#অতঃপর দুজনে একা – [২১]
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————–
–“আপনি কী চাইছেন বলুন তো? মেয়ে হয়ে নিজের পছন্দের কথা বলবো?”
খোলা আসমান। আকাশে সহস্র তাঁরার মেলা। আকাশের বুকে চাঁদ নেই। হিম হাওয়ায় পরিবেশ নিমজ্জিত। বর্তমানে আয়ন্তি এবং মাহবিন বাগানে অবস্থান করছে। এই বাগানটাই মাহবিন এবং আয়ন্তির বারান্দা থেকে দেখা যেত। এখানে বাড়ির ভেতরের মতো কোলাহল নেই। কীরকম নিস্তব্ধ, প্রাণখোলা পরিবেশ। মাহবিন সেলফোনে জরুরি কথা বলার জন্যে এদিকে এসেছে। আয়ন্তিও তার পিছু পিছু এখানে আসে। কথা শেষে যখন পিছে ঘুরে আয়ন্তিকে দেখলো। তখন মাহবিন একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আয়ন্তির ছটফট করা সেই এক জোড়া আঁখিতে। আয়ন্তির এহেন প্রশ্ন শ্রবণ হলে মাহবিনের কুচকানো ভ্রু আরও কুচকে গেলো৷ বেশ থমথমে গলায় বলে,
–“মানে?”
–“মানে টা আপনি আমার চেয়ে ভালো বুঝেন। নয়তো নীলাকে কখনোই ওসব বলতেন না।”
মাহবিন এবার নিরব থাকলো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। যেন সে সবকিছু সম্পর্কে অবগত। আয়ন্তি নাক টেনে মাহবিনের দিকে দুই ধাপ এগিয়ে গেলো। ঝাপসা নয়নে মাহবিনের চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে শুধায়,
–“আমার মতো ঠুনকো মানুষটিকে কী আপনার হৃদয়ে জায়গা দেয়া যায় না?”
মাহবিন সহজ স্বীকারোক্তির সাথে বললো,
–“শুধু হৃদয়ে কেন? আসো, জীবনেও বিরাট জায়গা দিয়ে দেই।”
আয়ন্তির বিস্ময় যেন আকাশচুম্বী। গোল গোল চোখে মাহবিনের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই যেন হতবুদ্ধি হারিয়ে বসলো সে। কী বললো মাহবিন? ঠিক শুনেছে আয়ন্তি? আয়ন্তির খুব ইচ্ছে হলো হাতে চিমটি দিয়ে ঘোর ভাঙিয়ে নিতে। নিজের কানের প্রতি যে তার তীব্র অবিশ্বাস। আয়ন্তির বো’ কা চাহনি দেখে মাহবিনের গম্ভীর মুখশ্রীতে হাসির রেশ খেলে গেলো। চমৎকার হাসি দিলো মাহবিন। হাসতে হাসতে বললো,
–“কী মনে করেছিলে? ভালো শুধু তুমি-ই বাসতে জানো? আমি পারি না? না পারলে তো তোমায় বিরিয়ানিও পাঠাতাম না। সেদিন তো না খেয়েই দিন কাটাতে।”
আয়ন্তি পুণরায় আকাশ থেকে পরলো। এর মানে কী বিরিয়ানি গুলো মাহবিন পাঠিয়েছে? ব্যস্ততায় বিরিয়ানির কথা ভুলেই গিয়েছে আয়ন্তি। মাহবিন না বললে তো পুরোপুরি ভুলে যেত। আয়ন্তি অস্ফুট স্বরে বলে,
–“আপনি..”
–“শুধু বিরিয়ানি নয়, অনেক কিছুই করেছি। শুধু তুমি বুঝোনি। আমি তো নিরবে ভালোবেসে গেছি তোমায়। চাপা স্বভাবের মানুষ তো, তাই কখনো বলিনি।”
আয়ন্তির চোখের অশ্রু’রা যেন বাঁধ ভেঙ্গে গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। এই অশ্রু তো দুঃখের নয়। মাঝেমধ্যে সুখের আবরণে মানুষ এতটাই উত্তেজিত হয়ে পরে যে তৃপ্তিতে, প্রাপ্তিতে তাদের আঁখিদ্বয়ে অশ্রু’রা ভীড় জমায়। আয়ন্তির হৃদপিন্ড তীব্র শব্দে ওঠা-নামা করছে। মাহবিন তার কনিষ্ঠা আঙুলের সাহায্যে আয়ন্তির গাল ভেঁজানো অশ্রুদের পরম আবেশে মুছে দেয়। আয়ন্তি আবেশে চোখ বুজে ফেলে। এই স্পর্শ তাকে ভীষণরকম সুখ দিচ্ছে। মাহবিন হঠাৎ তার বলিষ্ঠ হাত দ্বারা আয়ন্তির ডান হাতের কব্জি খানা আবদ্ধ করলো৷ আয়ন্তি সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকালো। একবার হাতের দিকে তো একবার মাহবিনের দিকে তাকালো। অস্ফুট স্বরে আওড়ায়,
–“কী করছেন…?”
–“অনুমতি নিবো না বড়োদের থেকে? বড়োদের দোয়া ব্যতীত শুভ পবিত্র কাজ সারতে নেই।”
আয়ন্তির উত্তরের অপেক্ষা না করে মাহবিন আয়ন্তিকে নিয়ে চলে গেলো বাড়ির ভেতরে। কোথাও চলছে ছাদে প্রেম, আবার কোথাও চলছে বিয়ের সজ্জা। বাড়িটায় যেন বিয়ের রঙ লেগেছে৷ আগাম বিয়ের আমেজের বাতাস বইছে।
নুরুল আলম, আয়েশা, মেঘার বাবা-মা সবাই একসাথে বসে ছিলেন। নিলয় এবং মেঘাও আছে। তাঁরা দু’জন আপাতত মধ্যমণি। মেঘা পেটে ক্ষণে ক্ষণে মমতার সাথে হাত বুলাচ্ছে। নিলয় একমনে বড়োদের আলাপ শুনছে। এমন সময় মাহবিন আয়ন্তিকে নিয়ে হাজির হয়। মাহবিন হালকা কাশি দিয়ে সকলের মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করলো। সকলে একসাথে ওদের দিকে তাকালো। নিলয়ের সর্বপ্রথম নজর গেলো আয়ন্তি এবং মাহবিনের হাত ধরাটা। নিলয় কিছু বলার জন্যে প্রস্তুতি নিতেই নজরে এলো প্রাণপ্রিয় বোনের লাজুক মুখশ্রী। মুহূর্তে-ই যেন নিলয় দমে গেলো। হয়তো কিছু একটা ধারণা হয়েছে তাঁর। নুরুল আলম মাহবিনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
–“কিছু বলবে বাবা?”
মাহবিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে এক দমে বলা শুরু করলো,
–“দেখুন আঙ্কেল। অতীতে যা হয়েছে সেটা অতীতে চলে গেছে। সেসব মনে করেও লাভ নেই। আমি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ ভেবে আপনার কাছে প্রস্তাব করছি, আপনার মেয়েকে আমি বিয়ে করতে চাই। স-সম্মানে আমার ঘরের রাণী করতে চাই সে। আশা করছি সে নিজেও আমায় স্বামী রূপে চায়। তাই আপনাকেই সর্বপ্রথম অবগত করলাম। এখন আপনার মতামত জানতে চাই।”
মুহূর্তের জন্যে সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। মাহবিনের কথার মাঝেই রিয়ন তার মা-বাবাকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়েছে। মাহবিনের এরকম প্রস্তাব শুনে রিয়নের হাসি-মাখা মুখশ্রী মুহূর্তে-ই বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেলো। সে যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। মিনিটখানেক সকলে ওভাবেই স্তব্ধ হয়ে রইলো। নিরবতা বিরাজ করলো। নিরবতা প্রগাঢ় হতে না দিয়ে নুরুল আলম মুখ খুললো,
–“আমি আয়ন্তির সিদ্ধান্ত নিতে চাই। আগের বারের মতো নিজের পছন্দ আমার সন্তানের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। মামুণী! আমি তোমার মুখে শুনতে চাই।”
আয়ন্তির গাল জুড়ে লাল আভা ছড়িয়ে পরলো। লাজুক স্বরে আমতা আমতা করে বললো,
–“আমার কোনো আপত্তি নেই আব্বু।”
আয়ন্তির উত্তর শুনে রিয়নের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেলো। বিস্ময়ের সাথে আয়ন্তির দিকে তাকিয়ে রয়। রিয়নের মা অর্থাৎ আয়ন্তির খালামণি মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
–“বাহ, আমাদের মেয়েরও দেখছি বিয়ে হয়ে যাবে। ভালো হয়েছে বেশ। আমি তো রিয়নের জন্যেও মেয়ে ঠিক করে রেখেছি। খুব শীঘ্রই তাঁর বাসায় প্রস্তাব দিতে যাবো।”
খালামণির কথায় রিয়ন শুকনো হাসি দিলো। হয়তো নিজের কষ্টগুলো আড়াল করতে চাইছে। আয়ন্তি চমকে খালামণির দিকে তাকালো। সকলের দিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলো তাদের কারো আপত্তি নেই। আয়ন্তি খুশি হলো, খুব। অতঃপর দু’জনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। একে অপরকে একাকী অনুভব করতে পারবে৷ দুঃখের পর বুঝি এত সুখ আসে? হৃদয় বাগানে প্রজাপতি’রা নানান রঙে আবৃত করে? রিয়ন কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে বাহিরে চলে গেলো।
————–
–“নিঃসঙ্গতার জন্যে কখনোই সি/ গারেট ভালো বন্ধু হতে পারে না। ওটা ফেলে দাও। বাস্তবতা আমাদের সকলকেই মানতে হয়।”
মাহবিনের কন্ঠস্বর শুনে রিয়ন দ্রুত বেগে পিছে ফিরে তাকালো। হয়তো মাহবিনকে প্রত্যাশা করেনি এমন একটি মুহুর্তে। রিয়ন নিজের বিস্ময় আড়াল করলো। আবার সামনে ঘুরে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। মাহবিন এগিয়ে এলো। পকেটে দু’হাত গুঁজে রিয়নের পাশে দাঁড়ালো। রিয়ন শক্ত, সটান মেরে দাঁড়িয়ে আছে। সি/ গারেটে আগুন ধরানো হয়নি। মাহবিন সেটাতে লক্ষ্য করে বললো,
–“জীবনসঙ্গীনি উপর থেকে-ই নির্ধারিত। শুধু একটু পরিশ্রম করতে হয়। এখন অন্যকে ভেবে নিজের ক্ষ’ তি করা কিন্তু বো’ কামী ব্যতীত কিছু নয়।”
রিয়ন চিৎকার করে উঠলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
–“তাহলে আমার ভালোবাসা কী অপরাধ ছিলো?”
–“অবশ্যই না। কিন্তু ভালোবাসাটা ভুল মানুষের জন্যে হওয়াটা অপরাধ। আয়ন্তি তোমার কাজিন, ছোট থেকে তোমায় ভাই হিসেবে ভেবে এসেছে। তার থেকে এসব এক্সপেক্ট করো কী করে? আমি মানছি, কেউ কখনোই নিজে থেকে কাউকে ভালোবাসে না। ওই অনুভূতিটা হুট করে হয়ে যায়৷ আমার বেলাতেও হয়েছে। আমিও মনে-প্রাণে চেয়েছিলাম আয়ন্তিকে ভুলতে কারণ আয়ন্তি ওয়াসিফের হবু বউ। তার জন্যে ওই অনুভূতি আমার জন্যে পাপ। কিন্তু আমার অবাধ্য মন মানেনি। দুর্বল করে দিয়েছিলো আমায়। কিন্তু হয়তো সৃষ্টিকর্তার অন্য কোনো পরিকল্পনা ছিলো৷ তাই তোমাকে বলছি, তুমি নিজেকে সামলে নাও। হয়তো কঠিন তোমার জন্য, তোমার এই নিঃসঙ্গতা আমি বা অন্যকেউ কাটাতে পারবো না। তাই বলছি, আন্টির কথানুযায়ী বিয়ে করে ফেলো। এবার অন্তত নিজের মায়ের মুখের দিকে তাকাও। তোমার বোন যা করেছে, আন্টি অনেক ভেঙ্গে পরেছে। তুমি বুঝদার ছেলে। আমি জানি তুমি আমার এত বড়ো ভাষণের অর্থ বুঝেছো। আসছি।”
মাহবিন চলে গেলো। রিয়ন সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়।
সময় তার ধারাবাহিকতা মেনে চলতে লাগলো৷ মাহবিন এবং আয়ন্তির বিয়ের ডেট ঠিক হলো মেঘার বাবু আসার পনেরো দিন পর। ওদের বিয়ের তোড়জোড় চলছে বিধায় রিহাব এবং নীলা বিয়ের কথা চেপে গেলো। তবে রিহাব জানিয়েছে মাহবিনকে। মাহবিন তাকে সঠিক পরামর্শ-ই দিয়েছে। সেই পরামর্শে নীলাও সমর্থন জানায়। আপাতত তাদের চুটিয়ে প্রেম চলছে। রিহাব মাহবিনের অফিসে যোগ দিয়েছে। অন্ততপক্ষে নীলার বাবা-মা বেকার ছেলের হাতে তো তাদের মেয়েকে তুলে দিবে না। তাই রিহাব মাহবিনের সাথে বিজনেসে মনোযোগ দেয়। শায়লা এখন মাহবিনের ফুপির সাথে থাকে। সারাদিন দুটো পুরুষ মানুষ বাহিরে থাকে। শায়লা অতো বড়ো বাড়িতে একা কী করবে? তাই এই সিদ্ধান্ত নেয়া। এছাড়া সোনিয়া এবং শাকিলেরও খোঁজ নেই। মাহবিনের কাছে খবর এসেছে কিছুদিন আগে তার মাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছিলো। শাকিল তাকে বেধর মে’ রেছে। সেই মা’ রে বেঁহুশ হওয়ার ফলে তাকে হসপিটাল নিতে হয়েছে। শাকিল অবশ্য কিছুদিন পুলিশের ভয়ে পলাতক ছিলো। পরে আবার ফিরে আসে যখন সোনিয়া নিজে শাকিলের কেস তুলে নেয়। মাহবিন সব শুধু চুপচাপ জেনে গেছে। একে একে মাহবিন উপলব্ধি করতে পারছে তার মা নামক মহিলা এবং শাকিল দু’জনেই তাদের কর্মফল ভোগ করছে। তাদের কর্মফল থেকে নিস্তার নেই। কোনোভাবেই নেই।
————-
–“আজ তোমার সাথে ঘুরতে ইচ্ছে করছে। শাড়ি পরবে?”
মাহবিনের নেশালো কন্ঠস্বরে আয়ন্তি লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো। কীসব বলছে ছেলেটা? তাঁর বুঝি লজ্জা করে না? আয়ন্তি লাজুক স্বরে আওড়ায়,
–“বিয়ের আগে নো ঘুরাঘুরি। এছাড়া ভাবী….”
হঠাৎ মেঘার আর্তচিৎকার ভেসে আসলো নিচের থেকে। মেঘা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় নুরুল আলম নিলিয়ের ঘর নিচে শিফট করে দিয়েছে। যাতে কোনোরকম ওঠানামা করতে না হয় মেঘাকে। আয়ন্তি মেঘার চিৎকার শুনে আঁতকে উঠলো। কল কেটে একপ্রকার দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে পরলো। যত নিচের দিকে যাচ্ছে ততোই যেন মেঘার কান্নাকাটির শব্দ গাঢ় লাগছে। চিন্তায়, উত্তেজনায় আয়ন্তির কপাল জুড়ে ঘামে’রা বিচরণ করছে।
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্