,খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজানো কোনো দেবদাস উদাস মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিনা।যদি দেখতে পাস তবে সেই আমার হাজবেন্ড।সে ছাড়া ওভাবে আর কেউ এখানে ঘুরে বেড়ায় না।’হ্যাঁ?তাহলে আমার খরচ কে চালায়?’
কে আবার আমার শ্বশুর।বেচারা বুড়ো মানুষ সারাদিন অফিসে খাটাখাটুনি করে।কি বললি?’আমার তার থেকে টাকা চাইতে সঙ্কোচ লাগে কিনা?’….হ্যাঁ তা তো একটু লাগেই।শ্বশুরকে কি আর সব প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা বলা যায়!এখন আর কি করার!স্বামী যদি না দিতে পারে তবে তো শ্বশুরের কাছেই চাইতে হবে নাকি!
তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড তাই তোর কাছে মনের কথা বললাম।তুই তোর ইঞ্জিনিয়ার জামাই নিয়ে ভালো থাকিস।আমিও ভালোই আছি।’
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে শেষ করে আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে দেখলাম অভ্র মুখ থমথম করে রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে।এদিকে ব্যাংক লোনকারী এতক্ষণে হতভম্ব হয়ে থেকে আবার ম্যাম ম্যাম শুরু করছে।আমি ফোন কানে নিয়ে উল্লাসিত হয়ে বললাম,
‘আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ফোন দেওয়ার জন্য।আমি কথা দিচ্ছি,কখনও যদি লোন নেই তবে আপনার ব্যাংক থেকে আপনার হাত দিয়েই নেবো।’
ফোন কেটে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।অভ্র ইদানিং আমার জীবনটা হুট করে বদলে দেবার জন্য খুব অনুতপ্তে ভোগে আর আমিও সেই অস্ত্রটাই কাজে লাগালাম।তার মুখের যেই অবস্থা দেখলাম তাতে মনে হচ্ছে কাজ হয়েছে।
চলবে,