#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
আমি অস্ফুট স্বরে কিছু বলে উঠার আগেই উনি হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন।আমি হতভম্ব হয়ে রইলাম।কিছুক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে মাথা নত করে আমার হাত দুটো তার মুঠোয় নিয়ে বললেন,
‘আই এম স্যরি অরু।আমি তোমার সাথে সত্যিই খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি।যেখানে তোমার কোনো দোষই ছিলো না।আমি সত্যিই খুব লজ্জিত।’
আমি কি বলবো কিছু বুঝতে পারছি না।শুধু বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রয়েছি।অভ্র বলতে লাগলো,
‘তোমার কাছে মাফ চাওয়ার মতো মুখও আমার নেই।আমি তোমার ক্ষমার যোগ্য না।সত্যি বলতে ইরার আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো।আমি কি করছি,কি বলছি তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
আমার সাথেই কেনো এমন হলো বলতে পারো অরু?আমি তো আমার ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখিনি।নিজের সর্বোচ্চ টুকু দিয়ে উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম।তুমি যে বললে না আমি কেনো ইরাকে চিনতে পারিনি?ইরার অনেক স্বভাবই আমার ভালো লাগতো না।ও বারবার ভুল করতো কিন্তু আমি ক্ষমা করে দিতাম।আমি ভাবতাম ভালোবাসার মানুষটিকে কিইবা ভালোবাসলাম যদি তার ভুলগুলোকে ক্ষমাই না করতে পারি।আমি ইরাকে কতটুকু ভালোবেসেছিলাম তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না।কিন্তু ইরা যে আমাকে এভাবে এতবড় কষ্ট দিবে তা আমি কখনো ভাবতে পারিনি।এর থেকে যদি ইরা আমায় খুন করতো তবুও হয়তো এতোটা কষ্ট পেতাম না।একদিকে ভালোবাসার থেকে ধোঁকা পেয়েছি আরেকদিকে বন্ধুত্বের থেকেও।ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের উপরেও যে আমাকে সন্দেহ করতে হবে এটা আমি ভাবতেও পারিনি।আমার খুব নিঃসঙ্গ লাগে অরু।এতোটা কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিনা।এই কষ্ট আমার অস্তিত্বটাকেও পাল্টে দিয়েছে।ইরার দেওয়া কষ্টের আঘাতে আমিও পুরো আবেগশূন্য হয়ে পড়েছিলাম।আমার শুধু মনে হতো আমার সাথে অন্যায় হয়েছে আর এর জন্য সবাই দায়ী।কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলাম।কাউকে বিশ্বাস হচ্ছিলো না।
বাবা ঠিকই বলেছিলো আমি যা করেছি তাতে আমার আর ইরার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।আমি সত্যিই একটা নিষ্ঠুর।খুব নিষ্ঠুর।জেদের বশে অন্ধ হয়ে তোমার জীবনটা আমি নষ্ট করে ফেললাম।আমি নিজেকে এর জন্য কখনো ক্ষমা করতে পারবো না, অরু।কখনোই না।’
অভ্র’র চোখ থেকে এই প্রথম ইরার আপুর জন্য অশ্রু না দেখে অনুতপ্তের অশ্রু ঝরতে দেখছি।আজকে আর তিনি লুকিয়ে ছুপিয়ে কাঁদছেন না।আমার সামনে অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।তাকে থামানোর জন্য অনেক কিছু বলতে চাইলেও আমি বলতে পারছি না।আবেগে কথাগুলো গলায় আটকে আসছে।উনার কান্না দেখে এখন যে আমারও চোখে পানি চলে এসেছে।
১২.
খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ল অভ্র সাদা পান্জাবী গায়ে নামাজ পড়ছে।আমি উঠে বসলাম।এই প্রথম তাকে আমি নামাজ পড়তে দেখছি।অভ্র’র বাবা আমাকে বলেছিলো অভ্র আগে নিয়মিতই নামাজ পড়তো।শুধু ইরা আপুর ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই বাদ দিয়েছে।আমিও অযু করে জায়নামাজ নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে পরলাম।নামাজ শেষে সালাম ফিরিয়ে দেখতে পেলাম তিনি এখনো মোনাজাত দিচ্ছেন।আল্লাহর কাছে আমি শুধু এই দোয়াই করলাম অভ্র যেনো তার আঘাত টা ভুলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।উনি দীর্ঘ মোনাজাত শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে একটা ফ্যাকাসে হাসি দিলো।আর বলল,
‘জানো অরু,ঐ ঘটনার পর থেকে আমি দুটো বড় পাপ করে ফেলেছি।একটি হলো আমি মদ খেয়েছি।এটা হারাম।আর আরেকটি হলো তোমার সাথে অন্যায় করেছি।আমার নিজেকে প্রচন্ড খারাপ মানুষ মনে হচ্ছে অরু,প্রচন্ড খারাপ।আল্লাহ আমাকে বোধহয় কখনো মাফ করবেন না।তুমিও আমাকে মাফ করো না।আমার এই প্রাপ্য।’
‘আপনি শুধু শুধু নিজেকে এতোটা দোষারোপ করছেন।আপনি অনুতপ্ত হলে আল্লাহ নিশ্চয়ই আপনাকে ক্ষমা করবেন কারণ তিনি দয়ালু এবং মহান।আর আমি তো আপনাকে কখনো অপরাধীই ভাবিনি তাহলে ক্ষমা করবো কি!সেটাতো কাল একটু রাগের মাথায় বেশি বেশি বলে ফেলেছিলাম।’
‘না।তুমি বেশি বেশি বলোনি।যা বলেছো একদম ঠিক বলেছো।আমি সত্যিই তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।আমার জেদের কারণে তোমার জীবন নষ্ট করেছি।তোমারও নিশ্চয়ই কিছু স্বপ্ন ছিলো জীবন নিয়ে?যা আমার কারণে শেষ হয়ে গেলো।আমি জানি,এখন চাইলেও আমি তোমাকে আর আগের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবো না।সমাজ তা হতে দিবে না।একটা মেয়ের জন্য তো কখনোই না।
তাই আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার আর কোনো অসুবিধা হতে দিবো না।তোমার যেসব স্বপ্ন আছে সব পূরণ করতে আমি তোমাকে সাহায্য করবো।তোমাকে আর কোনো কষ্ট পেতে দিবো না।’
বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলে তিনি একটি ছবি বের করে আমার হাতে দিলেন।এটি সেই ছবি যেটা কাল অভ্র ছিঁড়ে ফেলেছিলো।ছবিটা খুব ভালোভাবে জোড়া লাগানো হয়েছে।আমি অবাক হয়ে গেলাম এতো কুটিকুটি করে ছেঁড়া ছবিটা তিনি আবার কিভাবে জোঁড়া লাগিয়ে ফেললেন।কাল সারারাত বসে বসে নিশ্চয়ই এই করেছেন।
নিচে গিয়ে চম্পার থেকে জানতে পারলাম রাতে অভ’র বাবা এসেছেন।নিজের হাতে চা বানিয়ে আমি তার রুমে গেলাম।বাবা চশমা চোখে দিয়ে একটা ফাইল দেখছেন।এতোদিনে অভ্র’র বাবা আর আমার মধ্যে অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক হয়ে গেছে।মানুষটা খুব ভালো।
‘বাবা।’
অভ্র’র বাবা চমকে তাকিয়ে হেঁসে বললেন,
‘অায় মা,বোস এখানে।’
আমি তার সামনের টি টেবিলে চায়ের কাপটি রেখে বসে অভিযোগের সুরে বললাম,
‘আপনি না কাল রাতেই ফিরলেন।এখন আবার অফিসের কাজ নিয়ে বসে পড়েছেন।একটুও বিশ্রাম না করলে কিভাবে চলবে?’
অভ্র’র বাবা হেঁসে ফেললেন।’তুই তো দেখি আমার পুরো মা হয়ে গেছিস।তোর কথায় আমার আম্মার কথা মনে পড়ে গেলো।’
‘আমার বাবাও তাই বলে আমাকে দেখলেই নাকি তার মার কথা মনে পড়ে যায়।’
‘তা তো বলবেই কারণ তুই যে একটা লক্ষ্মী মেয়ে।’
‘বুঝেছি।কিন্তু আপনি এখন এগুলো রাখুন।এতো কাজ করতে হবে না।’
‘আরে,এগুলো কোনো কাজ হলো!বয়স থাকতে আরো কতো কাজ করেছি।এই পুরো বিজনেসটা দাঁড় করিয়েছি।আমার বাবা ছিলেন কৃষক।পড়তে দেখলেই বই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কাস্তে হাতে ধরিয়ে মাঠে নিয়ে যেতেন।তার ভেতর লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ালেখা করে আজ এখানে এসেছি।ভেবেছিলাম বুড়ো বয়সে ছেলের হাতে সবকিছু দিয়ে নিশ্চিন্ত হবো।প্রথম প্রথমতো অভ্র একাই সব দায়িত্ব পালন করা শুরু করেছিলো কিন্তু এখন……।
কথাগুলো বলে অভ্র’র বাবা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।আমি বুঝতে পারছি তার মন খারাপ হয়ে গেছে।কথা ঘুরানোর জন্য আমি বললাম,
‘কাল যে গাজীপুর থেকে আসলেন আমার জন্য কি এনেছেন?’
‘হুম,এনেছি তো।একটু দাঁড়া।’
আলমারী থেকে একটা চকলেটের বক্স বের করে বললেন,
‘এই নে তোর চকলেট।চকলেট তুই এতো পছন্দ করিস?’
‘চকলেট সব মেয়েরাই পছন্দ করে।কিন্তু আমি সবথেকে বেশি যেটা পছন্দ করি তা হলো ফুচকা।ফুচকার কথা মনে পড়লেই খেতে ইচ্ছে করে।কি যে মজা!’
‘তুই ফুচকা এতো পছন্দ করিস আগে বলবি তো!দরকার হলে তোর জন্য বাড়ির সামনে আমি একটা ফুচকার দোকানই বানিয়ে দিবো।’
‘তার এতো দরকার নেই।একদিন বিকেলে আমাকে ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে যাবেন তাতেই হবে।আপনাকে খাইয়ে দেখাবো ফুচকা আসলেই কতো মজা।’
‘ঠিকাছে ঠিকাছে তাহলে সেই কথাই রইলো।’
আমি চলে আসছিলাম হঠাৎ অভ্র’র বাবা আমাকে পেছন থেকে ডেকে উঠে বললেন,
‘কিরে অরু।তুই এমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেনো?’
বাবা বুঝে ফেলায় আমি ভয় পেয়ে গেলাম।হেঁসে বললাম,
‘ঐ একটু লেগেছিলো বাবা,তেমন কিছু না।’
বাবা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন,
‘অভ্র কি কিছু করেছে?’
‘আপনার এমন কেনো মনে হচ্ছে?’
‘কি জানি মা,আজকাল যেমন হয়ে গেছে!কোনোকিছুতেই আর বিশ্বাস করতে পারি না।’
‘আপনার ছেলে অনেক ভালো।আপনি শুধু শুধু এমন ভাবছেন।’
‘ভালো হলেই ভালো।’
১৩.
আমার সাথে এই মুহূর্তে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যের মতো একটি ব্যাপার ঘটে গেছে।আমার জামাকাপড় সব চুরি হয়ে গেছে।প্রথমে একটি নীল রঙের ওড়না লাগেজ থেকে বের করার জন্য আমি লাগেজ সচরাচব যেখানে রাখি সেখানে গিয়ে দেখি আমার লাগেজ নেই।তারপর পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখি কোথাও নেই।অবশেষে আলমারির পাশের চিপা থেকে লাগেজ উদ্ধার হলো কিন্তু লাগেজ উঠিয়ে দেখি পুরো হালকায় ঠনঠন করছে।ভেতরে কোনো জামাকাপড় তো দূরে থাক একটা সুতা অবধি নেই।তার মানে নিশ্চয়ই চুরি হয়েছে।কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো এই বিশাল বাড়িতে এতো কিছু থাকতে চোর আমার জামাকাপড়ই শুধু নিলো কেনো?আমার জামাকাপড় তার এতো পছন্দ হয়েছে।আর নিলো তো নিলই একটা সুতা পর্যন্ত ছেড়ে গেলো না।কি সাংঘাতিক ব্যাপার!
এই ভয়ংকর সংবাদ চম্পাকে জানানোর জন্য আমি আতংকিত হয়ে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠলাম,
‘চম্পা…..!’
অভ্র রুমে এসে একটা ধমক দিয়ে বলল,
‘এমন চেঁচাচ্ছো কেনো?’
আমি আতংকিত হয়ে বললাম,
‘আমার জামাকাপড় সব চুরি হয়ে গেছে।’
‘হোয়াট?’
‘হ্যাঁ,সত্যি বলছি।আমি পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেলেছি আর দেখুন লাগেজও পুরো ফাঁকা।’
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,
‘চোর কখনো এতো কাঠখোট্টা পুড়িয়ে জামাকাপড় চুরি করতে আসে?’
‘তাই তো ভাবছি।দুনিয়ায় এতো কিছু থাকতে আমার জামাকাপড়ের সাথে কারো কি শত্রুতা থাকতে পারে বলুন তো।’
অভ্র একটি বিরক্তিকর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আলমারীর একটি কবাট খুলে দিলেন।কিন্তু যা দেখলাম তাতে জামাকাপড় চুরি হওয়ার চাইতেও বেশি অবাক হলাম।মুখ হা হয়ে গেলো।আমার সব জামাকাপড় তার আলমারীর একসাইডে অবশেষে স্থান পেয়েছে।সব খুব সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখা আছে তার জামাকাপড়ের পাশে।কতক্ষণ ওভাবে মুখ হা করে ছিলাম জানি না।একসময় অভ্র বলে উঠলো,
‘এবার মুখটা অন্তত বন্ধ করো।নাহলে সব মাছি তাদের গুহা ভেবে তোমার মুখের মধ্যে চলে যাবে।’
আমি থতমত খেয়ে মুখ বন্ধ করে নিলাম।অভ্র বলল,
‘আমিই তোমার জামাকাপড় আলমারীতে রেখে দিয়েছি।তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।কিন্তু যেভাবে তুমি মুহুর্তের মধ্যে চোর বানিয়ে দিলে!তুমি নাকি পুরো রুম তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছো?যদি দেখেই থাকো তবে পেলেনা কিভাবে?’
আমি হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
‘আমি ভেবেছিলাম আমার জামাকাপড় পৃথিবীর যেকোনো কোনায় থাকতে পারে কিন্তু আপনার আলমারীতে কখনোই থাকবে না।যেভাবে গতবার ফেলে দিয়েছিলেন….!
আমার কথায় অভ্র’র মন খারাপ হয়ে গেলো।আমিও বুঝতে পারলাম বোকার মতো কি বলে ফেলেছি।তাই কথা ঢাকতে বললাম,
‘শুধুশুধু আপনি কষ্ট করে রাখতে গেলেন কেনো?আপনার জামাকাপড় রাখতে অসুবিধা হতে পারে।তাছাড়াও আমার এখন খারাপ লাগে না, অভ্যাস হয়ে গেছে লাগেজে রাখতে।’
‘না অরু,প্রয়োজন হলে আমার জামাকাপড় লাগেজে রেখে দিবো কিন্তু আমার জন্য তোমার কোনো অসুবিধা হতে আর দিবো না।আগেও অনেক অদ্ভট কান্ড করে ফেলেছি আর না।তোমাকে আমি এই বাড়িতে নিয়ে এসেছি তাই তোমার যাতে সুবিধা হয় তুমি তাই করবে।’
চলবে,,