#অতঃপর_সন্ধি (২১)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
‘পুষ্পি মাথা কি বেশি যন্ত্রণা করছে? এই পুষ্পি?’
কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ভীতি, অভিশঙ্কা দানা বাঁধতে থাকে মনে। ভয়বিহ্বল হয়ে পড়ল সে। ওপাশ থেকে আশিকও আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে।
‘আশিক তোর সাথে পরে কথা বলবো।আজকের অর্ডারগুলো তুই হ্যান্ডেল কর।’ ব্যস্ত গলায় বলল তানজিফ।
পায়ের উপর থেকে ল্যাপটপ সাইডে রেখে পুষ্পিতা
কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সে। বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছে দিলো সযত্নে।
‘আমি ঔষধ আনছি। ব্যথা কমে যাবে।’
পুষ্পিতা কে রেখে উঠতে নিলেই তানজিফের হাত খাঁমচে ধরলো সে।
‘কোথাও যাবি না তুই। আমাকে ফেলে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। আমাকে তোর বুকের সাথে মিশিয়ে রাখ।তোর বুকে অনেক উষ্ণতা। অনেক শান্তি। এই শান্তি আর কোথাও নেই।’ আরো কিছু বলতে চাইলো পুষ্পিতা এর আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। ভারী নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তানজিফের উন্মুক্ত বুকে।
কপালে চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা স্পষ্ট তানজিফের। চিন্তিত হয়ে পুষ্পিতার কপালে হাত ঠেকাল। এতোক্ষণ বুঝতে না পারলেও এখন বুঝতে পারলো পুষ্পিতা গায়ে জ্বর। জ্বরের প্রকোপে ভাট বকে গেলো সে। ফিচেল হাসলো তানজিফ।
‘সজ্ঞানে তোকে এসব বলেনি তানজিফ। এমন দিন আসতে অনেক দেরি। আদৌও আসবে কিনা সন্দেহ।’
________________
সকালের সোনালি মিষ্টি রোদ চিকচিক করতে চোখ পিটপিটিয়ে তাকাল পুষ্পিতা। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। রোদের ঝলকানিতে চোখ মেলে রাখা দায়। ভ্রু যুগল কুঁচকে মিটমিট করে চোখ একবার খুলছে তো আরেকবার বুঁজছে। আচমকাই পুষ্পিতার চক্ষু জোড়া বড় আর স্থির হয়ে গেলো। বালিশের জায়গায় তানজিফের প্রশস্ত বুক দেখে নিদ্রা উবে গেলো। তানজিফ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গভীর ঘুমে নিমগ্ন।
নিশ্বাস নিচ্ছে না সে। যদি তানজিফ জেগে যায়। লজ্জা আর ত্রপা আঁকড়ে ধরলো তাকে। নতুন বউয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছে। তানজিফের বুক ছেড়ে আসতে চাইলো কিন্তু চেয়েও পারলো না। অদৃশ্য এক মোহ মায়ায় আটকা পড়ে গেলো। তানজিফের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। খুব কাছ থেকে এই প্রথম সে তানজিফকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগে।
দেয়ালঘড়ির দিকে নজর পড়তেই চোখ চরাক গাছ পুষ্পিতার। কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে। জিভে কামড় দিয়ে লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে সে। পুষ্পিতা উঠার সাথে সাথে তানজিফও বসে পড়ে। আহাম্মকের মতো পুষ্পিতার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। বুকে জ্বালা করতেই উন্মুক্ত বুকে নেত্রপাত করল সে। পুষ্পিতার নখের আচরে চামড়া ছিলে গিয়েছে অনেকখানি। নাকমুখ কুঁচকে সামনের দিক তাকাতেই দেখলো পুষ্পিতার ছায়াটুকুও নেই।
________________________
পরোটা বাজছেন সুমনা এহমাদ। ডিম পোঁচ করার ফ্রিজ থেকে ডিম বার করতেই সামনে এসে পুষ্পিতা দাঁড়াল। এক কানে ধরে চোখ খিঁচে বন্ধ করে অপরাধীর স্বরে বলল,
‘স্যরি স্যরি মামনি। কিভাবে এতো বেলা হয়ে গেলো একেবারেই টের পাইনি।’
‘হয়েছে হয়েছে আর ঢং করতে হবে না। এসব করেই মন গলাও।’
চমত্কার হেসে আফসানা হককে কিছু বলার আগেই পিছনে এসে দাঁড়ায় তানজিফ।
‘এতো তিরিং বিরিং করিস কেন? দেখি চেক করতে দে।’
তানজিফের উন্মুক্ত বুকে সদ্য দেওয়া আঁচড়ের দাগ দৃষ্টিগোচর হতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সুমনা এহমাদ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললেন,
‘তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে আসি। একটু পরে অফিসের সময় হয়েছে বলে চিৎকার করবে।’
দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করেন তিনি।
পুষ্পিতার কপালে হাত দিয়ে দেখল জ্বর আছে কি না। তাপমাত্রা স্বাভাবিক মনে হতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল তানজিফ।
‘সারারাত জ্বালিয়ে মা’র’লি আমাকে। নিজের সাথে মিশিয়ে রাখ। একদম ছাড়বি না আমায়,,,,,,’
কপাল কুঞ্চিত করে তানজিফের দিকে তাকিয়ে আছে পুষ্পিতা। কথার আগামাথা কিছু বুঝতে পারলো না।
‘মানে?’
তপ্ত শ্বাস ছাড়ল তানজিফ।
‘না কিছু না। রাতে জ্বর এসেছিলো তোর। এখন আর নেই।’
আর দাঁড়াল না তানজিফ। রুমের দিকে পা বাড়ায়।
চুলোর পাশে রাখা চারটে ডিম হাত নিলো পুষ্পিতা। একটা ডিম পোঁচ করা হয়ে গেলে আরেকটা ফ্রাইপ্যানে দেওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ হতেই তার হাত থেকে ছু মে’রে ডিমটা নিয়ে যান সুমনা এহমাদ। অন্যদিকে তাকিয়ে বলেন,
‘যা গোসল করে আয়।’
সুমনা এহমাদের কথায় তাজ্জব বনে গেলো পুষ্পিতা। বোকার মতো চেয়ে রইলো।
‘কি বললাম, শুনতে পাসনি? যা গোসল করে আয়।’
‘এই সকাল বেলা অকারণে গোসল কেন করবো?’
‘এতো কিছু বলতে পারবনা। গোসল করে তারপর খাবি।’
_________________
ঠান্ডা পানির ছাট লাগতেই আরো জ্বলতে থাকে তানজিফের বুক। নুইয়ে বুকে ফু দিতে লাগল।
‘তোর আবার কি হলো।’
ভয়ে চমকে উঠে তানজিফ। থুথু দিলো বুকে।
‘নিজে নখ দিয়ে করে এখন নিজেই জিজ্ঞেস করছিস?’
‘আমি আবার কখন করলাম?’
তানজিফ রগড় গলায় বলল,
‘সকালে। রাক্ষসী নখ কাটবি তুই।’
সুমনা এহমাদের গোসল করার কথাটা মাথায় আসতেই ত্বরিত গতিতে প্রশ্ন করলো,
‘তুই কি খালি গায়ে নিচে গিয়েছিলি?’
মাথা নাড়ে তানজিফ।
গোসলের রহস্য এতোক্ষণে উদঘাটন করতে পারলো পুষ্পিতা। লজ্জা ফুটে উঠলো তার আনন জুড়ে। জিভে কামড় মনে মনে বলল,
‘ইশ! জীবনে কিছু না করেও আজ এতো বড় লজ্জার মুখোমুখি হলাম।’
_________________________
গুটি গুটি পায়ে দিনগুলো বছরে রূপ নেয়।শরীরে দানা বাঁধে বার্ধক্য। মানুষ ধাবিত হয় মৃ’ত্যু’র দিকে।
বিবাহিত জীবনের একটা বছর গত হয়ে গেলো তানজিফ আর পুষ্পিতার। তবে দু’জনের মাঝে দূরত্ব বিলীন হতে গিয়েও হচ্ছে না। কোথাও যেন মিষ্টি সম্পর্কটা গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে।
আজ পুষ্পিতার ভীষণ ইচ্ছে করছে শাড়ি পড়তে। কালো রঙের জামদানী শাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না। পুরো আলমারী উলোটপালোট করে ফেলেছে। রাগে আলমারি থেকে সব জামা কাপড় সারা রুমে ছুড়তে থাকে। অকস্মাৎ ছোট্ট একটা বক্স পায়ে পড়তেই তার মেজাজ আসমান ছুলো। মনে মনে ভর্ৎসনা করে বক্সটা হাতে নিলো। ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল তার। বক্সটা খুলে বুকের ভেতরটা ধঁক করে উঠলো।
________________
লজ্জায় আড়ষ্ট পুষ্পিতা। মায়ানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।
‘দেখি হাতটা বাড়ান।’
মায়ানের কথায় চমকে উঠলো সে। আড়ষ্ট স্বরে বলল,
‘জ্বি?’
‘হাতটা বাড়াতে বলছি।’
অনড় রইলো পুষ্পিতা। পুষ্পিতার কোনো ভাবাবেগ না দেখে নিজেই পুষ্পিতার হাতটা ধরে। কেঁপে উঠল পুষ্পিতা সমস্ত কায়া। বক্স থেকে ঘড়িটা বের করে পুষ্পিতার হাতে পড়িয়ে দিলো। চোখে চোখ রেখে অনুভূতি মিশ্রিত, নরম স্বরে বলল,
‘আজ এই মুহুর্ত হতে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে কিছু সময় আমার। শুধুই আমার। এই ঘড়িটা আপনাকে তাই মনে করিয়ে দিবে। কমদামি হতে পারে অবহেলায় ঘড়িটা কে ফেলে রাখবেন না কখনো। একজনের ভালোবাসা মিশে আছে এটাতে।’
____________
পুরোনো মিষ্টি স্মৃতি মানসপটে ভাসতেই নির্জীব হাসলো পুষ্পিতা। ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিরস গলায় বলল,
‘ভালোবাসা থাকলে কখনো এভাবে ছেড়ে যেতে পারতেন না মায়ান। আপনি আমাকে কখনো ভালোই বাসেন নি।যা ছিলো চোখের মায়া। যা চোখের আড়াল হলেই মিলিয়ে যায় হাওয়ায়। আপনিও আমার কোথাও নেই মায়ান। মন থেকে আপনার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে অনেক আগে। অন্য কেউ সেই জায়গাটাকে একটু একটু করে নিজের করে নিচ্ছে। কোনো শূন্যস্থান অপূর্ণ থাকে না। কেউ না কেউ ঠিকই পূরন করে দেয়।’
ঘড়িটা হাতে নিয়ে থমথমে, বোধশূন্য হয়ে বিছানায় বসে রইলো পুষ্পিতা। মিষ্টি স্মৃতি গুলো আজ তিক্ত, বিষাক্ত। যত মনে পড়ে তত মনটা বিষাদে ভরে যায়।
‘কি যে পাগলামি করিস না তুই পুষ্পিতা।’
ছড়ানো ছিটানো কিছু জামাকাপড় হাতে নিয়ে বলল তানজিফ।
পুষ্পিতাকে এমন চুপচাপ নীরব দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে তার। দু’পা এগিয়ে পুষ্পিতার সামনে এসে দাঁড়ায়। পুষ্পিতা তখনো অন্যমনস্ক। কাঁধে হাত রাখতেই আঁতকে উঠল সে।
‘তুই ঠিক আছিস? আর হাতে,,,,,,, ‘
‘মায়ানের দেওয়া ঘড়ি।’
চমৎকৃত হলো তানজিফ। চাহনি নিক্ষেপ করলো চোখের দিকে। শুষ্ক মুখশ্রী, ভেজা আঁখি পল্লব। আর কিছু বলার সাহস পেলো না সে। বুকটা ভার হয়ে আসছে তার। এলোমেলো কাপড় গুলো একে একে ভাজ করে রাখলো আলমারিতে।
_________________
কালো জামদানী শাড়িটা পরিধান করে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত পুষ্পিতা। শাড়িটা তানজিফের ইনকামের টাকায় কেনা। প্রথম ইনকাম। ভাবা স্বামী প্রথম উপার্জনে কেনা উপহার। অন্যরকম এক প্রশান্তি। সেজন্য শাড়িটাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছিল সে।
গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল সে। সুমনা এহমাদ মাংসের পাতিল চুলো থেকে নামিয়ে রাখলেন।
‘যা পায়েস রান্না কর।’
এক গাল হেসে এক হাঁড়ি দুধ চুলোয় চাপিয়ে দিলো। দুধ ফুটতেই আধভাঙ্গা চালগুলো দিয়ে দিলো তাতে।
‘তোর সাথে আমার কিছু দরকারি কথা আছে পুষ্পিতা। রুমে চল।’
‘পায়েস বসিয়েছি। এক সেকেন্ডের জন্য কোথাও গেলে দুধ উতলে পড়ে যাবে৷ এখানেই বল কি দরকারি কথা।’
‘আজকের এই বিশেষ দিনে তোকে সারাজীবনের জন্য মুক্ত করে দিতে চাই।’
#চলবে।
#অতঃপর_সন্ধি (২২)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
চুলোর আচঁ কমিয়ে এক ভ্রু উঁচিয়ে তানজিফের অভিমুখে বিকীর্ণ করে সূঁচালো আর তীক্ষ্ণ চাহনি।
‘আমার সবটা জুড়ে তুই থাকলেও তোর কোথাও আমি নেই। হয়তো কখনো জায়গা করেও নিতে পারবো না। এতগুলো বছরেও তোর মনে জায়গা করে নিতে পারলাম না। আমার মতো অভাগা ক’জন আছে বল? তোর মাঝে এখনো মায়ান মিশে আছে। তার মায়া জড়িয়ে আছে তোকে আষ্টেপৃষ্টে। এই মায়া আমি আমার ভালোবাসা দিয়ে কাটাতে পারবো না। তুই চলে যা। তুই যত আমার চোখের সামনে থাকবি তত আমার আকাঙ্ক্ষা বাড়বে।’
তানজিফের অনর্গল বলা একেকটা বাচ্য শুনে গেলো পুষ্পিতা। বহুকষ্টে সে হজম করছে এসব লজিকলেস কথাবার্তা । দাঁতে দাঁত চেপে। রাগে শাড়ি খামচে ধরলো। রাগে, ক্ষোভে গা রিঁরিঁ করছে শরীর।
‘কি লাভ বল এমন একটা সম্পর্কে বাঁধা থেকে? তার চেয়ে ভালো আলাদা হয়ে যাই। নামেমাত্র সম্পর্ক কেবল যন্ত্রণা বাড়ায়। ভালোবাসা পাওয়ার চাহিদা বাড়ায়। অনুভূতি প্রখর হয়। আমি তোদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি। তুই আমার কখনো ছিলি না পুষ্প। কবুল বলেও আমি তোকে পাইনি।’
‘তোর কেন মনে হলো মায়ান এখনো আমার সাথে জড়িয়ে আছে?’ অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো পুষ্পিতা। চুলোর আচঁ সম্পূর্ণ বাড়িয়ে নিমেষহীন ফুটন্ত দুধের দিকে চেয়ে রইলো।
‘মায়ানের দেওয়া উপহার পেয়ে তোর চোখেমুখে আমি যেই হাহাকার দেখেছি তাই সব প্রমাণ করে। তুই মায়ানকে বিয়ে করে নে। আমি মায়ানকে বলবো যে আমাদের মাঝে কোনোরকম স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ছিলো না। সবটাই বন্ধুত্ব আর অভিনয় ছিলো। আমাদের মনের দূরত্ব কমেনি কোনোকালেই।’
দুধ উতলে চুলো নিভে গেলো। দুধের পোড়া গন্ধ নাকে আসলো তীব্রভাবে। পুষ্পিতা ঠাস করে চুলো বন্ধ করলো। দাঁতে দাঁত পিষল।
‘বাহ্! বেশ ভালো সিদ্ধান্ত। তা কবে আমাকে মায়ানের হাতে তুলে দিবি? এমন একটা সুযোগের আশায় তো ছিলাম আমি। যেন সাপও ম’রে আর লাঠিও না ভাঙে।’
কান্না দলা পাকিয়ে গেলো গলায়। নিজের দূর্বলতা দেখাতে চায় না তানজিফ। পুষ্পিতা কত অবলীলায় বলে দিলো, এই সুযোগের আশায় ছিল। ঘনঘন পলক ফেলে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা চালায় সে। সফলও হলো।
‘তোর আর আমার বিচ্ছেদ হয়ে গেলেই।’
সহ্য আর ধৈর্য্যের মাত্রা অতিক্রম করলো পুষ্পিতা। এসব গা জ্বালানো কথা আর নিতে পারলো না সে।ঠাস করে পায়েসের হাড়ি উল্টে ফেলে দিলো মেঝেতে। ছিটকে পায়ে এসেও পড়লো পুষ্পিতার। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো। মেজাজের উত্তাপের কাছে এই উত্তাপ কিছুই না।
এহেম কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেলো তানজিফ। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার মুখেপানে। পুষ্পিতা ধুপধাপ পা ফেলে তানজিফের মুখোমুখি দাঁড়াল।
‘এগুলো পরিষ্কার করে তারপর রুমে আসবি।’
কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে আবারও ফিরে এলো।
‘ওহ্ ধন্যবাদ, আমার এতো বড় উপকার করার জন্য। আপনার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।’
গটগটিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতেই হন্তদন্ত হয়ে এলেন সুমনা এহমাদ। আতঙ্কিত গলায়।
‘ পায়ে ফেলে দিয়েছিস পায়েস? আমি আগেই বলেছি দরকার নেই আমি রান্না করবো। শুনলি না আমার কথা। তা শুনবি কেন? আমি কে?’
পুষ্পিতাকে ড্রয়িং রুমে আর তানজিফকে রান্নাঘর দোরগোড়ায় দেখে দ্রুত কদমে সেদিক গেলেন।
‘নিশ্চয়ই তুই ফেলেছিস? মেয়েটা কত শখ করে বলেছিলো পায়েস রান্না করবে। পায়ে পড়েছে?’
‘কারো কিছু হয়নি মামনি। আসলে আমার ভাগ্য খারাপ। এগুলো তোমার ছেলে পরিষ্কার। তুমি হাত লাগাবে তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।’ থমথমে মুখে কথা গুলো বলে রুমে চলে গেলো।
সুমনা এহমাদ বুঝলেন দু’জনের মনমালিন্য হয়েছে। কৌতুহল মনে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না। শ্বাশুড়ি হয়ে স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত ব্যপারে নাক গলানো দৃষ্টি কটু। তপ্ত শ্বাস ফেলেন। রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলেন। আধ সিদ্ধ চাল আর দুধে মাখামাখি মেঝে।
পুষ্পিতার স্বাভাবিক এর মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ দেখে তাজ্জব বনে গেলো তানজিফ। স্তব্ধ, বিমূঢ় চোখে চেয়ে রইলো পুষ্পিতার যাওয়ার পানে। পুষ্পিতা এমন আচরণ কি হিসেবে গ্রহণ করবে বুঝে উঠতে পারছে না। ঠান্ডা মাথায় নিজের রাগ জাহির করে গেলো মেয়েটা। পুষ্পিতার এই জেদ কি সুখকর কি কিছু?’
____________________
লাগেজ টানতে টানতে নিচে এলো পুষ্পিতা। কঠিন, গম্ভীর মুখ। ড্রয়িংরুমের মাঝটায় এসে দাঁড়ায়। রান্নাঘর থেকে মাত্রই বের হলো তানজিফ। লাগেজ সমেত পুষ্পিতা কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো।
পুষ্পিতা গলা উঁচিয়ে ডাকল সুমনা এহমাদকে। ব্যস্ত পায়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে এলেন তিনি। পুষ্পিতার মতিগতি ভালো ঠেকল না উনার কাছে। বিশাল আকারের লাগেজ নজরে আসতেই তিনি ব্যতিব্যস্ত গলায় প্রশ্ন করেন,
‘এই রাত্তিরে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’
তানজিফের দিকে কঠিন অক্ষপাত করে পুষ্পিতা। দাঁতে দাঁত পিষে রুক্ষ, খর্খরে স্বরে বলে,
‘বাবা বাড়ি। সারাজীবনের জন্য।’
‘কিসব অলক্ষুণে কথাবার্তা। গেলে বাড়াতে যাবি। সারাজীবনের জন্য যাবি কেন?’
‘তোমার ছেলে যেমন আমাকে পাগল পাগল হয়ে সবার মাথা নষ্ট করে বিয়ে করেছে তেমনি বছর ঘুরতেই সব ভালোবাসা উবে গিয়েছে। এখন আর আমাকে ভালো লাগে না। তাই বলেছে আমি যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাই।’
ভ্রু যুগল কুঁচকে গেল সুমনা এহমাদের।
‘পুষ্পিতা ঠিক বলছে তানজিফ?’
কথা বলার জন্য একটু সুযোগ পেতেই হাত ছাড়া করতে চাইলো না তানজিফ।
‘আমি তো এজন্য বলিনি।’
‘তুই ওকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিস কিনা?’
মাথা নুইয়ে ফেলে তানজিফ। তানজিফকে কয়েকটা কঠিন কথা বলতে গিয়েও বললেন না তিনি। পুষ্পিতার কাছে এগিয়ে গেলেন। পুষ্পিতার দু’টো মুঠোবন্দি করে আদুরে স্বরে বললেন,
‘ও বলেছে বলে চলে যেতে হবে নাকি? বাড়িটা ওর? ও বানিয়েছে? এটা তোর বাড়ি। তুই থাকবি না কে থাকবে?’
‘যার হাত ধরে এবাড়িতে এসেছি সে বলেছে চলে যাওয়ার কথা। হাজারটা অজুহাত দেখালেও আমি থাকবো না। তোমার ছেলের যাকে চোখে ধরেছে, যেখানে তার মন আটকেছে তাকেই বিয়ে করতে বলো।’
নিজের হাত দু’টো ছাড়িয়ে সদর দরজার পানে পা বাড়ায় সে। তানজিফ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো কি ঘটনা পুরো হয়ে গেলো উল্টো। নির্বোধ, বোকার মতো চেয়ে রইলো।
সুমনা এহমাদ কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। তাজওয়ার নওশাদও এখনো ফিরেননি। দ্রুত পায়ে তানজিফের কাছে গেলেন।
‘মৌচাকে ঢিল ছুড়তে মজা লাগে কিন্তু সামলানোর ক্ষমতা নেই। মেয়েটাকে আটকা না হয় পিছু পিছু যা।’
সুমনা এহমাদের কথায় পা থেমে গেলো পুষ্পিতার।
‘কেউ আমার পিছু পিছু এলে গাড়ির নিচে মাথা নিতে আমি দু’বার ভাববো না।সারাজীবনের মতো সবাইকে মুক্ত করে দিয়ে যাবো।’
_________________
কলিংবেল চাপার সাথে সাথে খুলে গেলো দরজা। আফসানা হক যেন কলিংবেল বাজার অপেক্ষায় ছিলেন।
‘ছেলেটার সাথে কি নিয়ে ঠুকাঠুকি লেগেছিস?
চৌকাঠ মাড়াতেই পা থেমে গেলো পুষ্পিতার। দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে গেলো।
‘মামনি নিশ্চয়ই বলেছে? আবার আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?’
‘মেয়েদের এতো জেদ ভালো না।’
‘ওবাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছি। এখন এবাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবো নিজেও জানি না। ফিরে গেলে কিন্তু সারাজীবনেও খুঁজে পাবে না।’
দরজা সরে দাঁড়ালেন তিনি। পুষ্পিতা লাগেজ ঠেলতে ঠেলতে ভেতরে গেলো। দরজা আটকে চাপা স্বরে বললেন,
‘রাতের বেলা কাউকে সাথে না নিয়ে চলে এলি। রাস্তায় কোনো বিপদ হলে? দিনকাল এমনি ভালো না।’
‘বিপদ হয়নি তো? শুন মা, মেয়েরা জেদ সব সময় করে না। কিছু কিছু কথা শুনলে মনের সুপ্ত জেদটাকে আর দমিয়ে রাখা যায় না।’
______________
মোবাইল সুইচঅফ করে রুমের মধ্যে ঘাপটি মে’রে বসে আছে পুষ্পিতা। তানজিফের কথাগুলো মনে পড়লেই মাথার মধ্যে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ইচ্ছে করছে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিতে। যদি রাগটা একটু কমে। ওই ঘড়ি কবে সে ও বাড়িতে নিলো সেটাই মনে করতে পারছে। ধীরে ধীরে রাগটা গিয়ে জমা হচ্ছে মায়ানের উপর। ক্ষণিকের ভালো লাগা এখন যত যন্ত্রণা আর অশান্তির কারন। এই একটা মানুষ তার জীবনটাকে উলোটপালোট করে দিলো।
দরজায় কড়াঘাতে চমকে উঠলো সে। বাইরে থেকে আফসানা হক ডেকে চলেছেন।
‘একদম বিরক্ত করবে না মা। মন মেজাজ এমনিতে ভালো নেই।’
‘ও বাড়িতে থেকে ফোন করেছে।’
‘বলে দাও আমি এসে গিয়েছি।’
‘বলেছি বিশ্বাস করছে না। তোর সাথে কথা বলতে চায়।’
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজা খুলে দিলো পুষ্পিতা। আফসানা হকের হাত থেকে মোবাইল ছু মে’রে নিয়ে ঠাস করে দরজা আঁটকে দিলো।
মোবাইল কানে ঠেকালো। ফুস ফুস শব্দ কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই তানজিফ নত স্বরে বলল,
‘স্যরি!’
নির্বাক রইলো পুষ্পিতা। তানজিফের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র স্পৃহা তার নেই। আজকের এই সুন্দর দিনে তার মেজাজ বিগড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই ছেলেটা।
‘আসলেই তুই উনার দেওয়া উপহারটা হাতে কাঁদছিলি তো তাই।’
‘তো? তাই তুই তোর মনগড়া কাহিনি বানিয়ে নিলি। ভেবে নিলি আমি এখনো মায়ানের জন্য দিওয়ানা। পাগল হয়ে আছি উনাকে পাওয়ার জন্য। তাই তো?
নিস্তব্ধ রইলো তানজিফ। এখন কিছু বললে পুষ্পিতা আরো রেগে যাবে।
‘শুন তানজিফ, আমার চোখ বেয়ে যত ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে আর যত সেকেন্ড ব্যয় করে আমি এ বাসায় এসেছি সব কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করে রেখেছি। সবকিছুর শোধ আমি তুলবো। পরপুরুষের হাতে বউকে তুলে দেওয়ার তোর বড্ড শখ না? আমি পুষ্পিতা দেখে নিবো তোর সহ্য ক্ষমতা ঠিক কতটুকু।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।