অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৬

0
733

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৬
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

টানা তিনবার কল বেজে কেটে যাওয়ার পর চতুর্থবারের বেলায় রিসিভ করলো সানাত। ফোন কানের কাছে নিয়ে সোজা বেলকনিতে চলে গেলো।

হ্যালো, শাকিল বল।

কি ব্যাপার আপু কতদিন ধরে কল করছি তোমাকে রিসিভ করছোনা কেনো?

ফোন চার্জ দেওয়া হয়নি বন্ধ হয়ে পড়েছিল। আজকে চার্জ দিলাম। বাড়ির সবাই কেমন আছে? আর বাবা?

সবার কথা বাদ দেও। তুমি ঠিক আছো তো আপু?

সানাত মলিন হাসলো তারপর বললো,

আমি ঠিক থাকবো না কেনো! আমি একদম ঠিক আছি।

ছোঁয়া আপুদের বাসায় ফোন করেছিলাম সেখান থেকে পুরো ঘটনা জানতে পেরেছি।

বাবাকে বলেছিস নাকি আবার?

হ্যাঁ বলেছি।

তুই কি পাগল শাকিল? বাবাকে কেনো বলতে গেলি? বাবা নিশ্চই অনেক টেনশন করেছে।

কান্না করেছে অনেক।

কেনো বলতে গেলি? খুব কি দরকার ছিল?

পরে জানলে আরো কষ্ট পেতো তাই বলে দিয়েছি।

আচ্ছা বাদ দে। বাবার শরীর কেমন?

খুব একটা ভালো নেই। ওষুধ ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। শরীরে আবার পানি আসছে। সারারাত দাহ করে।

সানাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

আমাকে একটা দিন সময় দে টাকা যোগাড় করে পাঠিয়ে দেবো। তুই করিম চাচার ফার্মেসী থেকে আপাদত বাকিতে ওষুধ নিয়ে আয় । আমি পরশু টাকা পাঠাচ্ছি।

আচ্ছা। তুমি আসবে কবে?

জানিনা। আচ্ছা এখন ফোন রাখ। বাবার খেয়াল রাখিস। আর সাবা আর তুই মন দিয়ে পড়িস। খালি টইটই করে ঘুরে বেরাস না।

ঠিকাছে। তুমি ভালো থেকো।

থাকবো। বলেই ফোন কেটে দিলো সানাত। আজকে বিকেলে এক স্টুডেন্টের মা ফোন করে না করে দিয়েছে। এতদিন কামাই করায় তারা আর তাকে দিয়ে আর পড়াবেনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। এ মাসের টিউশন ফি টা এসে নিয়ে যেতে বলেছে। তিনটা টিউশনের মধ্যে একটা চলে গেছে। তিনটা টিউশন করেও সে সংসার চালাতে হিমশিম খায় তাহলে এ মাসে কি করে চালাবে এই চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে সানাতের। এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই রুমে প্রবেশ করলো সানাত। রুমে ঢুকেই অন্তিমকে দেখে সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। অন্তিম কখন রুমে এসেছে তা একদম টের পায়নি সানাত। আচ্ছা লোকটা কি তার ফোনের কথাগুলো শুনতে পেরেছে নাকি। ভাবতেই অস্বস্তিতে পড়ে গেলো সানাত। এসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ চোখের সামনে কেউ তুরি বাজাতেই ঘোর কেটে গেল সানাতের। সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো অন্তিম তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তারপর বললো,

হোয়াট হ্যাপেনড? তুমি এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছো কেনো?

সানাত কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রথমত সে অতিমাত্রায় অবাক। এতই অবাক যে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তার কারণ সে নিজের চোখ-কান কাউকেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না যে অন্তিম আহসান নিজে তার সাথে সেধে এসে কথা বলছে। অন্তিম এবার বিরক্ত হয়ে আবারও বললো,

কি ব্যাপার? কথা বলছো না কেনো? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো নাকি!

সানাত কোনো কথা না বলে নিজের হাতে চিমটি কাটলো। তৎক্ষণাৎ ব্যথায় ককিয়ে উঠলো। আর এদিকে অন্তিম অবাক হয়ে সানাতের উদ্ভট কর্মকাণ্ড দেখছে। সানাত এবার অন্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো,

তারমানে আপনি সত্যিই এখানে দাড়িয়ে আছেন?

হোয়াট? এই তুমি কিসব বলছো মাথা ঠিক আছে তোমার? মিথ্যে মিথ্যে আবার কিভাবে দাড়িয়ে থাকে?

না মানে আপনার মত এতো দাম্ভিক, অহংকারী মানুষ সেচ্ছায় এসে আমার সাথে কথা বলছে এটা ঠিক হজম করে উঠতে পারিনি।

অন্তিম অপরাধীর মতো তাকালো কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলে উঠলো,

সরি।

সানাত যেনো ধাক্কা খেলো। নিজের কান কি তার সাথে ফাইজলামি করছে নাকি তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সে কি ঠিক শুনেছে অন্তিম আহসান তাকে সরি বলেছে? এটা কি আদেও সম্ভব? সানাত রোবটের মত বললো,

হঠাৎ সরি? কিসের জন্য?

অন্তিম বেশ শান্ত সুরেই বললো,

আসলে আমার মনে হয়েছে আমি তোমার সাথে ঠিক করিনি, অন্যায় করে ফেলেছি। হয়তো তোমার কোথাও ভুল ছিলোনা। জেদের বশে তোমার লাইফটা হেল করে দিয়েছি।
অন্তিম এইটুকু বলে সানাতের দিকে তাকাতেই দেখলো সানাত জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়তে নিলেই অন্তিম ধরে ফেললো। পুরো ঘটনায় অন্তিম বাকশুণ্য। তার ঠিক কি প্রতিক্রিয়া করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারছেনা সামান্য একটা সরি বলেছে তাতেই এই মেয়ে অজ্ঞান। নিজেকে এই মুহূর্তে ভূত বা কোনো জোকার মনে হচ্ছে অন্তিমের।

🌻
চোখে মুখে পানির ছিটা পরতেই হালকা পিট পিট করে চোখ খুললো সানাত। চোখ খুলতেই দেখলো মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা অনবরত ঘুরছে। আর তার দিকে অনেকগুলো চোখ তাকিয়ে আছে। সানাত বেশ অস্বস্তিতে পড়লো। মাথার কাছে অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম, পায়ের কাছে ওহী বসে আছে। আর খাটের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে অন্তিমের বাবা, বাড়ির কাজের মহিলা লতা। সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতেই দৃষ্টি আটকে গেলো অন্তিমে। অন্তিম বিরক্ত হয়ে তারদিকে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পরে গেলো তার অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা। পুরো ঘটনা মনে করতেই সানাত লজ্জায় নুইয়ে গেলো। নিজের প্রতি নিজেরই ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে তার। অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত তুমি ঠিক আছো? হঠাৎ কি হলো অজ্ঞান হয়ে গেলে কি করে?

ভূত দেখেছিল। বললো অন্তিম।

ঘরের সবাই অবাক হয়ে তাকালো অন্তিমের দিকে আর তারপর সানাতের দিকে। সবার মাঝে ওহী বলে উঠলো,

কিন্তু ভাইয়া সানাত ভূতে কেনো ভয় পাবে? না মানে ভূতের তো ওকে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারানোর কথা।

ওহীর ইয়ার্কি মার্কা কথায় ফিক করে হেসে দিলো লতা খালা। তারপর হাসতে হাসতেই বললো,

আফনে পারেনও ছোডো আফামনি।

এদিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম। রাগী গলায় বললো,

কানের নিচে একটা দেবো ফাজিল মেয়ে। সবসময় ফাইজলামি। দেখছিস ও অসুস্থ এই সময়ও তোর ইয়ার্কি না করলে চলেনা তাইনা!

ওহী ঠোঁট টিপে হাসছে। আর ওর হাসি দেখে সানাতের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। অসভ্যটাকে পড়ে মজা দেখাবে সে। তার আগে নিজেকে আসন্ন তুফান থেকে বাঁচাক। অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত আমি লতাকে দিয়ে গরম দুধ পাঠিয়ে দিচ্ছি খেয়ে নাও, ভালো লাগবে। আর শরীরের যা হাল তাতে দেখে তো তুলোর বস্তা মনে হয়। আমার বাসায় কিন্তু আমি আমার ছেলেমেয়েদের খাওয়া-দাওয়া নিয়ে খুব স্ট্রিক। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোনো হাংকী-পাংকী চলবেনা। তোমার বেলাতেও এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না বলে দিলাম। ওহীকে যেমন শাসন করি তোমাকেও করবো তাতে তুমি আমায় খারাপ শাশুড়ি ভাবলে ভাবতে পারো। আমি আমার মেয়েদের নিয়ে খুব পজেসিভ। বুঝেছ? সানাতের হঠাৎ কি হলো সানাত জানেনা সে আচমকা অর্পিতা আঞ্জুমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। মায়ের পর খালাকেই মায়ের চোখে দেখেছে সে তবে একটা সময় পর সেও দূরে ঠেলে দিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আর রইলো সৎ মা সে তো সানাতের ছায়াও সহ্য করতে পারেনা। অর্পিতা আঞ্জুম বুঝতে পেরেছেন সানাতের কান্নার কারণ। তিনি খুব স্নেহের সাথে আগলে ধরলেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

এই মেয়ে একদম কাঁদবেনা। এমন ছিচকাদুনে মেয়ে আমার মোটেও পছন্দ নয়। আমার মেয়েরা থাকবে স্ট্রং একদম আমার মতো বুঝলে। মা পাশে আছি সবসময় বুঝলে তাই একদম কাঁদবেনা।

পাশ থেকে ওহী নকল অভিমানের সুরে বলে উঠলো,

বাবাহ আম্মু তুমি লাস্ট কবে আমায় এভাবে জড়িয়ে আদর করেছিলে আমার তো মনে পড়ছেনা অথচ সানাতকে পেয়ে আমার কথা ভুলে গেলে! আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি নাকি?

নাহ তুই ড্রেনের পানি দিয়ে ভেসে এসেছিলি। পাশ থেকে বলেই শব্দ করে হেসে উঠলেন অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান। তার কথায় যেনো পুরো ঘরময় হাসির রোল পড়ে গেলো। সানাতও হেসে দিলো। ওহীর মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেছে এতবড় অপমানে! কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে নিজেও হেসে উঠলো। আজ অনেকদিন পর আহসান মঞ্জিলে সুখের আনাগোনা দেখা দিলো। অদ্ভুতভাবে আজকের এই দৃশ্যটা অন্তিমের কাছে খারাপ লাগলো না বরং কোথাও না কোথাও ভালোলাগা কাজ করলো। তারপর সে সানাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

মা তোমার ওই পাতানো মেয়ের মাথায় কিন্তু ছিট আছে তাই একটু সাবধানে থেকো।
অন্তিমের কথায় প্রথমে সবাই একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও পরমুহূর্তে সবাই হেসে দিলো। তারপর অন্তিম বললো,

আচ্ছা আমি এখন একটু বের হবো।

কোথায় যাবি এখন? বললেন অন্তিমের বাবা।

ভার্সিটিতে চাকরির এপ্লাই করবো তাই একটু দরকার আছে।
এইটুকু বলেই সে বেরিয়ে গেলো। আর এদিকে পুরো ঘরে উপস্থিত সবাই চরম অবাক। সবার মাথায় একটাই কথা হঠাৎ এই ছেলের এতো পরিবর্তন! আর সানাত সে বেকুবের মতো তাকিয়ে আছে আর ভাবছে আজ হচ্ছেটা কি!
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে