#অতঃপর_সন্ধি (২৭)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
শিমুলের বিয়ের উদ্দেশ্যে গ্রামে পা রেখেছে মায়ান। বড় বোনের বিয়ের সময় কিছু না বুঝলেও মেঝবোনের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তার কাঁধে। ব্যাগ পত্তর নিয়ে অটোতে উঠে বসল সে। টিউশনি করিয়ে জমানো টাকার ছোট্ট ব্যাগটা সাবধানে রাখল। হারিয়ে গেলেই বিপত্তি।
বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই আছরের আজান পড়লো। ওজু করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলেন খায়রুল আলম। ছেলেকে উঠোনে দেখে দৌড়ে এলেন তার কাছে। মায়ানের কাঁধ থেকে ভারি ব্যাগটা নিলেন।
‘তুমি আইছো বাজান?’ অতঃপর হাঁক ছেড়ে ডাকলেন মায়ানের মাকে।
‘আফিয়া’র মা তাড়াতাড়ি বাইরে আহো। তোমার পোলা বাইত আইছে।’
মাটির ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দিলারা বানু। ছেলেকে দেখে অশ্রুসিক্ত হলো চক্ষু জোড়া। চোখেমুখে হাত বুলিয়ে দিলেন পরম মমতায়।
‘শিমুল তোর ভাই আইছে। তাড়াতাড়ি পানি তোল। তোর ভাই গোসল দিবো।’
ছেলের দিকে দৃষ্টি ফিরালেন। পুনরায় মায়াভরা গলায় বললেন,
‘তোমার অনেক খিদা লাগছে না বাজান?’
মায়ের কথায় হাসলো মায়ান।
‘আম্মা বুবু আসে নাই।’
‘আইবো বাবা কাইল। সংসার সামাল দিয়া আওন লাগে তো। এহন তুমি ঘরে আহো। কাপড়চোপড় ছাইড়া গোসল দেও।’
_______________
চারিদিকে ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। দূরদূরান্ত থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে কুকুরের হাঁক ডাক। কিছুক্ষন আগেই বাবুর্চি সবকিছুর লিস্ট দিয়ে গেলো। কোনটা কি পরিমাণে লাগবে।
মায়ান নতুন ঘরে গিয়ে ছোট্ট টাকার ব্যাগ নিয়ে আসলো। খায়রুল আলমের হাতে দিয়ে বলল,
‘আপনার ছেলে যতটুকু পেরেছে ততটুকু আপনার হাতে তুলে দিছে আব্বা। আমারে সময় দিলে বাকি যা ধারদেনা থাকবে সেগুলোও ধীরে ধীরে শোধ করে দিবো।’
তিনি টাকা গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন অপলক। কিয়ৎকাল বাদে চাইলেন ছেলের মুখের দিকে। নেত্রপল্লব ভেজা। হয়তো কান্না লুকাতে গিয়েও পারেননি।
‘দেখলা আফিয়ার মা? গেমারে বেবাক মানুষ কইছে আমার পোলা শহরে গিয়া আমাগোরে ভুইল্লা যাইবো। আমাগোর কতা হুনবো না। পড়ালেহার দরকার নাই। আমি কি আমার পোলারে এমন শিক্ষা দিছি কও? এহন কেউ কিছু কইলে আমি বুক ফুলাইয়া কইবার পারুম আমার পোলা বদলায় নাই। শহরে পড়তে গেলে হগ্গলে খারাপ হয় না।’
বাবা মায়ের চোখের উচ্ছ্বাস দেখে টানাটানি করে চলার দিনগুলোর কষ্ট যেন মুহূর্তেই উবে গেলো।
‘আপনাদের আরো একটা খুশির খবর দেওয়ার আছে আব্বা।’
চোখ মুছলেন দু’জনই। খায়রুল আলম জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি খবর আব্বা?’
‘শিমুল আর বৃষ্টিরে ডাকেন।’
দিলারা বেগম ডাকতেই দু’জন ছুটে এলো।বৃষ্টি সামনে এলেও আড়ালে এসে দাঁড়াল শিমুল। ভাইয়ের সামনে আসতে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে।
‘আমি স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম আব্বা। আমি সিলেক্টেড হয়েছি।’
এবার সামনে এলো শিমুল। মৃদু চিৎকার করে বলল,
‘তুমি সত্যি বলতেছো ভাইয়া?’
একগাল হেসে মাথা দুলায় মায়ান।
দিলারা বেগম বুঝলেন না কথার মানে।
‘এইডা আবার কি বাজান?’
‘আরে আম্মা আমি যে ক্লাস এইটে বৃত্তি পাইছিলাম তোমার মনে আছে?’ চঞ্চল বৃষ্টি তাড়াতাড়ি করে চটপটে গলায় বলল।
বোনের চঞ্চলতা দেখে হাসলো মায়ান। আফিয়া আর শিমুল শান্তশিষ্ট হলেও বেশ চটপটে বৃষ্টি। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন। কোনো কিছু তেমন একটা ব্যাখ্যা করতে হয় না। চট করে বুঝে ফেলে।
‘তোমারেও টেকা দিবো বাজান?’
কোনো জবাব দিলো না মায়ান। মায়ের কাছে এসে মাটিতে বসে পড়লো।
‘করো কি বাজান? নিচে বইয়ো না। উপ্রে আইয়ো।’
দিলারা বানুর কথা শুনলো না মায়ান। মাটিতেই বসে বসে রইলো ঠায়। মাথা রাখলো উনার কোলে। সুস্থির গলায় বলল,
‘আমি দেশের বাইরে পড়তে যাবো আম্মা।’
আঁতকে উঠলেন দিলারা বানু সহ খায়রুল আলম।
‘কি কও তুমি? শহরে থাহো এরপরেও তোমার লাইগ্গা পরানপুড়ে। তুমি বিদ্যাশ গেলে থাকুম কেমনে?’
মায়ের কর্মঠ হাতে চুমু এঁকে দিলো সে।
‘তোমাদের এই কষ্ট আর থাকবো না। জীবনে তো অভাব ছাড়া কিছু দেখলে না।’
চুপচাপ কেউ কোনো কথা বলছে না। নিরবতা ভাঙলেন খায়রুল আলম।
‘যাওয়ার লাইগ্গা টেকা পাইবা কই?’
‘ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। উনারাই সকল খরচ বহন করবে।’
‘আমাগোর অভাব থাকুক তোমার বিদ্যাশ যাওয়ার দরকার নাই।’
‘নিষেদ কইরো না আফিয়ার মা। আমার পোলা পড়ুক। আমার পোলা অনেক বড় হইবো।’
স্বামীর দিকে অসহায় চোখে চাইলেন দিলারা বানু। উনার চোখেও একরাশ অসহায়ত্ব।
আনন্দের মাঝে হঠাৎই মায়ান বলে উঠলো,
‘তোরা দু’জন ওইঘরে যা। আমার আব্বা আম্মার সাথে দরকারী কথা আছে।’
বৃষ্টি ত্বরিত গতিতে বলল,
‘কি দরকারী কথা?’
‘সময় হলে তোরাও জানতে পারবি। এখন যা।’
‘যাইতে কইছে যা।’
শিমুল বৃষ্টির হাতট ধরে বাইরে নিয়ে এলো। ঘর থেকে বের হওয়ার পর বৃষ্টিকে আর একচুল নড়াতে পারলো না শিমুল। ফিসফিস করে বলল,
‘চল, দাঁড়িয়ে না থেকে।’
বৃষ্টি একরোখা হয়ে জবাব দিলো,
‘তুই যা আমি শুনবো কি বলে ভাইয়া।’
‘ভাইয়া দেখলে কিন্তু রেগে যাবে।’
‘এই ভিতুর ডিম তুই যা তো।’
বোনের সাথে না পেরে অগত্যা একাই চলে গেলো শিমুল। দরজার আড়ালে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইলো বৃষ্টি।
____________________
‘মায়ান আমতা আমতা করছে। প্রণয়ের কথা বাবা মায়ের সামনে বলতে অস্বস্তি হচ্ছে তার। কিভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। ফাঁকা ঢুক গিলে সে।
‘একটা আবদার আছে আমার।’
দিলারা বানু মায়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘কি আবদার?’
চোখ বুঁজে নিঃশ্বাসে মায়ান বলল,
‘আমি ঢাকায় একটা মেয়েরে খুব পছন্দ করি আম্মা। মেয়েটাও আমারে করে।’
হাত থেমে গেলো দিলারা বানুর। স্বামীর মুখপানে নেত্রপাত করলো।
‘তোমরা চাইলে,,,,,,
‘তোমার আবদার রাখতে পারমু না বাজান।’
স্থির হয়ে গেলো মায়ান। এমন উত্তর সে আশা করেনি। ঘাড় বাঁকিয়ে বাবার দিকে চাইতেই তিনিও মাথা নিচু করে ফেলেন।
‘ও অনেক ভালো মেয়ে।’
‘শহরের মাইয়ারা ভালা হয় না। ওই মাইয়া তোমারে আমগো থাইকা আলাদা কইরা দিবো।’
‘আম্মা তুমি জানো না,,,,
‘আমার আর জানন লাগবো না। আমি জানি।’
‘আম্মা আমি ওরে অনেক পছন্দ করি। আব্বা আপনি কিছু বলেন না।’
‘তোমার বাপে কি কইবো।
খায়রুল আলমের আসলেই কিছু বলার নেই। নির্বাক শ্রোতার মতো সব শুনে যাচ্ছেন।
‘আম্মা সব মেয়ে খারাপ হয় না।’
‘আমি তোমার মামুরে কথা দিছি।’
ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো মায়ানের। কপালে ভাসমান হয় চিন্তার বলিরেখা।
‘কি কথা?’
‘আমি সুইটিরে তোমার বউ করুম।’
ছিটকে দূরে সরে এলো মায়ান। চোখ জোড়ায় বিস্ময়।
‘আমারে না বলে কিভাবে কথা দিলা আম্মা। সুইটি আমার কত ছোট। ওরে তো বোন ছাড়া কিছু ভাবি না আমি।’
‘আফিয়ার বিয়ার সময় তোমার বাপ এক লাখ টাকা আনছে। এহনো দেয় নাই।’
‘আম্মা আমি মামুর সব টাকা ফেরত দিয়ে দিবো। একটু সময় দেন আমারে।’
‘আমার মা ম’রা ভাইঝিডারে বউ কইরা আনো। আমিও তোমার কাছে আবদার করলাম।’
মাকে বুঝাতে না পেরে এবার কেঁদেই দিলো মায়ান। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
‘আম্মা একটু বুঝো। ফিরিয়ে দিও না। আমার অভাবের কথা জেনেও পিছ পা হয়নি মেয়েটা। একটু রহম করো।’
আশানুরূপ উত্তর পেলো না সে। অসহায়ের মতো দু’পা জড়িয়ে ধরলো খায়রুল আলমের। তিনি তখনো নির্বাক। মাথা নিচু করে রইলেন। ছেলের চোখে চোখ রাখার সাহস পেলেন না।
‘নতুন দু’চালা ঘরটা তোলার সময়ও টেকা দিছে। আবার কইছে শিমুলরে কানের জিনিস দিবো। তোমার বাপের ওতো সমরথ নাই। আমি কইছি তার মাইয়ারে আমার পোলার বউ করুম। তুমি একটা চারকি পাইলে তারে আমার ঘরে আনুম।’
‘তোমার ছেলের চাওয়ার কোনো মূল্য নাই।’
‘তোমার আম্মার জবানের দাম নাই।’
চুপচাপ হয়ে গেলো মায়ান।বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।
‘তোমার ছেলেও ওই মেয়েরে কথা দিছে আম্মা।’
‘সুইটিরে বিয়া না করলে আমি আমার ভাইয়ের সামনে যাইতে পারমু না।’
‘আমি মামুরে সব বুঝাইয়া বলবো। ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিবো।’
‘যে ভাই আমার বিপদে পাশে দাঁড়াইছে। তার মাইয়ারে আমার ঘরের না করলে আমি গলায় দ’ড়ি দিমু।’
আকস্মিক মায়ের হৃদয় কাঁপানো কথায় পড়ে যেতে নিলো সে। মায়ের দিকে চেয়ে রইলো। এতোটা কঠিন আর রুষ্ট হতে আর আগে সে দেখেনি। চোখ বুঁজতেই মায়ের মৃ’ত মুখ চোখে ভাসলো। তড়িঘড়ি করে চোখ মেলে তাকায় সে। জন্মদাত্রীর মৃ’ত মুখ দেখার সাহস তার নেই।
‘আম্মা?’
‘ওই মাইয়ারে যদি তুমি আমারে না কইয়া বিয়া করো, আমি গলায় দ’ড়ি দিমু। আমি কইলাম সত্যই এই কাম করুম্’
ফিচেল হাসলো মায়ান।
‘আমি এতোটাও খারাপ নই আম্মা।’
‘আমাগোরে ঋণমুক্ত করা তোমার দায়িত্ব।’
মায়ান আবারও দিলারা বানুর পায়ের কাছে এসে বসল। হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো।
‘আম্মা ঋণমুক্ত করবো তো। তোমরা সবাই তো আমার দায়িত্ব। সময় দেও। শুধু বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে করতে বলো না।’
‘আমি যে জবান দিছি ওইডা রাখনও তোমার দায়িত্ব। আমারে মুনাফেক বানাইয়ো না।’
কাতর স্বরে দিলারা বেগম ডাকতেই তিনি বললেন,
‘গরীব মাইনষের পছন্দ হইলো টেকা। টেকা সুখ দেয়। আর কিছু না।’
_______________
বুকে এক আকাশ সম দুঃখ লুকিয়ে শিমুলের বিয়ের সমস্ত আয়োজন করেছিলো মায়ান। কাউকে এতটুকু পর্যন্ত বুঝতে দেয়নি।
শিমুলের বিদায়ের পরে যখন মেহমান আসতে আসতে কমতে শুরু করলো। বাড়ি ফাঁকা হতেই মায়ের পা ধরে বসে ছিলো মায়ান।
‘আম্মা আমার কষ্ট হচ্ছে। এতো বড় সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিয়েন না। আপনি মামুরে বলেন না হয় আমি মামুরে বলি বুঝিয়ে। মামু বুঝবে।’
অনেক বুঝিয়েছিলো। তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন। ছেলের চোখের পানি দেখেও মন গলেনি।
ব্যর্থ হয়ে মাটির ঘরের পিছনে থাকা আম গাছটার আড়ালে গিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলো সে। মায়ের অবাধ্য হওয়ার সাহস তার নেই। অন্যদিকে পুষ্পিতা। একবার মনে হয়েছিল ম’রে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে। পরক্ষণেই মনে পড়লো বাবার হাড়ভাংগা পরিশ্রমের কথা। ছোটবেলায় মায়ের বাড়ি বাড়ি ধানের কাজ করার কথা। দায়িত্ব এসে কাঁধে চেপেছে।
সবার থেকে নিজের কষ্টগুলোকে আড়াল করতে পারলেও শুধু পারেনি বৃষ্টির চোখ থেকে আড়াল করতে। শত যন্ত্রণার সাক্ষী ওই বাচ্চা মেয়েটা।
বয়সে ছোট হয়েও বড় বোনের মতো আদেশ করেছে,
‘তুমি ওই আপুকে বিয়ে করো ভাইয়া। বিয়ে করে সোজা বাড়ি চলে আসো। আম্মা কয়েকদিন রেগে থাকবে। দেখবে পরে সব ঠিক হয়ে।’
‘আম্মা উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে। সহজ সরল মানুষটার অনেক রাগ।’
‘আরে মানুষ কত কথা বলে। এভাবে কষ্ট পেয়ো না। আমারও কষ্ট হয়।’
যদি সত্যি সত্যি গলায় দ’ড়ি দেয়?
___________________
চোখ মেলে তাকাল মায়ান। চোখ জোড়া টকটকে লাল । অতীতের কথাগুলো ভাবলে হৃদয় চূর্ণবিচূর্ণ হয়। অসহনীয় যন্ত্রণা হয় বুকে। তার মা বুঝেনি তার যন্ত্রণা।সেও তো কথা দিয়েছিল মেয়েটাকে। কথা ছিলো সারাজীবন একসাথে থাকবে। কথা রাখতে পারেনি। তবে কি সেও মুনাফিক? কতটা ভালো সে বাসতো মেয়েটাকে। মায়ের জন্য ছেড়ে দিয়েছিল নিজের ভালোবাসাকে।
‘ভেবেছিলাম খুশির খবরটা দেওয়ার পর আপনার কথা বললে তারা আমাকে ফিরিয়ে দিবে না। কিন্তু আমি জানতাম না বিচ্ছেদের সূচনা তখন থেকেই হবে। জানলে কখনোই বলতাম না। কখনো না।’
মোবাইল থেকে পুষ্পিতার একটা ছবি বের করলো।লাল শাড়ি পড়া। নিমেষহীন চেয়ে রইলো।
‘আপনাকে ছোঁয়ার আগে দায়িত্ব ছুঁয়ে দিলো নিবিড়ভাবে। দায়িত্বের বলিষ্ঠ হাতের আলিঙ্গন হতে আমি বের হতে পারিনি।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।