অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০২

0
787

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০২
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আচমকা পুরো মুখে পানি পরতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সানাত। হঠাৎ পানি ছুঁড়ে মারাতে সানাতের নাকে কানেও পানি গেছে শাড়িও বেশ খানিকটা ভিজে গেছে। ঘুমের রেশ ঠিক মত না কাটলেও চোখ মুখ কুচকে সামনে তাকাতেই অন্তিমকে দেখে থমকালো সে। তার সামনেই অন্তিম একটা ফাঁকা গ্লাস নিয়ে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। সানাত কিছু বলার আগেই অন্তিম সানাতের হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে ধাক্কা মারতেই সানাত ছিটকে ফ্লোরে পড়লো। তারপর অন্তিম চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

“কোন সাহসে আমার বেডে শুয়েছো? বিয়ে করেছি বলে কি সব কিনে নিয়েছো ভাবছো? নাকি ভাবছো তোমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি? যদি তাই ভেবে থাকো তাহলে শুনে নেও তোমাদের মত থার্ড ক্লাস মেয়েদের আর যাই হোক ভালোবাসা যায় না।”

সানাত আহত দৃষ্টিতে তাকালো অন্তিমের দিকে। অন্তিম আবারও বলতে লাগলো,

“কি ভেবেছিলে তুমি আর তোমার বেস্টফ্রেন্ড বড়োলোকের ছেলের সাথে টাইম পাস করে কেটে পরবে! অবশ্য তোমাদের মত মেয়েরা তো এসবই পারে বড়লোক ছেলেদের নিজেদের কথা আর রূপের জালে ফাঁসাতে। এই একটা কাজেই তোমরা পারফেক্ট। তোমরা শুধু টাকা চেনো।”

“ভুল ভাবছেন আপনি।”

“একদম চুপ। কিচ্ছু ভুল ভাবছিনা যা ভাবছি একদম ঠিক ভাবছি। তোমার সো কল্ড বেস্টফ্রেন্ডকে যে তুমি পালাতে হেল্প করেছো সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি তাই এসব মিথ্যে বানোয়াট কাহিনী আমাকে শোনাবে না। তুমি আর তোমার বেস্টফ্রেন্ড এই সবকিছু প্ল্যান করে করেছো। তবে তুমি তোমার নিজের পাতা ফাঁদেই ফেঁসে গেছো। তোমাকে বিয়ে করেছি শুধুমাত্র নিজের জেদ আর প্রতিশোধ নিতে আর তোমার লাইফটা হেল করে দিতে। তোমার বেস্টফ্রেন্ড নাহয় পালিয়ে গেছে কিন্তু তুমি? তোমার মুক্তি নেই। তোমার বেস্টফ্রেন্ডের ভুলের মাশুল তোমাকে দিতে হবে। মাইন্ড ইট।”
বলেই অন্তিম লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। আর এদিকে সানাত অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। আজ অন্তিমের বলা প্রত্যেকটা কথা তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। সে বারবার একটা কথাই ভাবছে ভুলের মাশুল দিতে হবে কিন্তু কিসের ভুল! সে কোন ভুলের মাশুল দেবে! তার ভুলটা কোথায় সে নিজেই তো পরিস্থিতির শিকার। সবটা কেমন ওলোট পালোট হয়ে গেলো এক নিমিষেই। সানাতের চোখে ভাসতে থাকলো অতীতের সেই দিনগুলো।
সানাত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় তার খালামণি অর্থাৎ ছোঁয়াদের বাসায় আসে। এখানে আসার পথেই অন্তিমের সাথে তার প্রথমবারের মতো দেখা হয়। ভোর ৪ টায় বাস ঢাকার কাউন্টারে পৌঁছায়। সানাত এই প্রথম একা এতদূর এসেছে। এর আগে হয় বাবা না হয় খালামণি কাউকে নিতে পাঠিয়েছে। বাইরে তখনও অন্ধকার। শহরটা বেশ নিঃস্তব্ধ। সানাত গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে চোখ বুলালো। খুব একটা মানুষের আনাগোনা নেই বললেই চলে। এই নিঃস্তব্ধ শহরের ফুটপাতে শুয়ে আছে কিছু কুকুর। মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে আছে। হাত ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো ৪ টা বেজে ১০ মিনিট। রাতে বৃষ্টি হওয়ার ফলে আবহাওয়াটা বেশ শীতল। রাস্তায় কাকে জিজ্ঞেস করবে সেটা খুঁজতেই হঠাৎ এক লোককে দেখতে পেয়েই সানাত এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

এইযে ভাই শুনছেন?

লোকটি ফিরে তাকাতেই সানাত বললো,

জামে মসজিদ রোডটা কোন দিকে একটু বলবেন? আসলে আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছি। আমার এক আত্মীয়ের বাসায় যাবো। জামে মসজিদ রোডটা একটু দেখিয়ে দেবেন। আমার আত্মীয়ের আমাকে ওখান থেকে নিতে আসার কথা।

আচ্ছা চলুন আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

সানাত যেনো একটু ভরসা পেলো। সে লোকটির সাথে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু কিছুদূর যেতেই তার মনে অদ্ভুত ভয় কাজ করতে লাগলো। কারণ লোকটি তাকে বেশ সরু গলি দিয়ে কোথায় যেনো নিয়ে যাচ্ছে। এর আগেও সে তার খালামণিদের বাসায় এসেছে তবে এমন রাস্তা দিয়ে সে আসেনি। সানাত থেমে গেলো। তারপর লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলো,

এটা কোন রাস্তা? আপনি আমায় কোন রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন?

আরে আপনি ভয় পাবেননা। আসলে সামনের রাস্তাটা গতরাতে ঝড়ের ফলে গাছ পড়ে ব্লক হয়ে আছে। তাই এই রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আরেকটু সামনেই প্রায় এসেই পড়েছি।

সানাতের সন্দেহ যেনো দূর হলো না। সে বলল,

না না আমি এই রাস্তা দিয়ে যাবনা। আমি মেইন রোড দিয়েই চলে যাবো।

লোকটি আচমকা সানাতের হাত চেপে ধরে বললো,
আরেহ যাবেনা মানে? এতদূর এনেছি কি এমনি এমনি নাকি?

সানাত ঘাবড়ে গেলো। তার আর বুঝতে বাকি নেই সে ভুল মানুষের সাথে এসেছে। নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে সানাত বললো,

ছাড়ুন আমার হাত।

এতো সহজে তো ছাড়বোনা ।

ছেড়ে দিন বলছি। কোনো রকমে হাত ছাড়িয়ে সানাত ফাঁকা রাস্তায় ছুটতে লাগলো। আর তার পেছন পেছন ছুটতে লাগলো সেই লোকটি। সানাত দৌড়াতে দৌড়াতে একসময় আচমকা ধাক্কা খেলো কারো বলিষ্ঠ পিঠে। আচমকা পেছন থেকে আক্রমনে অন্তিম কিছুটা পিছিয়ে গেলো তবে পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে পেছনে ঘাড় ঘুরাতেই দেখতে পেলো একটি শ্যাম বর্ণের মেয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। মেয়েটি রীতিমত হাঁপাচ্ছে। অন্তিম কিছু বলার আগেই মেয়েটির পেছনে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখতেই বুঝতে পারলো পুরো ঘটনা। লোকটি বিশ্রী হেসে বলে,

কি মামণি এবার কোথায় পালাবে? পালানোর সব রাস্তা তো বন্ধ।

সানাত অসহায় দৃষ্টিতে অন্তিমের দিকে তাকায়। অন্তিম এবার একটু ঠিকঠাক হয়ে দাড়িয়ে বলে,

কি ব্রো এভাবে এই সময় একটা মেয়ের পেছনে দৌড়াচ্ছ কেনো? মনে ধরে গেছে নাকি?

মনে ধরবে না আবার এইসময় ফাঁকা রাস্তায় আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছি মনে না ধরে উপায় আছে ?

বাট আফসোস চাঁদটা আর হাতে পাওয়া হলো না?

মানে?

মানে এখান থেকে কেটে পর। নোংরামি অন্য কোথাও গিয়ে কর। একটা মেয়ের পিছনে জা*নো*য়া*রে*র মতো হামলে পড়েছিস কেনো?

শালা গেঞ্জাম করিসনা। আমারটা আমাকে বুঝে নিতে দে। হিরোগিরি পরে করিস। এখন সর।

তুই বোধয় বাংলা ভাষা বুঝিসনা। তোকে এখনো ভালোভাবে বলছি চলে যা নইলে আমি ক্ষেপে গেলে তোর মরা ছাড়া গতি নেই।

দেখ আমি আবারও বলছি সমস্যা করিস না। এর থেকে চল দুজনে ভাগ করে মজা নেই। মেয়েটা হেব্বি আছে কিন্তু।

অন্তিমের ধৈর্যের বাঁধ মুহূর্তেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে লোকটির গাল বরাবর ঘুষি মারলো। মুহূর্তেই লোকটি মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়লো। অন্তিম লোকটির ডান হাতটা পা দিয়ে রাস্তার সাথে পিষে ধরে বললো,

কু*ত্তা*র বা*চ্চা। মেয়ে দেখলেই তোদের নোংরামির ইচ্ছা জাগে তাইনা? তোদের জন্য সমাজের এই হাল। ঘরে মা বোন নেই তোদের!

সানাত পেছন থেকে কাপাকাপা গলায় বললো,

ছ.. ছেড়ে দিন। ম.. মরে যাবে।

অন্তিম ছেড়ে দিলো। তারপর এগিয়ে এসে সানাতের মুখ বরাবর দাড়িয়ে কঠিন ঝাড়ি দিয়ে বললো,

এই সময় একা বাসা থেকে বেড়িয়েছেন কেনো? ননসেন্স! আজকে একটা বিপদ হলে কে দেখতো আপনাকে? আন্সার মি ! বেশি স্বাধীনতা পেলে যা হয় আর কি!

সানাত কেপে উঠলো। তারপর কাপাকাপা গলায় বললো,

আ..আমি চ..চট্টগ্রাম থেকে এসেছি আমার খালামনির বাসায়। ফ..ফোনের চার্জ শ..শেষ।
জামে ম..মসজিদ রোড থেকে আমাকে নি..নিতে আসার কথা তাই জায়গা চিনতে ওই লোকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম । কিন্তু ঐ লোকটা…
অন্তিম কিছুটা নরম হলো। তারপর বললো,

ঠিকাছে চলুন। বলেই সে সামনে হাঁটতে লাগলো। কিন্তু একটু সামনে এগোতেই দেখলো মেয়েটি তার পাশে নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলো মেয়েটি সেই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। অন্তিম গলা ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

আমি খারাপ লোক নই। আশা করি মাথায় এইটুকু যাচাই করার ঘিলু আছে। তাই ড্রামা না করে চলুন।

সানাত কিছু বললোনা। চুপচাপ হাঁটতে লাগলো।
জামে মসজিদ রোডের পাশে একটা দোকানের বেঞ্চে তারা দুজনেই বসে আছে। অন্তিম সানাতের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো,
আপনার চক্করে পরে আমার ফ্রেন্ডদের সাথে ট্যুরে যাওয়াটা মাটি হয়ে গেলো। ডিসগাস্টিং! কোথায় আপনার রিলেটিভ? এখনো আসছেনা কেনো?

কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে বোধয়।

আপনি এখানে একটু বসুন। আমি দু মিনিটের মধ্যেই আসছি।

সানাত মাথা নেড়ে সায় জানালো। অন্তিম যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে নিতে আব্দুর চাচা এসে পড়লো। আব্দুর তার খালামনির বাসার অনেক পুরোনো ড্রাইভার। সানাত চলে যাওয়ার আগে বেশ কিছুক্ষণ অন্তিমের অপেক্ষায় ছিলো কারণ লোকটিকে একটা ধন্যবাদ দেওয়া যে বাকি। আর সানাত বকেয়া আর ঋণ জিনিসটা মোটেও পছন্দ করেনা। তবে অপেক্ষা করেও যখন লাভ হলো না। অন্তিমের দেখা তার আর মেলেনি। সানাত ব্যাগ থেকে একটা নোটবুক বের করে তার পাতায় লিখলো,

“আপনি অপেক্ষা করতে বলেছিলেন কিন্তু আমায় নিতে লোক এসে পড়েছে। আপনার অপেক্ষা করেছিলাম কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। আজকের সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ। আপনার এই উপকার আমি তোলা রাখলাম যদি কখনো ভাগ্য সুযোগ করে দেয় তবে তা ফিরিয়ে দেবো। আমি ঋণ আর বকেয়া রাখতে পছন্দ করিনা।”
এইটুকু লিখে সানাত কাগজটা তারা যে দোকানের বেঞ্চে বসেছিল সেখানেই ভাঁজ করে রেখে চলে গেলো। সে জানেনা আদেও এই চিঠি প্রাপক অব্দি পৌঁছাবে কি না? আর না তার সাথে আর কখনো এই আগন্তুকের দেখা হবে কি না?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে