স্যার যখন স্বামী সিজন২ পার্ট_১৪

0
2888

স্যার যখন স্বামী সিজন২
পার্ট_১৪
#লিখা জান্নাতুল ফেরদৌস

ভেবে পাচ্ছিলাম না ওই মূহুর্তে করা উচিত।

তিথি- “তমা এখন কি করব?”

তমা- “বাচ্চাটাকে জন্ম দিব।”

তিথি- “তমা কি বলছিস তুই? কার না কার বাচ্চা তোর পেটে।এই বাচ্চা দুনিয়ায় আনলে তোর উপরে কি ঝড় আসবে বুঝতে পারছিস।”

তমা- “তিথি আমি কিছু জানি না।শুধু এতটুকুই জানি এই নিষ্পাপ বাচ্চা যে কোন পাপ করে নি তাকে মেরে আমি কিভাবে পাপ কাজটা করব?একটা নিষ্পাপ প্রাণকে আমি কিভাবে মারব?এই পাপ আমি করতে পারব না।”

তিথি- “আমি জানি তমা।বিয়ে ছাড়ায় একটা মেয়ের পেটে বাচ্চা আসার পরিণাম খুব ভয়াবহ। তোর মামণি এমনিতে জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এই খবর শুনলে হয়ত সে মরে…..”

তমা- “তিথি চুপ কর।কি বলছিস তুই।আমি আমার মামণির সাথে এইরকম কিছু হতে দিব না।”

তিথি- “তাহলে এবরশনটা করে ফেল।”

তিথির হাত ধরে সেদিন বুকফাটা আর্তনাদভাবে কেঁদেছিলাম।যা কিছুই হোক বাচ্চাটাতো আমারি।সে আমার গর্ভের সন্তান।চাইলেও তো এই সত্যটাকে আমি মিথ্যা প্রমাণ করতে পারব না। কিন্তু এমনিভাবে বাচ্চাটা আমার পেটে আসল যে কেউ ওকে মেনে নিবে না,,ও সহ আমিও অনেক ধিক্কার পাব এই সমাজ থেকে যদিও আমাদের দুইজনের কারোরই কোন অপরাধ ছিল না। ওকে বাঁচানোর মতন কোন পথই পেলাম না।মা হওয়ার সাধটা সাথেসাথে মাটিতে চাপা দিয়ে মেরে ফেলতে হল।লাইফে কি করতে চাইলাম আর কি হয়ে গেল।কোনকিছুরই হিসাব মিলাতে পারছি না।সেদিন পেটের বাচ্চাটাকে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলেছিলাম,,”তোর মাকে মাফ করে মা।তোকে আমি বাঁচাতে পারলাম না।”

তখন বারবার একটা কথায় মনে হচ্ছিল মার থেকে সন্তান দূরে গেলে মার কতটা কষ্ট লাগে।যেমন কষ্টটা আমি আমার মামণিকে দিয়েছি। মামণি অনেকবার বলেছিল তাকে ফেলে রাজশাহী যাতে না যায়।কিন্তু আমি মামণির কান্নায় সেদিন গলেনি।মামণিকে ফেলে এখানে চলে আসছি।আর আজকে আমার বাচ্চাটা পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই বিদায় নিবে।আমার থেকে দূরে চলে যাবে।
.
.
তমা- “তিথি এবরশনের জন্যতো টাকা লাগবে।এত টাকা আমি পাব কোথায়?বাসার কারোর কাছেও আমি এখন টাকা চাইতে পারব না।এক্সট্রা টাকা চাইতে গেলে মামণি অনেক প্রশ্ন করব।মামণিকে আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না।”

তিথি- “চিন্তা করিস না।আমি কিছু একটা ব্যবস্থা করছি।একটা না একটা উপায় পেয়ে যাব। আমি থাকতে তোর টেনশন নিতে হবে না দোস্ত।”

ওর হাত দুটো ধরে কেঁদে দিলাম।কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে সেদিন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারলাম না।

এরপর এবরশনটা করেই ফেললাম।মেরে ফেললাম আমার বাচ্চাটাকে।একটা পবিত্র, নিষ্পাপ বাচ্চাকে মেরে ফেলার অপরাধবোধটা আমাকে দিনদিন কুঁড়ে খাচ্ছিল।এই বয়সে এসে এক সাথে দুইটা শোকের ধাক্কা সামলাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।তারপরও অনেক কষ্টে নিজেকে সামলিয়েছি।এই দুই মাসে তানভীর আমার সাথে একবারো যোগাযোগ করেনি।কি অবস্থায় ছিলাম,, বেঁচে আছি না মরে গেছি সেই খবরও রাখেনি।অবশ্য রাখবে কি করে ওতো একটা স্বার্থপর, পাষন্ড!

সেদিন যদি একটু সাহস করে তানভীর বিপদের সাথে মোকাবেলা করত তাহলে আমার এতবড় ক্ষতি হত না এই বিশ্বাসটা আমি তখনো মনে করতাম আর এখনো করি।কোনদিনও তোমাকে ক্ষমা করবো না,,কোনদিনও না।
.
.
অতীত থেকে যখন কল্পনায় আসলাম তখন আর থাকতে পারছিলাম না।বুকের ভিতরে খুব কষ্ট হচ্ছিল।কি করব না করব দিকদিশা পাচ্ছিলাম না।বিয়ে বাড়ির সবাই বাইরে আনন্দ করছে আর আমি ভিতরে ভিতের কষ্ট পাচ্ছি যেটা সহ্য করার মতন না।ভিতরের জ্বালাটা কমাতে হবে।নিজেকে কষ্ট দিতে হবে।কি করব,, কি করব?সামনেই ব্লেট একটা দেখলাম।ব্লেড দিয়ে হাতের রগটা কেটে দিলেই হয়ত আমার কষ্টের জ্বালাটা কমে যাবে। অনেকক্ষণ ধরে হাতে ব্লেট নিয়ে বসে আছি।কারণ তখন নিজের ভিতরের জ্বালা কমাতে চাইলেও মনের দিক থেকে নিজের ক্ষতি করার সাহসটুকুও আসছিল না।
.
.
অনেকক্ষণ ধরে বাইরে তমার জন্য অপেক্ষা করছিল ফারিদ।শেষে ওর মাথাটায় খারাপ হয়ে গেল।

ফারিদ- “আমাকে টেনশনে রাখতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না তমা?আজকে তুমি শেষ।আমার ধৈর্যের পরীক্ষা অনেক নিয়ে ফেলছ তুমি।এই আসব বলে আর আসলে না। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।”

সব জায়গা খুঁজেও যখন ফারিদ তমাকে পেল না তখন ওর বুকের ভিতরটা অজানা কারণে মোচড় দিয়ে উঠল। মনে মনে তখন একটা কথায় বারবার ওর মনে হচ্ছিল,, “আমার তিলোত্তমা ঠিক আছে তো।ওর কোন বিপদ হয় নিতো?”
.
.
ফারিদ তাড়াতাড়ি তমার রুমে চলে গেল।জানালা দিয়েই দেখতে পেল তমার হাতে ব্লেড।ব্লেডটার দিকে ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

যে বিপদের আশঙ্কা ও করেছিল তাই হচ্ছে।মেয়েটা কি করতে যাচ্ছে।মেয়েটাতো ওকে মেরেই তারপর দম নিবে।কিচ্ছু ভাবতে পারছিল না ফারিদ সে সময়।এখন কাউকে ডেকে ও বিপদ বাড়াতে চায় না। একনাগাড়ে দরজা ধাক্কাতে লাগল আর তমাকে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডাকতে লাগল।

ফারিদ- “তমা কি করছ তুমি?হাত থেকে ব্লেডটা ফেল?”

কিন্তু তমার কোন হুশই ছিল না।ফারিদের কথার আওয়াজ ওর কানে গেল না।

ফারিদ- “দেখ তমা ব্লেড ফেলতে বলছি।ব্লেডটা হাত থেকে ফেলে দাও।আমি যদি এখন ভিতরে ঢুকে যায় না তাহলে তোমাকে আমি মেরেই ফেলব।”
.
.
দরজা ধাক্কার কিছুক্ষণ পর,,

তমার দু কাধ ঝাকিয়ে,,,

ফারিদ- “এই মেয়ে কি করছিলে তুমি?”

ফারিদের তাকিয়ে ভাবলেশহীনভাবে তমা তাকিয়ে রইল।

ফারিদ- “আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?কেন এইরকম করতে চাইলে?মরার খুব শখ না তোমার!তুমি জানো না তোমার কিছু একটা হয়ে গেল তোমার মামণির কি হত?আমার কি হত?”

ফারিদ খেয়াল করল তমার চোখ থেকে পানি পড়ছে।কতটা শান্ত হয়ে গেছে ও।চোখ মুখ পুরো ফুলে গেছে।চুলের অবস্থা এলোমেলো।আর গলার লুকানো আচড়টা দেখা যাচ্ছে।

তমার এই অবস্থা দেখে ও আর কিছু বলতে পারল না।সাথে সাথে ওকে জড়িয়ে ধরল।

ফারিদ- “লক্ষ্মীটা কি হয়েছে তোমার?কেউ কিছু বলছে?কি জন্য এই বাজে কাজটা করতে যাচ্ছ।প্লিজ বল আমাকে?আমাকে কিছু না বললে আমি বুঝব কি করে?”

ফারিদের কোন কথাই ওর কানে যাচ্ছে না।এতক্ষণ পর ফারিদের বুকে আশ্রয় পেয়ে ওর মনের জ্বালাটা কমে আসছে।কিন্তু খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছ ওর।তাই ফারিদের পাঞ্জাবী পড়া পিঠে ও হাত দিয়ে অনেক শক্ত করে ধরে ওর পিঠে জোরে জোরে খামছি কাটছে।

এত জোরে খামচি কাটার কারণে ফারিদের পিঠে ছিলে যে জ্বালা করছে তাতে সে বুঝতে পারল এর থেকেও বেশি কষ্টের জ্বালা তমা পাচ্ছে।তাই ফারিদ তমার চুলে হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

পুরোটা রাত ওর পাশেই ছিল ফারিদ।বারবার শুধু ভাবতে লাগল এইটুকু মেয়ে কি জন্য এইরকম কাজ করতে গেল?তমার সাথে এই কয়েকদিন মিশে ও অনেক আগেই আঁচ করতে পেরেছিল তমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে?ওর খারাপ অতীতটা জানলে হয়ত ওকে এই কষ্ট থেকে সে মুক্তি দিতে পারত?কিন্তু তমার অতীতের স্মৃতি
জানতে চেয়ে সে ওকে অতীতের ভাবনায় ডুবিয়ে রাখতে চায় না।তাই সব বুঝতে পেরেও ফারিদ তমাকে দিয়ে ওর অতীত ঘাটাতে চাই না।বরং সে চায় তমা অতীতের খারাপ স্মৃতি ভুলে গিয়ে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করুক, ফারিদকে ভালোবাসোক।

আজকে যা হল এরপর থেকে তমাকে চোখের আড়ালে রাখা যাবে না।নাহলে এর থেকেও বড় অঘটন ওর আড়ালে হয়ে যেতে পারে।তাই ওকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে।একবার ভার্সিটিতে তমা ভর্তি হয়ে গেলে হয়।এরপরের ব্যবস্থা সে নিজে নিবে।যাতে আর তমাকে নিয়ে ভয়ে না থাকতে হয়।
.
.
দিপার বিয়ে হয়ে গেলেই ওরা সবাই আবার চট্টগ্রামে রওনা দেয়। চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ফারিদের কাছে তমা কয়েকমাস পড়ে।আর ফারিদ ও তমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখে।

অবশেষে ফারিদের ভার্সিটিতেই তমা টিকে যায়।ফারিদ যা চেয়েছিল ঠিক তাই হল।এখন আর তমাকে আপন করে পেতে ওর আর বাধা রইল না।কয়েকদিন পর ফারিদসহ ওর পরিবার তমার মামণির কাছে বিয়ের কথা বলতে যাবে।এরপর দেখবে সে,, কিভাবে তমা ওকে ইগনোর করে।ও যে তমাকে এত ভালোবাসে তা কেন জানি ও বুঝতে চাই না।নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে।
.
.
অনেক হয়েছে আমার লুকোচুরি ভালোবাসা।আর নয়।এবার আমার ভালোবাসার প্রকাশ করব।তবে সেটা বিয়ের পর।বিয়ের পর ওর সাথে জমিয়ে প্রেম করব।যাকে বলে বৈধতার প্রেম।বিয়ের পর প্রেম করলে সে প্রেমটা হয় খাঁটি আর কাউকে ধোকা দেওয়ারও সুযোগ থাকে না।তমাকে সেই কবে থেকে ভালোবাসি।ওকে ধোকা বা ওর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা আমার পক্ষে সম্ভব না।তাই বিয়ের আগে ওকে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারিনি।কিন্তু একটাবার বিয়েটা হয়ে গেলেই ওকে আমার ভালোবাসার কথা জানাব।উহুম মুখে ভালোবাসি কথাটা বলব না।ওকে অনুভব করাব।ভালোবাসাটাতো অনুভব করার জিনিস।তাই ভালোবাসি কথাটা মুখে বলে আমি আমার ভালোবাসাকে সস্তা করব না।আমার প্রতিটি কাজে,আবেগ আর যত্ন দিয়ে তমা তোমাকে বুঝাব আমি কতটা তোমাকে ভালোবাসি।আমার ভালোবাসার ডাকে তো তোমাকে সাড়া দিতে হবেই পাখিটা।এত এত ভালোবাসব যে আমার ভালোবাসার ডাকে তুমি সাড়া না দিয়ে পাড় পাবে না।মুচকি হেসে ফারিদ মনে মনে কথাটা বলল।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে