অঙ্গীকার (১৫তম পর্ব)

0
1879
অঙ্গীকার (১৫তম পর্ব) লেখা- শারমিন মিশু শাফী রুমের ভেতরে ঢুকতেই রাদিয়াকে আফিয়ার পছন্দের শাড়ীটা পরে থাকতে দেখে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ইচ্ছে করলো এই শাড়ীটা পরার জন্য রাদিয়া কে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কি দরকার ছিলো আজকের দিনে এ শাড়ীটাই পরার?? বুকের ভিতরে চেপে রাখা কষ্টরা যেনো জেগে উঠেছে। পুরো হৃদয়জুড়ে আফিয়ার জন্য হাহাকার করে উঠলো। ও থাকলে তো এমন কিছু আজ হতে পারতোনা। বড় গলায় কিছু কথা শুনাতে চেয়েও শুনালোনা। এখন রাগারাগি করার সময় নয়। আগে রাদিয়ার সাথে বোঝাপড়াটা দরকার। শাফী গিয়ে রাদিয়ার সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। রাদিয়া আস্তে করে সালাম দিলো। রাদিয়াকে দেখতে পেয়ে বুশরা শাফীর কোল থেকে ওর কোলো ঝাপিয়ে পড়লো। শাফী সালামের জবাব দিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো। তারপর আস্তে করে বললো,,, তোমাকে কে জোর করেছে?
-রাদিয়া স্বর নিচু করে বললো,,,মানে??. -মানে আমাকে বিয়ে করতে কে জোর করেছে? -কেউ আমাকে জোর করেনি আমি নিজ ইচ্ছায় সম্মতি দিয়েছি। -তোমার কি মনে হয়না তুমি নিজ ইচ্ছায়একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছো? – না মনে হয়না। কেন এটা মনে হবে? -এ বিয়েটা করলে তোমার কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবেনা। -আমি যখন স্বেচ্ছায় কষ্টকে আমার করে নিচ্ছি তখন তো সেটা আমার সমস্যা আপনার এ ব্যাপারে কথা কেনো? -আমি তোমাকে কখনোই আফিয়ার জায়গায় বসাতে পারবোনা। -আমি কি আপনাকে বলেছি আমার বড়াপুর জায়গায় আমাকে বসাতে হবে? নাকি আপনার কাছে আকুতি মিনতি করেছি? হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিটা মুছলো রাদিয়া। তারপর শান্তস্বরে বললো,,, আপনি বললে ও আমি কখনো আমার বোনের জায়গা নিতে পারবোনা। আমি শুধু আপনার বাড়ীতে যাবো বুশরার মা হয়ে এর বেশি কিছু আমি আশা করিনা। -শুধুমাত্র বুশরার মা হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া সম্ভব নয় রাদিয়া। তোমার জীবনের অনেক আনন্দময় সময় সামনে অপেক্ষা করছে এভাবে তুমি শুধু বুশরার জন্য সেগুলো ত্যাগ করতে পারোনা। -আমি যদি বুশরার জন্য আমার জীবনের সব আনন্দ উৎসর্গ করি তাতে আপনার কি কোন কথা থাকতে পারে? -রাদিয়া দেখো আবেগের বশে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়োনা। এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় একটা সিদ্ধান্ত। এভাবে হুট করে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে না আবার সারাজীবন কাঁদতে হয়!! -আমি আবেগ নয় বিবেক দিয়ে গত সতেরো দিন যাবত দিনরাত ভেবেছি। অনেক ভেবেচিন্তে এ সিদ্ধান্তটা আমি নিয়েছি। আমি শুধু বুশরার মা হতে চায়। ওকে ছাড়া একদিনও কাটানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সেইজন্য এ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর আপনি যদি আমাকে বিয়ে না করে বুশরাকে আমাকে দিয়ে দেন তাহলে আমাদের কাউকে কোনকিছু ত্যাগ করতে হবেনা। আপনিও আপনার মত জীবন কাটাতে পারবেন। কি দিবেন আমাকে? -এটা কি করে সম্ভব? আমি আমার মেয়েকে তোমাকে কেন দিবো? -জানি পারবেন না। এটা কোনভাবে সম্ভব না। কোন বাবা মাই পারেনা নিজের সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দিতে। বুশরা আমার হৃদয়ের সাথে মিশে গেছে। ওকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। আর ওকে সারাজীবন আমার মেয়ে হিসাবে পাওয়ার জন্য শুধু এই একটা রাস্তা খোলা আছে আমার সামনে। এতটুকু সহানুভূতি আপনার কাছে চাচ্ছি আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আমার বোনের ইচ্ছাটা আমায় পূরণ করতে দিন। শুধু বুশরার মা হতে চায় এর বেশি কিচ্ছু চাইনা আমি। -রাদিয়া তুমি আরেকবার ভাবো!! -আর কোন ভাবাভাবি সম্ভব নয় !! আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। শাফী আর কিছু না বলে বেরিয়ে গেলো। এর সাথো কথা বলা আর না বলা দুটোই সমান। ও ভেবেছে রাদিয়াকে বুঝিয়ে বিয়েটা আটকাতে পারবে। কিন্তু এই মেয়ে তো জিদ ধরে বসে আছে। শাফী কোনভাবে বিয়েটা মেনে নিতে পারছেনা। বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে। বারবার আফিয়ার স্মৃতিগুলো সামনে এসে জ্বালাতন করছে। আফিয়ার সাথে যেদিন বিয়ে হয়েছে সেদিন দুজনের মনে কত স্বপ্ন ছিলো। সেদিন ছিলো অন্যরকম পরিবেশ। আজ আবারো সেই বাড়ীতে শাফী এসেছে দ্বিতীয় বিয়ে করতে আফিয়ার ছোট বোনকে। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস!!! সেদিন ছিল দুজনের চোখে কত স্বপ্ন আর আজ স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট। শাফী মনে মনে আল্লাহর কাছে অভিযোগের সুরে বললো,, আর কতো আমায় পরীক্ষা করবে ? একজনের ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে দিয়ে তাকে কেড়ে নিয়েছো। বুকে পাথরচাপা দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছি সেখানে ও পারিনি। আজ আবার কেনো আরেকটা মেয়ের সাথে বেঁধে দিচ্ছো আমায় যাকে কখনো আমার মেনে নেয়া সম্ভব নয়। কেনো করছো আমার সাথে এমন? এ কোন খেল খেলছো আমার সাথে?? শাফী বেরিয়ে যেতেই রাদিয়া মুখে হাত দিয়ে কাঁদতে লাগলো। দুচোখ বেয়ে অঝোরে শ্রাবণ ধারার মত টপটপ করে অশ্রু ফোটা বইতে লাগলো। বিড়বিড় করে বলে,, ভাইয়া আপনি কি মনে করছেন আমি খুব খুশি হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কতগুলা ইচ্ছেকে মাটি চাপা দিয়ে যে আমায় এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা তো আমি জানি। আপনার সাথে বন্ধনে জড়াতে আমারও যে কোন ইচ্ছে নেই। বোনের সাজানো গুছানো সংসারে যেতে যে আমার ও কষ্ট হচ্ছে। ওর ঘর ওর সংসার আর আজ আমায় ওখানে যেতে হচ্ছে। এটা যে কতটা কষ্টের তা আমি কি করে বুঝাবো সবাইকে। শুধু মৃত বোনের ইচ্ছার মূল্য দিতে আর এতটুকু একটা বাচ্ছার অভাব পূরণ করতেই আজ আমায় এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। না আপনার কাছে আমার কোন চাওয়া পাওয়া নেই,,, আর না কোনদিন সেই দাবি নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবো!” বুশরা কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাদিয়া ওকে শুইয়ে দিয়ে দু’রাকাঅাত নফল নামাজ পড়ে নিলো। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে সকল প্রকার অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দোয়া করলো। বোনের উদ্দেশ্যে বললো,,, আপুরে তোর কথা রাখতে আজ আমি তোর সংসারে পা রাখছি দোয়া করিস আল্লাহ যেনো আমার প্রতি রহমত দান করে। তোর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে যেনো পালন করতে পারি। আজ নিজের সমস্ত আশা-আকাঙ্খা,,,হাসি -আনন্দ আর স্বপ্নগুলো বিসর্জন দিয়ে তোর স্বপ্ন পূরণ করার লাড়াইয়ে নেমেছি আমি। আমার জন্য দোয়া করিস। কবুল বলতে গিয়ে শাফী মেয়েদের মতো কান্না করে দিয়েছে। কোনভাবে ওর মুখ দিয়ে ওই তিনটা শব্দ আসছেনা। ওর কাছে এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এই তিনটি শব্দ সবচেয়ে কঠিন শব্দ। কেউ যেনো ভিতর থেকে গলা চেপে ধরেছে। প্রায় আধাঘন্টা পরে শাফী কবুল বললো। রাদিয়াকে কবুল বলতে বলা হলে,, ও বুশরাকে বুকে চেপে ধরে নির্বিকার ভাবে তিনবার কবুল বলে দিলো কোন সময় না নিয়ে। ওর কাছে মনে হয়েছে যে কথাটা আজ বলতেই হবে তা নিয়ে এতো সময় নষ্ট করা একেবারে অযাচিত। তবে এটা নিয়ে কেউ অবাক হয়নি। কি পরিস্থিতিতে বিয়ে হচ্ছে,, কেন হচ্ছে? এটা তো কারো অজানা নয়। রাদিয়া মনে মনে পণ করেছে ও আর কাঁদবেনা। কিন্তু বিদায়ের সময় হাজার চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারেনি। বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে বেরিয়ে পড়লো এক অনিশ্চিত স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে। গাড়ীতে ও শাফী দম মেরে বসে ছিলো। কবুল বলার পর থেকে ও আর একটা কথা ও বলেনি। এমনকি জাওয়াদ সাহেব যখন রাদিয়ার হাত ওর হাতের মধ্যে দিয়ে বললো,,, বাবা আজ আবার আমার আরেকটা মেয়ের দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। ওর অয়ত্ন করোনা তখনো শাফী কিছু বলেনি। চুপচাপ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। গাড়ী থেকে নামার পরে শাফী দ্রুত পায়ে রুমে ডুকে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিলো৷ ও আর পারছেনা এভাবে ভালো থাকার মিথ্যে অভিনয় করতে। আফিয়া মারা যাওয়ার পর ও ওর এতো কষ্ট হয়নি। বুশরার দিকে তাকিয়ে কখনো চোখের পানি ঝরায়নি। কিন্তু আজ যে চোখের পানিরা কোন কথা শুনছেনা। সব বাঁধ ভেঙে বেরুচ্ছে। উফ!! এতো কষ্ট কেন হচ্ছে আমার? বুকটা যে ফেটে যাচ্ছে। আফিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,,এবার তো তুমি খুশি হয়েছো। তোমাকে করা অঙ্গীকারটা আজ পূরণ হলো। আমি কেন সব কষ্ট মেনে নিবো বলতে পারো? কেনো আমাকে নিয়ে এতো খেলছে উপরওয়ালা?? কবে তোমার মতো আমারও মুক্তি হবে? শাফীর ভেতরের হৃদপিন্ডটা মনে হয় অসংখ্য শকুন ধারালো ঠোঁটে ছিন্ন ভিন্ন করে খাচ্ছে। খুব অস্থির লাগছে ওর। পানি খেতে হবে। গলাটা অনেক শুকিয়ে আসছে। পৃথিবীটা ওর কাছে এ আগে এত বয়স্ক মনে হয়নি। এই রাত যেনো অজস্র বছরের পৌঢ় অন্ধকার গায়ে মেখেছে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে। উফ!!! এতো যন্ত্রনা কেন হচ্ছে। রাদিয়াকে বাড়ীতে তুলে সালেহা উনার ঘরে নিয়ে গেছে। রাদিয়া খাটের একপাশে চুপচাপ বসে শাশুড়ি আর ইফতির কথা শুনছে। বুশরা ঘুমিয়ে আছে। এখানে বসে থাকতে রাদিয়ার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ওর উপর দিয়ে যে কতবড় ঝড় বয়ে গেছে সে তো শুধু ও নিজে জানে। এই মুহুর্তে একটু বিশ্রাম দরকার। এভাবে বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। সালেহা রাদিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ক্লান্তি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে ইফতিকে টেবিলে খাবার লাগাতে বললো। সালেহা শাফীকে কয়েকবার ডাক দিয়েছে খাবার খেতে আসার জন্য। শাফী কিছুক্ষণ পর বললো,,, ও খাবেনা। অগত্যা ওকে কেউ আর জোর করেনি। রাদিয়ার ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও অল্প একটু ভাত খেলো মেন্টালিটি রক্ষার জন্য। খাওয়া দাওয়ার পরে যখন রাদিয়াকে শাফীর রুমে দিতে গেলো তখনি বাঁধলো বিপত্তি। রাদিয়া বুশরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সালেহা বারবার করে শাফীকে ডেকে যাচ্ছে দরজা খুলতে৷ কিন্তু দরজা খোলা তো দূরে থাকে ও কোন কথাই বলছেনা। শাফী অনেকক্ষণ চুপ থেকেও যখন দেখলো কাজ হচ্ছেনা। মা সমানে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে একবারের জন্য ও থামছেনা। শাফী রেগেমেগে উঠে এলো,,কি শুরু করেছো টা কি মা? দেখছো দরজা খুলছিনা তারপরও দরজা ধাক্কাচ্ছো কেনো? -সালেহা ও সমানে রাগ দেখিয়ে বললো,,, তো ওরা ঘুমাবেনা? -ঘুমাতে নিষেধ করেছে কে? -তুই দরজা আটকে বসে থাকলে ঘুমাবে কি করে? -বাসায় কি রুমের অভাব পড়ছে। আমার রুমে আমি কাউকে জায়গা দিতে পারবোনা বলে ধড়াম করে আবারো দরজা আটকে দিলো। এরকম স্পষ্ট অপমানে রাদিয়া কিছুটা কষ্ট পেলো। রাদিয়া লজ্জায় অপমানে অসহায় চোখে শাফীর মায়ের দিকে তাকালো……..
চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে