অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৪

0
785

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৪
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

অন্তিম সবে মাত্র নিজের রুমে ঢুকেছে। গরমে গায়ের শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে। এই মুহূর্তে শাওয়ার না নিলে স্বস্তি মিলবে না। প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট, ফোন আর হাতের ঘড়িটা খুলে বিছানার পাশের সাইড টেবিলে রেখে সোজা আলমারি থেকে টিশার্ট বের করতে এগিয়ে গেলো। তবে আলমারি খুলতেই শান্ত মস্তিষ্ক মুহূর্তেই দপ করে জ্বলে উঠলো। রাগে সমস্ত শরীর কাঁপছে তার। তার আলমারিতে সানাতের জামাকাপড়। সানাত মাত্রই ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছিল। তবে ঘরে অন্তিমের উপস্থিতি দেখে সে কিছুটা অস্বস্তিতে পরে গেলো। সে ধীর পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই অন্তিম চেঁচিয়ে উঠলো। সানাত কিছু বুঝে উঠার আগেই অন্তিম তাকে টেনে এনে আলমারির সামনে দাঁড় করিয়ে বলতে লাগলো,

“হাও ডেয়ার ইউ? এতো বড় স্পর্ধা কি করে হয় তোমার? বিয়ে করেছি বলে কি নিজেকে আমার বউ ভাবতে শুরু করে দিয়েছো? অধিকার বুঝে নিচ্ছো?”

“আপনি ভুল ভাবছেন। আপনি ওগুলো রাখিনি।”

“জাস্ট শাট আপ। একদম ইনোসেন্ট সাজতে আসবেনা অন্তত আমার সামনে তো একদমই না। তোমার সাহস কি করে আমার আলমারিতে নিজের জামা কাপড় রাখার! কোনোকিছুর পারমিশন নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করোনা তাই না? অবশ্য তোমাদের মতো মেয়ের থেকে আর কিই বা এক্সপেক্ট করা যায়! তোমরা তো এই একটা কাজই পারো আদায় করতে সেটা যেভাবে হোক। যেমন ফ্যামিলি তেমন মেয়েরা!”

সানাত আহত দৃষ্টিতে তাকালো অন্তিমের দিকে। অথচ অন্তিম তার দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,

“ভবিষ্যতে কখনো এসব স্ত্রী সাজার নাটক করবেনা। তোমার মতো লোভী, স্বার্থপর, নাটকবাজ মেয়েদের আর যাইহোক স্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া যায় না। না আমি এই বিয়ে কোনোদিন মানবো আর না তোমাকে কখনো নিজের স্ত্রী হিসেবে মানবো। সো এসব সস্তা আবেগ আমার সামনে দেখাতে আসবেনা। আর ভুলে যেওনা এই বিয়েটা শুধুমাত্র তোমার আর তোমার বোনের বেইমানির রিভেঞ্জ নেওয়ার জন্য করেছি।” বলেই অন্তিম ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো।

সানাত ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো আর তারপর হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। কি দোষ তাঁর? সে তো কাপড়গুলো রাখেনি ওহী রেখেছিলো। আর কি বলে গেলো সস্তা আবেগ! তার আবেগ সস্তা! কতো অনায়াসে তার আবেগকে সস্তা বলে গেলো লোকটা! শুধু সস্তা নয় তাকে লোভী, স্বার্থপর, নাটকবাজ নামক উপাধি দিয়ে গেছে। আচ্ছা আদেও কি সে লোভী, স্বার্থপর? এতটা অপমান কি তার প্রাপ্য? সানাতের ভেতরের সত্তাটা বলে ওঠে,
“না সানাত তুই লোভী না, তুই স্বার্থপর না, তুই অপরাধী না। এতো অপমান তোর প্রাপ্য না। কেনো মুখ বুঁজে সহ্য করছিস? আর কতো সহ্য করে যাবি? সবাই যে তোর কোমলতার সুযোগ নিয়ে তোকে আঘাত করে যাচ্ছে। কেনো তুই অন্যের দায় নিজের ঘাড়ে নিবি? এবার তো অন্তত জবাব দে। অন্তত নিজের জন্য হলেও জবাব দিতে শিখ। চুপ করে থাকিস না আর!”
মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে সানাত ক্লান্ত। এরই মাঝে নিচ থেকে ডাক এলো তাকে নিচে ডাকছে। সানাত সন্তপর্নে গালের পানি মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

🌻
ড্রয়িং রুমে সোফায় মাথায় ঘোমটা টেনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে সানাত। তাঁকে ঘিরে রেখেছে অন্তিমের ফুফু, খালা, মামীরা। সকলের মধ্যে অন্তিমের বড়ো ফুফু বেশ অদ্ভুত ভাবে সানাতকে দেখছে। কণ্ঠে বেশ গম্ভীরতার রেশ টেনেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন,

“তা তোমার বাবার বাড়ি কোথায়?”

“জ্বি, চট্টগ্রাম।”

“ও। বাবা কি করেন?”

“জ্বি, তাত শাড়ীর ব্যবসা করেন।”

“শুনলাম মা নেই তোমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন!”

“হ্যাঁ, আমার জন্মের সময়ই মা মারা গেছেন। এরপর বাবা বিয়ে করেছেন।”

“সে ঘরে ছেলে-পেলে নেই?”

“হ্যাঁ দুই ভাই-বোন আছে। বোন উচ্চমাধ্যমিক দেবে আর ভাই দশম শ্রেণীতে পড়ে।”

“ও।” বলেই তিনি পেছনে দাঁড়ানো অন্তিমের মায়ের পানে তাকিয়ে বলে ওঠেন,

“অন্তিমের মা যা দেখলাম তাতে এই মেয়ে অন্তিমের জন্য আনা লাগেনা। বাপের বাড়ির অবস্থাশালিও কোনো রকম তেমন ভালো নয়। মেয়েও তেমন আহামরি সুন্দরী নয়। গায়ের রং চাপা। কোথায় আমার ভাতিজা অন্তিম আর কোথায় এই মেয়ে! একদম বেমানান!”

সানাতের চোখ দুটো মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো। কিন্তু সে সর্বোচ্চ দিয়ে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

“আহ বড় আপা। এভাবে বলবেন না। টাকা পয়সার কথা উঠছে কেনো টাকা পয়সা কি আমাদের কম আছে! আর গায়ের রং একটু চাপা তাতে কি চেহারাটা বড্ডো মায়াবী। আমার ওহীর বান্ধবী ওকে তো আমি এর আগেও কতো দেখেছি। যথেষ্ট অমায়িক মেয়ে।”

“থামো তুমি। কতো ভালো মেয়ে তা আমার ঢের জানা আছে। এক বোনকে দিয়ে তো দেখলাম কতো ভালো! যার বোনই অমন চরিত্রহীনা সেখানে ও কেমন তা খুব ভালো করেই জানি। একদম মাথায় তুলে নাচবেনা বলে দিলাম।”

অর্পিতা আঞ্জুম বড়ো ননদের সামনে আর কিছুই বলতে পারলেন না। সানাত মাথা মাথা তুলে একবার সামনে তাকালো চোখের সামনে স্পষ্ট ডাইনিং টেবিলে অন্তিম খাচ্ছে আর টুকটাক কথা বলছে। ওখান থেকে সে সব কথাই শুনতে পেয়েছে অথচ একটাবারও ফিরে তাকালো না। সানাত নিজের ভাবনায় নিজেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ভেতরের সত্ত্বাটা বলে উঠলো,
“তুই কার কাছ কি আশা করিস সানাত? অন্তিম আহসানের থেকে তুই তোর জন্য সম্মান আশা করিস! এতো পুরো মূর্খের স্বর্গে বাস! যে মানুষ তোকে অসম্মান করতে এক তিল পরিমাণ ছাড় দেয় না তাঁর কাছ থেকে কিনা তুই সম্মান আশা করিস! হাস্যকর! ধিক্কার জানানো উচিৎ তোর নিজের ওপর।”
সানাত আর ভাবতে পারলোনা। সে নিজেও জানেনা তার এতো খারাপ কেনো লাগছে। সে তো জানে তাঁর সাথে এমন কিছুই হবে তবুও কেনো কষ্ট হচ্ছে? সানাতের ভাবনার মাঝেই অন্তিমের মা অর্পিতা আঞ্জুম বলে উঠলেন,

“সানাত তুমি ওহীর সাথে ওপরে যাও গিয়ে তৈরি হয়ে নাও। রিসেপশনটা অত বড় করে করা তো আর সম্ভব হয়ে উঠলো না এই পরিস্থিতিতে। তাই ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে। ওহী সানাতকে নিয়ে ওপরে গিয়ে রেডি করে দে। একটু পরেই মেহমানরা আসতে শুরু করবে। ”

সানাত আর দাঁড়ালো না ওহীর সাথে ওপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।

🌻
ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে নিজেকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল সানাত। শ্যাম বর্ণ গায়ে জড়িয়েছে মেরুন রঙের কাতান শাড়ি, সাথে কিছু ভারী অলঙ্কার আর মুখে মোটামুটি প্রসাধনী। সবমিলিয়ে সানাতের মায়াবী মুখটা আরো মায়াবী লাগছে। ওহী পেছন থেকে আয়নায় সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

“কিরে কেমন সাজালাম বল? বলেছিলাম না তুই নিজেই নিজের থেকে চোখ ফেরাতে পারবিনা, মিললো তো? সত্যিই সানাত তোকে আজ খুউব সুন্দর লাগছে। মাশাআল্লাহ। দাড়া একটু কাজল ছুঁইয়ে দিই নাহলে আবার নজর লাগবে।”

“তুই থামবি ওহী! আমার মতো কালো মেয়ের দিকে কেউ নজর দিবেনা, বুঝলি।”

“একদম ফালতু কথা বলবি না সানাত। কে বলেছে তুই কালো? তুই হলি উপন্যাসের কবিদের লেখা শ্যামসুন্দরী রমণী।”

সানাত হেসে বললো,
“তোর সান্ত্বনা তোর কাছেই রাখ আমি জানি আমি দেখতে কেমন।”

“কচু জানিস তুই।”

সানাত আয়নার দিকে তাকিয়ে ওহীকে দেখে মলিন হাসলো। তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল,

“আচ্ছা ওহী আজ তো ওই বাড়ি থেকে মামণি আর খালুও আসবে, তাই না?”

ওহী কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো তারপর
শান্ত স্বরে বলে উঠলো,

“ওনারা আসবে না সানাত।”

সানাতের উচ্ছাসটা যেন হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো। ওহী বললো,

“বাবা কল করেছিলো তোর খালুকে। সে মুখের ওপর না জানিয়ে দিয়েছে।”

“ওহ।”
সানাতের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। তবুও সে কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

“আজ আমার জায়গায় ছোঁয়া হলে নিশ্চই খালা মামণি আসতো বল। আমি বলেই আসছে না। অবশ্য ঠিকই আছে। হাজার হলেও আমি তো আর তাদের নিজেদের মেয়ে নই। ছোঁয়াতো নিজের মেয়ে। নিজের সন্তানের সাথে অন্যের সন্তানের তুলনা চলে!”

“সানাত বাদ দে এসব। আজকের দিনটায় এসব ভেবে কষ্ট পাস না।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে