অতঃপর_তুমি পর্ব-০৫

0
5981

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

১০.
ডিম নিয়ে একটি বহুল প্রচলিত কথা আছে,
‘পরীক্ষার আগে আগে ডিম খেলে নাকি পরীক্ষায় ডিমের মতোই আন্ডা পেতে হয়।’
ছোটোবেলায় এই কথাটি দাদীর মুখে শুনে আমি এতটাই আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম যে শুধু পরীক্ষা কেনো পড়ালেখা সম্পর্কিত কোনো কাজের আগেও আমি ডিম খেতাম না।বাবা তো আমার এই কান্ড দেখে সেই রাগ!
ক্লাস ফাইভে থাকতে বৃত্তি পরীক্ষার দিন সকালে আমার সেই ভ্রান্ত ধারণা দূর করার জন্য হুট করে বাবা আদেশ জারি করলেন আজকে আমায় ডিম খেয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে।কথা শুনেই আমার বিষম উঠে গেল।মা বাবার এই ঘোষণায় ঘোর আপত্তি জানিয়ে বললেন,
‘কি দরকার শুধু শুধু রিস্ক নেওয়ার!মেয়েটা ভয় পায়,থাকুক না।’
‘ইরার মা, তুমিও কি এসব উদ্ভট কথা বার্তায় বিশ্বাস করো নাকি!আমার মেয়ে কষ্ট করে পড়ালেখা করেছে,ভালো ফলাফল করবে তার নিজের যোগ্যতায়।ডিমের এখানে কাজ কি!আমার মেয়েকে ঠেকিয়ে রাখবে এই ডিম!অরু মা নে এই ডিমটাকে খেয়ে এক্কেবারে শেষ করে দেতো।’

বাবার ভয়ে সেদিন ঠোঁট ফুলিয়ে ছলছল চোখে আমি সম্পূর্ণ সিদ্ধ ডিমটা খেলেও ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে যায়।খাওয়ার সময় বারবার মনে হচ্ছিলো ‘যাহ!খেয়ে ফেললাম তো সব পড়া।এবার পাবো একটা বিশাল আন্ডা।কি লাভ হলো শুধু শুধু এতো পড়ালেখা করে।’

ডিম খেয়ে সেদিন পরীক্ষা দেওয়ার পর পরীক্ষা ভালো হওয়া সত্ত্বেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিলো আমি পরীক্ষায় আন্ডা পাবো।কিন্তু আমাকে চরম আশ্চর্য করে রেজাল্ট আসে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি।
খুশিতে আমি সেদিন চারটা ডিম সিদ্ধ একসাথে খেয়ে ফেলি।
ডিম নিয়ে এই উদ্ভট মাতামাতিটা সেখানে থেমে গেলেও পারতো কিন্তু বাবা এর থেকেও বড় একটি অদ্ভুত কান্ড করে বসেন।আমার ভালো রেজাল্ট উপলক্ষে মিষ্টি বিতরণের পরিবর্তে পুরো মহল্লা জুড়ে দুটি করে ডিম বিলিয়ে দেওয়া শুরু করেন।
এলাকাবাসীর মুখ দেখার মতো ছিলো যখন তারা বাবাকে পিরিচে করে ডিম দিতে দেখতে লাগলেন।হতবিহ্বল হয়ে সবাই মুখ হা করে তাকিয়ে থেকে মুখের কথাই হারিয়ে ফেলেছিলেন।

সকালে নাস্তার টেবিলে ডিম সিদ্ধ দেখে অনেকদিন পর আমার সেই বিখ্যাত ডিমের ইতিহাস মনে করে আমি ফিক করে হেঁসে দিলাম।তারপর হুঁশ ফিরায় তাকিয়ে দেখি সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।সামনে মুখ বরাবর বসা অভ্রও ভ্রু ভাঁজ করে মুখের সামনে চামচ তুলে তাকিয়ে আছে।অভ্র’র মা আজ একটু সুস্থতা অনুভব করায় সবার সাথে নাস্তা করতে এসেছিলো টেবিলে।উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি আমার কান্ডে খুবই বিরক্ত।আমি তাড়াতাড়ি মুখ হাত দিয়ে ঢেকে জিহ্বায় মৃদু কামড় দিয়ে ঝটপট মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম।

অভ্র’র বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন,
‘অরু মা তোমার ভর্তি বিষয়ে কিছু ঠিক করলে?কোন ভার্সিটিতে ভর্তি হবে?কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়বে?’

‘এখনও কিছু ঠিক করিনি।আজ কয়েকটা ভার্সিটিতে এপ্লাই করবো তারপর সাবজেক্ট অনুযায়ী যেটা ঠিক মনে হবে সেখানেই ভর্তি হবো।’

‘বেশ,তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই করবে।এবছর তো দেশের পরিস্থিতি ভালো না থাকার কারণে ভর্তির কার্যক্রমটা এতদূর পিছিয়ে গেলো।এই হরতাল,ধর্মঘট,ভাঙচুর কত ঝামেলা!অভ্র,তুমি অরুর সাথে যাও।অরুর ভর্তি বিষয়ে সব কাজ তুমি দেখবে।ও একা একা সামলাতে পারবে না।’

অভ্র বলল,
‘বাবা প্লিজ!আমাকে এসব ঝামেলায় জড়িয়ো না।আমার আরো অনেক কাজ আছে।অন্য কারোর পেছনে খরচ করার মতো ফালতু সময় আমার নেই।’

অভ্র’র বাবা রাগ হয়ে বললেন,
‘অরু অন্য কেউ নয় অভ্র,অরু তোমার স্ত্রী।যেটাকে তুমি ঝামেলা আর ফালতু সময় বলছো সেটা তোমার দায়িত্ব।ভুলে যেও না তুমি নিজে অরুকে বিয়ে করতে চেয়েছো।তোমাকে কেউ জোর করেনি।’

‘আই ডোন্ট কেয়ার।’

‘ইউ হেভ টু কেয়ার,অভ্র!মনে রেখো তুমি যা করছো তাতে তোমার আর ইরার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না।’

বাবার কথায় অভ্র রাগ করে খাওয়া ছেড়ে উঠে চলে গেলো।অভ্র’র মা বিরক্তি নিয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘দিলে তো ছেলেটার খাওয়া বন্ধ করে।এমনিতেই ও’র মনে কতো বড় আঘাত লেগেছে।এখন কি এসব কথা না বললেই নয়!’

‘সালেহা,তোমার সামনে বসা মেয়েটাও কিন্তু কারো সন্তান।তারও মন আছে,কথাটা মাথায় রেখো।’

অভ্র’র বাবা উঠে চলে গেলেন।কিছুক্ষণ পর মা’ও উঠে পড়লেন।শুধু আমি সেখানে নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলাম।আর তারপর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া এক ফোঁটা বিসর্জিত অশ্রু উষ্ণ কফির মগে নিজের অস্তিত্ব লুকিয়ে ফেললো।

সেদিন আমার আর ভর্তির এপ্লাই করতে যাওয়া হলো না।বাসার পরিবেশটাই এমন হয়ে গেলো।অভ্র রাগ করে বাইরে চলে গেলো।তার মা’র আবার মাইগ্রেইনের ব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়ায় তিনি দরজা জানালা বন্ধ করে শুয়ে রইলেন।অভ্র’র বাবা একটি মিটিংয়ের কাজে গাজীপুরে গিয়েছে।
আমি এই বাড়ির বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।বিশাল বড় বাগান।দেশি বিদেশী সব ধরণের ফুলই মোটামুটি লাগানো।অভ্র’র দাদা নিজ হাতে এই বাগান তৈরি করে গেছেন।উনার গাছপালার ভীষণ শখ ছিলো।শেষ বয়সটা গাছের পরিচর্যা করেই কাটিয়েছেন।তারই ফল আজকের এই বিশাল বাগান।সবই চম্পার কাছ থেকে শোনা।
বাগানের মধ্যে ছোট্ট এক অংশ জুড়ে শুধু গোলাপ ফুলের গাছ।তবে এখন বেশিরভাগ চারাই কেমন শুকিয়ে গেছে।গোড়ার কাছটা আগাছায় ভর্তি।আমি ঝুঁকে হাত দিয়ে দেখতে লাগলাম।পাতাগুলো লাল হয়ে গেছে।
‘আফামনি,আপনে হেনে কি করেন?’
আমি পেছনে ঘুরে মিষ্টি হেসে জবাব দিলাম,
‘কিছু না চম্পা।এমনিই ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম।’
‘এই রোদের মইধ্যে আপনে হেনে থাইকেন না আফা।আপনার এতো সুন্দর গায়ের রং নষ্ট হইয়া যাবো।’
আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
‘তুমি আমার গায়ের রং এতো সুন্দর কোথায় দেখলে!আমার গায়ের রং তো সাধারণ বাঙালী মেয়েদের মতোই।গায়ের রং তো আছে তোমাদের অভ্র ভাইয়ার।’
‘হায় হায়!কি কন আফা!আফনে সাধারণ!আফনে জানেন আপনারে এতেই কতো সুন্দর লাগে।আমাগো অভ্র ভাইজান তো এক্কারে পুরা রাজপুত্র!রাজপুত্র।আর আপনে হলো হের রাজকুমারী।দুইজনরে যে কি ভালা মানাইছে।আপনেরা দুইজন পুরা পারফয়েট’

চম্পার কথা বলার ভঙ্গিতে আমি খিলখিল করে হেঁসে দিলাম।
চম্পা খানিকসময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘আফামনি আপনে জানেন,আপনে যহন হাসেন তহন কি যে ভালা লাগে।মন চায় খালি চাইয়াই থাহি।’
‘হয়েছে চম্পা তোমার আর আমার দিকে এতো তাকিয়ে থাকতে হবে না।আমার দিকেই যদি সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকো তাহলে মফিজ ভাইকে দেখবে কখন।’

চম্পা মুখে ওড়না চাপা দিয়ে হেঁসে বলল,
‘যান আফামনি!আপনে এডি কন?’
‘হয়েছে চম্পা এখন আর তোমাকে এতো লজ্জা পেতে হবে না।রান্নার মাঝে মাঝে ইমারজেন্সি ফোনগুলো কার কাছে যায়,সকালে ময়লার ঝুড়ি ফেলতে যাওয়ার সময় পনের মিনিট দেরী কেনো হয় তা সবই আমি জেনে গেছি।’

চম্পা লজ্জায় আট খানা হয়ে বলল,
‘আফামনি আপনে বুঝলেন কেমনে?’
‘আমি বুঝি চম্পা।সব বুঝি,তোমার লাজুক প্রেমের গল্প।’
তারপর আঙ্গুল গোল করে আমি চম্পার স্টাইলেই বললাম,
‘তোমরাও দুজনেই পুরো পারফয়েট!’

চম্পা আর আমি দুজনেই একসাথে হেঁসে দিলাম।
‘আচ্ছা চম্পা,এই গোলাপের গাছগুলো এমন শুকিয়ে গেছে কেনো?অন্য গাছগুলো তো ঠিকই আছে।এই গাছগুলোর কি কোনো যত্ন নেওয়া হয় না?’

‘আর কইয়েন না আফা!এই গাছগুলা সব অভ্র ভাইজান শখ কইরা লাগাইছিলো।কত যত্ন যে করতো!এই এত্ত বড় বড় লাল টুকটুকা সুন্দর ফুল হইতো।অহন তো আর হে বাগানে আহেই না।আর ঐ কামচোরা মালী বেডাও এই জায়গাডা একটু ভিতরে বইলা ঠিকমতো যত্ন নেয় না।কোনোদিন পানি দেয় আবার দেয় না।’

‘চম্পা একটা কাজ করো তো একটা কাস্তে,কীটনাশক স্প্রে আর একটু পানি নিয়ে এসো।’

‘আফামনি আপনে কি এহন এইসব করবেন?আপনে ভিতরে যান,আমি করতাছি।’
‘আমি যা বলছি তা করো চম্পা।যাও তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।’

আমার কথা মতো চম্পা সবকিছু নিয়ে এলে আমি মাথার চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিজ হাতে গাছের গোড়ার আগাছা গুলো পরিষ্কার করে দিতে লাগলাম।হঠাৎ চম্পা ডেকে উঠলো,
‘আফামনি।’
‘হুম’
‘ভাইজান যদি রাগ হয়।’
‘রাগ হলে হবে।আমরা গাছগুলোতে প্রাণ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।আমার মনে হয় না এতে কেউ রাগ হতে পারে।’
কিছুক্ষণ নিরবতা শেষে আমি চম্পাকে ডেকে উঠলাম,
‘চম্পা।’
‘হুম কন আফামনি।’
‘তোমরা সবাই কি তোমাদের অভ্র ভাইজানকে খুব ভয় পাও?’
‘এহন পাই।আগে পাইতাম না।আগে অভ্র ভাইজান খুব ভালা আছিলো।সবসময় হাসি খুশি থাকতে,আমাগো লাগে কথা কইতো,মজা করতো।আফা আপনে ভাইজানরে এহন যেমন দেখতাছেন ভাইজান মোটেও হেমন না।ভাইজান অনেক ভালা মানুষ।দেইখেন একদিন ভাইজান আবার আগের মতন হইয়া যাইবো।’

আমি চম্পার কথার কোনো জবাব না দিয়ে মাটিগুলো আলগা করায় মনোযোগ দিলাম।তারপর পানি দিয়ে গাছের পাতায় কীটনাশক স্প্রে করে দিলাম।সব কাজ শেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাত থেকে মাটি ঝাড়া দিয়ে বললাম,
‘যাক!সব শেষ।’

‘আফামনি আপনে হয়রান হইয়া গেছেন।চলেন এহন ভিতরে যাই।’
‘ধূর!এতটুকুতে কি কেউ আবার হয়রান হয় নাকি!
আমার তো বেশ ভালো লাগছে এখানে।’

আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি দেখলাম এখান থেকে অভ্র’র রুমের বারান্দাটা সোজা দেখা যায়।চারপাশে চোখ বুলিয়ে হঠাৎ বাগানের কোনায় একটি বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখে চমকে উঠলাম।গাছ ভর্তি হয়ে আছে লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে।ফুল বোঝাই বড় বড় প্রকান্ড ডালপালাগুলো ছড়িয়ে আছে।সেগুলো দেখে আমার একটু লোভ পেয়ে গেলো।
আমি চম্পাকে বললাম,
‘চম্পা,আমাকে একটা বড় মোটা দড়ি আর কাঠের কোনো শক্ত তক্তা জোগাড় করে এনে দিতে পারবে?’
‘কেন পারুম না।আফামনি আপনে হেনে দাঁড়ান।আমি এক্ষুনি আসতাছি।’

এই বলে চম্পা দুলতে দুলতে চলে গেলো।আমি ছুটে গাছতলায় চলে গেলাম।গাছতলাটা কি সুন্দর ছায়ায় ভরা।নিচে ঘাসের উপর শিউলি ফুল পড়ে ভরে আছে।কিছুক্ষণ পর চম্পা ফিরে এলো দড়ি নিয়ে।সাথে এ বাড়ির ড্রাইভার মফিজ ভাইকেও নিয়ে এসেছে।

‘মফিজ ভাই আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে।এই দড়িটি ঐ মোটা ডালটির সাথে বেঁধে আমাকে একটা দোলনা বানিয়ে দিন না!’

‘ভাবীসাব আমি এক্ষুনি করতাছি।’

চম্পা পাশ থেকে মফিজ ভাইকে একটা চিমটি মেরে বলল,
‘এই তুমি ভাবীসাব কও কে?দেহো না আমি আফামনি কইয়া ডাকি!তুমিও তাই কইবা।’

আমি হেঁসে বললাম,
‘সমস্যা নেই।যার যেটা বলে ইচ্ছা সেটা বলেই ডেকো,কেমন?’
ওরা দুজন একসাথে মাথা দুলিয়ে চরম উৎসাহে গাছের ডালে দোলনা বাঁধার কাজে লেগে পড়ল।এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝটপট একটি খুব সুন্দর দোলনা বানিয়ে ফেললো।
আমি খুব খুশি হয়ে দোলনায় বসতে গেলাম।চম্পা বলে উঠলো,
‘আফামনি বাগানের মইধ্যে তো একটা বড় দোলনা আছেই আপনে তো হেইডাতেই আরাম কইরা বসতে পারতেন!’
‘যেই মজা গাছের ডালের সাথে বাঁধা দোলনায় পাওয়া যায় সেই মজা কি আর ওসব একটুখানি লোহার শিকলে ঝোলানো দোলনায় পাওয়া যায়!’

‘এইডা এক্কারে ঠিক কথা কইছেন আফামনি।আমরা আগে কতো গেরামে থাকতে এমন দোলনা বানায় চড়তাম।অনেক মজা লাগতো।আসেন আফামনি,আমি আপনারে পিছন থিকা ধাক্কা দিয়ে দিতাছি।’

চম্পা আমাকে পেছন থেকে জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো।দোলনাটি গাছের অনেক উঁচু একটি ডালের সাথে বাঁধায় অনেক লম্বা হয়েছে।যার ফলে অনেক সামনে পর্যন্ত অগ্রসর হচ্ছে। গাছের ছায়ায় এমন দোলন খেতে কি যে মজা লাগছে!চম্পার প্রথম ধাক্কার পরে দ্বিতীয় ধাক্কা খেতেই আমার মাথার হাত খোঁপাটা খুলে পিঠ ভর্তি চুলে ভরে গেলো।গোলাপি পাতলা ওড়নার সাথে তাল মিলিয়ে বাতাসে তা উদ্দাম হয়ে উড়তে লাগলো।আনন্দে আমি অনেকদিন পর খিলখিল করে হাসতে লাগলাম।কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখি অভ্র গেটের ভেতরের রাস্তামুখে বাগানের দিক থেকে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি হাসি থামিয়ে দোলনা থামাতে চাইলাম কিন্তু তা থামলো না।আমাকে নিয়ে দুলতেই থাকলো।আমার চোখে চোখ পড়ায় অভ্র সেখান থেকে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর আমিও রুমে চলে আসলাম।অভ্র বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে ফোন টিপছিলো।আমি কি করবো বুঝতে না পেরে রুমে থাকা বুকশেলফটা ঘাটাঘাটি করছিলাম আর আড়চোখে তার মেজাজ অনুধাবনের চেষ্টা করছিলাম।বেখেয়ালি হয়ে থাকার কারনেই হয়তো বুকশেলফের কোনায় থাকা কিছু একটায় আমার হাত লেগে নিচে পড়ে গেলো।আওয়াজে চমকে উঠে নিচে তাকিয়ে দেখি একটা কালো চেনের ঘড়ি।আমি তাড়াতাড়ি নিচ থেকে হাতে তুলে দেখি উপরের কাঁচটা ভেঙে গেছে।অভ্রও আমার হাতে থাকা ঘড়িটার দিকেই তাকিয়ে আছে।একসময় ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।ভয়ে আমার রীতিমতো ঘাম ছুটে গেলো।সে বলেছিলো তার কোনো জিনিসে হাত না দিতে আর এখন তো আমি ডিরেক্ট ভেঙে ফেলেছি।না জানি এখন কি করে!

‘স…স্যরি!আমি আসলে খেয়াল করিনি।কিভাবে হাত লেগে পড়ে গেলো…ইচ্ছে করে করিনি।সত্যি!’

উনি আমার হাত থেকে ঘড়িটা নিয়ে তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
‘যা করেছো ভালোই করেছো।ইরার কোনো চিহ্নই আর আমি আমার জীবনে রাখতে চাই না।সব ফেলে দিয়েছি,হয়তো এটা এই কোনায় পরে বাদ থেকে গিয়েছিলো।’

অভ্র’র ঠোঁটের কোনায় একটা মৃদু ভাবলেশহীন হাসি ফুটে উঠেই পরক্ষণে মিলিয়ে গেল।হাতের ঘড়িটা তিনি রুমের কোনায় রাখা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন।

১১.
একটি মোটা ফাইল হাতে নিয়ে সরু রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।রোদে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না।হাতের ফাইলটা একবার মাথার উপর চোখকে আড়াল করে রোদের থেকে আবার ডান হাত থেকে বাম হাতে নিলাম।সামনে খানিক দূরত্বে বিশাল লাইন।বুঝতে পারছি না লাইনের মধ্যে কি ঢুকে যাবো?এই বিশাল লাইন শেষ হতেও ঠিক কতো ঘন্টা লাগবে?ভার্সিটির সামান্য ফরম তুলতেও আমার জান দফা রফা হয়ে যাচ্ছে।সত্যি বলতে এসব ভর্তির কাজটাজ আমি একদমই বুঝি না।প্রতিবার তো আপুই সব করে।এসব ব্যাপারে আবার ইরা আপু পুরো পারদর্শী।তার উপর ইরা আপু এই ভার্সিটিতেই পড়তো।

একা একা ভীষণ নার্ভাস লাগছে।কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।বাবাকে কি একটা ফোন করবো?এখানে আসতে বলবো?
নানা ভাবনা চিন্তার পরে বাবাকে ফোন করার জন্য ব্যাগটা খুলে ফোনটা হাতে নিতেই বাইক চালিয়ে সেখানে অভ্র উপস্থিত।তাকে দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম।আমার অবাক দৃষ্টিকে কোনো পাত্তা না দিয়ে তিনি আমার হাত থেকে ফাইল নিয়ে ভীড় ঠেলে একটা রুমে ঢুকে পড়লেন।এবং খুব সহজেই ফরম তুলে এনে আমাকে দিয়ে ফিল আপ করিয়ে আবার জমাও দিয়ে এলেন।আমার বেশ ভালো লাগলো।তিনি না এলে কি হতো!আমি তো হয়তো একা একা ঠিকমতো কিছু করতেও পারতাম না।

কাজ শেষে তিনি বাইরে হল থেকে বেড়িয়ে এলেন।আমি পেছন থেকে তার পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,
‘আপনি এখন কোথায় যাবেন?’
‘বাসায়।’
রাস্তার পাশে দাঁড় করানো বাইকে অভ্র উঠে বসলো।আমিও পেছনে বসতে গেলাম কিন্তু তার আগেই তিনি রাস্তার পাশে দাঁড়ানো একটি রিকশা হাত ইশারা করে ডাকলেন।রিকশাওয়ালা রিকশা নিয়ে এগিয়ে আসতেই তিনি আমার কথা বলে পৌঁছে দিতে বললেন।ঠিক সেই সময় গেটে থাকা দাড়োয়ানটি এগিয়ে এসে বললো,
‘আরে অভ্র ভাই না!ভালো আছেন?’
অভ্র মিষ্টি হেঁসে জবাব দিলো,
‘হ্যাঁ ভালো।তুমি ভালো আছো কাদের ভাই?’
‘জ্বি ভাই ভালো আছি।কতদিন পর আপনের সাথে দেখা হইলো আপনে তো আর এদিকে আসেনই না।আজকা আসলেন কি কোনো কাজে?’
‘হুম।বাবা বললো ও’র ভর্তির কাজে একটু সাহায্য করে দিতে।নতুন তো তাই।’
‘আপনের কি হয় ভাই?’
এই কথার উত্তরে অভ্র সামনে তাকিয়ে শক্ত করে বলল,
‘কেউ না।’

অভ্র বাইক চালিয়ে চলে যাওয়ার পর দাড়োয়ানও নিজের জায়গায় চলে গেলেন।রিকশাওয়ালা পাশ থেকে বলে উঠলো,
‘আফা যাইবেন না?’

আমি তার যাওয়ার পথের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে একটি ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।সত্যিই তো আমি তার কে?কেউ না।আমি তার কেউ না।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে