#অতঃপর_সন্ধি (১৯)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
কি উত্তর দিবে ভেবে পেলো না তানজিফ। সত্য বলল বাবা স্নেহ থেকে বঞ্চিত হবে পুষ্পিতা। আশহাব শেখ মুখ ফিরিয়ে নিবেন সারাজীবনের জন্য। বাবা আর মেয়ের মাঝে তৈরি হবে অদৃশ্য দেয়াল। যা তানজিফ কখনো চায় না। মনে মনে উত্তর তৈরি করতে ব্যস্ত সে।
‘উত্তর দিচ্ছো না কেন তানজিফ? পুষ্পি কি অন্যকারো সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে ছিলো?’
তানজিফ মাথা নুইয়ে কম্পমান গলায় জবাব দিল, ‘না।’
‘তাহলে তোমায় প্রত্যাখান কেন করেছিলো? প্রত্যাখান করার কারন তো থাকবে।’
শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো তানজিফ। মনে মনে তৈরি রাখা উত্তরটা ঠোঁট গলিয়ে বেরিয়ে এলো।
‘আপনি জানলে কষ্ট পাবেন তাই। আপনাকে কষ্ট দিয়ে ও কিছু করতে চায়নি। যা হবে আপনার অনুমতি নিয়ে।’
থমথমে আনন জুড়ে প্রস্ফুটিত হলো বিস্তীর্ণ হাসি। সেই হাসিতে আছে সন্তুষ্টি আর পরিতৃপ্তি। ঠোঁটের হাসিটা আরো চওড়া করে আশহাব শেখ তাজওয়ার নওশাদকে প্রশ্ন করলেন,
‘নওশাদ ভাই আপনি বিয়ের প্রস্তাব কি ছেলের পাগলামি দেখে নিয়ে এসেছেন? নাকি আপনি চান এমনটা হউক?’
‘মানুষ বরাবরই চায় ভালো কোনো পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করার জন্য। আমার ছেলেটা কিন্তু এখনো বেকার ভাই।’
‘ছেলে মেয়ে দুইজনে একসাথে মাস্টার্স কমপ্লিট করুক।আমিও নিশ্চিন্ত থাকি আমার মেয়েটা একটা ভালো পরিবার পাবে।’
_____________________
‘আমি কিন্তু তোর কথা রেখেছি। তোর বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই হাজির হয়েছি পরিবার নিয়ে।’
দু’কদম এগিয়ে দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব আরো একটু কমিয়ে নিলো তানজিফ। ব্যকুল, কাতর, ব্যগ্র স্বরে পুনরায় কন্ঠনালী দিয়ে উচ্চারিত করলো,
‘পুষ্পিতা করবি তো আমায় বিয়ে? হবি তো সারাজীবনের জন্য আমার?’
সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল পুষ্পিতার। কাতর স্বরে বলা একেকটা নিগদের ঝংকার বিদ্যুৎ এর ন্যায় প্রবাহিত হলো কায়া জুড়ে। সহসা পুষ্পিতার চোখের পাতা ভেদ করে বারিবিন্দু গাল ছুঁয়ে দিলো নিবিড়ভাবে। অতি সন্তর্পণে সেই পানি মুছে নিলো পুষ্পিতা। কম্পান্বিত স্বরে থেমে থেমে বলল,
‘আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে কখনো তোর বিবেক তোকে প্রশ্ন বিদ্ধ করবে না, তোর বউ অন্য কাউকে ভালোবাসতো?’
‘করুক, বিবেক প্রশ্ন করলে আবার বিবেক উত্তর খুঁজে বের করবে। আমি শুধু জানি, যাকে আপন করে চেয়েছি তাকে পাওয়ার জন্য আল্লাহ আমাকে সুযোগ করে দিয়েছে। সেই সুযোগ কে আমার কাজে লাগাতে হবে।’
নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে আশপাশ।
‘তোর কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে।’
‘কী’
‘কখনো তোর ভালোবাসা তোর কাছে ফিরে এলে। কি করবি? ছেড়ে যাবি আমাকে?’
ফিচেল হাসলো পুষ্পিতা। তানজিফের দিকে মুখ করে দাঁড়াল।
‘আমার চোখের দিকে তাকা।’
অপ্রত্যাশিত অনুমতি পেয়ে পুষ্পিতার চোখের দিকে অপলক, অনিমেষ তাকিয়ে রইলো তানজিফ।
‘কিছু বুঝলি?’
নিরুত্তর তানজিফ। চোখ জোড়ায় তখনো দৃষ্টি নিবদ্ধ।
‘আমি কিন্তু তোর চোখে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছি। তোর চোখের ভাষা কিন্তু আমার কাছে স্পষ্ট। বাদ দে সেসব কথা। মায়ান কখনো আমার পায়ে এসে পড়ে থাকলেও আমি কখনো ওর কাছে ফিরবো না। কখনো সখনো মানুষের কথার আ’ঘা’ত তরবারির আ’ঘা’তের চেয়েও গভীর হয়। ব্যথা বেদনা ছড়িয়ে পড়ে সর্বাঙ্গে। বেখাপ্পায় মুখনিঃসৃত বচন দূরত্ব সৃষ্টি করে। আর জেনে-বুঝে কিছু বললে তো ক্ষমার অযোগ্য তা। মায়ান তার আর আমার মাঝে দূরত্বের যে উঁচু দেয়াল তৈরি করেছে তা দূর্ভেদ্য। যতদিন যাচ্ছে সেই দেয়াল তত দৃঢ় আর মজবুত হচ্ছে। যতই ভালোবাসার আমর্ষ দেওয়া হউক না কেন, যতি স্পর্শানুভূতি প্রভাবিত করুক না কেন এই দেয়াল ভাঙবে না। স্বয়ং মায়ানও অপারগ সেই দেয়াল ভেদ করতে। দু’জনের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচবে না আজীবন।’ একনাগাড়ে কথা গুলো বলে উষ্ম শ্বাস ফেলে পুষ্পিতা। ঢুক গিলে গলায় ভিজিয়ে নিলো। বিবর্ণ হেসে পুনরায় বলল,
‘বিয়েটা কিন্তু ইদানীং এর মাঝে হতে হবে। তুই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি তোকে বিয়ে করবো না। আমি একটা বেকার ছেলের হাত ধরতে চাই দৃঢ়ভাবে। সবাইকে কিভাবে ম্যানেজ করবি তুই জানিস।’
‘আমাকে এভাবে বাঘের মুখে ফেলিস না। এমনিতে বহু কষ্টে বেঁচে ফিরেছি।’
‘কষ্ট করে কিছু অর্জন করলে তার গুরুত্ব থাকে আজন্ম।’
‘একজনের সাথে জেদ করে বিয়ে করছিস আমায়। সারাজীবন আমার সাথে থাকতে পারবি?’
‘আমার জেদটা ভালোবাসায় বদলে নিস।’
________________
মেহমানে গিজগিজ করছে পুরো বাসা। মরিচ বাতির ঝলকানিতে ঝকমক করছে বাহির। আশহাব শেখ অসুস্থ শরীর নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। বিশ্রাম নেওয়ার ফুসরত পাচ্ছে না একটু। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। এক সপ্তাহের বিয়ের আয়োজন করা চাট্টিখানি কথা না। ছেলেটাকে হাজার বলেও বুঝাতে পারেনি কেউ। জেদ ধরে বসে ছিলো। তিনিও মনে মনে পণ করেছেন, ‘ নাতিনাতনি হলে তিনিও এভাবে ছেলেটাকে নাকানিচুবানি খাওয়াবেন। তখন বুঝবে কেমন মজা।’ ভেবেই হেসে ফেলেন তিনি। খুড়িয়ে খুড়িয়ে ক্যাটারিং এর দিক টায় গেলেন। একটু বাদে তানজিফ এসে হাজির হবে বরবেশে।
বউ সেজে খাটে মধ্যমনি হয়ে বসে আছে পুষ্পিতা। ভারী সাজে অস্বস্তি হচ্ছে তার। নতুন এক অনুভূতির বর্ষণ হচ্ছে অন্তঃদেশে। সেই সাথে হচ্ছে জ্বলন। মিশ্র অনুভূতিতে সিক্ত সে।
গাড়ির হর্ন শুনে রুমের উপস্থিত সবাই দৌড়ে চলে গেল বর দেখার জন্য। গুটি গুটি পায়ে পুষ্পিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক।
‘আজকের এই সাজটা আপনার জন্য হতে পারতো মায়ান। তবে আপনি তার যোগ্য না। আমি সেজেছি সেই মানুষটার জন্য সবকিছুর উর্ধে গিয়ে যে আমাকে চায়। কয়েক মুহুর্ত পর হতে আমি শুধু মিসেস তানজিফ নওশাদ। আমি ছেলেটাকে ভালোবাসতে চাই। ছেলেটার অনুভূতির বর্ষণে ভিজতে চাই। মিশে যেতে চাই ঘনিষ্ঠভাবে।’
‘মানুষের চাওয়া যদি পবিত্র হয় তা অবশ্যই পূর্ণতা পায়।’
জারিনের অপ্রত্যাশিত কথায় কেঁপে ওঠে পুষ্পিতা। জারিন পুষ্পিতার দু কাঁধে হাত রেখে আরশীর দিকে ইশারা করল।
‘আজকের সাজটা তোর তানজিফের জন্য। ছেলেটার এতোদিনের করা সকল পাগলামি একটু পরেই পূর্ণতায় রূপ নিবে।’
‘জারিন আমি কি স্বার্থপরের মতো কোনো কাজ করছি?’
‘নিজের সুখের জন্য সবাই স্বার্থপর। একটু ভালো থাকার জন্য এতকিছু। তবে তানজিফকে একটু ভালোবাসিস।’
পুষ্পিতা পিছন ফিরে জারিনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো।।
‘তোর সকল মোনাজাতে আমায় একটুখানি রাখিস। অভিশপ্ত অতীত ভুলে আমি যেন ছেলেটার আবেগ, অনুভূতির মূল্য দিতে পারি।’
জারিন পুষ্পিতার থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে কপালে চুমু দিলো।
‘পারবি।’
_________________
নতজানু পুষ্পিতা। পাতলা পর্দার অপর পাশে তানজিফ। কাজি সাহেব তাগাদা দিচ্ছেন কবুল বলার জন্য। কন্ঠনালী কাঁপছে পুষ্পিতা।গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না কিছুতেই। দম ফাটা চিৎকার দিতে ইচ্ছে করছে তার। আজকের পর সে এই বাসার মেহমান। চোখের কোণে পানি জমছে একটু একটু করে। কাজি সাহেব আবারও বললেন কবুল বলার জন্য। পুষ্পিতা চুপ রইলো। জারিন ফিসফিসিয়ে বলল,
‘বলছিস না কেন? সবাই অপেক্ষা করছে।’
পুষ্পিতা চোখ বুঁজে এক নিঃশ্বাসে তিনবার কবুল বলে। তানজিফ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
বিয়ে পড়ানো শেষে মাঝের পর্দা সরানো হলো। ভেজা আঁখি পল্লবে পুষ্পিতা চাইলো তানজিফের দিকে। তানজিফের আঁখি জোড়া তার মাঝেই নিবদ্ধ। তানজিফের চোখে চোখ রেখে পুষ্পিতা মনে মনে আওড়াল, ‘কবুল বলে আজ থেকে আপাদমস্তকে আমি শুধু তোর।’
_________________
কাশির শব্দে ধ্যান ভগ্ন হয় দু’জনার। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে চাইলো পুষ্পিতা। তবে তখনো চাহনি স্থির ছিলো তানজিফের। জারিন রগড় গলায় বলল,
‘আশেপাশে নজর দে ভাই। বড়রা উপস্থিত এখানে। এমন বেহায়াপনা করলে হয় নাকি। বাসরঘরে বউকে মনপ্রাণ ভরে দেখিস।’
বিদায়বেলা!
আশহাব শেখের বুকের সাথে লেপ্টে আছে পুষ্পিতা। আজকের পর বাবাকে আর চোখের সামনে রোজ দেখবে না। আর না তাকে সময়ে অসময়ে মা বলে ডাকবে। কলিজা ফেটে যাচ্ছে তার। আশহাব শেখ বুক থেকে ছাড়াতে গেলে পিঠ খাঁমচে ধরে পুষ্পিতা। উল্টো হাতে চোখ মুছেন তিনি। একহাতে মেয়েকে বুকে আগলে ধরে অন্যহাতে তাজওয়ার নওশাদের একটা হাত ধরলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন,
‘আমার মেয়েটাকে আগলে রাখবেন ভাই। আমার বুকের মানিক আপনার হাতে তুলে দিলাম।’
অদূরে আঁচল চেপে নিঃশব্দে কাঁদছেন আফসানা হক। মেয়ের সামনে যাওয়ার সাহস টুকু নেই। এটা-ওটা বলে সান্ত্বনা দিয়েও বুঝ মানাতে পারছেন না সুমনা এহমাদ। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে গেলেন তিনি। কপাল কুঁচকে বিরক্তির বললেন,
‘তুই এমনভাবে কাঁদছিস যেন মেয়েকে নিয়ে গিয়ে আমি বেচে দিবো।’
চোখ রাঙানি দিলেন আফসানা হক।
ধীরপায়ে মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন আফসানা হক। চক্ষু জোড়া লাল। কান্নার রেখা স্পষ্ট। পুষ্পিতা ফুঁপিয়ে উঠে মায়ের বুকটা আঁকড়ে ধরলো। বুক ফাঁটা আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। অশ্রুসিক্ত চক্ষু জোড়া ফারদিনকে খুঁজতে ব্যস্ত পুষ্পিতা। এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাইকে খুঁজলো কিন্তু হদিস পেলো না।
একটু নির্জন স্থানে গিয়ে হেঁচকি তুলে কাঁদছে ফারদিন। বোনের জন্য মন কেমন করছিলো তার। কিন্তু সবার সামনে কাঁদতে তার কেমন লজ্জা করছিল। আকস্মিক কারো ছোঁয়ায় কেঁপে উঠল সে। তিতির তার দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে আছে। ফারদিন তড়িঘড়ি করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে চোখ মুছে নিলো। তিতির সরল মনে প্রশ্ন করলো,
‘তোমার বিয়ে হয়ে গেলেও কি তুমি এভাবে কাঁদবে?’
_____________________
তানজিফের রুমটায় পুষ্পিতা বসে আছে ঘন্টা পেরোতে চলল। বসে থাকতে থাকতে কোমর ব্যথা হয়ে গেলো তার।দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসল সে। তানজিফ তার সম্মুখে এসে বসল। তানজিফ তার দিকে হাত বাড়াতেই নিজেকে গুটিয়ে নিলো পুষ্পিতা। স্মিত হাসলো সে। পুষ্পিতা মেহেদী রাঙা দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। তালুর মধ্যে তানজিফ নামের গাঢ় রং। দৈবাৎ তানজিফ পুষ্পিতার মেহেদী রাঙা হাতে নিজের ঠোঁটের উষ্ম স্পর্শ দিলো। কেঁপে উঠল পুষ্পিতা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। কেঁদে উঠলো তানজিফ। পুষ্পিতা যেন স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে আকস্মিক কান্ডে। আহাম্মকের ন্যায় তাকিয়ে রইলো অপলক।
‘তুই কবুল বলার সাথে সাথে আমার ইচ্ছে করছিলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরি।’
পুষ্পিতার হাত দু’টো ছেড়ে একটু দূরে সরে এলো।
‘জানি তোর মনের কোথাও আমি নেই। যেদিন আমি তোর মনের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে পারবো সেদিন আমি তোকে ছুঁয়ে দিবো নিবিড়ভাবে। সকল দূরত্ব মিটিয়ে নিবো। তোর সর্বাঙ্গে থাকবে আমার বিচরণ। ছুঁয়ে দিবো আমি আর কল্পনায় থাকবে অন্যকেউ। আমি তা সহ্য করতে পারবোনা। অপেক্ষায় রইলাম।’
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
#অতঃপর_সন্ধি (২০)
রূপন্তি রাহমান (ছদ্মনাম)
মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এলো পুষ্পিতা। চেহেরায় ফুটে ওঠেছে স্নিগ্ধতা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধছিল তানজিফ।পুষ্পিতাকে দেখে বিস্তীর্ণ হাসলো সে। পুষ্পিতা তানজিফের সামনে এসে দাঁড়ায়। তানজিফ ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করলো, কী?
তানজিফের টাই বেঁধে দিতে দিতে নতজানু হয়ে কোমল গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ফিরবি কখন?’
পুষ্পিতার ব্যস্ত, পিটপিট করতে থাকা চক্ষু জোড়ার পানে নিমেষহীন তাকিয়ে রইলো তানজিফ। শরীরের দূরত্ব একটু একটু কমছে।মনের দিক থেকে দূরত্ব কতটুকু কমেছে তা জানা নেই তার।
‘আগে ব্যাংকে যাবো। টাকা তুলবো তারপর যাবো মালামাল কেনার জন্য। সেগুলো শো-রুমে রেখে তারপর আসবো বাসায়। রাত দশটা বাজতে পারে।’
টাই বাঁধা হয়ে গেলে পুষ্পিতা আলমারির গোপন ড্রয়ার থেকে গয়নার বাক্স বের করে। গয়নার বাক্সগুলো তানজিফের হাতে দিলো সে।
‘তোর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুদ্ধে আমিও সঙ্গী হতে চাই।’
বাক্স হাতে নিলো সে। খুলে দেখল কি কি আছে। অতঃপর সেগুলো বিছানার উপর রেখে পুষ্পিতার একটা হাত আলতো করে নিজের মুঠোবন্দি করল। হাতের উল্টোপিঠে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিল কোমলভাবে।
‘এই যে হাতের মালিক আমার হাতটা সারাজীবনের জন্য ধরেছে শক্তপোক্ত করে অটল আর দৃঢ়ভাবে। এটাই ঢের। এটাই আমার অনেক বড় সাপোর্ট। আর কিছু লাগবে না। মানুষটা আমার পাশে থাকুক শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার আর কোনো চাওয়া নেই।’
‘রাখ না আপাতত। তোর একটু হেল্প হবে।’
পুষ্পিতার নাক টেনে দু কাঁধে হাত রাখে তানজিফ।
‘না ম্যাম লাগবে না। যদি কখনো লাগে তখন বলবো।’
তৎপরে পুষ্পিতাকে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ায়। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে দু’হাতের আঙুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে দু’হাত মুঠোবন্দি করে নিলো পুনরায়।
‘ আরশীতে থাকা মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছিস?সে আমার মনের রানী। দোয়া কর, মনের রানীকে যেন বাস্তবেও রানীর মতো সোনাগয়না দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে পারি। বহুদিনের সাধনা সে আমার।’
কপালের একপাশে দীর্ঘ চুম্বন করে স্থান ত্যাগ করে দ্রুত।
নিজের প্রতিবিম্বকে দেখতে ব্যস্ত পুষ্পিতা। লালাভ চোখ জোড়ায় পানি টইটুম্বর। উন্মুক্ত পাপড়িদ্বয় পানির ভার সইতে না পেরে মিলিত হতেই গাল আলিঙ্গন করলো বারিবিন্দু। বুক ভেঙে আসছে তার। আঙুল দিয়ে নিজের প্রতিবিম্বকে স্পর্শ করলো সে।
‘ভালোবাসার সমীকরণ মিলাতে তুই বড্ড আনাড়ি পুষ্পিতা। পাগলাটে ছেলেটার ভালোবাসা আগে উপলব্ধি করতে পারলে আজ এভাবে দগ্ধ হতি না প্রণয়ের দহনে। তুই পুড়তি না। সুখের জোয়ারে ভাসতে গিয়েও পারছিস না তুই। কোথাও কিছু একটা নেই। কিছু একটার শূন্যতা অন্তর্দেশে।’
_______________
ক্লান্ত, অবিশ্রান্ত তানজিফ। ক্লান্তিতে মুদে আসছে চোখ জোড়া। হাত থেকে ঘড়িটা খুলতে খুলতে বিছানার দিকে নজর বুলালো। ছটফট করছে পুষ্পিতা। বালিশ একবার মাথার উপর দিচ্ছে তো আরেকবার মাথার নিচে। কোনোমতে স্বস্তি পাচ্ছে না। তানজিফ ডাকল তাকে।
‘পুষ্পিতা?’
পুষ্পিতা ভারী গলায় জবাব দিলো, ‘হুম।’
‘কিছু হয়েছে তোর?’
খানিক চুপ থেকে উত্তর দিলো,
‘না।’
বিশ্বাস হলো না তানজিফের। পুষ্পিতার দিকে চেয়ে রইলো অপলক। শরীরে ধূলোবালি গিজগিজ করছে বলে কাছেও যেতে পারছে না। তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খাটে এসে বসল তানজিফ। কয়েকবার ডাকল সে পুষ্পিতাকে। কোনো সাড়াশব্দ পেয়ে পুষ্পিতার গা স্পর্শ করল।
দৈবাৎ পুষ্পিতা ফুঁপিয়ে উঠে তানজিফের কোমর জড়িয়ে ধরল। হতবিহ্বল হয়ে গেলো তানজিফ। পুষ্পিতা জড়িয়ে ধরায় শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো তার। ফাঁকা ঢুক গিলে পুষ্পিতার মাথায় আদরের সহিত হাত বুলিয়ে দিতে লাগে।
‘কি হয়েছে না বললে বুঝবে কিভাবে?’
কান্নার প্রভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছে পুষ্পিতার শরীর।
জোর করে টেনে পুষ্পিতার মাথা উপরে তুলে তানজিফ।
ভেজা নেত্রচ্ছদ ফোলে আছে। কপালের ছোট ছোট চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা মুখ জুড়ে। নাকের ডগা লাল। বাদে বাদে নাক টানছে সে। এলোমেলো সেই চুল পরম যত্নে কানের পিছনে গুঁজে দিলো তানজিফ। মুখটা হাতের আঁজলায় নিয়ে আহ্লাদী স্বরে সুধাল,
‘কাঁদছিস কেন?’
আরো একটু আহ্লাদ পেতেই পুষ্পিতার কান্না মাত্রা বাড়লো যেন।
‘মাথা ব্যথা করছে।’
গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছে দিয়ে পুনরায় তানজিফ বলল,
‘তাই বলে বাচ্চাদের মতো কাঁদবি?’
‘আর সহ্য করতে পারছি না।’
উষ্ম শ্বাস ফেলে তানজিফ।
‘দিনে কান্না করেছিলি কেন?’
দৃষ্টি নত করে ফেলে পুষ্পিতা। জবাব দিল না সে।
‘গত তিনটা মাস এক ছাদের নিচে থাকার পর তোর অনেক অভ্যাস বদ অভ্যাস সম্পর্কে অবগত হয়েছি আমি। কাঁদলে তোর মাথা করে। অনবরত কান্নার ফলে এখন তা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। আচ্ছা বাদ দে। আম্মুকে বলেছিলি বা ঔষধ খেয়েছিস?’
এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে জবাব দিল, ‘না।’
তানজিফ ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
‘কেন?’
‘সারাদিন বা সন্ধ্যায় এতো ব্যথা ছিলো না। রুমে আসার পর বেড়েছে।’
‘আমার বুকে মাথা রাখবি? আমি তোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিবো। দেখবি ঘুম চলে আসবে।’
তানজিফের মুখপানে চেয়ে রয় পুষ্পিতা। কোনো প্রকার জবাব ছাড়া। পুষ্পিতা জবাব না দেওয়াতে ফিচেল হাসলো সে।
‘থাক তবে। বুকে মাথা রাখতে হবে না। তুই তোর বালিশে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি মুভটা নিয়ে আসি আর লাইট অফ করে আসি। আলোতে ঘুম আসবে না তোর।’
লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে সে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসতেই একটু স্বস্তি পাওয়ার লোভে তানজিফের বুকের এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে পুষ্পিতা। তানজিফকে কোনো কিছু ভাবার ফুরসত দিলো না । চোখ বুঁজে বলল,
‘আমি ঘুমাবো৷ ডাকবিনা একদম।’
আঙুলের ডগায় একটু মুভ নিয়ে পুরো কপালে মালিশ করে দিতে লাগল সযত্নে। মুভ দেওয়া শেষ হলে চুলে বিলি কেটে দিলো। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস ভারী হতেই বুঝতে পারলো পুষ্পিতা ঘুমিয়ে পড়েছে। তবুও চুলের ভাঁজ হতে হাত সরালো না তানজিফ। দগ্ধ, উত্তপ্ত বক্ষঃস্থলে শীতলতা বিরাজ করছে শুধু এই মেয়েটা বুকে মাথা রেখেছে বলে। বুকের ছাতির সাথে পুষ্পিতার মাথাটা আরো একটু চেপে ধরে।
‘মনের বিশাল দূরত্ব কমছে কি পুষ্প?’
______________________
খুব সন্তর্পণে পুষ্পিতাকে বালিশে শুইয়ে দিল তানজিফ। ল্যাপটপ নিয়ে বসল কি কি অর্ডার এসেছে তা দেখার জন্য। একের পর এক অর্ডারের মেসেজ দেখে ওষ্ঠদ্বয় প্রশস্ত তার। চোখেমুখে উৎফুল্লতা ছড়িয়ে পড়ে। কাল বিলম্ব না করে নিজের পার্টনারকে ভিডিও কল করে তানজিফ। সময়ও দেখলো না যে কত রাত হলো। রিসিভ হতে মৃদুস্বরে চিৎকার করে উঠলো সে। পুষ্পিতার কথা মনে পড়তেই সামলে নিলো নিজেকে।
‘দুস্ত অর্ডার দেখেছিস?’
আশিক উত্তর দিলো,
‘দুস্ত আমার তো চোখ কপালে। গতবারের চেয়ে বেশি। আল্লাহ এইবার মুখ তুলে চাইবে।’
কথা বলার মাঝেই ঘুমন্ত পুষ্পিতা পুনরায় তানজিফের কোমর প্যাঁচিয়ে ধরলো। ল্যাপটপের মৃদু আলোতে মেয়েলি হাত দৃষ্টিগোচর হতেই মুখ টিপে হাসল আশিক। অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করে তানজিফ।
‘তোদের রোমান্স দেখানোর জন্য আল্লাহ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। বন্ধু মানুষ বউ নিয়ে ঘুমায় আর আমি এখনো মোবাইল নিয়ে।’
‘চুপ শা’লা। আমি তোর মতো লু’চ্চা না। আগে বউ ভালোবাসবে তারপর,,,,,,,,,,,’
অপর পাশ থেকে তানজিফের দিকে সূঁচালো দৃষ্টিতে নিমেষহীন চেয়ে রইলো আশিক।
‘পুষ্পিতার উপর সম্পূর্ণ অধিকার তোর। কেউ একজন ছিলো কোনো এক সময় ওর জীবনে। তাই বলে নিজেকে এভাবে গুটিয়ে নিবি? মানুষের শারীরিক চাহিদা বলতেও তো কিছু একটা থাকে নাকি?’
আশিকের কথায় ফিচেল, নিরস হাসলো তানজিফ। নেত্রপাত করল ঘুমন্ত পুষ্পিতার মুখপানে।একহাতে খুব সাবধানে আগলে নিলো পুষ্পিতাকে।
‘চাইলেই অধিকার ফলানো না।অধিকার আদায়ও করা যায়। কিন্তু অন্তর্দেশে অনুভূতির বীজ বপন করা যায় না। আমি চাই ও আসুক।আমার সাথে মিশে যাক। দু’জনের মধ্যকার কোনো দূরত্ব মিটে যাক। তবে সেটা সম্পূর্ণ পুষ্পিতার ইচ্ছেয়। শারীরিক চাহিদার অজুহাতে অধিকার ফলাতে গিয়ে ওর মনে নেতিবাচক কোনো ধারণা আমি দিতে চাই না।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে খুব সাবধানে পুষ্পিতা ঘনকালো কেশে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।
গালে হাত দিয়ে তানজিফের কথা মনযোগ দিয়ে শুনে গেলে আশিক।
আবছায়া আলোতে পুষ্পিতার দিকে চাহনি স্থির রেখে পুনরায় বলল,
‘আমার তো এখনো বিয়ে করার কোনো প্লানিং ছিলো না শুধু মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য শত পাগলামি। কবুল শব্দটাকে আমি খুব বিশ্বাস করি। এর অদৃশ্য এক শক্তি থাকে। যা দুই প্রান্তের দুজন মানুষকে রূপান্তর করে একজনে ।অচেনা অজানা মানুষের মধ্যে তৈরী করে ভালোবাসার বন্ধন। আমি অপেক্ষায় আছি, এই কবুল শব্দটার জোরে পুষ্পিতা আমার দু’টো হাত ধরে বলবে, আজ থেকে আমি শুধু তোর।’
আকস্মিক আবারও কেঁপে উঠল পুষ্পিতার শরীর। ভয় পেয়ে গেলো তানজিফ। আতঙ্ক, শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ে সারা মুখ জুড়ে। চোখের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দেখল নেত্রপল্লব ভেজা পুষ্পিতার। অজানা আতঙ্কে বুকটা ধঁক করে উঠে তানজিফের।
#চলবে
ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।