অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-১২

0
748

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-১২
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

আজ সকাল থেকে একবারও অন্তিমের সামনে পরেনি সানাত। কাল রাতের ঘটনার পর থেকে লজ্জায় বেশ সাবধানে এড়িয়ে চলছে সে অন্তিমকে। আজ অন্তিমের ভার্সিটিতে চাকরির প্রথম দিন। তার যাওয়ার সময়ও সানাত ইচ্ছে করে সামনে আসেনি। আর এর মধ্যে ওহী সকাল থেকেই তারদিকে বাজপাখির নজরে তাকিয়ে আছে। সানাত ওহীকে নিয়ে খুব ভয়ে আছে। এই মেয়ে যদি একবার গতকাল রাতের ঘটনা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারে তাহলে আর সমাজে মুখ দেখাতে হবে না।
ভার্সিটিতে ক্লাসে অলস হয়ে বসে আছে সানাত। এই মুহূর্তে ক্লাসে কোনো টিচার নেই। শুনেছে তাদের লেকচারার স্যার নাকি অসুস্থ তাই কিছুদিন ছুটিতে আছেন তাই আজকে ক্লাসটা বোধয় হবে না। এদিকে এই খবর শুনে আকাশে বাতাসে উড়ছে ওহী। সে এই চান্সে একটু প্রেমকথন আদান-প্রদান করবে তার প্রেমিক মানুষটার সাথে। এদিকে ওহীর কাণ্ড থেকে সানাত মহা বিরক্ত। সে ভেবেই পায়না প্রেমে পড়লে এতো নাচার কি আছে! কই সেও তো প্রেমে পড়েছে, গভীর ভাবে প্রেমে পড়েছে কিন্তু সে তো এই মেয়ের মতো লাফায়নি। এই মেয়ে বড্ডো আজব! আজ সানাতরা বসেছে একদম পেছনের দিকে। আর তার পাশের সারিতে তার বরাবর বসেছে আলভী। একটু পরপরই তার দিকে তাকাচ্ছে আর এটা সেটা বলছে সানাতকে। সানাত এর প্রতিও বেশ বিরক্ত। তার এই একরাশ বিরক্তির মাঝে হঠাৎ তাদের ডিপার্টমেন্টের একজন প্রফেসর স্যার এসে উপস্থিত হলেন। তৎক্ষণাৎ সকলে উঠে দাঁড়ালো। ওহী তখনও চ্যাটিং করতে ব্যস্ত। সানাত কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বললো,

এই ফাজিল। পরে চ্যাটিং করিস। প্রফেসর স্যার এসেছে এখন ফোন রাখ।

ওহী বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে মধ্যবয়স্ক লোকটিকে কিছু গালাগাল দিয়ে ফোন ব্যাগে রেখে দিলো। সকলের উদ্দেশ্যে প্রফেসর ড এ এম আসাদুজ্জামান বলে উঠলেন,

তোমরা সকলেই জানো তোমাদের লেকচারার তন্ময় স্যার বেশ কিছুদিন ধরে একটু শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাই উনি কিছুদিন ছুটিতে আছেন। তাই ওনার পরিবর্তে আজ থেকে একজন নতুন লেকচারার স্যার তোমাদের এই ক্লাসটা নেবেন কিছুদিন।

সানাতের বিন্দু পরিমাণ কোনো মনোযোগ নেই ক্লাসে। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে। ওহী বার বার হাম তুলছে। সেও বেশ বোরিং। তাদের এই সকল বিরক্তির মধ্যে প্রফেসর স্যার বলে উঠলেন,

স্যার আপনি ভেতরে আসুন।

তৎক্ষণাৎ একজন নতুন লেকচারার এসে উপস্থিত হয় ক্লাসের মাঝে। সানাতের তখনও মনোযোগ নেই। প্রফেসর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য বলে উঠলেন,

ইনি হচ্ছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের তোমাদের সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের নতুন লেকচারার জনাব অন্তিম আহসান। প্রথমে খেয়াল না করলেও একটুপরই চিরচেনা নামটা কানে পৌঁছাতেই সানাত চোখ তুলে সামনে তাকালো। আর তৎক্ষণাৎ সে সবথেকে বড়ো ধাক্কাটা খেলো। কোনো রিয়াকশন দেওয়ার কথাও সে বেমালুম ভুলে গেলো। সে আদেও কোনো ঘোরের মাঝে আছে কিনা তা ঠিক বুঝতে পারছেনা। তাই ওহীর বাহু ধরে ঝাকি দিয়ে বললো,

এই ওহী!

ওহী রোবটের মত সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

হুঁ বল ।

বলছি আমি যা দেখছি তুইও কি তাই দেখছিস?

তুই যা দেখছিস আমিও তাই দেখছি।

কি দেখছিস?

মীর জাফরকে।

কিহহ! মীর জাফর! ওই ব্যাটা তো কোন কালেই মরে গেছে তুই তাকে দেখিস কিভাবে? গা*জা খাইছিস?

মনে হয় এক কেজি খাইছিলাম। তুই কাকে দেখতেছিস সেটা বল?

আমি তো তোর ভাইরে দেখতেছি। কিন্তু তুই কেমনে মীর জাফররে দেখস?

ওরে ছাগল! আমার ভাই মীর জাফরের চেয়ে কম কিছু! কতো বড়ো বেঈমান হইলে মানুষ একবার নিজের বোনরে বলেনা তার কথায় চাকরি হইছে! তুই ভাবতে পারতেছিস কতো বড়ো শয়তান হইলে আমাদের ভার্সিটিতেই জয়েন করে অথচ আমাদের বলেনা। হ্যাঁ রে তুইও কি এই মাত্র আমার মতো জানলি নাকি তোকে তোর জামাই আগেই বলছে? আর তারপর জামাইর সাথে মিলা ঘসেটি বেগমের মতো আমার সাথে বেইমানি করলি?

তুই থামবি! তোর ভাই কি আমার ধার ধারে যে আমাকে বলবে! আমিও তোর মত এখনি জানতে পারছি।

বিশ্বাস কর দোস্ত ওরে আমার নিজের ভাই বইলা পরিচয় দিতে কিডনি, লিভার, পাকস্থলীতে বাঁধতেছে!

ওহীর এমন স্টুপিড মার্কা কথা শুনে সানাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললো,

কি? কিডনি, লিভার, পাকস্থলীতে বাঁধে মানে?

ওরে হারামজাদি তোর জামাই আমার সব আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলো রে! আমার সব স্বপ্ন শেষ রে! বলেই ন্যাকা কান্নার ঢং ধরলো।

সানাত বিরক্ত হয়ে বললো,

এই কিসব বলছিস এসব? আর আমার জামাই আমার জামাই করতেছিস কেন তোর কি কিছু হয়না? আর কি করছে আমার জামাই তোর?

আমি কতো স্বপ্ন দেখছিলাম ভার্সিটির নামে রাদিফের সাথে ঘুরতে যাবো, চুটিয়ে প্রেম করবো কিন্তু তোর শয়তান জামাইয়ের কারণে এখন আর সম্ভব না। সিসি ক্যামেরার মতো আমার পিছনে লেগে থাকবে। ভাল্লাগেনা!

সামনে থেকে দাড়িয়ে পেছনে সানাত আর ওহীর সব কাণ্ড দেখছে অন্তিম। মনে মনে বলছে বেয়াদব দুটোর এখানেও এক দন্ড ভদ্রতা নেই। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে হচ্ছে দুটোর গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে। ফাজিল কোথাকার!

🌻
ক্লাস চলছে। সামনে অন্তিম একটা ইম্পর্ট্যান্ট টপিক নিয়ে আলোচনা করছে। এদিকে পেছনে আলভী বারবার সানাতকে ডিস্টার্ব করে যাচ্ছে। সানাত শুনেও না শুনার ভান করছে। আলভী আবারও ডেকে উঠলো,

এই সানাত?

সানাত এবার বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে বললো,

কি হয়েছে আলভী? ডাকছো কেনো বারবার?

একটু কথা ছিল সানাত?

কিসের কথা? দেখছো না ক্লাস হচ্ছে।

তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি সানাত।

কি জিনিস?

দাড়াও দেখাচ্ছি।

না না এখন না ক্লাস শেষ হোক। পরে দেখবো…

এই যে পেছনের ব্যাকবেঞ্চার? অন্তিমের আচমকা ডাকে থেমে গেলো সানাত। অন্তিম আবারও বললো,

শেষের বেঞ্চের লেফট সাইডে যে বসে আছো তোমাকে বলছি। স্ট্যান্ড আপ!

সানাত আশেপাশে একবার তাকিয়ে সন্ধিহান গলায় বললো,

স্যার আমি?

জ্বি তুমি । স্ট্যান্ড আপ।

সানাত উঠে দাঁড়ালো। তারপর অন্তিম বললো,

নাম কি?

সানাত যেনো ধপাস করে মাটিতে পড়লো এমন প্রশ্ন শুনে। তার নাম কি মানে? এই লোক কি তার সাথে মশকরা করছে?

কি ব্যাপার আন্সার মি। নাম কি?

জ..জ্বি সানাত।

ওহ। আমি তোমাকে অনেকক্ষন ধরেই নোটিস করছি তুমি পেছনে বসে সাইড টক করছো। যেটা আমার ক্লাসে আমার একেবারেই অপছন্দের একটা কাজ। আমার ক্লাস ভালো না লাগলে বেড়িয়ে যাও। কিন্তু ক্লাসে বসে আমাকে ডিস্টার্ব করো না। এতো ম্যাচুয়েড হয়ে গেছো অথচ এই টুকু কমনসেন্স নেই যে নতুন টিচার আসলে তার সাথে ঠিক কেমন বিহেভিয়ার করা উচিত ?

স্যার আমি আসলে জাস্ট…

আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।

সানাতের এই মুহূর্তে ভয়ংকর রাগ হচ্ছে। প্রথমত আলভীর ওপর তারপর অন্তিমের ওপর। এই লোক কালকে তার সুযোগ নিয়ে ওসব করে এখন এমন একটা হাভভাব দেখাচ্ছে যেনো কিচ্ছু হয়ইনি কাল। আর এখন দেখ এখানে এসে কিভাবে টিচরগীরি করছে। অসহ্য ! আর তখন তাঁকে কি বলে সম্মোধন করলো ব্যাকবেঞ্চার! সে একদিন বাধ্য হয়ে পেছনে বসেছে বলে সে ব্যাকবেঞ্চার হয়ে গেলো! এতো বড়ো অপমান! দেখে নেবে সে!

টানা ৪০ মিনিট দাড়িয়ে থেকে সানাতের পায়ের অবস্থা কাহিল। অন্তিম পেছনে গিয়ে সানাতের পাশাপাশি দাড়িয়ে থেকে তারপর সানাতকে অতিক্রম করতে করতে ফিসফিসিয়ে বললো,

কাল রাতে কি বলেছি মনে নেই? আলভী বা অন্য কোনো ছেলের সাথে দেখলে খুন করে ফেলবো। আর হ্যাঁ এটা ভার্সিটি, এখানে আমাদের সম্পর্ক জাস্ট প্রফেশনাল। বাইরে আমাদের সম্পর্ক যাই থাকুক না কেনো সেটা যেনো ভার্সিটিতে পাবলিশ না হয়। ওকেহ?

সানাত শুধু হাবার মতো মাথা কাত করে সায় জানিয়ে গেলো। এরপর ক্লাস শেষ হলে অন্তিম বেরিয়ে যেতেই সামনের বেঞ্চ থেকে কিছু মেয়ে বলাবলি করছে অন্তিমকে নিয়ে। তাদের মধ্যে একজন বলছে,

দেখেছিস নতুন লেকচারার স্যারটা দারুন না? যেমন হ্যান্ডসাম তেমনি পার্সোনালিটি। আমি তো পুরা ক্রাশ খাইছি রে।

তার পাশ থেকে আরেকজন বলছে,

পুরাই আগুন স্যার।

সানাত মুহূর্তেই জ্বলে উঠলো। কতবড় সাহস তার স্বামীর দিকে নজর দেয়! এদের তো ঝাটা পেটা করে বিদেয় করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে নিরুপায়।
#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে