#অতঃপর_সন্ধি (০৩)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘না বললে থাকবে আফসোস। আর বললে থাকবে যন্ত্রণা। আমার উভয়সংকট দুস্ত।’
‘মেয়েদের অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। এই ক্ষমতা অদৃশ্যমান। এরা পানির মতো। যেই পাত্রে রাখা হয় সেই আকার ধারণ করে। এরা হাজারো কষ্ট সয়ে স্বামীর ঘর করে। ভিন্ন পরিবেশে গেলে মানিয়ে নেওয়া হয়তো কষ্ট। তবে তারা মানিয়ে নেয়। মিশে যায় ভিন্ন পরিবেশের প্রতিটা মানুষের সাথে। তবে তার জন্য প্রয়োজন স্বামী নামক মানুষটার একটু সাপোর্ট। ওই মানুষটা থাকলে সবকিছু মানিয়ে নেওয়া সহজ হয়ে যায়। ভেবে দেখ কি করবি।’
__________________
জমকালো আয়োজন! আশেপাশে অনেক পরিচিত অপরিচিত মানুষ ঘুরাঘুরি করছে। কারো চোখে চোখ পড়লেই রেডিমেড হেসে অন্য দিকে চলে যাচ্ছে পুষ্পিতা। প্রানপ্রিয় বান্ধবী সুমনা এহমাদের সাথে খোশগল্পে মগ্ন আফসানা হক।
‘মা? জারিন মনে হয় আসবে না। আমার একা একা একদম ভালো লাগছে না। আমি বাসায়,,,,,,,
আফসানা হক চোখ রাঙানি দিতে দেরি আর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে রোবটের মতো হয়ে যেতে দেরি হলো না।
‘জারিন আসেনি তো কি হয়েছে? তানজিফ তো আছে? যা ওর সাথে গিয়ে আড্ডা দে।’
‘আমার শত বিরক্তির কারণ তো ওই বেয়াদবটাই। তোমার বান্ধবীর গুণধর ছেলে আমাকে জ্বালিয়ে শেষ করলো।’৷ বিড়বিড় করে আওড়াল পুষ্পিতা।
‘কিছু বললি?’
‘আমার শাড়ি পড়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।’
‘তাহলে আমার মাথা না খেয়ে কোথাও চুপচাপ বসে থাক। বহুদিন পরে সবাই একটু একসাথে হয়েছি। আর জ্বালাতে আসবি বাসায় তোর উপর ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে।’
মুখ কালো করে সেখান চলে গেলো পুষ্পিতা। একটু নিরিবিলি পরিবেশ খুঁজতে লাগল। যদিও পাওয়া দুষ্কর। সব জায়গায় মানুষ গিজগিজ করছে।
‘মিসেস তানজিফ নওশাদ?’
পা চলা বন্ধ হয়ে গেলো পুষ্পিতার। থমকালো সে। চোখ বন্ধ করে নিলো বিহ্বলতায়।
‘তুই কিন্তু বলেছিস আমাকে আর জ্বালাবি না।’
মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে তানজিফ। চোখ দু’টি হাজারো ভালোবাসার কথা বলতে চায়।তানজিফের গভীর আসক্তি ভরা দৃষ্টিতে হকচকিয়ে গেলো পুষ্পিতা। ফাঁকা ঢুক গিলে অন্য দিকে তাকাল সে।
‘আমি তো তোর নাম ধরে ডাকিনি? আর তুই তো আমার বউও না। তাহলে এমন থমকে গেলি কেন? মিসেস তানজিফ নওশাদ হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?’
‘আমি কিন্তু এখন আন্টির কাছে বিচার দিবো।’
আড়মোড়া ভাঙে তানজিফ। পুষ্পিতার কথাটাকে যেন ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলো।
‘তোকে বিরক্ত করবো না, তোর সামনে আসবো না এই কথা গুলো জাস্ট কালকের জন্য ছিলো।আলরেডি চব্বিশ ঘণ্টা পার হয়ে বত্রিশ ঘন্টা হওয়ার পথে। তাই তানজিফ আবার আগের ফর্মে।
রাগে চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে পুষ্পিতার। হাতে থাকা ছোট্ট পার্সটা চেপে ধরলো।
‘আমি তো কাউকে বিরক্ত করতে যাইনি। মহারানী নিজে তার সাম্রাজ্যে পা দিয়েছেন। রাজাকে একটু দুষ্টুমি করতেই হয়।’
কোথা থেকে দৌড়ে গিয়ে একটা গোলাপ নিয়ে আসলো। চারপাশে একটু নজর বুলালো। এইদিকে আপাতত কেউ নেই। একটু বাদে কেক কাটবে সবাই সেইদিকে। নমনীয়, আবেগী কন্ঠে বলল,
‘আমার ব্যক্তিগত ফুলটার জন্য আরেকটা ফুল।’
হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে পুষ্পিতা। দৃষ্টিতে প্রখরতা বিদ্যমান
‘উহুম, উহুম। কেউ না দেখলেও আমি দেখে ফেলেছি।’
‘তুই দেখলে সমস্যা নেই।’ চোখ টিপ দিয়ে বলল তানজিফ।
‘তুই কি ফুলটা নিবি না।’
হাত গুটিয়ে নিরুত্তর রইলো পুষ্পিতা।
‘আচ্ছা থাক হবে না। দু’টো ফুলই আমার থাক। একটা এখনের জন্য। আর জীবন্ত ফুলটা ভবিষ্যতের জন্য। বাই দ্য ওয়ে তোকে আজ পার্পেল জামদানীতে পুরো বউ বউ লাগছে। আর এই যে রাগ করে নাক ফুলিয়ে আছিস আমার বুকের এইখানটায় লাগছে।’
___________________
‘ হবু ননদের জন্মদিনের পার্টিতে এসে কেমন লাগছে মহারানী?’
কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় জারিনের দিকে পুষ্পিতা।
‘এভাবে তাকাস না প্লিজ। আমি মেয়ে হয়ে ঘায়েল হয়ে যাচ্ছি আর বেচারা তানজিফ যে নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে এটাই অনেক।’
দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ স্বরে পুষ্পিতা আওড়াল,
‘আমি এইজন্য এখানে আসতে চাইনি।বাবার সাথে বাসায় থাকতে চেয়েছি।তার উপর মা আবার এই শাড়ি পড়িয়ে নিয়ে এসেছে।’
জুসের গ্লাসে আয়েসি ভঙ্গিতে চুমুক দিলো জারিন।
‘আমার মনে হয় জানিস? তারা দুই প্রাণপ্রিয় বান্ধবী বেয়াইন হওয়ার ধান্দায় আছে।’
‘বাজে বকা বন্ধ করবি?’
‘ছেলেটা তোর পিছনে এভাবে পড়ে আছে। তুই রাজি কেন হচ্ছিস না? তোর ভাইয়ের ওই এটিটিউডওয়ালা টিচারের জন্য?’
তানজিফ কারো সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছে।সেইদিকে তাকাল পুষ্পিতা। অপলক, অনিমেষ।
‘ফারদিনের টিচার তো এসেছে কয়েকমাস। তানজিফ আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছে কলেজ লাইফে। বিশ্বাস কর আমি হাজার চেষ্টা করেও ওর প্রতি সিরিয়াস হতে পারছি না। ওর প্রতি আমার আবেগ, অনুভূতি কাজ করে না।’
মলিন, বিষন্ন স্বরে জারিন বলল,
‘ভালোবাসা কত অদ্ভুত তাই না? একজনকে আরেকজন চায়। ওই আরেকজনকে আবার অন্যজনকে চায়। তবে আমি হলফ করে বলতে পারি, তুই তানজিফকে ছ্যাচড়া বলিস আর যাই বলিস।ছেলেটা তোকে সত্যি ভালোবাসে।’
‘আপু, আপু তোমাকে ডাকছে।’
‘ কে ডাকছে তিতির?’ হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলো পুষ্পিতা।
‘ওই ওই দিকে।’ এইটুকু বলেই চলে গেল তানজিফের বোন তিতির। সাদা গাউন টা সামলাতে তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
‘তানজিফের বোনটা কিন্তু বেশ মিষ্টি।’
‘শুধু মিষ্টি না পাকনি বুড়িও বটে। হয়তো মা ডাকছে। আমি যাই ওইদিকে। তুই খেতে যা। আমি আসছি।
সবাই খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত। অনুষ্ঠান প্রায় শেষ পর্যায়ে। তিতির দেখানো জায়গাটায় এসে ঘুরঘুর করছে সে। আচমকা কারো বুকের সাথে ধাক্কা লাগতেই ভরকে গেলো পুষ্পিতা। পিছনে তানজিফকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
‘ওহ তুই ডেকেছিস?’
পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। এবার মুখে আর দুষ্টুমির ছাপ নেই। গম্ভীরতা বিদ্যমান। দৃষ্টিতে তীক্ষ্ণতা।
‘বেঁধে রাখা চুলগুলো ছেড়ে। তোর ঘাড়ের তিলটা দেখা যাচ্ছে। অনেকে কামুকী নজরে তাকাচ্ছে তোর দিকে। আমি চাই না কেউ আমার ব্যক্তিগত মানুষটার দিকে বাজে নজরে তাকাক।’
‘খুলবো না চুল। আর কে তোর ব্যক্তিগত মানুষ?’
‘তাহলে আমিই খুলে দেই চুলের কাটা? তখন ভালো লাগবে তো?’
_______________________
শুক্রবার দিন!
নামাজ শেষ করে নিজের রুম থেকে বের হতে গিয়েও হলো না পুষ্পিতা। কেননা সবার সাথে মায়ানও বসে আছে। চাপা রাগ কাজ করলো তার মাঝে। সে খাটে এসে মোবাইল নিয়ে শুয়ে পড়লো। ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগল আপনমনে।
‘পুষ্পি এখনো নামাজ শেষ হয়নি? বাবা অপেক্ষা করছি তো তোর জন্য।’
আশহাব শেখের ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে পুষ্পিতা।
‘বাবা, এখন খিদে নেই। পরে খাবো।’
ফিরতি আরো কিছু বলতে নিলে বাঁধ সাধেন আফসানা হক।
‘আর ডেকো না। অসময়ে পুড়ি খেয়েছে। এখন জোর করে খেলে বদহজম হবে।’
তপ্ত শ্বাস ফেলেন আশহাব শেখ।
‘মেয়েটা যে কি করে না।’
আফসানা হক মায়ানের প্লেটে মুরগির পিস দিয়ে বললেন,
‘খাওয়া শুরু করো বাবা।’
আফসানা হকের সাথে তাল মেলালেন আশহাব হক।
‘হ্যা, হ্যা, শুরু করো।’
‘আপনি খাবেন না আন্টি?’
‘না বাবা, পুষ্পিতার সাথে খাবো।’
পুষ্পিতা ধীরপায়ে হেঁটে দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। পর্দাটা একটু ফাঁক করে মায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে বেশ লাগছে।
____________________
‘আজকাল বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে টিভিতে দেখছো তো?’
বাধ্য ছেলের মতো নাড়ে ফারদিন।
‘সেজন্য আমাদের কি করতে হবে জানো?’
‘কি ভাইয়া?’
‘পরিবারের সবার ফোন নম্বর মুখস্থ রাখতে হবে।’
‘আমার সবার নম্বর মুখস্থ।’
‘দেখি এইখানটায় লিখো তো সবার নম্বর।’
_____
রাত আনুমানিক এগারোটা। চাইনিজ স্বামী স্ত্রীর খাবার ভিডিও দেখছে পুষ্পিতা। একটু পর পর তানজিফ মেসেজ দিচ্ছে মেসেঞ্জারে। সেসবের তোয়াক্কা করছে না সে।নোটিফিকেশন অফ করে রাখলো। একটা আননোন নম্বর থেকে মেসেজ আসায় তার ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল। বিরক্তি নিয়ে ব্যাক বাটনে ক্লিক করে ইনবক্সে গেলো। মেসেজ দেখে চোখ ছানাবড়া পুষ্পিতার।
‘আমাকে দেখে খেতে আসলেন না কেন? নাকি আপনার ভাগের খাবার গুলো আমাকে দেওয়া হয়েছিল?’
#চলবে
#অতঃপর_সন্ধি (০৪)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
দুপুরের বিষয়টা মাথায় আসতেই বুঝতে বাকি রইলো না মেসেজটা কে পাঠিয়েছে। থমকে গেল পুষ্পিতা। অবিশ্বাস্য চোখে মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। হৃদপিণ্ড খুব দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত মেসেজ পেয়ে মুখের বিরক্তি ভাবটা সরে লাজুকতা দেখা দিলো। প্রসারিত হয় ঠোঁটের কোণ। সে কিছু একটা লিখতে গিয়েও লিখলো না। যদি ওপাশ থেকে আর কোনো রিপ্লাই না আসে? ভাবনার মাঝে আবারও টুং করে শব্দ হলো। নাম্বারটা থেকে আবারও মেসেজ এসেছে।
‘কি হলো উত্তর দিচ্ছেন না যে।’
উপায় না পেয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপ করলো,
‘আসলেই তখন আমার খিদে ছিলো না।’
মিনিটের মাথায় আবারও মেসেজ আসলো।
‘মিথ্যে কথা। আমি দেখেছিলাম আপনি আসছিলেন। পরে আমাকে দেখে আড়ালে চলে গেলেন।’
ধরে পড়ে যাওয়ায় জিভে কামড় দিলো।
‘আপনি ভুল দেখেছেন।’
‘চশমা পড়ে ভুল দেখার প্রশ্নই আসে না।’
তাদের বাকবিতন্ডা চলতে থাকলো মাঝরাত অব্দি। হয়তো এই বাকবিতন্ডা থেকেই প্রণয়ের সূচনা ঘটবে।
____________________
গুটি গুটি পায়ে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন। মায়ান আর পুষ্পিতার মাঝে বেশ সখ্যতা বেড়েছে। বেড়েছে তাদের রোজ কথা বলা। দুই মিনিট থেকে চার মিনিট আর এখন ঘন্টা পেরিয়ে যায় কথা শেষ হয় না। আগে মেসেজে কথা হতো আর এখন কলে কথা হয়। একজন একনাগাড়ে কথা বলে যায়৷ আরেকজন চুপটি করে সে কথা শুনে। কখনো কখনো মেতে উঠে খুনসুটিতে। আর সাথে বেড়েছে তানজিফের পাগলামিও। তানজিফ থেকে বেশ দূরত্বে থাকার চেষ্টা করে পুষ্পিতা। তারপরও রেহাই মিলে না। কখনো কখনো বউ বলে ডেকে ওঠে সে। হকচকিয়ে যায় পুষ্পিতা। অস্বস্তিতে কোনো দিকে তাকাতে পারে না। এসবের মজা নেয় জারিন।
ফোনের লুকানো ফোল্ডার থেকে মায়ানের ছবি বের করে সেটার দিকে অপলক তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। মায়ানের ভ্রু যুগল কুঁচকানো। চেহারায় গম্ভীরতা আর চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ফারদিনকে পড়াচ্ছিল সে৷ সেই ফাঁকে লুকিয়ে ক্লিক করেছিল পুষ্পিতা। সাদাসিধা ছেলেটার মাঝে কি আছে ভেবে পায় না সে। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে তার। অপলক, অনিমেষ।
মোবাইল রিং হওয়া শুরু করলো। স্ক্রিনে নাম দেখে হাসলো সে।
‘ঘুম ভাঙালেন আমার। কাজটা কি ভালো হলো?’
মায়ান কালবিলম্ব না করে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল,
‘শুভ জন্মদিন মেম।’
বিস্ময়ে চোখ জোড়া বড় হয়ে গেলো পুষ্পিতার। চমৎকৃত কন্ঠে বলল,
‘আজ আমার জন্মদিন?’
পুষ্পিতার করা প্রশ্নে মৃদুস্বরে হাসলো মায়ান।
‘ইয়েস মেম। আজ ডিসেম্বরের তিন তারিখ। অলরেডি ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ক্রস করেছে।’
পুষ্পিতার বিস্ময় যেন কাটছেই না।
‘আপনি জানলেন কি করে?’
‘ফেসবুকের বদৌলতে।’
মায়ানের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত পুষ্পিতা। একের পর এক কল দিয়ে চলেছে তানজিফ। কল গুলো দেখেও ইগনোর করলো সে। একরাশ ভালো লাগার মাঝে সে মুড খারাপ করতে ইচ্ছুক না কোনোমতে।
নিজের রুমের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে তানজিফ। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি আর শর্ট প্যান্ট। বাইরে হিমেল হাওয়া বইছে। সেই হাওয়া তানজিফকে মোটেও স্পর্শ করতে পারছে না। তার মন অশান্ত আর বিক্ষিপ্ত। বার বার একটা কথায় মাথা ঘুরছে পুষ্পিতা একটু একটু করে আরো বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। সময় দেখলো সে। দেড়টা বাজে। তপ্ত শ্বাস ফেলে আবারও ফোন লাগালো পুষ্পিতার নাম্বারে। আবারও ওয়েটিং। বড্ড অসহায় লাগছে তার। বুকের মধ্যে হাহাকার আর হারিয়ে ফেলার ভয়।
‘কার সাথে এতো কথা বলিস? বার বার ওয়েটিং বলতেছে। তোকে প্রথম উইশ করার জন্য সেই কখন থেকে ওয়েট করতেছি। তোর কাছে তো আমার জন্য সময়ই নেই। হয়তো বেশি বিরক্ত করি তোকে। ‘শুভ জন্মদিন আমার জীবন্ত পুষ্প।’ তুই মানিস আর না মানিস, তোকে পাই বা না পাই তুই সারাজীবন আমার কাছে আমার ব্যক্তিগত পুষ্প হিসেবেই থাকবি।’
মেসেজটা সেন্ট করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো সে। ওয়েটিং শব্দটা কানে ভাসতেই বক্ষঃস্থলে প্রকাণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
_________________
ঘুমে চোখ নিভু নিভু করছে মায়ানের। কল কেটে পিছনে ফিরে কালো অবয়ব দেখে এক লাফে দূরে সরে যায়। ভয়ার্ত, তটস্থ গলায় প্রশ্ন করলো,
‘কে কে?’
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে কালো অবয়বটি। মায়ান তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাশলাইট মুখ বরাবর ধরলো। মুখটা স্পষ্ট হতেই বুকে থুথু দিলো মায়ান। একটা ঝাড়ি দিয়ে বলল,
‘কথা বলতে পারিস না বেয়াদব।’
হাত ভাঁজ করে সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আতিক।
‘এতোরাতে বাইরে এসে কার সাথে কথা বলিস?’
আতিকের করা প্রশ্নটা যেন মায়ানের কর্ণকুহর অব্দি পৌঁছালো না। ফেসবুক স্ক্রল করতে ব্যস্ত সে।
‘একটা প্রশ্ন করেছি তো আমি।’
মোবাইলে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘পুষ্পিতার সাথে।’
বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে গেল আতিকের। হা হয়ে মায়ানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
‘মুখ বন্ধ কর। না হয় মশা ঢুকে যাবে।’
‘মজা করছিস আমার সাথে?’
এবার মোবাইল থেকে মনযোগ সরিয়ে আতিকের দিকে দৃষ্টিপাত করলো মায়ান।
‘ভাগ্যকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। দেখি আমার ফেভারে যায় কিনা।’
আতিক দৈবাৎ মায়ানের একটা হাত আকঁড়ে ধরলো। প্রফুল্ল, প্রাণোচ্ছল গলায় প্রশ্ন করলো,
‘প্রপোজ করেছিস?’
মাথা নাড়ে মায়ান।
‘খুব শীঘ্রই করবো। পৃথিবীতে সবকিছুর ঔষধ পাওয়া গেলেও মনের রোগের কেবল একজনের কাছেই পাওয়া যায়। যার জন্য প্রতিনিয়ত হৃদয় পুড়ে তার সান্নিধ্যে গেলেই সেই পোড়া প্রশমিত হয়।’
মায়ানের পিঠে চাপর মা’রে আতিক।
‘এতোদিনে বুদ্ধিসুদ্ধি হয়েছে তোর এতেই আমি খুশি।’
_______________________
‘রাতে এতোগুলো কল দিলাম, মেসেজ দিলাম রিপ্লাই দিলি না যে।’
তানজিফের কথায় ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় পুষ্পিতা। পাত্তা দিলো না তেমন একটা।
‘দেখতে পাইনি।’
‘মিথ্যে বলছিস কেন? রাতে না হয় দেখিসনি। সকালে তো মোবাইল হাতে নিয়েছিস। তখন দেখিসনি?’
‘দেখেছি কিন্তু মেসেজের রিপ্লাই বা কলব্যাক করার প্রয়োজন মনে করিনি।’
তানজিফ মলিন, বিষন্ন স্বরে প্রশ্ন করলো,
‘তোর জীবনের বাতিলের খাতায় আমি।’
‘সেটা তো বহুদিন আগে থেকেই।’
সদুষ্ণ শ্বাস ফেলে তানজিফ। পুষ্পিতা মাথায় হাত রাখল তানজিফ। মৃদুস্বরে তার কন্ঠনালী দিয়ে স্ফুরিত হলো,
‘শুভ জন্মদিন আমার পুষ্প। আমার ভাগের হায়াত যেন আল্লাহ তোকে দেয়।’
বিমূঢ়, স্তব্ধ হয়ে তানজিফের দিকে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতা। তানজিফ মলিন হেসে চলে গেলো।
‘ফারদিনের টিচার তোকে প্রথমে উইশ করাতে খুশি হয়েছিলি না? আই থিংক তোর এই উইশটার জন্য খুশি হওয়া দরকার। এবারের জন্মদিনের তোর বেস্ট উইশ এটা।’
জড়বস্তুর মতো বসে আছে পুষ্পিতা। নির্জীব, প্রাণহীন চোখে জারিনের পানে চেয়ে রইলো। পুষ্পিতার বিমূঢ়তা দেখে আর ঘাটালো না জারিন। পরিবেশ স্বাভাবিক করতে বলল,
‘আজ তো আর ক্লাস হবে না। আয় আমাকে তোর জন্মদিনের ট্রিট দিবি।’
_____________________
ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই রিক্সায় মায়ানের সাথে অন্য একটা মেয়েকে দেখে একেবারে স্থির হয়ে গেলো পুষ্পিতা। অপলক সেই দিকে তাকিয়ে রইলো।
হাঁটতে হাঁটতে কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়েছে জারিন। হঠাৎ পাশে পুষ্পিতা কে না দেখে ভয় পেয়ে যায় সে। পিছনে ফিরে পুষ্পিতাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। একদৌড়ে কাছে এসে পুষ্পিতা কে আস্তে ধাক্কা দিতেই সম্বিত ফিরে আসে।
‘এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?’
‘কিছু না, এমনি।’
নিজের মনকে অনেক ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করলো। মেয়েটা প্রেমিকা হবে না।
রিক্সায় বসে আছে জারিন আর পুষ্পিতা। রিক্সা শপিং মলের আসতেই জারিন বলল,
‘পরে খাবো আগে তোকে আমার তরফ থেকে একটা গিফট দেই। তোর পছন্দ মতো কিছুই আমি তোকে কিনে দিবো।’
ভাড়া মিটিয়ে দুজন শপিং মলে গেল। সেকেন্ড ফ্লোরে গিয়ে হাঁটা হাঁটি দেখতে লাগলো কি নেওয়া যায়। আচমকা ঘড়ির দোকানে আবারও মায়ানকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মায়ান খুব যত্ন সহকারে মেয়েটার হাতে ঘড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে।
পুষ্পিতার মন খারাপ যেন আরো গাঢ় হচ্ছে। হারিয়ে ফেলার তীব্র গন্ধ নাকে এসে ঠেকলো। কিছু কেনার মুডই চলে গেল তার।
‘কিরে চল। একটু পর পর এভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছিস কেন?’
জারিনের উৎফুল্ল মুখটার দিকে তাকালো। নিজের মন খারাপ চাপা দিয়ে অন্যদিকে গেলো। কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে একটা আইশ্যাডো প্লেট আর একজোড়া কানের দুল কিনলো। তারপর গেল রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার পর বাঁধে বিপত্তি। ব্যাগ হাতরে পুষ্পিতা ছোট্ট পার্সটা বের করে টাকা পেলো না। পঞ্চাশ টাকার মতো আছে। দুইজনের বিল আসছে এক হাজারের উপর। জারিনও গিফট কিনার চক্করে সব টাকা খরচ করে ফেলছে। দুইজন মুখ কালো করে বসে আছে।
অকস্মাৎ ওদের সামনে এসে দাঁড়ায় তানজিফ। দু’জনের গোমড়ামুখে দেখে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে?
তানজিফ কে দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো পুষ্পিতা। জারিনের যেন জানে পানি আসলো।
‘আরে খাওয়ার পর বিল দিতে গিয়ে দেখি দুজনের কারো কাছে টাকা নেই। রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের চুর বলে না আবার মা’রা শুরু করে।’
তানজিফ আস্বস্ত করে বলল,
‘ওহ্ এই ব্যপার? সমস্যা না আমি বিল মিটিয়ে দিচ্ছি। তুই আমাকে পরে দিয়ে দিস।’
তানজিফের কথাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না পুষ্পিতা। অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে।
‘তুই থাক আমি বাবাকে বললে এখনই বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিবে। আমি ক্যাশআউট করে আসছি।’
পুষ্পিতাকে আটকালো তানজিফ।
‘বললাম তো আমি দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে পরে দিয়ে দিস।’
এবারে গর্জে উঠলো পুষ্পিতা। উচ্চ শব্দে বলল,
‘তোর কাছে আমি টাকা চেয়েছি? চাইনি তো? তাহলে এমন আলগা পিরিত কেন দেখাচ্ছিস? এসব হিরোগিরি অন্যদের গিয়ে দেখা অন্তত আমাকে না।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।