#অতঃপর_সন্ধি (২৫)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
বিগত দিনগুলোর ন্যায় আজও পুষ্পিতাদের বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে তানজিফ। একটু বাদে বাদে মশা মা’রছে।পর্দার আড়াল থেকে তানজিফকে পর্যবেক্ষণ করছে পুষ্পিতা। নিজের মোবাইলের কথা মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
‘মা তোমার মোবাইল দাও তো।’
‘মোবাইল দিয়ে কি করবি?’
‘আহা! দাও না কাজ আছে।’
‘চাইছে দিয়ে দাও। এতো কথার কি আছে?’ চশমা ঠিক করে বললেন আশহাব শেখ।
‘আজ সুমনার সাথে ফিরে গেলি না কেন?’ দাঁত কিড়মিড় করে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন আফসানা হক।
বিরক্তিতে ‘চ’ উচ্চারণ করে পুষ্পিতা।
‘তুমি মা বেশি কথা বলো। বলেছি না আমাদের ব্যপার নিয়ে চিন্তা করবে না। মামনিকে যা বলার আমি বলেছি। তুমি এবার একটু প্রেশারটা কম নাও।’
চোখ গরম করে চাইলেন তিনি।
‘হ্যা, এখন আমি বেশি কথা বলি,,,,,,,,’
পুষ্পিতা মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে বিছানার উপর থেকে মোবাইল নিয়ে সুর সুর করে চলে এলো। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে ততক্ষণই কথা শুনাবেন তিনি।
______________
রিং হতেই পকেট হতে মোবাইল বের করে তানজিফ। স্ক্রিনে শ্বাশুড়ির নাম ভাসতেই শির উঁচিয়ে উপরের দিকে তাকায়।
থমথমে মুখে, চাহনি সূঁচালো করে কানে মোবাইল ঠেকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। বিস্তর হাসলো সে। প্রফুল্ল মনে কল রিসিভ করলো।
‘বখাটেদের মতো আমার বাসার নিচে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’
ভড়কে গেলো তানজিফ। চোয়াল ঝুলে গেলো তার।
‘আমি বখাটে?’
‘একটা অবিবাহিত মেয়ের বাসার দাঁড়িয়ে আছিস। তো কি বলবো?’
দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো তানজিফের।
‘তুই অবিবাহিত?’
‘অবশ্যই, কোনো সন্দেহ আছে?’ বলেই গা জ্বালানি হাসি দিলো সে।
নিচ থেকে পুষ্পিতার হাসি বুঝা না গেলেও তানজিফ বুঝতে পারলো তাকে জ্বালিয়ে মজা পাচ্ছে পুষ্পিতা।
‘এই বিল্ডিংয়ে নিশ্চয়ই শুধু একা তোরাই থাকিস না। আরো ভাড়াটিয়া থাকে। ছয় তলায় একটা মেয়ে থাকে। সম্ভবত কলেজে পড়ে। কি মিষ্টি দেখতে। দেখলেই ইচ্ছে করে,,,,’
মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেলো পুষ্পিতার। রাগ ভর করে চেহেরায় রাগে ফুঁসতে লাগে সে। ক্রূর হাসলো তানজিফ। আড়মোড়া ভেঙে পুনরায় বলল,
‘আসলে বউ বলেছে, আমার চোখে যার রূপ আটকেছে। আমার মনে যে আছে তার কাছে চলে যেতে। তাই বউয়ের কথা রাখতে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। উফ! মেয়েটা কি যে সুন্দর।’
রাগে জানালার পর্দা চেপে ধরলো পুষ্পিতা। রেগে ফুস ফুস করতে থাকা সেই আধান তার কর্ণে এসে ঠেকল। আরো রাগাতে আবারও তানজিফ বলল,
‘মেয়েটা একটু বাদে বাদে বারান্দায় এসে আমাকে দেখে যাচ্ছে। হয়তো বুঝতে পেরেছে আমি ওর অপেক্ষায় আছি।’
তিনতলার জানালা দিয়ে মাথা কাত করে ছয় তলায় দেখার বৃথা চেষ্টা করলো পুষ্পিতা। জানালার গ্রিল বাদে কিছুই দেখা গেলো না।
নিচ থেকে এমন দৃশ্য দেখে মুখ টিপে হাসলো তানজিফ।
‘পরশুদিন চলে যাবো ভেবেছিলাম। আর যাবো না। তোর শাস্তি আরো বাড়লো।’
খট করে মোবাইল কেটে গজগজ করতে করতে মায়ের রুমের দিকে গেল।
মশারী টানিয়ে শুয়ে পড়েছেন আশহাব শেখ। কিন্তু রুমে আফসানা হক নেই। হয়তো ওয়াশরুমে। বালিশের উপর মোবাইল রেখে ফিরে এলো নিজের রুমে।
আবারও জানালার পাশে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ নজরে তানজিফকে দেখলো। নাক ফুলিয়ে পর্দা টেনে লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো সে।
____________________
সকালে ডিম ভাজতে গিয়ে আফসানা হক খেয়াল করলেন ফ্রিজে ডিম নেই। পরিচিত মুদিওয়ালাকে কল করতে গিয়ে ভুল করে মেসেজ অপশনটায় ক্লিক করে ফেললেন। একদম উপরে তানজিফের নাম্বার দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে গেলো। মেসেজ আন সীন।
‘আমি উপরে আসি? মেইন দরজাটা,,,,,,,,’
অর্ধ সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ে কৌতূহল বাড়লো উনার। ইনবক্সে গেলেন তিনি। উপরের মেসেজ গুলো পড়ে থতমত খেয়ে গেলেন। অস্বস্তি বাড়লো উনার। ত্বরিত গতিতে মেসেজ অপশন থেকে বেরিয়ে এলেন।
পেঁয়াজ কুচো করছেন আফসানা হক। মেয়ের প্রতি রাগের মাত্রা তরতর করে বাড়ছে। এমন খামখেয়ালিপনা মোটেও উনার পছন্দ না। মেয়ের এমন করাটা মোটেও ভালো লাগছে না। সবকিছু নিয়ে মজা সাঝে না।
‘মা? বাবা কি কলেজে চলে গিয়েছে?’ হাই তুলতে তুলতে বলল পুষ্পিতা।
‘কাল রাতে তানজিফ এসেছিলো?’
আমতা আমতা করতে লাগলো পুষ্পিতা।
‘তোর কি সবকিছু ছেলেখেলা মনে হয়? খেলনাবাটি খেলতে বসেছিস? ছেলেটাকে এমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছিস কেন? যেদিন মুখ ফিরিয়ে নিবে সারাজীবনের জন্য সেদিন বুঝবি।’
‘শক্ত বাঁধনে বাধছি। যেন মুখ ফিরিয়ে না নিতে পারে।’
‘বাঁধন যত শক্ত করবি ছিঁড়ে যাওয়ার প্রবনতা তত বেশি থাকবে। বাঁধন বেশি টাইট করতে নেই। একটু ঢিলে রাখতে হয়।’
মাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে পুষ্পিতা।
‘চিন্তা করো না মা। যখন দেখবো দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ার পথে তখন ঢিলে করে দেবো।’
_____________________
সতেরো দিন পর!
তিতিরকে পুষ্পিতাদের বাসায় দিতে এসেছেন সুমনা এহমাদ। দরজার বাইরে থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পুষ্পিতা বলে উঠলো,
‘মামনি বাড়ির চাবি?’
‘ইশ মনেই ছিলো না।’ বলে তাড়াতাড়ি করে পার্স থেকে চাবির গোছাটা দিল পুষ্পিতার হাতে। দাড়াঁলেন না আর দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলেন। হাসলো পুষ্পিতা।
নিচে নেমেই গাড়িতে উঠে তাজওয়ার নওশাদের এর পাশে বসলেন।
‘তোমার ছেলের বউ যে কি করে না। এই বুড়ো বয়সে এসব সাঝে?’
তাজওয়ার নওশাদের কথায় হাসলেন সুমনা এহমাদ।
‘প্রথমে যখন বলেছিলো এমনটা করবে তখন আমারও খুব অস্বস্তি হয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে বেশ ভালো হয়েছে। কতগুলো দিন চলে গেলো তোমার সাথে একান্তে বসে আকাশ দেখা হয় না। ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। বয়স বাড়ছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাহিদা গুলো কেমন তলিয়ে যাচ্ছে পড়ে যাচ্ছে বয়সের চাপে।’
‘আমাদের সাথে উনারা আসলেও ভালো হতো।’
‘আফসানাদেরও পাঠানোর প্লানিং ছিলো। কিন্তু আশহাব ভাইয়ের ছুটি নেই।’
____________________
রাত ন’টা কি সাড়ে ন’টা। সেজেগুজে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো পুষ্পিতা।
টিভিতে কার্টুন দেখছে তিতির। টেবিলে খাবার দিয়ে সবাইকে ডাকলেন আফসানা হক। সবাই উপস্থিত হলেও পুষ্পিতা কে না দেখে বকতে বকতে রুমের দিকে গেলেন। গিয়ে দেখলেন দেয়ালে চিরকুট আটকানো।
‘আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি তানজিফের সাথে আছি। আজকে রাতে তুমি তিতিরের সাথে আমার রুমে থেকো।’
মেয়ের এমন পাগলামি দেখে হাসলেন আফসানা হক। হাসতে হাসতে প্রস্থান করলেন রুম থেকে।
তালা খুলে মাত্রই বাড়িতে ঢুকলো তানজিফ। তিমিরে আচ্ছাদিত পুরো বাড়ি। বাড়িতে কেউ নেই বলে আজ একটু দেরি করেই বাড়ি ফিরেছে। দিনকে দিন ব্যবসা বাড়ছে। সাথে কাজের প্রেশারও। বড্ড ক্লান্ত সে। পুষ্পিতাকে এক নজর দেখার জন্য মন আর চোখ কাতর হয়ে আছে। কিন্তু পুষ্পিতাদের বাসায় যাওয়ার জন্য শরীরে কুলচ্ছে না৷ তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়াল।
রুমের দরজার কাছে আসতেই ফুলের মিষ্টি সুভাস নাকে এসে ঠেকল তানজিফের। ব্যপারটাকে তেমন একটা পাত্তা দিলো না সে। কিন্তু লাইট অন করে চক্ষু চরাক গাছ তার। রুমের প্রতিটা কোণা ফুলে ফুলে সজ্জিত। খাটটাও সুন্দর করে সাজানো। যেন একটু পরেই নবদম্পতি প্রবেশ করবে। মনের ভ্রম ভাবলো তানজিফ। চোখ কঁচলে পুনরায় সামনে চাইলো। না সে ঠিক দেখছে। কিন্তু কে সাজাবে সেটাই বুঝতে পারছে না।
হাততালির শব্দে ঘোর কাটে তানজিফের। পিছনে পুষ্পিতাকে দেখে কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলো। যদি বিশ্বাস হচ্ছে না পুষ্পিতা এসেছে।
‘বাহ্! বাহ্! আমিও বাসায় নেই। মামনি বাবাই ও বাসায় নেই সেই সুযোগটাকে কাজে লাগালি? কয়েকটা দিন তোর চোখের সামনে ছিলাম না বলে তুই অন্য কারো সাথে,,,,,,,?’
বলেই দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল।
হতভম্ব হয়ে গেলো তানজিফ। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো পুষ্পিতার দিকে। পুষ্পিতার কথাগুলো যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো তার।
‘কোথায়, কোথায় সেই মেয়ে? নিশ্চয়ই ওয়াশরুমে? ভাগ্যিস এসেছিলাম না হলে তো জানতেই পারতাম না এসব কিছু।’
বলেই দৌড়ে চলে গেলো। কথা বলার সুযোগ টুকু পেলো না তানজিফ। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সেও ছুটলো পুষ্পিতার পিছু। পুষ্পিতাকে সিঁড়ির দিকে ছুটতে দেখে অজানা আতংক বাসা বাঁধে মনে। শরীরের সকল ক্লান্তি যেন উবে গেলো।
ছাদে উঠে হাঁপাতে লাগলো সে। পুষ্পিতা রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।
‘পুষ্পিতা স্টপ দেয়ার। আর এক পা ও এগোবি না।’
আরো একটা কদম বাড়ায় পুষ্পিতা। তানজিফ তড়িঘড়ি করে বলল,
‘আরে আমি জানি না এসব কে সাজিয়েছে। আমি সেই সকালে বেরিয়েছি আর মাত্র বাসায় এলাম। ভীষণ ক্লান্ত আমি। আমার চোখ নিভু নিভু করছে সিরিয়াস ব্যপার নিয়ে পাগলামি করবি না প্লিজ।’
বেঁধে রাখা চুলগুলো ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। রাতের নিস্তব্ধ হাওয়ায় এলোমেলো উড়ছে সেগুলো। অদ্ভুত আচরণে কপাল কুঁচকে গেলো তানজিফের। পুষ্পিতা রেলিঙে হাত রেখে।নম্র স্বরে বলল।
‘কুড বি আস তানজিফ? উইল বি মাইন ফরএভার?’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#অতঃপর_সন্ধি (২৬)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
স্তম্ভিত হয়ে গেলো তানজিফ। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। মন বলছে সে ভুল শুনেছে। সম্পূর্ণটা মনের ভ্রম। নির্বোধের মতো চেয়ে রইলো।
উত্তর না পেয়ে পিছন ফিরে চাইলো পুষ্পিতা। গুটি গুটি পায়ে তানজিফের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। তানজিফের কোমরের কাছে শার্ট খামচে আরো একটু কাছে নিয়ে আসলো। দূরত্ব মিটলো দুজনের মধ্যকার। তানজিফের মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
‘শুধু কাগজে কলমে না প্রকৃত অর্থে এই একজনাতে আসক্ত মানুষটাকে চাইছি।’
শিরদাঁড়া বেয়ে তরল স্রোত প্রবাহিত হলো তানজিফের। গা, হাত, পা ছেড়ে দিলো তার। অসাড় হয়ে এলো সমস্ত কায়া। শিরা উপশিরা যেন বন্ধ করে দিলো র’ক্তের প্রবাহ। স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু। পুষ্পিতাকে আজ এতো কাছে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে। হাসফাস লাগছে ভীষণ। ফাঁকা ঢুক গিলল।
‘দূরে যা প্লিজ।’ অনুরোধের স্বরে বলল তানজিফ।
পুষ্পিতা একরোখা, আপসবিমুখ কন্ঠে জবাব দিলো,
‘যাবো না।’
‘আমার গায়ে ধূলো বালি, ঘামের গন্ধ।’
খামচে ধরে রাখা শার্টের কোণা ছেড়ে দিলো পুষ্পিতা। তানজিফের বুকে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো দৃঢ়নিষ্ঠ হাতে।
‘আমি সহ্য করতে পারলে তোর সমস্যা? তুই শুধু উত্তর দে, উইল বি মাইন ফরএভার?’
নির্বাক, নিরুত্তর তানজিফ। কন্ঠনালী গলিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। গলাতেই দলা পাকিয়ে আটকে আছে। নিরবতার চাদরে জড়িয়ে নিয়েছে সে নিজেকে। মিনিট দুয়েক বোলশূন্য থেকে বহুকষ্টে কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারণ করলো,
‘এটা কি আদৌও ভালোবাসা নাকি অভ্যাস?’
তানজিফের বক্ষে লেপটে ছিলো পুষ্পিতা। প্রশ্ন শুনে শির উঁচিয়ে চাইলো। তানজিফের চোখের দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসলো সে।
‘অভ্যাস না ভালোবাসা জানি না। শুধু জানি, আমার শুধু এই মানুষটাকে চাই। এই মানুষটার উপর আমি ব্যতীত আর কারো অধিকার থাকবে না। তার আর আমার মনের মধ্যে যে দূরত্ব সেই দূরত্ব মিটিয়ে দিতে চাই। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে এই মানুষ বলিষ্ঠ হাতের আলিঙ্গনে মিশে যেতে চাই তার বুকের সাথে। দিন শুরু করতে চাই আমার কপালে তাট দেওয়া দীর্ঘ চুম্বন দিয়ে। কিছু কিছু অভ্যাস থাকে যা র’ক্তে’র সাথে মিশে যায়। চাইলেও ছাড়ানো যায়। যদি নিজেকে তুই আমার অভ্যাস বলিস, তবে তুই আমার র’ক্তে’র সাথে মিশে যাওয়া সেই অভ্যাস। তুই মিশে গিয়েছিস আমাতে। নিবিড়, অভেদ্যভাবে। এই অভ্যাস যে আ’মৃ’ত্যু ছাড়াতে পারবো না। বাকি রইলো ভালোবাসা? ভালোবাসা আছে বলেই আমি তোর এতোটা কাছে। যে মানুষটা শত অবহেলা, অপমানের পরেও পিছু ছাড়েনি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা তার ভালোবাসাকে উপেক্ষা করার সাধ্য আমার নেই।’
‘ভেবে বলছিস তো? এরপর কিন্তু চাইলেও নিজেকে আমার থেকে দূরে নিতে পারবি না।’
‘ভালোবাসা ভেবে হয়? আর দূরত্ব কি বলেকয়ে তৈরি হয়? ভালোবাসা তৈরি হয় মানুষের পাগলামি দেখে। অনুভূতির জোয়ারে ভেসে। আর দূরত্ব বাড়ে অবহেলায়।’
‘তুই তো মায়ানকে ভালোবাসিস?’
মিষ্টি, আবেগি মুহুর্তে মায়ানের নাম শুনে তেতে উঠলো পুষ্পিতা। ধপাধপ করে মাথায় র’ক্ত চড়ে গেলো তার। দাঁত কিড়মিড় করে ছিটকে সরে তানজিফের কাছ থেকে। আঙুল উঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
‘হ্যা, মায়ানকে ভালোবাসি। কোনো সমস্যা? আমি তোকেও ভালোবাসি। তোর সাথে সারাটা জীবন পার করতে চাই। হাতে হাত রেখে। যে মানুষটা আমাকে পাওয়ার জন্য শেষ অবদি যেতে পারে তাকে রেখে কই যাবো? মায়ানের কাছে? যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে সারা জীবন একা কাটিয়ে দিবো। আমার কাছে যদি লাস্ট অপশন মায়ান হয় তারপরও আমি ফিরবো না। মায়ান নাম শুনলে আমার কানে বাজে “ব্রাইট ফিউচার” শব্দটা। আমি নাকি ব্রাইট ফিউচার দেখে ছাড়তে চাইছি না। আমার জন্য কথাটা কত অপমানজনক শুধু আমি জানি। অথচ আমি যখন তার হাত ধরেছিলাম তখন তার ব্রাইট ফিউচার ছিলো না। একজন সাদামাটা মানুষ ছিলো।’
অবস্থা বেগতিক দেখে কাছে পুষ্পিতাকে বলিষ্ঠ হাতের বাহুডোর আবদ্ধ করে নিলো তানজিফ।
‘বেঁচে থাকতে কখনো একা থাকার প্রয়োজন পড়বে না তোর।’
পুষ্পিতা ফুঁপিয়ে উঠে জবাব দিলো,
‘আল্লাহর কাছে না চাইতেই মুঠো ভর্তি সুখ পেয়েছি। সুন্দর একটা পরিবার পেয়েছি। হাতে হাত রেখে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়ার জন্য চমৎকার একজন মানুষ পেয়েছি জীবনসঙ্গী রূপে। তাই কে আমাকে ছেড়ে গেলো, কে আমার অনুভূতির মূল্য দিলো না, কে মাঝপথে আমার স্বপ্ন ভেঙেছে এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি শুধু জানি আমার সুখ তুই। আমার শান্তি তুই। না চাইতে যেই সুখ আমি পেয়েছি হেলায় হারাতে চাই না।’
অশ্রুসিক্ত লোচনে মুখ তুলে তানজিফের দিকে চাইলো। আলতো করে হাত রাখলো তানজিফের দুগালে।
‘আমি উপরওয়ালার নিকট একটু সুখ চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে সুখের পুরো খনিটাই দিয়ে দিলেন।’
বলে আবারও তানজিফের বলিষ্ঠ বুকে মাথা ঠেকালো সে। আস্তে করে বলল,
‘ভালোবাসার চেয়ে বেশি প্রয়োজন ভালো থাকা। আর আমি তোর সাথে ভালো আছি।’
এভাবেই কেটে গেলো কয়েক মুহুর্ত। নিস্তব্ধ রজনীতে দু’জন দু’জনকে অনুভব করতে ব্যস্ত। গা ছুঁয়ে দিচ্ছে নির্মল পবন।
পুষ্পিতার মুখটা হাতের আঁজলিতে নিলো তানজিফ। ললাটে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে দিলো।
‘বেশ তবে, তোর মাঝে সপে দিলাম নিজেকে।আমি আর আমার নই।সম্পূর্ণ টাই তোর।’
____________________
রাত্রি শেষভাগ! কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ফজরের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত হবে চারপাশ। একটা রাত পুরো নিদ্রাহীন কাটিয়ে দিলো এই দম্পতি।
পুষ্পিতা তানজিফের এক বাহুর উপর রেখে অন্য হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে দিচ্ছে। আবার হাত ছেড়ে দিচ্ছে। ঘাড় কাত করে পুষ্পিতাকে ব্যস্ত তানজিফ।
মাথা কিঞ্চিৎ উঁচু করে তানজিফের মুখপানে চাইলো পুষ্পিতা।
‘একটু পরেই তো আজান পড়বে। ঘুমোবি না?’
পুষ্পিতাকে আরো একটু নিয়ে আসলো তানজিফ। বদ্ধ করে নিলো দু’হাতের দৃঢ় বন্ধনে। এইবারে পুষ্পিতা মাথা ঠেকেছে তানজিফের বুকে।
‘আমার জীবনের বহুল প্রতীক্ষিত রাত। এসে ধরা দিয়েছে কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই। ঘুমিয়ে গেলেই তো শেষ। তার চেয়ে ভালো জেগে অনুভব করি। আমার ভালোবাসার মানুষটা আমার খুব কাছে। ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশে আছে আমাতেই৷ ঘুমোনোর জন্য হাজারো রাত আসবে জীবনে। বাট এই রাতটা স্পেশাল।’
পুষ্পিতা মিইয়ে যাওয়া গলায় অপরাধীর সুর টানলো।
‘তোকে যে আমার থেকে দূরে দূরে রেখেছি এতোদিন। তুই কি রেগে আছিস আমার উপর?’
পুষ্পিতার এলোমেলো চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ালো তানজিফ। দূর্ভেদ্য হেসে জবাব দিলো,
‘আজকের রাতের কাছে পুরোনো সকল রাগ, অভিমান পানসে হয়ে গিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম হলেও সারপ্রাইজটা বেস্ট ছিলো। যা ইমোশনাল ড্রামা করলি আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’
তানজিফের উন্মুক্ত বুকে আঁকিবুঁকি করছিলো পুষ্পিতা। কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠলো। তানজিফ পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
‘মাকে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাজি করালি কি করে?’
______________________
মুখ ফসকে বেফাঁস কথা বলে জিভে কামড় দিয়ে চুপচাপ রইলো।
সুমনা এহমাদ পুষ্পিতার কাঁধে হালকা চাপড় মে’রে বলল,
‘বেয়াদব মেয়ে শ্বাশুড়ির সাথে কিভাবে কথা বলতে জানিস না? লজ্জা করলো না তোর?’
বুকে সাহস সঞ্চয় করে সে জবাব দিলো।
‘তুমি তো শ্বাশুড়ি কম বান্ধবী বেশি। তোমার সাথে লজ্জা কিসের?’
পুষ্পিতার কান টেনে ধরলেন তিনি।
‘তোর মায়ের বান্ধবী আমি। তোর না।’
‘কোন শাস্ত্রে লেখা আছে মায়ের বান্ধবী হলে তার মেয়ের বান্ধবী হওয়া যাবে না?’
উঠে বসে পুষ্পিতা। সুমনা এহমাদের হাতটা নিজের মুঠোয় নিলো।
‘শুনো মামনি, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলেই জীবন নামক উপন্যাসের সমাপ্তি। ক্ষুদ্র জীবনের বয়সের প্রতিটা ধাপকে উপভোগ করতে হবে। বয়স হয়েছে, লোকে কি বলবে? এসব অজুহাতের বেড়াজালে নিজেকে জড়িয়ে নিলে তো চলবে না । দু’হাত মেলে অনুভব করতে হবে নিজেকে।’
নিমেষহীন পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে আছেন সুমনা এহমাদ। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে পুষ্পিতা হাসলো।
‘তোমরা মা জাতির কাছে জীবন মানে হেঁসেল আর স্বামী সন্তানের দেখাশোনা করা, তাদের যত্ন করা। পারিবারিক কূটনীতিতে জর্জরিত হওয়া। তোমাদের চারজনের জন্য ট্যূরের একটা প্যাকেজ সিলেক্ট করেছি। তিনদিনের জন্য। নিজেদের মতো করে সময় কাটিয়ে আসো।’
‘টাকা কোথায় পেলি তুই?’
কানের পাশের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালো পুষ্পিতা। একটু ভাব নিয়ে বলল,
‘আমার শ্বশুরের কম আছে না আমার স্বামীর। স্বামীর পকেট কেটেছি। শ্বশুর শ্বাশুড়িকে হানিমুনে পাঠাবো বলে।’
‘ঢং না করে বল যে রাগ, অভিমান ভাঙানোর একটা স্পেস চাইছিস। আমাদের দূরে সরানো তো অজুহাত মাত্র।’
‘মোটেও না। আমাদের দাম্পত্য জীবন তো মাত্র শুরু। হাজারো সুযোগ আসবে আমাদের। স্পেস তৈরি হবে। এটা তোমাদের জন্য।’
‘তানজিফের বাবা কি রাজি হবে?’
বিরক্তিতে “চ” উচ্চারণ করলো পুষ্পিতা।
‘কেমন স্ত্রী তুমি? স্বামীকে রাজি করাতে পারবে না। স্বামী থাকবে স্ত্রীর হাতে মুঠোয়। যা বলবে তা শুনবে। আমাকে দেখো। দেখে কিছু শেখো।’
সুমনা এহমাদ আবারও পুষ্পিতার কান টেনে বললেন,
‘তাই দেখছি করতে হবে।’
_______________________
খুঁক খু্ঁক করে কাশতে লাগলো তানজিফ।
‘কিরে তোর গলায় কি কথা আটকে গেলো নাকি?’
কাশি থামিয়ে তানজিফ জবাব দিলো,
‘মানুষকে কিভাবে হাত করতে হয় এটা তোর থেকে ভালো কেউ জানে না।’
‘এটার জলজ্যান্ত প্রমাণ তো তুই।’
শব্দ করে হেসে উঠলো তানজিফ।
সোনালী রোদে ঝলমল করছে চারপাশ। পর্দার ফাঁক গলিয়ে এক চিলতে সোনালী রোদের রশ্মি এসে পড়েছে বিছানায়।
উবু হয়ে ঘুমিয়ে আছে তানজিফ। গোসল শেষ করে মাত্রই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো পুষ্পিতা।চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে পেঁচানো। তানজিফের উন্মুক্ত পিঠ নজরে আসতেই প্রগাঢ় ত্রপায় আড়ষ্ট হলো সে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো তৎক্ষনাৎ। গুটি গুটি পায়ে আরশীর সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চাইলো।
‘অবশেষে জেদটা ভালোবাসায় রূপান্তর হয়েই গেলো।’
______________________
ফেসবুকের নিউজফিড একজোড়া দম্পতির কালো গাউন আর ক্যাপ পড়া ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটা মেয়ের ললাটে চুমু এঁকে দিয়েছে। সেই আবেগময় মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দি করেছে কেউ একজন। হাজার রিয়েক্ট, কমেন্টস আর শেয়ারের ছড়াছড়ি। কমেন্ট বক্সের সবাই আবেগের জোয়ারে ভাসছে।
যে ছেলেটা মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়েছে তাকে চিনে মায়ান। মেয়েটাকেও চিনে। দু’জনের হাস্যোজ্জল মুখ বলে দিচ্ছে কতটা সুখী তারা। বক্ষঃস্থলে ছ্যাৎ করে উঠলো মায়ানের। চিনচিন ব্যথা শুরু হলো সেখানে। না পাওয়ার ব্যথা।ছেড়ে চলে আসার কষ্ট। মনের হাজারো কষ্ট চাপা পড়ে আছে। অব্যক্ত কথাগুলো হয়তো কখনো পুষ্পিতাকে বলা হবে না। বেদনার্ত মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে পড়া শুরু করলো উপরের আবেগময়ী বার্তা।
‘শিক্ষাজীবনের অর্জনের স্বীকৃতি প্রাপ্তির দিনে আমি শুধু সনদই অর্জন করিনি, এই মেয়েটাকেও অর্জন করেছি। আমি অর্জন করেছি আমার অর্ধাঙ্গিনী কে। আমার প্রাপ্তির খাতা পূর্ণ করেছে সে। আমার বহুল প্রতীক্ষার ফল এই মেয়েটা। শত অবহেলার পরও আমি তার পিছু ছাড়িনি। আর সে ধরেছিল এক বেকার ছেলের হাত। প্রণয়ের সূচনা হয়েছিল বিয়ের বহুদিন পরে। পবিত্র প্রণয়।যেখানে নেই কোনো পাপ। যদি কাউকে ভালোবাসেন পিছু ছাড়বেন না। আপনার চাওয়া যদি পবিত্র হয় আর মানুষটা যদি আপনার জন্য কল্যানকর হয় তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে আপনার করে দিবে। হারিয়ে ফেলতে ফেলতেও পেয়ে যাবেন তাকে। যেমনটা আমি পেয়েছি। স্পেশালি থ্যাংক্স টু দিস ম্যান, যে ছেড়ে গিয়ে এই চমৎকার মেয়েটাকে আমার করে দিয়েছে। সারাজীবনের জন্য। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। ছোট্ট পরিসরের এই জীবনে যা চেয়েছি তাই দিয়েছে উপরওয়ালা। হয়তো বা অপেক্ষা আর ধৈর্য্যের পরে। আলহামদুলিল্লাহ সবকিছুর জন্য।’
লেখাটা পড়তে পড়তে ঘোলাটে হলো মায়ানের চোখ। ঝাপসা চোখে শেষের লেখাগুলো পড়তে ভীষণ কষ্ট হলো তার।বুকটা হাহাকার করছে। অন্তঃস্থলে প্রবলবেগে শুরু হলো র’ক্ত ক্ষরণ। দু-চোখের কপাটের মিলন ঘটতেই গাল স্পর্শ করলো বারিবিন্দু। ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে আওড়াল,
‘আপনাকে দেখি না সহস্রাব্দ বছর, ফুলবানু।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।