অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-২৩

0
729

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-২৩
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আজ সকাল থেকেই সানাত মহা ব্যস্ত। আজ ওহীর বিয়ে। মানে ঘরোয়া ভাবেই ছোটো খাটো করে আয়োজন। কাছের কিছু আত্মীয় স্বজনে গোটা বাড়ি ভরপুর। সানাত শাড়ীর আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ওহীর ঘরের দিকে পা বাড়ালো কিন্তু অমনি পেছন থেকে কেউ হেচকা টান দিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে দরজা লক করে দিলো। সানাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটার দিকে। তারপর বলে উঠলো,

একি আপনি হঠাৎ এভাবে এখানে টেনে আনলেন কেনো?

ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে। বললো অন্তিম।

সানাত যেনো ঝটকা খেলো এমন কথা শুনে। মুহূর্তেই ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠলো,

কিইই আপনি এখন এই সময় আমাকে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে এখানে নিয়ে এসেছেন!

হ্যাঁ। কি করবো তুমি এতো ব্যস্ত যে আমাকে তো এখন তোমার নাগাল পেতে গেলে এপয়েনমেন্ট নিতে হবে। তাই এভাবে চোরের মতো টেনে নিয়ে এসেছি।

দেখুন আপনার এসব ফালতু কথা শোনার মতো সময় আমার নেই। এমনিতেই আমি কাজের যন্ত্রণায় শান্তিতে দম নিতে পারছি না আর আপনি আমার সাথে এখন এসব ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করছেন! সরুন তো!

এভাবে ইগনোর করছো? ছি ছি সানাত আহত হলাম।

আপনার নাটক বন্ধ করুন। আমার অনেক কাজ আছে। ছাড়ুন।

এখন না হয় ছাড়লাম কিন্তু রাতে তোমার খবর আছে।

সানাতের কান গরম হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। হালকা রাগ দেখিয়ে বললো,

ছিঃ অসভ্য লোক! এতো নির্লজ্জ কেনো আপনি ?কোনো কথা মুখে আটকায়না। ঠোঁটকাটা!

অন্তিম বাঁকা হেসে বললো,

এখনো তো আসল কাজই করিনি তার আগেই আমি অসভ্য? আর হাসবেন্ড ওয়াইফ দুজনেই লজ্জাবতী হলে তো মহা সমস্যা। তুমি এমনিতেই যে লজ্জাবতী তোমার সাথে যদি আমিও তোমার মতো লজ্জাবতী হই তাহলে আমার আর বংশের বাতি জ্বলবে বলে মনে হয়না। তাই আমার বংশ রক্ষা করতে হলে আমাকে একটু নির্লজ্জ হতেই হবে।

সানাত লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে অব্দি পারছেনা। অন্তিম হো হো হেসে ফেললো সানাতের এই হাল দেখে। সানাত ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বললো,

দিন দিন চরম অসভ্য হয়ে গেছেন আপনি। পথ ছাড়ুন আমার।

বেশ যাচ্ছো যাও। আলমারিতে গিয়ে দেখো একটা লাল শাড়ি আছে। ওটা পরো আজ।

সানাত মিষ্টি করে হাসলো । তারপর চলে গেলো। এদিকে অন্তিম জানেনা ওই শ্যামবতীর হাসিতে কি ছিলো কিন্তু সে বুঝলো এই মুহূর্তে সে আবার আটকে গেলো ওই মারাত্মক ভুবনভুলানো হাসিতে।
.
.

ওহী সেজে গুজে বসে আছে। সানাত রেডি হয়ে সবে মাত্র ওহীর কাছে এসেছে। ওহী সানাতকে দেখা মাত্রই রেগে বললো,

কিরে হারামজাদি তুই এতক্ষনে এসেছিস!

বিয়ের দিনেও তুই আমাকে গালিগালাজ করছিস বেয়াদব!

তো করবনা? তুই কেমন বেস্টফ্রেন্ড একটা বারও আমার খোজ নিতে আসলি না!

আমি তোর বিয়েতে খেটে মরছি আর তুই আমাকে বলছিস আমি খোঁজ নেইনা?

আমার কাছে তো আর আসিস নি।

নাটক কম কর ফাজিল। খাবার এনেছি নে খেয়ে নে।

দোস্ত তুই আমার সত্যিকারের বান্ধুবি একদম আপন। আমি খিদার জ্বালায় মরে যাচ্ছিলাম। মানে আমার বিয়েতে আমি অভুক্ত এটা কোনো কথা? আমি বাদে সবাই পেট পুরে খেয়ে নিয়েছে।
.
.

ঠিক তিনবার কবুল আর একটা স্বাক্ষর করতেই ওহীও আজ কারো বিবাহিতা স্ত্রী হয়ে উঠলো। এই কিছুক্ষণ আগেই বিয়ে পড়ানো শেষ হয়েছে ওহী আর রাদিফের। ওহী নতুন বউ হয়ে ঘোমটা টেনে বসে আছে। আর পাশে বসেই সানাত ওর মজা নিচ্ছে। সব শেষে কাজীকে বিদায় দিতে গেলেই অন্তিম আটকে বললো,

দাঁড়ান কাজী সাহেব। যাচ্ছেন কোথায়?

কেনো বাবা আমার কাজ তো শেষ।

কে বললো আপনার কাজ শেষ। এখনো আরেকটা বিয়ে পড়ানো বাকি। অন্তিমের বলা এই একটা কথা যেনো বজ্রপাতের মত পড়লো ঘরের ভেতর। উপস্থিত সকলেই অবাক। কাজী নিজেও অবাক হয়ে বললো,

বিয়ে তো হয়ে গেছে বাবা। তুমি আবার কার বিয়ের কথা বলছো? বলেই তিনি পেছনে খুঁজতে লাগলেন। অন্তিম বলে উঠলো

আপনি ওদিকে কি খুঁজছেন? পাত্র তো আমি। আমি আমার বিয়ের কথা বলছি।

এবার যেনো উপস্থিত সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কাজী যেনো হোঁচট খেলেন। তারপর ঢোক গিলে বললো,

তা কি করে সম্ভব বাবা? তুমি তো বিবাহিত! বউ আছে তোমার।

তাতে কি হয়েছে দ্বিতীয়বার কি বিয়ে করা যায়না?

সানাত যেনো এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। মুহূর্তেই চিল্লিয়ে উঠে বললো,

এই আপনি কিসব বলছেন? আপনি দ্বিতীয় বিয়ে করবেন মানে?

অন্তিম সানাতের দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো,

আহ থামো তুমি।

তারপর আবার কাজীর দিকে তাকিয়ে বললো,

আপনি শুরু করুন কাজী সাহেব। আমি আবার দ্বিতীয় বিয়ে করবো। প্রথম বিয়েটা আমার মন মতো হয়নি পরিস্থিতি আলাদা ছিল তাই এবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করবো।

কাজী মিন মিন করে বললো,

কিন্তু বিয়েটা কাকে করবে বাবা? পাত্রী কই?

কেনো আপনি চোখে দেখছেন না? তারপর সানাতের দিকে ইশারা করে বললো,

ঐ যে পাত্রী।

কিন্তু ওটা তো তোমার বউ।

তো আমি কখন বললাম আমি অন্য কোনো মেয়ে বিয়ে করবো?

কিন্তু তুমিই তো বললে তুমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করবে !

তো আমি শুধু বলেছি আমি দ্বিতীয়বার বিয়ে করবো। কাকে করবো সেটা তো বলেনি। আর বিয়ে করা বউকে কি দ্বিতীয়বার বিয়ে করা যায় না? কোনো সমস্যা আছে?

হ্যাঁ করা যায় কোনো সমস্যা নেই কিন্তু ব্যাপারটা একটু কেমন না?

যেমনি হোক আমি করবো। আমার শখ আমার বউ। আমি আমার মনের মত করে বিয়ে করবো। বিয়ে নিয়ে সবাইরি কম বেশি অনেক স্বপ্ন থাকে। কিন্তু প্রথম বিয়েটা হুট করেই হয়ে গেলো। তাই আবার করবো। আপনি শুরু করুন। আমার বউ একদম লাল বেনারসিতেই আছে আর আমিও পাঞ্জাবিতে। বলেই সানাতের দিকে তাকালো অন্তিম। সানাত মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে লাজুক হাসছে। অন্তিমও হেসে ফেললো।
তারপর দুজনেই মুখোমুখি বসলো। তারপর আরো একবার নতুন করে শুরু করলো সবটা। পুরোনো সব অপূর্ণতা আজ পূর্ণতা পেলো অন্তিমের হাত ধরে। পুরো ঘর ভর্তি আত্মীয় স্বজন। সানাত লজ্জায় তাকাতে অব্দি পারছেনা। না জানি তারা এই পাগলামিকে কি ভেবেছে? সানাত মাথা নিচু করে বসে আছে। তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা জল। সানাতের আজও মনে আছে সেই বারও সে কবুল বলতে গিয়ে কেঁদেছিল এবারও কাঁদছে। তবে তফাৎ একটাই গতবারের কান্নাটা অসহায়ত্বের ছিলো আর এবারের কান্নাটা সুখের, প্রাপ্তির। সানাত বিশ্বাস করতে বাধ্য অপেক্ষা আর ধৈর্যের ফল সবসময় মিষ্টি হয়। আর অন্তিম বিশ্বাস করতে বাধ্য উপরওয়ালা যা কেড়ে নেয় তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ফিরিয়ে দেয়।
.
.

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২:৩০। সানাত সবে মাত্র ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছে। আজকের রাতটা রাদিফকে কে এখানেই রেখে দেওয়া হয়েছে। ওহীর বাসর ঘর সাজিয়ে সানাত নিজের ঘরে পা রাখলো। তবে তার ঘরে ঢুকে সে যা দেখতে পেলো তাতে সে পুরোপুরি স্তব্ধ। তার সামনে অন্তিম পুরো খাট ফুল দিয়ে সাজিয়ে খাটের মাঝে বসে আছে। সানাতকে দেখা মাত্রই অন্তিম বলে উঠলো,

সারাজীবন শুনে আসলাম বাসর রাতে নাকি বউরা বরের জন্য অপেক্ষা করে আর আমার ক্ষেত্রে তো পুরো উল্টো। আমি তোমার জন্য বসে আছি আর তোমার কোনো পাত্তাই নেই! মান ইজ্জত আর রইলো না।

সানাত দরজা লক করে এসে বললো,

এসব কি? কি করেছেন আপনি এসব? পুরো খাট এভাবে ফুল দিয়ে সাজিয়েছেন কেনো?

কি করবো বলো আমার তো আর বাসর ঘরের খাট সাজিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই তাই নিজেরটা নিজেই সাজালাম। তুমি।ভাবতে পারছো সানাত আমার ছোটো বোনও বাসর করে ফেললো আর আমি বিয়ের এতমাস হয়ে গেলো অথচ আমি করতে পারলাম না।

সানাত লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। তবুও মিথ্যে রাগ দেখিয়ে বললো,

ছিঃ! অসভ্য লোক। নিজের বোনের বাসরের কথা বলছে! এই আপনার একটুও লজ্জা করে না?এতো নির্লজ্জ কেনো আপনি?

অন্তিম কিছু না বলেই খাট থেকে নেমে সানাতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ওই মুহূর্তেই লোডশেডিং হয়ে গেলো। সানাত সামনে দাড়িয়ে থাকা অন্তিমকেই আকড়ে ধরে বললো,

একি অন্ধকার হয়ে গেলো কেনো?

ভালোই হয়েছে। এবার আমি আমার কাজ শান্তিতে করতে পারবো।

মানে?

আপনার নির্লজ্জ মানুষটা আজ নির্লজ্জের সর্বশেষ অব্দি যাবে। চলুন খাটে গিয়ে ফ্যামিলি প্ল্যানিং করি।
বলেই এক টানে কোলে তুলে নিলো সানাতকে। সানাত লজ্জায় মুখ লুকালো অন্তিমের বুকে। অন্তিম হাসলো। ভাগ্যিস আজ লোডশেডিং হয়েছিল নয়তো সানাত আজ আবারও কঠিন প্রেমে পড়ত অন্তিমের সেই নজরকাড়া হাসির প্রেমে।
অতঃপর আজ বহু বাঁধা আর দূরত্বের পরে অবশেষে একত্রিত হলো দুটি দেহ আর মিলন হলো আত্মার সাথে আত্মার। আজকের এই পূর্নিমার চাঁদও সাক্ষী হলো একটি মধুচন্দ্রিমা রাতের। চাঁদ হাসলো কি হাসলো না বোঝা গেলোনা তবে আজ অবশেষে পূর্ণতা মিললো অন্তিম আহসান আর সানাত নামের দম্পতির।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে