অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-২০

0
718

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-২০
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই পাশ বালিশটা শূন্য পেলো সানাত। মুহূর্তেই মনটা গাঢ় অভিমানে ছেয়ে গেল। সানাত উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই ডাইনিং টেবিলে অন্তিমকে দেখতে পেলো। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসে গল্প করছিল সে ওহী আর তার এক কাজিনের সাথে। সানাতকে দেখা মাত্রই অন্তিম কথা বলতে বলতেই তার পাশের চেয়ারটা টেনে বসার জন্য ইঙ্গিত করলো। তারপর প্লেট এগিয়ে দিলো সানাতের সামনে। তারপর একেক করে খাবার উঠিয়ে দিলো সানাতের প্লেটে। সানাত চুপচাপ বসে অন্তিমের কর্মকাণ্ড দেখছে। অন্তিম সানাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

আমাকে পরে দেখো। এখন খাও। আমাকে দেখলে পেট ভরবে না।

সানাত চোখ নামিয়ে ফেললো। তারপর খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। হঠাৎ করে অন্তিম সানাতের কপালে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

জ্বর নেই গায়ে। কাল রাতে অত জ্বর এসেছিল কি করে? ইচ্ছে করে বাঁধিয়েছিলে?

সানাতের খাওয়া থেমে গেছে ততক্ষনে। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে অন্তিম কি করে জানলো গতকাল রাতে তার জ্বর এসেছিলো? তবে কি সে রাতে ফিরে তার কাছে এসেছিলো? তাকে ছুঁয়ে দেখেছিল?

কি হলো তাড়াতাড়ি খাও ভার্সিটিতে যেতে হবে।

অন্তিমের কথায় সানাতের ঘোর কাটলো। সে সোজা খাওয়ায় মনোযোগী হলো।
.
.

ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে আছে সানাত। তার কিছুই ভালো লাগছে না। তাই ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে এসে বসে আছে। ওহী ক্লাসে। সানাতের সাথেই বসে আছে তার এক ফ্রেন্ড রাহি। সে নানান কথা বলে চলেছে কিন্তু সানাতের তাতে মোটেও মনোযোগ নেই। এমন মুহূর্তেই সানাতের ফোনটা বেজে উঠলো। সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে ভাসা নম্বরটা দেখতেই সানাত থমকে গেলো। আজ এতো মাস পর মামনির নম্বর থেকে কল এসেছে ভাবতেই সানাত অবাক হয়ে যাচ্ছে। সানাত রিসিভ করে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললো,

হ্যালো, মামণি!

কিরে কেমন আছিস? ভুলেই তো গেছিস দেখছি!

সানাত কি বলবে আনন্দে ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। মামণি তার সাথে আগের মতো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। সানাত আবেগে আপ্লুত হয়ে বললো,

ভালো আছি মামণি। তুমি কেমন আছো?

তোকে ছাড়া আর কেমন থাকতে পারি বল! সানাত এখন একটু বাসায় আসবি। তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কতদিন হলো তোকে দেখিনা!

সানাত কেঁদে ফেললো। তারপর বলে উঠলো,

আমি আসছি মামণি।

আয়। আমি অপেক্ষা করছি তোর জন্য। তারপর কল কেটে দিলো। আর সানাত উঠে দাঁড়ালো।
.
.

এই জ্যামের মধ্যে গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে একরকম হন্যে হয়ে ছুটে এসেছে সানাত। এতমাস পরে নিজের মায়ের মতো খালাকে কাছে পেয়ে সানাত সব ভুলে আকড়ে ধরলো। তারপর মুহূর্তেই হু হু করে কেঁদে ফেললো। রাবেয়া বেগম সানাতকে ধরে বললেন,

এভাবে কি কেঁদেই যাবি নাকি? বোকা মেয়ে চল ভেতরে। এতো দৌঁড় ঝাঁপ করে এসেছিস চল ভেতরে গিয়ে বসবি।
তারপর সানাতকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসালো।
টেবিলে এতো আইটেম সাজানো দেখে সানাত বলে উঠলো,

তুমি কি করেছো মামণি! এতো খাবার কে খাবে?

কেনো তুই খাবি। তোর জন্য করেছি। এতদিন পর এলি ভালো মন্দ আয়োজন করব না!

কিন্তু তাই বলে এতো কিছু করার কি দরকার ছিল! আর আমার অতো খিদেও নেই।

চুপ কর তুই। চুপচাপ খেতে বস।

সানাত বেশ অস্বস্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করে,

মামণি ছোঁয়া কোথায়? দেখছিনা যে।

ওর রুমে ঘুমাচ্ছে।

ওহ।
.
.

🌻
ড্রয়িং রুমে সোফায় মুখোমুখি হয়ে বসে আছে সানাত ও ছোঁয়ার বাবা আরহাম মির্জা। তার পাশেই দাড়িয়ে আছে ছোঁয়ার মা রাবেয়া বেগম। নীরবতা ভেঙ্গে আরহাম মির্জা নিজেই বলে উঠলেন,

তো কেমন আছো?

জ্বি, ভালোই আছি খালু।

ভালো তো থাকারই কথা। শোনো তোমাকে আজ এমনি এমনি এখানে ডাকিনি।

সানাত তাকালো। তারপর বললো,

মানে? কোনো দরকার ছিল?

দরকার তো অবশ্যই আছে তা নাহলে তোমাকে এতো ঘটা করে ডাকতাম না।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না খালু আপনার কথা।

ধৈর্য্য ধরো তারপর সব বুঝতে পারবে।
তারপর তিনি তার স্ত্রী রাবেয়া বেগমের দিকে কিছু একটা ইশারা করতেই রাবেয়া বেগম উঠে ভেতর থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে আসলেন। তারপর প্যাকেটটা সানাতের সামনে রেখে বললেন,

নে এটা তোর।

সানাত প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর বললো,

এতে কি আছে মামণি?

খুলে দেখ।

সানাত প্যাকেটটা খুলতেই থমকে গেলো। প্যাকেটের ভেতরে টাকার বান্ডিল রাখা। সানাত কিছু বলবে তার আগেই ছোঁয়ার বাবা বলে উঠলেন,

দেখো এতে চলবে কিনা তোমার? কম হয়ে গেলে আরো দেবো।

সানাত অবাক হয়ে বললো,

এসবের মানে কি?

মানে একটাই আমার মেয়ের সুখের পথ থেকে সরে যাও। অন্তিমকে ছেড়ে দেও।

সানাত অবাক হয়ে বললো,

এসব আপনি কি বলছেন?

পাশ থেকে রাবেয়া বেগম বলে উঠলেন,

একদম ঠিক বলেছে। তুই আমার মেয়ের সুখে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিস। তোর জন্য আজ আমার মেয়েটার চোখের পানি ঝড়ছে। তাই বলছি সরে যা। তোর তো টাকা হলেই হলো তাইনা? কতো লাগবে তোর তুই শুধু বল কিন্তু তার বিনিময়ে তুই শুধু অন্তিমকে ছেড়ে দে।

সানাত পাথর হয়ে দাড়িয়ে আছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার খালা তাকে ভালোবেসে নয় এভাবে অপমান করার জন্য ডেকেছে! সানাত কাপাকাপা গলায় বললো,

মা..মামণি তুমি এসব ক..কি বলছো?

একদম ঠিক বলছি। তোর জন্য কি করিনি আমি? সবসময় নিজের মেয়ের মতো দেখেছি। ছোঁয়া আর তোর মাঝে কখনো কোনো ভেদাভেদ করিনি। ভালো জামাকাপড় পড়িয়েছি, ভালো খাইয়েছি, থাকতে দিয়েছি, আদর যত্ন করেছি। জীবনে এতো কিছু জুটতো তোর কপালে যদি আমরা না দিতাম? তোর বাপেরই বা কি ছিলো? আর তুই কিনা বেঈমান মেয়ে আমার খেয়ে আবার আমারই ক্ষতি করিস! শোন সানাত শত হোক নিজের সন্তান নিজেরই। পর কখনো নিজের হয়না। তুই হলি আরেক গাছের ছাল। তোর জন্য আমার মেয়ের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে আর তুই সুখে থাকবি সেটা আমি মোটেও সহ্য করবো না। তাই বলছি চলে যা আমাদের জীবন থেকে। কেনো বুঝিসনা তুই একটা আপদ, একটা বোঝা তুই। অন্তিমের জীবনেও তুই একটা বোঝা। ওই ছেলে তোকে না পারছে বলতে আর না পারছে সইতে।

সানাত নিঃশব্দে দাড়িয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছে। রাবেয়া বেগম আবারও বলে উঠলেন,

আরেহ তুই কি অন্ধ নাকি নিজেকে কখনো আয়নায় দেখিসনি! কোথায় তুই আর কোথায় আমার মেয়ে! অন্তিম কেনো তোর মত একটা কালো চালচুলোহীন মেয়েকে নিয়ে ঘর করবে। মেলে তোর সাথে ওর! টাকা-পয়সা, নাম যশ সবকিছু থেকে আমাদের সাথে মেলে। তোর আছে কি যে তোকে নেবে? একটা মানান সই বিষয় তো আছে নাকি? মাটি আর চাঁদ তো কখনো এক হতে পারেনা। আর তুই বুঝিসনা লোকে হাসে অন্তিমের পাশে তোকে দেখলে। নেহাৎ ওরা যথেষ্ট ভদ্র তাই তোকে বুঝতে দেয়নি নাহলে কবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতো! আর সবথেকে বড়ো কথা সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক ওদের এটা কি এই কয় মাসে ভোলা সম্ভব! তাই বলছি তোর ভেতরে যদি সামান্যতম লজ্জাবোধ থাকে তাহলে মুক্তি দিয়ে দে অন্তিমকে। গলার কাঁটা হয়ে আটকে থাকিস না।

সানাত কান্নারত অবস্থাতেই মলিন হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

তুমি ভেবোনা মামণি আমি মুক্তি দিয়ে দেবো। ছোঁয়াকে আমি অন্তিমের সাথে সংসার করার রাস্তা করে দেবো। কাঁটা হয়ে আমি থাকবো না। এখন আসি।

আরহাম মির্জা বলে উঠলেন,

টাকাগুলো নিয়ে যাও।

সানাত একবার চোখ তুলে তাকালো তারপর বলে উঠলো,

টাকার বদলে আমি সম্পর্ক কেনা বেচা করিনা। এই টাকা গুলো নেওয়ার অর্থ হচ্ছে আমি কিছু টাকার জন্য অন্তিমকে বিক্রি করে দিয়েছি ছোঁয়ার কাছে। কিন্তু আমি অন্তিমকে বিক্রি করছি না। আমি তার ভালোবাসার মানুষের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। বলেই সানাত বেরিয়ে গেলো। তখন পেছন পেছন কাজের মেয়ে কাজল দৌঁড়ে এসে বললো,

আফা আপনের মোবাইল।

ধন্যবাদ কাজল। বলেই গেইট খুলে বেরিয়ে গেলো। আর কাজল মেয়েটা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।
.
.

🌻
সানাত বাড়ি ফেরেনি তুই আমাকে বলিসনি কেনো ওহী?

ভাইয়া আসলে আমি ভেবেছি ও বাড়ি চলে গেছে। আর আমিও ভার্সিটি থেকে একটু দরকারে বেড়িয়েছিলাম কিন্তু বিকালে বাসায় ফেরার পর আম্মু আমার সাথে সানাতকে না দেখে জিজ্ঞাসা করতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি ভেবেছি ও চলে গেছে বাড়িতে। কিন্তু ও যে আসলে বাড়ি যায়নি সেটা তো বুঝতে পারিনি।

জাস্ট শাট আপ ওহী। সানাত সেই এগারোটার পর বেরিয়েছে তারপর এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ ও কোথায় আছে কোনো খবর নেই।

ভাইয়া সানাত তো এমন কক্ষনো করে না। আজ হঠাৎ কি হলো? আমার খুব ভয় করছে।

আমিও বুঝতে পারছিনা ওহী ও ঠিক কোথায় যেতে পারে। আর বেয়াদবটা ফোনটাও অফ করে রেখেছে। কল করে যে একটা খোঁজ নেবো সেই উপায়ও নেই।

আচ্ছা ভাইয়া সানাতকে কি তুমি কিছু বলেছো? মানে কোনো ঝগড়া হয়েছে?

না ঝগড়া কেনো হতে যাবে।

তাহলে কি হলো?

কম তো খুঁজলাম না ওহী। এবার মনে হচ্ছে থানায় যেতে হবে।

ওহী ভয়ার্ত কন্ঠে বললো,

থানায়?

হুম।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে