অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৫

0
715

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৫
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘরে অন্তিম এখনও ঘরে ফেরেনি। সারাদিনের দৌঁড়-ঝাঁপ শেষে ক্লান্ত শরীরটা সোফায় এলিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে সানাত। শরীরটা যেনো আর চলছে না। চোখের পাতায় রাজ্যের ঘুম এসে ভর করতেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো সে।

বেশ সকালবেলাই ঘুম ভেঙে গেছে সানাতের। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই তার দৃষ্টি গেছে বিছানায় ঘুমন্ত অন্তিমের দিকে। কালরাতে সে যখন ঘুমিয়েছিল তখন অব্দি অন্তিম আসেনি তারপর কখন এসেছে তা সে জানেনা। সানাত অন্তিমের দিকে তাকিয়ে ভাবে ছোঁয়া কতই না ভাগ্যবতী হতে পারতো যদি সে এই বিয়েটা করতো। অন্তিম ছেলেটা দেখতে যথেষ্ঠ সুদর্শন। ফর্সা গায়ের রং, উচ্চতায় একটু বেশিই লম্বা, সেইভ না করায় গালে হালকা হালকা দাড়ি হয়েছে। সানাত আনমনেই হাসে তারপর নিজেকে শাসিয়ে বলে,
ছি সানাত তুই এভাবে একটা ঘুমন্ত পুরষের দিকে অমন কুদৃষ্টিতে তাকাচ্ছিস, তার সুযোগ নিচ্ছিস। তুই তো দেখছি ভারী অভদ্র মেয়ে।

🌻
সকালে ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সানাত। তার পাশেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওহী। তবে অদ্ভুত বিষয় একটু পর পর সে সানাতের দিকে তাকিয়ে বোকার মতো মিটিমিটি হাসছে। সানাত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওহীর দিকে। সকাল সকাল এই মেয়ের এমন অদ্ভুত আচরণে সে বেশ বিরক্ত। তাই এবার সে দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো,

এই কি হয়েছে তোর? এভাবে গাধার মত দাঁত কেলাচ্ছিস কেনো?

ওহী কিছু বললোনা উল্টো আবারও হাসলো। সানাত ক্ষেপে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এই ফাজিল তুই হাসছিস কেনো? মাথার তার ছিঁড়ে গেছে নাকি?

তোকে দেখে হাসছি। বলেই আবার হেসে দিলো।

কিহ! আমাকে দেখে হাসছিস মানে? আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে হাস্যকর লাগছে?

তোকে দেখে আমার শুধু হাসি না লজ্জাও লাগছে?

কি যা তা বলছিস? পাগল হয়েছিস নাকি? আমাকে দেখে তোর লজ্জা লাগছে কেনো?

কারণ তুই সকালে গোসল করেছিস? বলেই ওহী মুখ টিপে হেসে দিলো।

তো? এতে হাসার কি আছে?

তুই সকাল সকাল কেনো গোসল করেছিস তা কি আর জানিনা ভেবেছিস?

সানাত ওহীর কথার মানে বুঝতে পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তারপরই ক্ষেপে গিয়ে বললো,

অসভ্য, অশ্লীল। তোর চিন্তা ভাবনাও তোর মত! ছি ছি!

এহহ কি আমার সুশীল মেয়েরে! তোরা করতে পারবি আর আমি…
বাকি কথা টুকু বলার আগেই সানাত ওহীর মুখ চেপে ধরলো। তারপর চোখ রাঙ্গিয়ে বললো,

এই অসভ্য তোর মুখে কিছু আটকায়না? আর তুই যার সাথে আমার কথা বলছিস সে তোর বড়ো ভাই হয়! ছি ছি শেষ অব্দি কিনা নিজের ভাইয়ের… বলতেই ওহীর মুখ ছেড়ে দিলো। ওহী জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,

ফাজিল মেয়ে আরেকটু হলেই আমি মরে যেতাম। বাপরেহ!

দুজনের কথার মাঝেই হঠাৎ অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

সানাত?

হ্যা আন্টি বলুন।

অন্তিম উঠেছে?

জানিনা তো। আমি যখন উঠেছি তখন ঘুমোচ্ছিলো এখন বোধয় উঠেছে।

আচ্ছা তুমি একটু এই কফিটা ওর ঘরে দিয়ে আসো মা।

আমি?

হ্যাঁ তুমি। কেনো কোনো সমস্যা?

না মানে…

পাশ থেকে ওহী বলে উঠলো,

কোনো মানে মানে নেই। চুপচাপ কফিটা নিয়ে ভাইয়াকে দিয়ে আয়।

সানাত আর কিছুই বলে উঠতে পারলো না। কফি হাতে নিয়ে সোজা সিড়ির দিকে পা বাড়ালো।

🌻
অন্তিম ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে চুল মুছছে। এদিকে দরজার সামনে কাচুমাচু করে কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সানাত। ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। সানাত দরজায় আসতে করে টোকা দিতেই ভেতর থেকে ভরাট গলায় অন্তিম বললো,

খালা এতক্ষণ লাগে কফি আনতে?

সানাত ভয়ে রীতিমত ঘামছে। না জানি আজ কোন শনি আছে কপালে। শাড়ীর আঁচল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিয়ে বুকে ফু দিয়ে আস্তে করে পা রাখলো ঘরে। অন্তিম উল্টো দিকে ঘুরেছিল তাই এখনও খেয়াল করেনি। তারপর আবারও বললো,

কি হলো কফিটা… এটুকু বলেই থেমে গেলো অন্তিম। আয়নার মধ্যে দিয়ে সানাতকে দেখে ঘুরে তাকালো। তারপর চোয়াল শক্ত করে জিজ্ঞাসা করলো,

তুমি? তুমি কেনো কফি নিয়ে এসেছো?

সানাত তোতলাতে তোতলাতে বললো,

আ..আপনার ক..কফিটা। আন্টি প..পাঠিয়েছে।

অন্তিম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই সানাতের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। মুহূর্তেই ঘরজুড়ে চূর্ণবিচূর্ণর শব্দ হলো। সানাত চোখ বন্ধ করে মুখ খিচে দাড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলো ফ্লোরে কফির মগটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

আচ্ছা তোমার প্রবলেম কি? তুমি বোঝনা আমি জাস্ট তোমাকে সহ্য করতে পারি না। এতো গায়ে পড়া কেনো তুমি? ওহ শিট আমি কাকে কি বলছি? তোমরা তো গায়ে পরাই। তোমাদের ক্যারেক্টারই তো এমন। বড়োলোকের ছেলে হাত করা। তারপর রূপের জালে আর কথার মায়ায় ফাঁসিয়ে ইউজ করা। কিন্তু মানতে হবে তুমি আর তোমার বোন গেইমটা কিন্তু দারুণ খেলেছো। আই এপ্রিশিয়েট। বাট আফসোসের বিষয় পুরোপুরি সাকসেসফুল হতে পারলে না। তোমার সাহায্যে তোমার বেঈমান বোন প্লাস বেস্টফ্রেন্ড তো পালিয়েছে তার বড়লোক এক্সের সাথে। তোমারও নিশ্চই এরকমই প্ল্যান ছিল কোনো বড়োলোকের ছেলেকে হাত করে ফাসিয়ে নেওয়া। কিন্তু তুমি নিজেই খুব বাজেভাবে ফেঁসে গেছো। তোমরা ভালোবাসার নামে নোংরা খেলা খেলতে জানো। ভালোবাসা কি আদেও জানো? তোমাদের মতো ক্যারেক্টারলেস মেয়েদের দেখলে আমার জাস্ট ঘেন্না লাগে।

সানাত আর সহ্য করতে পারলো না। আজ সব ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে গেছে। সবসময় শান্ত থাকা সানাত মুহূর্তেই রণমূর্তী ধারণ করলো। হঠাৎ করেই অন্তিমের শার্টের কলার চেপে ধরে গর্জে উঠে বললো,

ব্যাস অন্তিম আহসান। এবার থেমে যান। অনেক বলেছেন আপনি কিন্তু আর না। শুরু থেকেই শুধু আপনার কথা হজম করে আসছি তবে আজ আর সহ্য করতে পারলাম না। আমার সহ্যের সীমা আজ আপনি লঙ্ঘন করে গেছেন। প্রথম থেকেই আমাকে আপনি যা নয় তাই বলে আসছেন আমি কিচ্ছু বলিনি। মুখ বুঝে সবটা সহ্য করে গেছি শুধুমাত্র এই ভেবে যে না আপনার মাথা ঠিক নেই এতো বড়ো একটা ধাক্কা খেয়েছেন তাই হয়তো রাগের মাথায় যা খুশি বলছেন। কিন্তু না আমার এখন মনে হচ্ছে আপনার মেন্টালিটিই এরকম চিপ। ঠিক-ভুল বিচার করার বোধ আপনার নেই। বারবার আমাকে সেই একই কথা বলে আসছেন আমি চরিত্রহীন, লোভী, স্বার্থপর, সুবিধাবাদী এরকম নানান উপাধি আমায় দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু আমি কিছুই বলিনি। কিন্তু আজ যদি আমি কিছু না বলি তার অর্থ এই হবে আমি এগুলো মেনে নিচ্ছি কারণ আমি এগুলোই। কিন্তু আমি জানি আমি এগুলোর একটাও নই। আপনি বারবার বলছেন আমি নাকি ছোঁয়াকে পালাতে হেল্প করেছি। এগুলো নাকি প্রিপ্ল্যান। আমি যদি ছোঁয়াকে পালাতে সাহায্য করেও থাকি তাতে আমার কি লাভ, আমি কেনো করতে যাবো এসব। আর ছোঁয়া তো কোনো বাচ্চা মেয়ে নয় যে আমি ওকে যা করতে বলবো ও তাই করবে। কই আপনাদের প্রেম তো আমি করিয়ে দেইনি, আপনারা নিজেরাই করেছেন। সাড়ে তিন বছর একটা সম্পর্কে ছিলেন। কতো সময় কাটিয়েছেন একসাথে, কতো সুখ-দুঃখের আলাপ করেছেন তাও কেনো অপর পাশের মানুষটাকে চিনে উঠতে পারেননি? কোথাও তো নিশ্চই খামতি ছিলো যার জন্য আজকে এই দিনটা এসেছে। ভালোবেসেছেন আপনারা অথচ আপনাদের ভালোবাসার বলি হয়েছি আমি। আচ্ছা আমার অপরাধটা কি একটু বলতে পারেন। আমার অপরাধ এটাই আমি ছোঁয়াকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছি। আচ্ছা ওহীও তো আমাদের বেস্টফ্রেন্ড। তাহলে কি ছোঁয়ার পালানোর পিছনে ওহীরও হাত আছে নাকি সে আপনার বোন বলে তার সাত খুন মাফ? আপনার কাছে এর কোনো জবাব নেই অন্তিম আহসান।
এই টুকু বলে সানাত অন্তিমের কলার ছেড়ে দিলো। অন্তিম কোনো কথা বলছেনা শুধু এক দৃষ্টিতে সানাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সানাত কাদঁছে। চোখের পানি মুছে আবারও বলতে লাগলো,

আপনি ভালোবাসার কথা বলছিলেন তাইনা? ভালোবাসার সংজ্ঞা আমার আপনার থেকে শিখতে হবেনা। কারণ আপনার থেকেও প্রখর ভাবে আমি ভালোবেসেছি একজনকে এবং এখনও বাসি তাকে। আপনাদের কাছে ভালোবাসা মানে হচ্ছে বাহ্যিক সৌন্দর্য, তাকে দৈহিকভাবে কাছে পাওয়া। কোনো না কোনো স্বার্থ আছেই আপনাদের ভালোবাসার পেছনে। কিন্তু আমি একজনকে পাবোনা জেনেও নিঃসার্থ ভাবে ভালোবেসে গেছি। ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। ভালোবাসা শুধু প্রাপ্তিতে নয় অন্তিম আহসান অপ্রাপ্তিতেও ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। আসলে সমস্যাটা আমাদের মতো মেয়েদের নয় সমস্যাটা আপনাদের। আপনাদের মতো বড়লোক ছেলেদের নিজেদের রূপ দেখিয়ে ফাঁসাবো অত সাধ্য আমাদের নেই। আপনাদের মতো ছেলেদের রুচি তো থাকে আপনাদের মতোই হাই ক্লাস ফ্যামিলির স্মার্ট, অতিমাত্রায় সুন্দরী, উশৃঙ্খল মেয়েদের দিকে। আমার মতো কালো মেয়েদের দেখলে তো আপনাদের রুচিতে বাধে, ঘেন্না পায়। এতো সাদামাটা মেয়ে আপনাদের ঠিক পোষায় না। আপনাদের দৃষ্টিতে বাহ্যিক সৌন্দর্যের কাছে আমাদের মনের সৌন্দর্যটা ফিকে পড়ে যায়। তাই তো আপনারা সুন্দর মন নয় সুন্দর রূপ খোঁজেন আর তারপর যখন সেই সুন্দর রুপের আড়ালে লুকিয়ে রাখা জঘন্য রূপটা সামনে আসে তখন আপনাদের কাছে সব মেয়েরা খারাপ। কখনো কারো ভেতরের সৌন্দর্য্য দেখে প্রেমে পড়েছেন? পড়েননি তাইনা? পরে দেখবেন সেখানে আর যাই হোক কোনো ধোঁকা, ছলনা বা মিথ্যা নেই। সেখানে শুধুমাত্র পবিত্রতা, শুদ্ধতা আর সত্যতা আছে। একজনকে দিয়ে অন্যজনকে বিচার করবেন না। সবাই এক নয় অন্তিম আহসান।
এইটুকু বলেই সানাত ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর অন্তিম ঠায় দাঁড়িয়ে সানাতের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার কানে এখনো বাজছে সানাতের বলা প্রত্যেকটা কথা। তার অবচেতন মন বলছে সে মারাত্মক ভুল করেছে।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে