অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৭

0
728

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৭
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

বিকাল পাঁচটা বেজে কুড়ি মিনিট। কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত শহরে তখন গোধূলি নেমে গেছে। শহরে আজ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রিকশায় বসে হাত ঘড়িটার দিকে একপলক চোখ বুলিয়ে সামনে তাকালো সানাত। এই বিষণ্ণ শহরে দূষিত অক্সিজেনের মাঝে হাপিয়ে উঠেছে সে। সকালে সেই যে খেয়ে বেরিয়েছিল তারপর ভার্সিটিতে একটা রোল খেয়েছিল তারপর থেকে এখন অব্দি আর পেটে কিছু পরেনি। এই মুহূর্তে সে যাচ্ছে এক স্টুডেন্টের বাসায় তাকে পড়াতে। আজ টানা পাঁচদিন পড়ানো হয়নি। টিউশনটা চলে যায়নি এই তার কপাল। একটা তো চলেই গেছে। এটাও চলে গেলে দিশেহারা হয়ে যাবে সে। সানাতের ভাবনার মাঝেই রিকশাওয়ালা মামা বলে উঠলেন,

আফা আইয়া পড়ছি। নামেন।

সানাতের ধ্যান কাটলো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সামনের কাঙ্ক্ষিত বিল্ডিংয়ের দিকে তাকালো। তারপর গেটের কাছে এসে দাঁড়াতেই দারোয়ান চাচা বিনয়ী হেসে গেটটি খুলে দিলেন।

🌻
আজ অন্তিমরা চার ফ্রেন্ড একসাথে হয়েছে। হাসি, মজা, ইয়ার্কিতে মেতে উঠেছে বন্ধুমহল। গল্পের মাঝেই অন্তিমের বন্ধু এজাজ বলে উঠলো,

অন্তিম তোর বিয়েটাতে তো অ্যাটেন্ড করতে পারলামনা। দেশের বাইরে ছিলাম। বিবাহিত লাইফ কেমন যাচ্ছে বল। আমরাও একটু শুনি। আর ভাবীর সাথে কবে আলাপ করাবি?

এজাজের কথায় লিমন বলে উঠলো,

দোস্ত আমিও ওর বিয়াটা খাইতে পারিনাই। শালার কাজিনের বিয়াটাও ওইসময় পড়ছিল তাই খুলনা গেছিলাম। পরে নাদিমের থেইকা জানলাম ওর বিয়ায় পুরা সিনেমার কাহিনী হইছে।

সে যাইহোক কিন্তু তোদের মধ্যে কি এখন সব ঠিকঠাক আছে?

তোরা প্লিজ এই টপিকটা বাদ দিবি। বললো অন্তিম।

বাদ দিবো কেন? দেখ অন্তিম যা হইছে হইছে একসেপ্ট করে নে দোস্ত। আমি তোরে একটা কথাই বলবো যা হইছে ভালোই হইছে। বললো নাদিম।

ভালো হইছে? তা ঠিক কি ভালো হইছে আমারে একটু বল? আমার লাইফটা শেষ হয়ে গেছে। সব জাস্ট হেল হয়ে গেছে।

তুই সত্যিই বুঝতে পারতেছিস না কি ভালো হইছে তোর?

না। সোজা উত্তর অন্তিমের। নাদিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

ভালো এইটাই হইছে যে ছোঁয়ার সাথে তোর লাইফটা জড়ায় নাই। যেই মেয়ের কাছে তোর ভালোবাসার কোনো মূল্য নাই সামান্য কিছু অর্থের জন্য ওই রকম লোভী, বেঈমান মেয়ের সাথে বিয়ে হয়নাই বাইচা গেছস। সানাত মেয়েটা ছোঁয়ার চেয়ে হাজার গুণ ভালো। আমি মানুষ চিনতে খুব একটা ভুল করিনা অন্তিম। তাই অভিজ্ঞতার জোর থেকেই বলছি তুই সানাতকে ছোঁয়ার সাথে গুলিয়ে ফেলিস না। মেয়েটা সত্যিই আলাদা। আর সব থেকে বড় বিষয় কি জানিস ইটস অল অ্যাবাউট ডেসটিনি।

দোস্ত আক্ষেপের বিষয় আমি এই সানাতরে থুড়ি ভাবিরে দেখলামনা। বললো লিমন।

লিমনের কথায় এজাজ বললো,

আমিও না রে।

আরেহ চাপ নিস না সময় তো আর পালাচ্ছে না।সামনে অনেক দেখা হবে। তখন দেখিস শ্যামবতীরে।

শ্যামবতী?

আরেহ আমি ডাকি ওরে এই নামে। আগে যখন ছোঁয়ার সাথে আসতো তখন এই নামেই ডাকতাম। বলেই মলিন হাসলো নাদিম। সেই হাসিতে কিছুটা বিষণ্ণতা ছিলো যা কারো দৃষ্টিগোচর হলো না।

অন্তিম কোনো কথা বললোনা। চুপচাপ বসে ছিল। কিছু সময় পর নাদিম বললো,

ওকেহ গাইস এখন যেতে হবে। ইমারেন্সি কাজ আছে।

যাহ যাহ তোর কি ইমারজেন্সি কাজ তা কি আর আমরা জানি না। বললো লিমন।

শালা তোর নেগেটিভ মাইন্ড। বলেই হেসে চলে গেল নাদিম।

🌻
এশা যেই ম্যাথ গুলো হোমওয়ার্ক দিয়েছি ওগুলো সলভ করে রাখবে। আমি কালকে এসে দেখবো।ঠিকাছে?

ওকে মিস।

ঠিকাছে তাহলে আমি এখন উঠি।

আচ্ছা।

আজকে তোমাকে শান্তিতে পড়াতে পারলামনা পাশের রুমে এতো হাসাহাসির আওয়াজ ছিলো। কারা এসেছিল এশা?

ভাইয়ার বন্ধু-বান্ধব।

ওহ।
তাদের কথার মাঝেই এশার মা ড্রয়িংরুম থেকে এশাকে ডেকে উঠলেন। এশা মায়ের ডাকে উঠে ড্রয়িংরুমে চলে গেলো। ড্রয়িংরুমে যেতেই দেখতে পেলো সেখানে তাঁর মা আয়েশা খানম তার ভাইয়ের বন্ধুদের সাথে হাসিমুখে কথা বলছে। এশাকে দেখা মাত্রই আয়েশা খানম বলে উঠেলন,

তোর পড়া শেষ?

হ্যাঁ আম্মু।

তোর মিস কোথায়?

বের হচ্ছে।

গিয়ে বল আমি ডাকছি।

এশা মায়ের কথায় সায় জানিয়ে মিসকে ডাকতে চলে গেলো। আর এদিকে আয়েশা খানম ছেলের দুই বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

আর বলোনা বাবা মাস শেষে তিন হাজার টাকা দেই। সেও মাত্র দুটো সাবজেক্ট পড়ায়। এরমধ্যে কামাই করে অর্ধেক মাস। এরকম করলে পড়া হয়?

অন্তিম আর লিমন জোরপূর্বক হাসলো। এজাজের মাকে তাদের খুব একটা পছন্দ নয়। মহিলার ব্যবহার মোটেও ভালো নয় সে সম্পর্কে তারা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু না জানি আজকে এই মাস্টারের কপালে কি আছে! তাদের ভাবনার মাঝেই সানাত এসে উপস্থিত হলো। সানাত আর অন্তিম দুজনের কেউই একজন অপরজনকে খেয়াল করেনি। অন্তিম মাথা নিচু করে ফোন চালাচ্ছে। সানাত বলে উঠলো,

আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আমাকে ডেকেছিলেন?

পরিচিত কণ্ঠস্বর কানে যেতেই মোবাইলের ওপর চলমান আঙ্গুল থেমে গেলো। মাথা উঠিয়ে সামনে তাকাতেই থমকে গেলো সে। ঠিক সেই মুহূর্তে সানাতেরও চোখ পড়লো অন্তিমের দিকে। সেও থমকে গেলো। দুজনের মনেই একই প্রশ্ন হানা দিলো, “ও এখানে?”
তাদের ভাবনার মাঝেই আয়শা খানম বলে উঠলেন,

ওয়ালাইকুম আসসালাম। জ্বি ডেকেছিলাম তোমাকে। কিছু কথা ছিল তোমার সাথে।

সানাত অন্তিমের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এশার মায়ের দিকে তাকালো। তারপর বললো,

জ্বি বলুন।

কতদিন পর পড়াতে এলে শুনি?

জ্বি আন্টি পাঁচদিন।

পাঁচদিন পড়াওনি অথচ মাস শেষে তিনটা হাজার টাকা দেই তোমাকে সেটা কি এমনি এমনি!

আন্টি আমি সত্যিই খুবই দুঃখিত। একটু সমস্যায় ছিলাম তাই আসতে পারিনি।

তোমার সমস্যা দিয়ে কি আমাদের চলবে শুনি? আমার মেয়ের পরীক্ষার সময়ই তোমার যত সমস্যা দেখা দেয়? মশকরা করছো আমার সাথে?

আন্টি সত্যিই ভীষন প্রবলেমের মধ্যে ছিলাম তাই আসতে পারিনি।

চুপ করো। কি প্রবলেম ছিলো তা কি আর আমি জানিনা মনে করেছো? তোমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে তোমার খালার কাছে কল করেছিলাম। সেখান থেকেই জানতে পারলাম বোনের হবু জামাইয়ের সাথে ফষ্টি-নষ্টি করে বোনের বিয়েটা ভেস্তে দিয়ে নিজে বিয়ে বসেছো।

সানাত নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে বললো,

এসব আপনি কি বলছেন আন্টি? মামণি বলেছে আপনাকে এসব?

হ্যাঁ তোমার খালা নিজে বলেছে আমাকে। তোমাকে দেখে তো ভালো মেয়েই মনে হয়েছিল যেনো ভাঁজা মাছটি উল্টে খেতে জানোনা এদিকে তো ভালই গুটি চেলেছ। শেষে কিনা নিজের বোনের ভালোবাসার মানুষ কেড়ে নিয়ে নিজে সুখী হতে চাইছো? অলক্ষ্মী, অপয়া, স্বার্থপর মেয়ে কোথাকার!

আন্টি প্লিজ আপনি না জেনে কোনো কথা বলবেননা।

খালা আর মায়ের মধ্যে তফাৎ কি? সেই মায়ের মত খালা কি মিথ্যে কথা বলেছে আর তুমি একা সত্য বলছো? বোকা পেয়েছ আমাকে?

আন্টি আমি আপনার মেয়েকে পড়াই তার বদলে পারিশ্রমিক পাই এইটুকুই আপনার সাথে আমার সম্পর্ক। এর বাইরে আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কোনো কথা বলতে পারেননা।

একদম বেশি কথা বলবেনা। তোমার মতো জঘন্য মেয়ে হওয়ার চেয়ে না হওয়া ঢের ভালো। চরিত্রহীনা মেয়ে কোথাকার!

অন্তিম এতক্ষণ অব্দি নিজেকে অনেক কষ্ট করে সংযত করে রেখেছিল কিন্তু এবারে আর পারলোনা। তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,

আন্টি প্লিজ এভাবে আপনি একজনের ক্যারেক্টার নিয়ে যা তা বলতে পারেননা। আপনার কোনো রাইট নেই। আপনার ঘরেও তো একটা মেয়ে আছে।

তুমি থামো অন্তিম। এসব মেয়েদের তুমি চেননা। আর এই মেয়ের সাথে আমার মেয়ের তুলনা দিওনা। আমার মেয়ে ওর মতো খারাপ নয়। তুমি ভাবতে পারছো কতোটা খারাপ মেয়ে হলে বোনের সংসার ভাঙ্গে। যার পাতে খেলো তার পাতেই থুথু ফেললো! ওর খালার থেকেই তো শুনলাম ওর মা মরে গিয়ে বেঁঁচে গেছে। এমন মেয়ে জন্ম দেওয়ার থেকে মরে যাওয়া ভালো। এরা মান সম্মান রাখেনা।

সানাত কেঁদে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

আপনি আমাকে নিয়ে যা বলেছেন আমি সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু আমার মরা মাকে নিয়ে কিছু বলবেননা। আমি সহ্য করতে পারবনা। আমি আপনার মেয়েকে কাল থেকে আর পড়াতে আসবোনা।

হ্যাঁ হ্যাঁ। এসো না আর। তোমার মতো মেয়ের ছায়া আমার মেয়ের ওপর পড়লে আমার মেয়েও নষ্ট হয়ে যাবে। কেনো যে বেঁঁচে থাকো তোমরা পথে ঘাটে গাড়ি ঘোড়ার নিচে পড়ে মরে গেলেও তো পারো। তাতে অন্তত অন্যের জীবনের ভোগান্তি কমে।

অন্তিম চেঁচিয়ে উঠে বললো,

আন্টি প্লিজ। আপনি কিসব বলছেন এসব? আপনারও সন্তান আছে আন্টি। একজন মা হয়ে অন্যের সন্তানের মৃত্যু কামনা করেন আপনি? ছিঃ!

সানাত অন্তিমের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। তারপর আয়েশা খানমের দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনি ভাববেন না আন্টি আপনার মেয়ে কেনো আমি দোয়া করি আমার মতো জীবন যেনো কোনো মেয়ের না হয়। কোনো মেয়ের না!
বলেই বেরিয়ে যেতে নিলে আয়েশা খানম সানাতের হাতে এ মাসের বেতনটা ধরিয়ে দেন। সানাত আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায়।
অন্তিমের আর এখানে থাকার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই। সে বেরিয়ে যেতে নিলেই লিমন বলে উঠলো,

কোথায় যাস? এজাজ খাবার অর্ডার করেছিলো আনতে গেছে। এসে যাবে এখনি।

আমার ভালো লাগছে না। এজাজ আসলে তুই একটু ম্যানেজ করে নিস। বলেই সে বেরিয়ে গেলো।

🌻
রাত ৯ টা। অন্তিম একটা দোকানে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় পকেট থেকে বের করেই দেখলো ওহীর ফোন। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় ওহী বললো,

ভাইয়া তুমি কোথায়?

বাইরে আছি। কেনো?

ভাইয়া আসলে সানাত এখনো বাসায় ফেরেনি।

অন্তিম প্রথমে খেয়াল করেনি তবে পরমুহূর্তে খেয়াল হতেই বলে উঠলো,

হোয়াট? বাসায় ফেরেনি মানে?

হ্যাঁ ভাইয়া বাসায় ফেরেনি। পড়াতে গেছিলো। কিন্তু ৮টার মধ্যেই ফিরে আসার কথা। সেখানে ৯টা বাজে। আমি ফোনও করেছিলাম সুইচস্টপ বলছে।বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আব্বু আম্মুও বাসায় নেই ছোটো ফুপি অসুস্থ সেখানে গেছে। সকালের আগে ফিরবেনা। আমার খুব টেনশন হচ্ছে ভাইয়া। কোনো বিপদ হলো না তো।

ওহী প্লিজ কাম ডাউন। আমি দেখছি। তুই টেনশন করিসনা। ও যেখানে যেখানে পড়াতে যায় তার ঠিকানাটা আমায় পাঠিয়ে দে।

আচ্ছা।
ফোন কাটতেই অন্তিম উঠে দাঁড়ালো। তার হঠাৎ সত্যিই খুব চিন্তা হচ্ছে তার সাথে ভয়ও হচ্ছে। সানাত কোথায় চলে গেলো। অভিমানের বশে নিজের কোনো ক্ষতি করে বসবেনা তো! যদি সত্যিই এজাজের মায়ের কথা মাথায় নিয়ে গাড়ি ঘোড়ার নিচে। নাহ্ আর ভাবতে পারছেনা অন্তিম। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরিয়ে গেলো সে সানাতের খোঁজে।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে