সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৯

0
1033

সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৯
#লেখা : রায়না মনি

ঈদের চার দিন পরে অঝোর ঢাকা চলে গেল। যাওয়ার আগে ধারাদের বাসায় আসছিল দেখা দিতে। ধারা অঝোরের সামনেই যেতে পারেনি, ধারার মনটা প্রচণ্ড খারাপ ছিল।
অঝোর চলে যাওয়ার দুদিন পরে, ধারা ওর ফোন থেকে অঝোরের কাছে একটা ম্যাসেজ দিলো,
‘আপনি আবার কবে খুলনা আসবেন ?’
আর কিছু লেখেনি। ধারা ম্যাসেজটা দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে, কখন অঝোর রিপ্লাই দিবে! কিন্তু অঝোর কি বুঝতে পারবে যে ম্যাসেজটা ধারা দিয়েছে ? এর আগে কখনো অঝোরকে নিজের মোবাইল থেকে কল, ম্যাসেজ কোনো টাই দেয়নি।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে অঝোর রিপ্লাই দিলো। অঝোর লিখেছে,
‘ঠিক নেই, তবে আসার আগে তোমাকে জানাবো ।’
ধারা ম্যাসেজটা দেখে অবাক হয়ে গেল! অঝোর কি ওকে চিনতে পেরেছে? কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব? নাকি অন্য কাউকে ভাবছে। ধারা আবার ম্যাসেজ দিলো,
‘আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

ধারার ম্যাসেজ টা দেখে অঝোর হাসছে আর মনে মনে বলছে,
‘ধারা তোমার ম্যাসেজটা দেখেই আমি বুঝে গেছি, এই ম্যাসেজ তুমি ছাড়া আর কেউ দিতে পারে না। তোমার অপ্রকাশিত অনুভূতি গুলো সম্পর্কে ও আমি জানি। আমি হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও তোমায় অনুভব করতে পারবো।’
অঝোর ম্যাসেজে এসব কিছুই লিখলো না, শুধু লিখলো,
‘ধারা তোমাকে না চেনার কী আছে ?’
ম্যাসেজটা দেখে ধারার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। অঝোর ওকে এভাবে চিনতে পারবে ও বুঝতেই পারেনি। ধারা আর কোনো ম্যাসেজ দিলো না। মন বার বার বলছে আর একটা ম্যাসেজ লেখ যে, ‘আমি আপনাকে খুব মিস করবো, আমার দিন গুলো আর ভালো কাটবে না!’
কিন্তু পারলো না।

অঝোর আর কোনো ম্যাসেজ দেয়নি, ধারাও দেয়নি।

ধারা সব সময় আশা করে অঝোর কল দিক ওর কাছে, ম্যাসেজ দিক কিন্তু এমন কিছু দেখার সৌভাগ্য ধারার হলো না । ধারার ইচ্ছা করে কল দিয়ে কথা বলতে কিন্তু কেমন একটা সংকোচ বোধ কাজ করে, তাই আর কল দেওয়া হয় না।

দুটো মাস কেটে গেল। ধারার মনটা কোনো কিছুতে এখন আর স্থির রাখতে পারে না। মনের ভিতর সারাক্ষণ অঝোরই ঘুরে বেড়ায়। লেখা পড়ার অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পড়তে বসলে অঝোরকে নিয়ে এটা সেটা লিখে লিখে ডায়েরির পাতা ভারী করে। আবার সেগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে।
বান্ধবীর সাথে সব কিছুই শেয়ার করেছে। বান্ধবী বলেছে ধারা নাকি অঝোরের প্রেমে পড়েছে, তাই এমন হচ্ছে।
ধারা প্রেম ট্রেম বুঝে না, ওর শুধু অঝোর কেই চাই। অঝোরকে না দেখতে পারলে ওর সব কিছুই বৃথা । অঝোরকে দেখে দেখেই ও জনম কাটিয়ে দিতে পারবে।
এর মাঝে ধারা একদিন অঝোরদের বাসা থেকেও ঘুরে এসেছে।
অঝোরের মা খুব অমায়িক একজন মানুষ। খুব যত্ন করলো ধারাকে। কথা বলার সময় তো ধারা মা বলেই ডাকে।

ধারার কাছে এক একটা দিন একেকটা বছর মনে হতে লাগলো। অঝোরের সাথে কথা বলার জন্য ধারার মনটা মরিয়া হয়ে উঠলো। অবশেষে কল দিয়েই ফেললো । অঝোর কলটা রিসিভ করতেই ধারা বললো,
” ভালো আছেন আপনি ? আপনার মাথার চুল গুলো আগের মতোই আছে তো? নাকি আবার কেটে ছোট করে ফেলেছেন ?”
ধারার কথা শুনে অঝোর হাসি চেপে রাখতে পারলো না, হাসতে হাসতেই বললো,
“এক সাথে এত প্রশ্ন ? আমি ভালো আছি, তোমার কী খবর? আর মাথার চুল গুলো তো মাঝে মাঝে কাটতেই হয়। না হলে অনেক বড় হয়ে যাবে। তা হঠাৎ আমার মাথার চুলের খবর নেওয়ার কারণ কী?”

“এমনি জিজ্ঞেস করলাম । আমার খবর শুনে আর কী করবেন! আচ্ছা আপনি আসবেন কবে ?”

“আর এক দু মাস পরে আসতে পারি।”
ধারা আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রাখলো। দিয়ার কথাও সব বলেছে।

ধারা অধীর আগ্রহে দিন গুনতে লাগলো। বৃষ্টি নামলেই ব্যালকনিতে গিয়ে বসে থাকে। আর ভাবে, এখন অঝোর এখানে থাকলে ও তো অঝোরকে দেখার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকতো। অঝোরকে দেখার জন্য কত যে এই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে থেকেছে। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছা করে অঝোরের সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে। মনে মনে ঠিক করে নিলো, অঝোর আসলে এইবার অঝোরের সাথে বৃষ্টিতে ভিজবেই। মনের মধ্যে যে অনুভূতি গুলো খেলা করছে তাও এবার অঝোরকে বলে দেবে। কিন্তু অঝোর সেগুলোকে কেমন ভাবে নিবে ?

ধারার ঘুম ভেঙে গেল। জানালাটা খোলা থাকায় সকালের মিষ্টি রোদটা এসে হানা দিয়েছে ঘরটায়। ধারা ঘুম ঘুম চোখে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো। দেখলো সকাল আটটা বাজে। ধারা ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলো।

ড্রয়িং রুমের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো, অঝোর সোফার উপর বসে ফোন টিপছে । কপালের উপর পড়ে আছে সেই ঘায়েল করা চুল। ধারা কিছুক্ষণ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইল অঝোরের দিকে।
ধারা বুঝতে পারলো, এটা ওর কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। ধারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যদি আজ সত্যি সত্যি এখানে অঝোর বসে থাকতো! কত ভালো হতো তাহলে। কিন্তু এটা তো এখন আশা করা যায় না।

ধারা মনে মনে বলে উঠলো,
“আরে ধারা তুই সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেলি নাকি? আজকাল যেখানেই যাস সেখানেই অঝোরকে দেখিস। ওহ বুঝতে পেরেছি অঝোর তোর মন কেড়ে নিয়েছে। এখন মন যদি অঝোর অঝোর করে, তাহলে চোখ তো অঝোরকে দেখবেই।”
শেষের কথা গুলো এমন ভাবে বললো যে, নিজেই হেসে ফেলল। তবে হাসিটা মনে মনে না, প্রকাশ্যেই হেসে ফেলল।ধারা স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডী হতে উপরে চলে গেল।

ধারা রেডি হয়ে যখন নিচে নামবে, তখন সিঁড়ির কাছে এসে আবার চোখ পড়ল ড্রয়িং রুমের সোফার উপর। আরে অঝোর এখনও বসে আছে! এর আগে তো একই জায়গায় অঝোরকে শুধু একবারই দেখেছে। আজ হঠাৎ একই জায়গায় দুইবার দেখা যাচ্ছে কেন? কোনো ঘাবলা আছে কি?
ধারা পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো।
অঝোরের কানে আওয়াজ আসাতে সিঁড়ির দিকে তাকালো। ধারাকে অমন ভাবে নামতে দেখে অঝোর একটু অবাক হলো। অঝোর ভেবেছিল ধারা ওকে দেখে খুশি হবে, হাসি হাসি মুখ নিয়ে অঝোরের সামনে এসে গল্প জুড়ে দেবে। কিন্তু একি! ধারা ওর দিকে চোখ সরু করে তাকিয়ে আছে, পা টিপে টিপে হাঁটছে। সবকিছু কেন জানি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে অঝোরের কাছে।

ধারা এসে অঝোরের সামনে দাঁড়ালো। একটু নিচু হয়ে হাত নাড়ালো অঝোরের চোখের সামনে। তারপর সামনা সামনি সোফার উপর বসলো। অঝোর এসবের মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝলো না। ধারা অঝোরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সাথে পর্যবেক্ষণ তো আছেই। ধারাকে এমন ভাবে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে অঝোর একটু নড়ে চড়ে বসে বললো,
“ধারা…”
অঝোরের কথা ধারার কান অবধি পৌঁছালো না। সে এখন গভীর ভাবনার সমুদ্রে সাঁতার কাটছে। আগের ন্যায়ই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
অঝোর কোনো সাড়া না পেয়ে আবারও বললো,
“ধারা… আর ইউ ওকে?”
ধারা এবারও কিছু বললো না। অঝোর উপায় অন্তর না পেয়ে সামনে থাকা টি টেবিলে কয়েক ঘাঁ বসিয়ে দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললো,
“ধারা…”
এত জোরে শব্দ শুনে ধারা লাফিয়ে উঠলো। ভাবতে লাগলো, “ব্যাপার কী? আজ কেমন জানি সব কিছু উল্টা পাল্টা লাগছে! এতদিন তো অঝোর শুধু ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর হেসেছে। কিন্তু আজ কী হলো? ধারার বিস্ময়ের সীমা রইল না।

অঝোরের গলা শুনে রুবিনা কিচেন থেকে দৌঁড়ে আসলেন। অঝোরকে বললো
“কী হইছে অঝোর ?”
রুবিনাকে দেখে অঝোর একটু স্বস্তি পেল। বললো,
“আন্টি আমার কিছু হয়নি। ধারার কোনো একটা সমস্যা হইছে। দেখেন কেমন করে চেয়ে রয়েছে!”
রুবিনার এতক্ষণে মেয়ের দিকে চোখ পড়লো, দেখলো সত্যিই তো ধারা কেমন করেই যেন তাকিয়ে আছে তার এবং অঝোরের দিকে।

ধারা তো এবার দ্বিগুন অবাক। ওর মাথার সাথে সাথে ওর মায়ের মাথাটাও কি গেছে? এতদিন তো শুধু ও অঝোরকে দেখেছে। এখন কি মাও দেখা শুরু করেছে? এও কি সম্ভব?

রুবিনা ধারাকে বললো,
” ধারা এভাবে কী দেখছিস ?”
ধারা বললো,
“নাথিং মা।”

এবার অঝোর বলে উঠলো,
“আন্টি আমার মনে হয় ধারার মাথায় সমস্যা হইছে।”
“কী জানি! কিছুই তো বুঝতে পারছি না বাবা।”

অঝোরের সাথে মাকে কথা বলতে দেখে ধারা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি কার সাথে কথা বলছো মা ?”

ধারার কথা শুনে রুবিনা আর অঝোর বিস্ময় ভরা চোখে তাকালো ধারার দিকে। রুবিনা বললো,
“তোর কি মাথার সাথে সাথে চোখ টাও গেছে? দেখতে পাচ্ছিস না অঝোরের সাথে কথা বলছি ।”

অঝোর বললো,
” মাথা যদি যায় তাহলে চোখ এমনিতেই যাবে আন্টি !”

রুবিনা অঝোরের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“সেটা তো ঠিক।”

ধারার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। এসব কথার মানে কী? অঝোর সত্যিই এসেছে? তাহলে কি ওরই বুঝতে সমস্যা হইছে? কিন্তু অঝোর তো বলেছিল আরও এক দু মাস পরে আসবে। আসার আগে জানিয়ে আসবে। একদিন ও তো হয়নি ঠিকমতো, কিন্তু এখনই চলে আসলো কীভাবে? আর আসার আগে একটু বলেও আসলো না।
ধারা হাসি হাসি মুখে বললো,
“আপনি সত্যি সত্যি আসছেন?”

তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বললো,
“আহ্ মা তুমি এখনও এখানে বসে আছো কেন? ওনাকে কিছু খেতে দাও ।”
রুবিনা মেয়ের কথা শুনে আরও এক দফা বিস্মিত হলো। সে তো অঝোরের জন্য নাস্তা রেডী করছিল, এখানের এই অবস্থার জন্যই তো ছুটে আসলেন। এতক্ষণ ধারা কী বললো, আর এখন কী বলছে। মেয়েটার মাথায় কি সত্যিই কোনো সমস্যা হলো? নাকি ঘুম থেকে উঠে কিছু ঠিক করতে পারেনি প্রথমে?
রুবিনা আর কথা বাড়ালেন না। মেয়ের দিকে একটু সরু চোখে তাকিয়ে ওখান থেকে চলে গেল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে