অতঃপর_তুমি পর্ব-০৪

0
6015

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-৪
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

৮.
রুমে প্রবেশ করা মাত্রই নিজের সব শাড়ি,জামা কাপড় ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে দেখে আমার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেলো।কতো কষ্ট করে সবকিছু সুন্দর করে গোছগাছ করে রেখেছিলাম আর তার এখন এই অবস্থা!অবস্থাকে আরো বেগতিক করে তুলতে অভ্র তো আছেই।তিনি তার ননস্টপ কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

‘এসব কি করছেন?আমার জামাকাপড় সব নিচে ফেলে দিচ্ছেন কেনো?’

আলমারির কোনায় থাকা শেষ বস্ত্রটাও মেঝেতে নিক্ষেপ করে তিনি একটি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘বলেছিলাম না আমার কোনো জিনিসে হাত দিবে না।আর তুমি তো ডিরেক্ট আমার জিনিসে কব্জা করে বসেছো।’

আমি কাতর স্বরে বললাম,
‘দেখুন,দু মাস ধরে জামাকাপড়গুলো লাগেজেই রেখে দিয়েছি।এভাবে কি প্রতিদিন লাগেজ থেকে বের করে করে ব্যবহার করা যায়?’

‘তা আমি বুঝি না।আমার আলমারিতে রাখতে পারবে না ব্যাস!’

‘তাহলে কোথায় রাখবো?’

‘যেখানে ইচ্ছা।শুধু আমার জিনিসপত্র থেকে দূরে।’

কথাটা বলে তিনি চলে যেতে নিলে আমি পেছন থেকে হতাশ গলায় বললাম,
‘আর এভাবে কতদিন চলবে?’

একটু থেমে আমার দিকে না তাকিয়েই উনি বললেন,
‘জানি না।’

বারান্দার রেলিংয়ে বসা একটি কাক কা কা করে অনবরত ডেকে যাচ্ছে।থামার কোনো নামই নিচ্ছে না।নিচে চম্পাকে বলেছিলাম আজকে আমাকে পাটশাকের ডাল রান্না করা শিখাতে।কুকারে সিটি বাজা শুরু হয়ে গেছে।চম্পা আমাকে এই ডাকতে এলো বলে।পুরো মেঝেতে অগোছালো জামাকাপড় গুলো বিছিয়ে আছে।এগুলোকে আবার পুনরায় ভাঁজ করে লাগেজে বন্দী করা প্রয়োজন।কিন্তু আমার এখন এসবে হাত দিতে মোটেও ইচ্ছে করছে না।চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।মাথাটা হঠাৎ ভীষণ ধরেছে।ভীষণ।

৯.
হুমায়ুন আহমেদ স্যার তার কোনো একটি বইয়ে বলেছিলেন ঢাকা শহরের মানুষদের জ্যেৎস্না দেখানোর জন্য কোনো এক পূর্ণিমার রাতে পুরো শহরে লোডশেডিং করা উচিত।আজ সত্যিই মনে হচ্ছে এমনটি হলে বেশ হতো।শুধু বেশ না,খুব খুব ভালো হতো।হঠাৎ করে পুরো শহরে এসে পড়তো ঘুটঘুটে অন্ধকার।একটু আবছা আলোর অনুসরণে নগরের প্রত্যেকটি মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে বিরক্তমুখে আকাশের দিকে তাকাতো আর মূহুর্তের মধ্যেই বাকশূন্য হয়ে তাদের দৃষ্টি মাথার উপরের খোলা আকাশে বিদ্যমান শুভ্র আলোয় ঢাকা বিশাল চাঁদ টির দিকে আটকে যেতো।সবাই মন ভরে বিরক্তকে পাশে সরিয়ে চন্দ্র বিলাস করতো।ঢাকা শহরে বেড়ে উঠলেও গ্রামের পূর্ণিমার রাতের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে।ছোটো থাকতে অহরহ যাওয়া হতো আমাদের গ্রামের বাড়ি।

অভ্র রুমে নেই।আমি একা একা বারান্দায় টুল টেনে রেলিংয়ে দু হাতের উপর মুখ রেখে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঐ চাঁদ টাকে দেখছিলাম।বারান্দার লাইট বন্ধ সত্ত্বেও বাগানের মাঝখানে থাকা সোডিয়াম লাইটের আলোর ধাক্কায় চাঁদের আলো তত ভিড়ছে না।তবুও চাঁদ তো চাঁদ-ই।অসুন্দর শব্দটি এর সাথে কখনো লাগতে পারে না।অন্ধকারের মাঝে প্রজ্জ্বমান দীপ্ত।

এই ‘অন্ধকার’ নিয়ে আমার দাদীর একটি বিখ্যাত গল্প আছে।আমার এই দাদী আমার সাথে অনেক গল্প করতেন।সেই গল্পগুলোর মধ্যে কিছু কিছু গল্প আবার খুব সাংঘাতিক হতো।মাঝে মাঝেই তিনি আমার সাথে ঘুমাতে আসতেন।ইরা আপু তখন উঠে গিয়ে অন্য রুমে ঘুমাতো।আর সেদিন রাতে দাদীর গল্পের জ্বালায় আমার ঘুম খুব কমই হতো।দাদীর সাংঘাতিক গল্পগুলোর মধ্যে বিখ্যাত গল্পটি হলো তার নিজের বাসর ঘরের গল্প।এই গল্পটি আমি বহুবার শুনেছি।তবুও দাদী জোর করে বারবার শোনাতে থাকতো।দাদীর গল্পটি ছিল এরকম….

‘আমি তহন মাত্র পইনরো বছরের খুকি বুঝছোস।আর তোর দাদায় ছিলো পুরা জোয়ান তাগড়া ব্যাডা।আমারে তোর দাদার দাদায় পছন্দ কইরা আনছিলো।তোর দাদায় বিয়ার আগে আমারে দেহেও নাইকা।আমার বিয়ের দিন আমার সব চাচতো খালতো বইনরাও লগে গেছিলো তোগো দাদার বাড়ি।হেদিন আছিলো পুরা ঘুইটঘুইট্যা আমাবইশ্যার আন্ধার।তোর দাদায় রুমে আইয়া বিছনায় বইবা মাত্রই বেড়ার ফাঁক দিয়া বাতাস আইয়া দিলো কুপি নিভাইয়া।আমার মাথায় তহন এক হাত ঘোমটা দেওয়া।তোর দাদায় গলা খাকারি দিয়া একটা কাশ দিয়া হেরপর আমার নাম ধইড়া ডাইকা কইলো,
‘হাছু(হাসনা থেকে হাছু),তুমি কিছু খাইছো তো?’

আন্ধারে এমনি ডরাইতাছিলাম তবুও তোর দাদার কতা হুইনা আমার তহন পেট ফাইটা হাসি আইতাছিলো।বাসর ঘরে কিনা খাওনের কতা জিগায়।হেদিকে না যাইয়া আমি কইলাম,
‘বাত্তিডা নিভা গেলো।এট্টু জ্বালায় দিয়া আইবেন।’

তোর দাদায় তহন একটু হাইসা কি কইলো জানোস,
‘ক্যান?আন্ধারে কি তোমার ডর লাগে?…..

গল্পে এর পরের অংশ আর আমি শুনতে পারতাম না।লজ্জায় পুরো জমে থাকতাম।কিন্তু দাদী স্বাভাবিক ভাবেই অনায়াসে তার বাসর ঘরের কাহিনী আমাকে শোনাতে থাকতো।

‘আরে ছেমড়ি শোন শোন,মজার ঘটনা তো ঘটছে বিয়ানে।তোর দাদায় হক্কাল হক্কালই বাইর হইয়া বাজারে গেছিল।আমার হাওড়ি আছিলো পুরাই আস্ত বেজাত।বিয়ার পরদিনই একটা পুরান কাপড় পিনবার দিলো।হেই কাপড় পইড়া আমি বারান্দায় শুকনা কাপড় ভাঁজ করবার লাগছিলাম।হেই সময় তোর দাদায় আইয়া আমার দিকে একটা আলতার শিশি বাড়াইয়া কয়,

‘তোমগো হাছু বইনরে এইডা এট্টু দিয়া দিয়ো।’
আমি তো তোর দাদার গলা হুইনাই চিন্না গেছিলাম।মুখে আঁচল চাপা দিয়া আমি তহন হাসতে হাসতে শেষ।বুঝছোস ছেমড়ি?তোর দাদায় মনে করছিলো আমি মনে হয় হের হালী লাগি।হি হি হি।রাইতে এতো আদর সোহাগ যারে করলো হের চেহরাও নাকি তহনো দেহে নাই।হি হি হি।’

দাদীর এই গল্প শোনায় যদি ভুলেও কখনো আপত্তি প্রকাশ করে ফেলতাম তাহলে তো আর কথাই নেই।দাদী বলতো,
‘সর ছেমড়ি!এতোডুতেই এমন লজ্জা পাও,জামাই যহন বাসর ঘরে কাপড় খুইলা গায়ে হাত দিবো তহন কি করবা?’

দাদীর এই ভয়ংকর কথায় আমি চোখ বড় বড় করে ছিটকে উঠে বসে পড়তাম।কিন্তু দাদী আফসোসের ভঙ্গিতে বলতো,
‘বুঝছি তোরে দিয়া কিছু হইতো না।তোর বাসর ঘরে দেহি আমারই থাওন লাগবো তোরে হিগানির লেইগা।হি হি হি।’

এখন মনে হচ্ছে ভাগ্যিস দাদী এখন নেই।নাহলে এই মহিলা এমন অদ্ভুত ছিল, সত্যি সত্যিই আমার বাসর ঘরে এসে পড়তো।আর তার এই নাতনির বাসর ঘরে যা হয়েছে তার থেকে উনার কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই হতো না।
আমার দাদী বাস্তবেই ছিলেন খুব অদ্ভুত মানুষ।তার মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন পুরো স্বাভাবিক।আমি তখন সবে ক্লাস নাইনে উঠেছি।একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি সবাই দাদীর ঘরের সামনে ভীড় করে রেখেছে।আর দাদী স্বাভাবিকভাবেই বিছানায় শুয়ে রয়েছেন।বাবা হঠাৎ একটু কেঁদে উঠলো আর তাতেই দাদী ধমকে উঠে বলল,
‘এই কদু(বাবার নাম হলো কাদের।দাদী ডাকতো কদু),তোর বাপে আমারে নিতে আইছে আর এহন তুই একদম মাইয়া মাইনসের মতো ফ্যাচ ফ্যাচ কইরা কানবি না কইলাম।নাইলে কিন্তু পিছা ডা দিয়া একদম মুখ পাসায় বাড়ি দিম।দেহি এট্টু কালমা পড়।’

দাদী যতই অদ্ভুত মানুষ থাকুক না কেনো।আমার দাদী ছিলেন সাক্ষাৎ একজন ভালো মানুষ।আমি আমার জীবনে যতগুলো ভালো মানুষ দেখেছি দাদী হলেন তাদের মধ্যে একজন।ক্লাস সেভেনে পড়া কালীন একবার স্কুল থেকে ফিরে এসে আমি বেলকনিতে মন খারাপ করে বসে ছিলাম।দাদী হঠাৎ পেছন থেকে এসে আমার মাথার বেণি ধরে টান দিয়ে বলল,
‘ঐ ছেমড়ি এমন মুখ ভাড় কইরা বইয়া আছস ক্যান।জামাই ঘর তোন বাইর কইরা দিছে?’

কথাটা বলে দাদী হাসতে লাগলো।আমি বললাম,
‘জানো দাদী,আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে আছে নাম স্নিগ্ধা।ও’র বাবা কাল এক্সিডেন্ট করেছে।ডাক্তার বলেছে অনেক টাকা লাগবে নাহলে নাকি বাঁচানো যাবে না।ওরা অনেক গরীব জানো,এখন ও’র বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ও বাবা বলে কাকে ডাকবে?’

‘তয় স্কুল তন সবার থিকা টাকা উডায় তারে না?’

‘উঠিয়েছে তো।কিন্তু সবাই দেয় দুই টাকা,পাঁচ টাকা।এতটুকুতে কি কিছু হয় বলো?আমার খুব মন খারাপ লাগছে জানো!’

আমার কথার দাদী কোনো জবাব না দিয়ে হঠাৎ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে তার একটা সোনার আংটি নিয়ে এসে আমার হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ঐ ছেমড়িরে কইস এইডা তার মার তন দিতে।হেই আগেরকালের সোনা।কোনো খাদ নাইকা।ভালো টাকা পাইবো।’

আমার চোখে পানি এসে পড়লো দাদীর এই কান্ডে।দাদী আমার গালে একটা জোড়ে ঠুকনা মেরে বলল,
‘এতোডুতেই কান্দন আইয়া পড়ে!মাইয়া তুই বিয়ার দিন কি করবি?’

হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আমার পেছনে কিছু একটা আছে।মুহুর্তের মধ্যেই ভয়ে আমার গা বেঁয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বেঁয়ে গেলো।ভূত নাতো!উফ!কে বলেছিলো একা একা এতো রাতে অন্ধকারে এখানে বসে থাকতে।ঘাড় ঘুরিয়ে যে দেখবো তাও ভয় করছে।যদি সত্যি সত্যিই ভূত হয় আর আমার ঘাড় মটকে ফেলে।মনে মনে দোয়া দরূদ পড়ে ধীরে ধীরে ঢোক গিলে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।
আবছা আলোয় পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ উঠিয়ে একটি লম্বুশ মূর্তির ন্যায় কিছুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা চমকে উঠে মুখ দিয়ে ‘উহ!’ শব্দ করে উঠলাম।তাড়াতাড়ি বুকে থুতু দিয়ে নিলাম।
‘কি হয়েছে এমন চমকে উঠলে কেনো?’
‘না মানে আমি ভেবেছিলাম ভূ…..’
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,’কি?’
‘না কিছু না।’
বসা থেকে উঠে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।আর তিনি ফোন উঁচু করে করে নেটওয়ার্কের খোঁজ করতে লাগলেন।হঠাৎ লাইন পেয়ে ফোন কানে ধরে বলতে লাগলেন,
‘হ্যালো…হ্যালো মিস্টার স্মিথ, ক্যান ইউ হেয়ার মি নাউ?’
ফোনের ওপাশ থেকে,’হ্যালো মিস্টার অউভরো,হোয়াট আর ইউ সেয়িং?’
‘আই ওয়ান্ট টু টেল ইউ দ্যা প্রজেক্ট অফ আওয়ার কোম্পানি….
‘হ্যালো হ্যালো….’
‘হ্যালো মিস্টার স্মিথ?’
‘হোয়াট!’
‘তোর মাথা গাধা।’

আমি ঠোঁট চেঁপে ফিক করে হেসে দিয়ে আবার মুখ ঠিক করে ফেললাম।অভ্র ফোন কানে নিয়েই আমার দিকে একবার তাকিয়ে রুমের ভেতর চলে গেলো।আমি কিছু মুহুর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে দৌঁড়ে রুমে ঢুকতে গেলাম আর ঠিক তখনই দরজার মুখে এসে অভ্র’র মাথার সাথে জোড়ে বারি খেয়ে নিচে পড়ে গেলাম।অভ্র মাথা নিচু করে আসছিলো যার ফল এই যে হলো।
অভ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা ঘষতে ঘষতে বলল,
‘আর ইউ ব্লাইন্ড?’
মাথায় আমিও ব্যাথা পেয়েছি।সেখানে হাত দিয়ে ধরে বললাম,
‘আপনিও তো দেখেননি!’
‘বলেছিলাম না বারান্দার বাতিটা জ্বালিয়ে দিতে।তা না অন্ধকার বানিয়ে রেখেছো।’
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে বিরবির করে বললাম,
‘কখন বললো?স্বপ্নে স্বপ্নে?মাথা মনে হয় পুরোটাই গেছে।’
তিনি নিচের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।আমিও উঠার জন্য ডান হাত বাড়িয়ে ধরতে গেলাম।কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে সেই হাত আমার দিকে না এসে পাশে পড়ে যাওয়া তার ফোন উঠিয়ে চলে যেতে লাগলো।আমি দাঁত কিরমির করে কিছু গালি আউড়ে জিহ্বা বের করে তাকে পেছন থেকে ভেংচি দিলাম।আসলেই একটা আস্ত ভূত।আমার গোমড়ামুখো স্বামী ভূত।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে