অতঃপর গল্পটা তোমার আমার পর্ব-০১

0
975

#অতঃপর_গল্পটা_তোমার_আমার
#পর্ব-০১
#হুমায়রা_আঞ্জুম (লেখনীতে)

নিজের বেস্টফ্রেন্ডের বাসর ঘরে তার বদলে বধূ বেশে জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছি আমি! আজ এখানে যার বধূ বেশে থাকার কথা ছিল তার পরিবর্তে আমি বসে আছি। আমি সানাত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আজ আমার বেস্টফ্রেন্ড ওরফে আমার খালাতো বোন ছোঁয়ার বিয়ে ছিলো। টানা সাড়ে তিন বছরের প্রেমের সম্পর্কটা আজ বিবাহ নামক পবিত্র সম্পর্কে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছিল তবে শেষ মুহূর্তে ভাগ্যের অদ্ভুত খেলায় ছোঁয়ার বদলে অন্তিম আহসানের সাথে স্বামী-স্ত্রী নামক পবিত্র বন্ধনে বাঁধা পরে গেছি আমি। অন্তিম আহসান এই নামটার সাথে অনেক অনুভূতি জড়িয়ে আছে আমার। জীবনে প্রথমবার কার প্রেমে পড়েছিলাম এটা কেউ জানতে চাইলে আমি বলবো আমি অন্তিম আহসানের প্রেমে পড়েছিলাম। আমার কিশোরী হৃদয়ে প্রথমবার যাকে দেখে ভালোবাসার সূক্ষ অনুভুতি সঞ্চার হয়েছিল সে হলো অন্তিম আহসান। তখন অবশ্য জানতামনা এই মানুষটা আমার বোন আমার বেস্টফ্রেন্ডের প্রেমিক। যেদিন এই কথাটা জানতে পেরেছিলাম সেদিন তৎক্ষণাৎ সরে এসেছিলাম। নিজের ভেতরেই দাফন দিয়ে দিয়েছিলাম তাকে নিয়ে ঘেরা সব অনুভূতির। তবে আমার বেহায়া মন তাকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারেনি। তাকে পাবেনা জেনেও আড়াল থেকে অকারনেই ভালোবেসে গেছি। কিন্তু আজকের এই পরিস্থিতিটা আমি চাইনি। ঘড়ির কাঁটায় এখন রাত ২ টা। তবে ঘরে আসেনি সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। সানাত আজ বড্ডো ক্লান্ত। দু চোখ বুজে আসতে চাইছে। বসে বসে একনাগাড়ে মনে করতে থাকে আজকের পুরো ঘটনাটা।

🌻
আজ সকাল থেকেই মির্জা বাড়িতে প্রচণ্ড কাজের ব্যস্ততা। ব্যস্ত হবে নাই বা কেনো আরহাম মির্জার একমাত্র মেয়ে ছোঁয়ার বিয়ে বলে কথা। বেশ ধুমধামের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সারা বাড়ি আত্মীয়-স্বজন,মেহমানে ভরপুর। সানাত সেই ভোরে উঠে হাতে হাতে কাজ করে যাচ্ছে। এই বিয়েতে তার উপরে কম ধকল যাচ্ছে না! সানাত চোখে মুখে পানি দিয়ে আবারো কাজে লেগে পড়লো। জন্মের পরেই মা মরে যাওয়া সানাত বড়ো হয়েছে তার খালার কাছে। বাবার বাড়ি,খালার বাড়ি দুটো মিলিয়েই সানাতের বড়ো হয়ে ওঠা। এখানে সে পাকাপাকি ভাবে ভার্সিটির এডমিশন টেস্টের সময় এসেছে। এর আগে বেড়াতে আসতো।
দুপুর ১২ টা। সানাত, ছোঁয়া তাদের আরো কিছু বান্ধুবী, কাজিনরা পার্লারে সাজতে এসেছিল। সবার সাজ কমপ্লিট হয়ে গেছে। তাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা হাইজ এসেছে। সবাই উঠে গেলেও ছোঁয়ার সাজ এখনো শেষ হয়নি। টানা ৪৫ মিনিট ধরে সবাই অপেক্ষা করছে। ছোঁয়া তাদের পাশের পার্লারে সাজতে গিয়েছে। সানাত আর অপেক্ষা না করে ছোঁয়াকে কল করলো। দু-বার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করলো ছোঁয়া।

হ্যালো ছোঁয়া?

হ্যা বল সানাত।

কিরে আর কতক্ষন লাগবে তোর? আমরা সবাই সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি তোর জন্য। মামণি ফোন দিয়ে তাড়া দিচ্ছে। বরযাত্রী রওনা দিয়ে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি কর।

সানাত আমার সাজ কমপ্লিট হতে এখনো মিনিট পঁচিশ লাগবে।

কি বলছিস তুই?

হ্যা রে তুই বরং এক কাজ কর তুই ওদের সবাইকে পাঠিয়ে দে। তারপর সাজ শেষ হলে আমি আর তুই একসাথে চলে যাবো। নাহলে সবার দেরি হলে বাসার সবাই ক্ষেপে যাবে।

কিন্তু…

কোনো কিন্তু নয় যা বলছি তাই কর।

আচ্ছা।

আর হ্যা শোন।

বল।

আমার জন্য একটু কষ্ট করে ফার্মেসী থেকে গ্যাসট্রিকের এক পাতা ট্যাবলেট নে। অনেকক্ষণ কিছু খাইনি তাই বমি বমি পাচ্ছে।

আচ্ছা। তুই একটু তাড়াতাড়ি কর।

আচ্ছা।
সানাত ফোন কেটে ওদেরকে সব বুঝিয়ে বলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। তারপর নিজে ছুটলো ফার্মেসীতে ওষুধ কিনতে।

🌻
ফোন অন করে দেখলো দুপুর ১টা বেজে ১০ মিনিট অথচ ছোঁয়ার কোনো পাত্তাই নেই। সানাত আট বার কল করে ফেলেছে কিন্তু রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে বারবার। সানাত এবার আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলো না। সে ছোঁয়ার পার্লারে গেলো। পার্লারে পৌঁছাতেই সে কোথাও ছোঁয়াকে দেখতে পেলো না। সানাতকে দেখে পার্লারের একজন মেয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

আপু আপনি এখানে? কিছু চাই?

হ্যা আজকে একজন কনে এসেছিল সাজতে সে কোথায়?

সে তো প্রায় ঘণ্টা খানেক আগেই চলে গেছে। সানাত থমকে গেলো।

চলে গেছে মানে?

হ্যা ওনার সাজ তো সেই অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে তাই চলে গেছে। কেনো কোনো সমস্যা হয়েছে?

সানাত নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে বলে,

ন.. না কোনো সমস্যা হয়নি। বলেই সে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। আবারও ফোন লাগালো ছোঁয়ার ফোনে। তবে এবারও রিসিভ করেনি। সানাতের মনে হঠাৎ করেই এক অজানা ভয় ঢুকে যায়। রীতিমত ঘামছে সে। তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ একটা নোটিফিকেশন এলো। সানাত নোটিফিকেশন চেক করতে নিলেই দেখলো ছোঁয়ার ম্যাসেজ। সানাত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে।ছোঁয়া ম্যাসেজে লিখেছে,
সানাত এই বিয়েটা আমি করতে পারবোনা। আমি আমার এক্স রেহানের সাথে পালাচ্ছি। তুই তো জানিস আমি বরাবরই হাই ক্লাস লাইস্টাইল লিড করতে চেয়েছি। আর সে জন্য রেহান একদম পারফেক্ট। দেখ আমি বলছিনা যে অন্তিম পারফেক্ট না অন্তিম যথেষ্ট ক্লাসি ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু ও বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে ফিরে গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলে। ক্যারিয়ারের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই তারওপর আবার ও শিক্ষকতা করতে চায়। এসবে আমার পোষাবেনা। আর অন্তিমের সাথে রিলেশন নিয়ে আমি অতটা সিরিয়াস ছিলামনা। রিলেশন করলেই যে বিয়ে করতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। তাই আমি রেহানের সাথে চলে যাচ্ছি। ও আমাকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে আর তারপর সেখানে আমরা হ্যাপি লাইফ লিড করবো। জানি তুই আমাকে খুব সেলফিস ভাববি বাট আমার কিছুই করার নেই। আমার কাছে আমার ড্রিমটাই আগে। প্লিজ তুই ওদিকের সবটা সামলে নিস।

সানাত নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে হাতের ফোনটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি জবাব দেবে সবাইকে। তার ওপরে ভরসা করে সবাই ছোঁয়ার দায়িত্ব দিয়েছিল তার কাছে কিন্তু সে ব্যর্থ। সানাত জানতো ছোঁয়ার চাওয়া পাওয়া অনেক উপরে। সে আত্মকেন্দ্রিক তবে এতটা স্বার্থপর এটা সে জানতোনা। নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সবাইকে এতো বড়ো ধোকা দিলো! একবারও বিবেকে বাঁধলো না! নিজের বাবা মা এমনকি অন্তিম কারো কথাই ভাবলোনা! আচ্ছা আজকের এই সত্যিটা যখন অন্তিম জানবে কি হবে তার? ছেলেটা যে ভেঙেচুরে চুরমার হয়ে যাবে। এই খাটি ভালোবাসা ছোঁয়ার কাছে ক’ টা টাকার জন্য ফিকে পড়ে গেলো!

সানাত বাসায় ফিরেছে। বরযাত্রী এসে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ। ইতিমধ্যে তারা কনের জন্য তাড়া দেওয়া শুরু করে দিয়েছে। সানাত ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে দেখে সবাই বসে আছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন ২ টা ৪৭ মিনিট। সানাতকে দেখেই ছোঁয়ার বাবা অর্থাৎ সানাতের খালু আরহাম মির্জা এবং তার খালা রাবেয়া এসে সামনে দাঁড়ায়। আরহাম মির্জা ঠান্ডা গলায় গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন,

তুমি একা কেনো ছোঁয়া কোথায়? ক’ টা বাজে খেয়াল করেছো!

সানাত কাপছে। সে বরাবরই তার খালুকে বেশ ভয় পায়। কি জবাব দেবে সে তাকে!

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো যেনো? কিছু জিজ্ঞাসা করছি বলো ছোঁয়া কোথায়?

খা..খালু ছো..ছোঁয়াকে প..পাওয়া যাচ্ছেনা।

পাওয়া যাচ্ছেনা মানে?

ছ..ছোঁয়া পালিয়েছে। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কষিয়ে এক থাপ্পর পড়লো সানাতের গালে। সানাত গালে হাত চেপে দৃষ্টি ফ্লোরে রেখে দাড়িয়ে রইলো। টারপর ছোঁয়ার পাঠানো ম্যাসেজটা সবাইকে দেখালো। এই ঘটনায় ছোঁয়ার মা রাবেয়া কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে । এরপর আর এই ঘটনা পাঁচ কান হতে সময় নিলোনা। বরযাত্রী এই ঘটনা শুনে চরম ক্ষেপে গেছে। তাদের একটাই কথা তারা কিছুতেই বউ ছাড়া যাবেনা। তাদের মান-সম্মান আছে। এভাবে বউ ছাড়া ফিরে গেলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবেনা। তাই মান-সম্মান বাঁচাতে আচমকা অন্তিমের বাবা ওয়ালিদ আহসান ছেলের জন্য সানাতের হাত চেয়ে বসেন। আরহাম মির্জাও না করেননি রাজি হয়ে যান। সানাত যেনো এক ঘোরের মধ্যে ছিলো। সে বুঝে উঠতে পারছিলনা তার জীবনে কি হচ্ছে। সানাত জানতো অন্তিম মরে গেলেও এই বিয়েতে মত দেবেনা তবে সানাতকে চরম অবাক করে দিয়ে অন্তিম রাজি হয়ে যায় বিয়েতে। আর তারপর আসরের আযানের পর ৩ লক্ষ টাকা কাবিন করে তিনবার কবুল বলে সে হয়ে যায় অন্তিম আহসানের বিবাহিত স্ত্রী। তারা কেউই জানেনা এই অনির্ধারিত বিয়ের ভবিষ্যৎ!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে