অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০৩

0
754

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০৩
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সকালবেলা কারো ধাক্কায় সানাতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলতেই দেখতে পেলো সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটি তার দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। সানাত কিছু বলে ওঠার আগেই মেয়েটি বলতে লাগলো,

“কিরে এতক্ষনে তোর ঘুম ভাঙলো! আমি সেই কখন থেকে তোকে ডেকে যাচ্ছি আর তোর কোনো হুশই নেই। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম ভাবলাম বিরহে তুই আবার কিছু খেয়ে-টেয়ে নিলি নাকি?”

সানাত খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ে তাকে আবারও খোঁচাচ্ছে। যাতে সানাত গতকালের ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে একটু স্বাভাবিক হতে পারে। সানাত সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,

“সকাল সকাল তুই শুরু করে দিয়েছিস তাইনা ওহী? সর সামনে থেকে।”

“নে সরলাম এবার ওঠ। উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে আমায় উদ্ধার কর বান্ধবী অপস থুরি মিস্টেক ভাবী। এখন তো আর তুই শুধু আমার বান্ধবী নেই ভাবি হয়ে গেছিস।”
বলেই হাসলো ওহী। অথচ সানাতের মুখটা মলিন হয়ে গেলো। যেনো ভেতরের ক্ষতটা আবার তাজা হয়ে গেছে। ওহী বুঝতে পারলো সানাতের অবস্থা তাই সানাতকে আশ্বস্ত করতে বললো,

“দেখ সানাত যাই হয়ে যাক না কেনো তোর আর আমার বন্ধুত্বে এর কোনো প্রভাব পড়বেনা। আমার ভাইয়ের সাথে তোর বিয়ে হয়েছে বলে তোর আর আমার বন্ধুত্বের সমীকরণ বদলে যাবেনা। ভাইয়ার সাথে তোর পরিচয়ের অনেক আগে থেকে তোর সাথে আমার বন্ধুত্ত্ব। তাই আমি চাইনা আমার ভাইয়ের জন্য তোর আর আমার মাঝে এক বিন্দু পরিমাণও দূরত্ব আসুক। তুই আগেও আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলিস আর এখনো আছিস ভবিষ্যতেও থাকবি। শুধুমাত্র একটা জিনিসই বদলাবে আগে আমরা তিন বেস্টফ্রেন্ড ছিলাম এখন আমরা দুই বেস্টফ্রেন্ড। কারণ আরেকজন কখনো বন্ধু ছিলইনা বরং বন্ধুর আড়ালে বেঈমান ছিলো। তাই আমি বলবো ভুলে যা পেছনের সবকিছু। আর শোন তুই এখন যতই সম্পর্কে আমার ভাবী হোস না কেনো ভাবীর আগে তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড।”

সানাত মলিন হেসে বললো,

“যেখানে তোর ভাইয়ের কাছে এই বিয়েটার কোনো ভিত্তিই নেই সেখানে কিসের ভাবী ননদের সম্পর্ক জুড়ছিস তুই?”

“এখন আর জোড়ার সময় নেই তুই জুড়ে গেছিস। এই বিয়েটা কেউ মানুক আর না মানুক তাতে সত্যিটা কখনো বদলে যাবেনা। যেই পরিস্থিতিতেই বিয়েটা হোক না কেনো বিয়ে তো হয়ে গেছে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।”

“ওহী সম্পর্ক মন থেকে তৈরি হয়, স্বীকৃতি মন থেকে দিতে হয় কিন্তু আমাদের এই সম্পর্কে যেটা আছে সেটা সম্পূর্ণ জোরপূর্বক। একটা বেরিশিকলের মতো। ওহী তুই তো জানিস আমি পরিস্থিতির শিকার, আমার কোনো অপরাধ নেই। তাহলে কেনো সবার চোখে আমি অপরাধী, স্বার্থপর, খারাপ। বলতে পারিস? ছোঁয়া কি করে পারলো এতো বড় একটা বেইমানি করতে?”
আর বলতে পারলোনা সানাত কান্নায় তার গলা জড়িয়ে আসছে। ওহী সানাতকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর সানাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো,

“সানাত তুইই তো সবসময় বলিস যা হয় ভালোর জন্য হয়। উপরওয়ালা কখনো ভালো মানুষের সাথে খারাপ করেননা। তাহলে আজ কেনো এই কথাটা বিশ্বাস করছিস না। হয়তো উপরওয়ালা অন্য কোনো পরিকল্পনা করে রেখেছে। তোর সাথে হয়তো ভাইয়ার ভাগ্যটাই জুড়ে রেখেছিল তাই আজ তোরা অনিচ্ছা সত্বেও এই বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়েছিস। সানাত হয়তো আজ সময়টা খারাপ যাচ্ছে কিন্তু এর মানে এই নয় সবসময় পরিস্থিতি এমনি থাকবে। সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। তুই অনেক সুখী হবি আমি বলছি তোকে তুই মিলিয়ে নিস। তুই সুখী না হলে আর কে সুখী হবে শুনি কারণ তুই তো পুরোটাই ভালো।”

“সান্ত্বনা দিচ্ছিস?”

“মোটেও না। জানি তুই হয়তো এখন বিশ্বাস করবিনা কিন্তু দেখিস একটা সময় আসবে যখন ভাইয়া নিজে তোকে পাগলের মত ভালোবাসবে। তোদের এই বিয়েটা তোদের জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়াবে। এটা আমি বলছি তোকে। তুই খুব ভালো করেই জানিস সানাত আমি বরাবর আমার ভাইয়ের সাথে তোকে দেখতে চেয়েছি। কিন্তু ছোঁয়ার সাথে ভাইয়ার সম্পর্ক থাকায় আমি এই চাওয়াটা কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। তবে আমি সবসময় চাইতাম যেনো তোর সাথেই আমার ভাইয়ার বিয়ে টা হয়ে যায়। আর দেখ উপরওয়ালা আমার ইচ্ছা পূরণ করেছে। এই বিয়েতে সবথেকে বেশি যদি কেউ খুশি হয়ে থাকে সেটা আমি। কারণ কেউ না জানলেও আমি জানি তুই আমার ভাইকে কতোটা ভালবাসিস। কেউ তোর সযত্নে লুকিয়ে রাখা ভালোবাসা বুঝতে না পারলেও আমি পেরেছি। তোর চোখে আমি ভাইয়ার জন্য যেই ভালোবাসা দেখেছি তার এক ভাগও আমি ছোঁয়ার চোখে দেখিনি। তাই সবসময় চেয়েছি তোর ভালোবাসা যেনো মর্যাদা পায়। সানাত কোনো পরিস্থিতি নয় তুই তোর ভালোবাসার জোরে ভাইকে পেয়েছিস। যে পাবেনা জেনেও নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারে তাকে উপরওয়ালা ঠকাবেন না। কিন্তু ওই ছোঁয়ার সাথে যদি আমার কখনো দেখা হয় তাহলে ওর সাথে প্রত্যেকটা হিসেব মেটাবো। ওর জন্য আমার ভাই, তুই, পুরো পরিবার কতোটা ভুগছে তার হিসেব ওকে দিতে হবে। আর হ্যাঁ মনে রাখিস একটা প্রবাদ আছে কিন্তু পুরুষ তার প্রথম নারীর কাছে ঠকে, আর দ্বিতীয় নারীর কাছে মরে। তাই আমি বলবো তোদের এই সম্পর্কটাকে সময়ের উপর ছেড়ে দে। যাই হোক তুই ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পাল্টে নিচে আয়। সবাই অপেক্ষা করছে।”
বলেই ওহী চলে গেলো। আর সানাত ঠায় দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো ওহীর বলা কথা গুলো। বিশেষ করে ওহীর বলা শেষ কথাটা। আচ্ছা আদেও কি সে কোনদিন অন্তিমের দ্বিতীয় ভালোবাসা হতে পারবে? দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসা যায়? এর উত্তর জানেনা সানাত। ওহীর সাথে তার আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিংএর সময়। সেখান থেকেই তাদের বন্ধুত্ত্ব। ছোঁয়া, ওহী, সে একই সাথে কোচিং করেছিলো তবে ভাগ্যক্রমে ওহী আর তাঁর একই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হলেও ছোঁয়ার হয়নি। ওহী মেয়েটা বরাবর সানাতের পাশে ছিলো। মেয়েটা সানাতকে সবথেকে ভালো বুঝতে পারে। ছোঁয়াও সানাতকে খুব ভালোবাসতো। তবে কেনো সে সানাতকেই বলির পাঁঠা বানালো তা জানেনা সানাত। সানাতের জীবনে দুজন ভালো বন্ধু ছিলো যার মধ্যে একজন নিজের বোন যে কিনা সময়ের সাথে সাথে আসল রূপটা দেখিয়ে দিয়েছে। অথচ আরেকজন ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জীবনে প্রকৃত বন্ধু চিনতেও সানাত ভুল করেছে। যে ভুল তাঁর পুরো জীবনটা এক নিমেষে বদলে দিয়েছে।

🌻
সানাতের আজও স্পষ্ট মনে আছে সেই দিনটার কথা যেদিন সে জানতে পেরেছিল ছোঁয়া আর অন্তিমের সম্পর্কের কথা। সানাত তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তার খুশি তখন আকাশ ছাড়িয়েছে। এদিকে তাঁর অবাধ্য মন সেদিনের হঠাৎ দেখা হওয়া অন্তিমকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। কবে থেকে কিভাবে তা জানেনা সানাত তবে এইটুকু জানে প্রথম সাক্ষাৎকারেই সে প্রেমে পড়েছে সেই লোকটির। ছেলেটির নাম ঠিকানা কিছুই জানেনা সে অথচ তাকে নিয়ে রোজ চিঠি লেখে। সেই চিঠি দিনশেষে তার টেবিলের ড্রয়ারেই পড়ে থাকে। তার কথা ভেবেই আনমনে হাসে সানাত। আর এদিকে সানাতের এই অদ্ভুত প্রেমকাহিনী শুনে ছোঁয়া মজা ওড়ায়। সে ভেবেই পায়না একটা অচেনা ছেলের সাথে প্রথম দেখায় কিছু না জেনেই কিভাবে গভীর প্রেমে পড়া যায়। ছোঁয়ার পেছনে এক ছেলে ৫ মাস যাবৎ ঘুরছে। অবশেষে ছোঁয়া ১ মাস হলো প্রোপোজে রাজি হয়েছে। প্রোপোজ একসেপ্ট করার পরে জানতে পেরেছে সেই ব্যক্তি আর কেউ না তাদেরই আরেক বেস্টফ্রেন্ড ওহীর ভাই। বেশ কিছুমাস আগেই বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরেছে। আজ ছোঁয়া সানাতকে নিয়ে যাচ্ছে সেই বিশেষ মানুষটির সাথে দেখা করাতে। অবশ্য সাথে ওহীও যাবে।
🌻
বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ ছোঁয়া আর সানাত একটা ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছে সেই বিশেষ মানুষটির জন্য। ছোঁয়া এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে করতে বেশ বিরক্ত। সানাত একটা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

“ক্ষেপিস না এসে যাবে? হয়তো জ্যামে আটকে গেছে।”

“ক্ষেপবোনা মানে? কতক্ষন ধরে ওয়েট করছি অথচ অন্তিমের কোনো হুশই নেই। কেউ কারো প্রেমিকার ব্যাপারে এতোটা কেয়ারলেস কি করে হতে পারে?”

“আচ্ছা শান্ত হ। আমি ওহীকে কল করছি।”

“করে কোনো লাভ নেই। আমি ট্রাই করেছি ফোন সুইচস্টপ। আচ্ছা বাদ দে ওদের কথা। তুই তো দেখছি এখানেও তাকে খুঁজছিস। আচ্ছা সে বুঝি খুব হ্যান্ডসাম।”

“জানিনা তবে আমার চোখে তো তাই।”

“ইশ এভাবে বলিসনা দেখা গেলো আমিই প্রেমে পড়ে গেলাম। তারপর তোর কাছে তাকে চেয়ে বসলাম। তখন তোর কি হবে জানু?” বলেই ছোঁয়া হাসতে লাগলো।

“কি আর করবো তুই চেয়েছিস আমি কি আর না করতে পারি হাসি মুখে দিয়ে দেবো।”

“থাক আর চাপা মারিস না। মানুষ সবকিছু শেয়ার করতে পারে কিন্তু ভালোবাসার মানুষকে না। বুঝলি?”
কথার মাঝেই ছোঁয়া সামনে তাকাতেই দেখলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি এসে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

“এই সানাত ঐ যে তোর জিজু এসে গেছে। দেখ।”

“কোথায়?”

“আরেহ গাঁধী তোর পেছনে?”

সানাত পেছনে তাকাতেই থমকে গেলো। চোখে মুখে ফুটে উঠলো খুশির ঝিলিক। অবশেষে সে এতদিন ধরে খুঁজে আসা মানুষটির দেখা পেলো। সানাত ছোঁয়ার হাত আকড়ে বললো,

“পেয়ে গেছি ছোঁয়া।”

“যাক তোর মত কানা যে দেখতে পেয়েছে এই অনেক।”

ইতিমধ্যে ওহী ও অন্তিম দুজনেই ওদের সামনে এসে উপস্থিত হলো। অন্তিম এখনো সানাতকে খেয়াল করেনি। সে ছোঁয়ার সমানে এসেই কান ধরে বললো,

“সরি মাই লাভ এতটা অপেক্ষা করানোর জন্য।”

মুহূর্তেই সানাতের সাজানো স্বপ্নগুলো গুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। অন্তিমের বলা কথাটা তার ভেতরে ঝঙ্কার তুলেছে। সানাত নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের মানুষটির দিকে। এদিকে ছোঁয়া বলতে লাগলো,

“হয়েছে আর নাটক করতে হবেনা। মিট হার। সি ইজ মাই কাজিন অ্যান্ড বেস্টফ্রেন্ড।”
বলেই সানাতের সাথে আলাপ করিয়ে দিলো। অন্তিম সানাতকে দেখতেই বলে উঠলো,

“আরেহ আপনি?”

“তুমি চেনো ওকে?”

“হ্যাঁ কিছুমাস আগে ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো। ঐতো উনি তখন…”

আর কিছু বলার আগেই সানাত থামিয়ে দিলো। কারণ তাদের কীভাবে দেখা হয়েছিল সেটা ছোঁয়া আর ওহী জানতে পারলে ওরা বুঝে যাবে অন্তিমই তার সেই মানুষ যাকে সানাত ভালোবাসে। সানাত বলতে লাগলো,

“আচ্ছা কিভাবে চিনি সেটা বড়ো বিষয় নয় আগে ওদের বসতে তো দে।”

সানাতের কথায় বাকিটা চাপা পড়ে গেলো। এরপর অনেক কথাই হলো কিন্তু সানাত ছিলো নিশ্চুপ। এই বিষয়টা কারো চোখে না পড়লেও ওহীর চোখে পড়েছিল। তবে সে বিষয়টা নিয়ে তখন চুপ ছিল।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে