সম্পৃক্ততা পর্ব ২

0
738

সম্পৃক্ততা — দ্বিতীয় পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৪.
ফাতেমা ভেবেছিল, তাহমিদ খাবার টেবিলে দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। তাই সে রান্নাঘরের ভিতরেই বেশ তোড়জোড় করে রান্না শেষ করছিল। কিন্তু রান্না শেষ করে যখন খাবার টেবিলের কাছে এলো, তখন তাঁর মেজাজ বিগড়ে গেল। ৮ টা বেজে গেছে। ছেলেটা খাবেই-বা কখন, আর অফিসেই-বা যাবে কখন?
মনেমনে এ-কথা বলে বিড়বিড় করে সে এগিয়ে গেল তাহমিদের ঘরের দিকে। দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো। ফাতেমা জোরে ধাক্কা মারল দরজায়। তাহমিদের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। রাগে আর ক্ষোভে সে ধুম করে দরজায় একটা লাত্থি মারল। মুখে চেঁচিয়ে বলল,
– ওই তাহমিদের বাচ্চা!

তাহমিদ সবেমাত্র গোসল করে বের হয়েছে। ফাতেমা সম্পর্কে তাঁর ভাবী হয়। বয়সে তাঁর থেকে বড় বা ছোট নয়। অনেকটা সেইম বয়সী দু’জনে। তবুও সে যথেষ্ট সম্মান করে ভাবীকে। ফাতেমা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে তুমি থেকে তুই বলে সম্মোধন করলেও তাহমিদ সবসময় ভাবীকে তুমি বলে সম্মোধন করেছে। হোক সে সমবয়সী; সম্পর্কে সে একজন শ্রদ্ধাশীল মানুষ।
তাহমিদের সাড়া না পেয়ে ফাতেমা বোধহয় আরও জোরে চেঁচানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিংবা বড় সাইজের কিছু দিয়ে দরজা ভাঙার মতো প্ল্যান করছিল। কিন্তু তাঁর আগেই তাহমিদ ভিতর থেকে বলে উঠল,
– ভাবী, আমি রেডি হচ্ছি। তুমি খাবার রেডি করো।

তাহমিদের কণ্ঠ শুনে শান্ত হলো ফাতেমা। বলল,
– ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি এসো।

– আচ্ছা।

স্বল্প সময়ের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল তাহমিদ। টেবিলের উপর থাকা পুরোনো সময়ের নতুন মডেলের বাটন মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। খাবার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল, কেউ নেই। অর্থাৎ বড় ভাই, ছোট বোন, কেউই নেই ওখানে। শুধু ফাতেমা একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। তাকে দেখে ফাতেমা ফোন রেখে প্লেট রাখল একটা চেয়ারের সামনে। পানির গ্লাস দিলো। তাহমিদ চেয়ারে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল,
– ভাইয়া কোথায় ভাবী?

– সে তো অনেকক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেছে। আজ কী যেন একটা জরুরি কাজ আছে বলল; তাই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে। খেয়ে পর্যন্ত যায়নি। আমাকে রাতে কিছু বলেওনি। আগে থেকে জানা থাকলে আমি আরও আগে ঘুম থেকে ওঠে রান্না করতাম।

তাহমিদ হাসল। আজ আর তাকে কেউ বলবে না, ‘এই পত্রিকার চাকরি ছেড়ে একটা ভালো চাকরি খোঁজ।।আজকাল দশ হাজার টাকার বেতনে চাকরি করা ছেলেদের হাতে কেউ নিজের মেয়েকে দিতে চায় না। বয়স তো হচ্ছে। দু’দিন পর সবাই কাকু ডাকতে শুরু করবে।’ এই একই কথা তাঁর ভাই, তুহিন তাকে প্রতিদিন সকাল-বিকাল নিয়ম করে বলে৷ বড় ভাইকে আবার সে কিছু বলতে পারে না। মানুষকে কষ্ট দিতে তাঁর রুচিতে বাধে। সে নিজেও একজন মানুষ। একজন মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষকে কষ্ট দেওয়াটা তাঁর কাছে ঠিক বোধগম্য না। তাই যখন বুঝে, তাঁর কথাতে বা তাঁর কাজে কেউ মনে আঘাত পাচ্ছে, সে চুপ করে যায়।
তাহমিদ গ্লাস থেকে পানি ঢালল প্লেটে। প্লেটটাসহ হাতটা ধুঁয়ে ভাবীর দিকে প্লেট এগিয়ে দিলো। মুখে বলল,
– ভাবী, ভাইয়া না খেয়ে গেছে বলে কী তোমার খুব আফসোস হচ্ছে?

ফাতেমা অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– এখানে আফসোসের কী আছে শুনি? একটা মানুষ না খেয়ে চলে গেল; জরুরি কাজ শেষ করে আবার কখন খাওয়ার সুযোগ পাবে, তাঁর কী ঠিক আছে? শেষে না শরীর খারাপ হয়ে যায়। উনার জন্য তৃষ্ণাটাও খেতে পারল না। সে তো আবার বড় ভাইয়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে যায়। বড় ভাই যেহেতু আজ তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে, তাই তাকেও না খেয়ে বড় ভাইয়ের সাথে যেতে হয়েছে।

এ-কথা বলে প্লেটে ভাত দিতে লাগল ফাতেমা। তাহমিদ বলল,
– সাভার থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিট। ভাইয়া অফিসে যায় ঢাকার পথে। অর্থাৎ তুলিকে ইউনিভার্সিটি গেইটে নামিয়ে দিয়ে তাকে আবার উল্টো দিকে ছুটতে হয়৷ এটা ঠিক না। তাছাড়া তুলি যথেষ্ট বড় হয়েছে। এই দশ মিনিটের পথ যদি ও একা যেতে না পারে, তাহলে তো সমস্যা।

– কী আর করার বলো; অভ্যাসটা তো তোমরাই তৈরি করেছ। ও একা একা কোথাও যেতে চায় না। তুমিও তো দেরি করে ঘুম থেকে উঠো। তাই বড় ভাইয়ের সাথেই যায়।

তাহমিদ খাওয়া শুরু করল। ফাতেমা তাকে তাগাদা দিয়ে বলল,
– তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো। কয়টা বাজে দেখেছে একবার? আজ এত দেরি করে উঠলে কেন?

– এর একটা বিশেষ কারণ আছে। রাতে অনেক দেরি হয়েছিল ঘুমাতে।

– শুধু তো আজ বা কাল না। তুমি প্রায়ই দেরি করে ঘুম থেকে উঠো। আমি নিশ্চিত, এইরকম ঘন ঘন করতে থাকলে তুমি শীঘ্রই চাকরিটা হারাবে। যদিও এতে আমরা খুশিই হবো। বাট ব্যক্তিগত ভাবে আমি চাই না তোমাকে কেউ বকাঝকা করে অফিস থেকে বের করে দিক। তুমি নিজে থেকে চাকরি ছেড়ে দিলে আমি বেশি খুশি হবো।

– আমি নিজে থেকে এই চাকরি ছাড়ব না ভাবী। আর আমার চাকরি নট করার মতো সাহস মহাকালের কারোর নেই। কারণ যে ওই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, সে আমার খুব কাছের বান্ধবী। একসময় আমরা খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড ছিলাম। এখনো আছি। সুতরাং আমি জানি, আর যাই হোক আমার চাকরি চলে যাবে না।

ফাতেমা হেসে বলল,
– ওহ্ আচ্ছা। তা তোমার চারিদিকে এত এত মেয়ে কেন? তোমার জীবনের সাথে এত মেয়ে জড়িয়ে আছে কেন?

তাহমিদ স্বাভাবিক ভাবে বলল,
– ভাবী, মেয়েদের আমি নিজের জীবনে জড়াই না। কীভাবে যেন মেয়েরাই আমার জীবনে জড়িয়ে যায়। এই যেমন, অফিসের মেয়েটা; ওর সাথে কিন্তু আমি সেই কলেজে একসাথে পড়েছিলাম। এরপর ও অনার্স করার সিদ্ধান্ত নিলো। আমি বিএসসি করতে অন্য জায়গায় গেলাম। এরপর আর যোগাযোগ ছিল না। মহাকালে চাকরি করার সময় হঠাৎ মেয়েটা এসে হাজির হয়। পুরো ম্যানেজমেন্ট টিম ওদের নিজেদের লোক। মহাকাল তো প্রায় ওদেরই। এবার তুমিই বলো, এখানে আমার দোষ কোথায়? আমি মহাকালে আসার পর ও এসেছে। ও আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে। আমি তো নিজে থেকে জড়াইনি।

– আর ওই রাতের মেয়েটা। যে তোমার স্বপ্নে আসে। যদিও এখানে আমার একটা খটকা আছে শুরু থেকেই।

তাহমিদ খাওয়া বন্ধ করে তাকালো ফাতেমার দিকে। বলল,
– আহ্, ভাবী! ভুল বললে। ও আমার স্বপ্নে আসে না। আমি জেগে থাকাতেই ও ফোন করে।

‘০০৯’ যে কোনো ফোন নম্বর না, ফাতেমা তা ভালো করেই জানে। সে যেদিন প্রথম তাহমিদের মুখে শুনেছিল, গভীর রাতে একটা মেয়ে তাহমিদকে ফোন দেয়, নানান বিষয়ে আলোচনা করে, সেদিনই অবাক হয়েছিল ফাতেমা। সে নিজের ফোনে ডালায় করেছিল ০০৯ নম্বরটা। কোনো লাভ হয়নি। এইরকম কোনো নম্বর নেই। প্রথমে ভেবেছিল কেউ অফিসিয়াল নম্বর দিয়ে তাহমিদের সাথে মজা করছে। কিন্তু পরে যখন দেখেছে বিষয়টি দিনদিন সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে, তখন তাহমিদের ফোন থেকে সিম কোম্পানিতে ফোন দিয়েছিল সে। সেখান থেকে জেনেছে, ০০৯ সংখ্যার কোনো নম্বর থেকে তাহমিদের সিমে কখনোই কোনো ফোনকল আসেনি। বিষয়টি নিয়ে নিজের স্বামীর সাথেও আলোচনা করেছে ফাতেমা। তুহিম বলেছে, হয় তাহমিদ নিজেই মজা করছে। নাহয় ওর মধ্যে মানসিক কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে।
ফাতেমা বলল,
– তাহমিদ, তোমাকে কতবার না বলেছি রাতে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমাবে। শোনো, কাল থেকে ঘুমানোর আগে মোবাইল আমার কাছে দিবে। তোমার তো এখন আর গালফ্রেন্ড নেই। বাড়িতে এসে সেভাবে কারোর সাথে ফোনে কথাও বলো না। সুতরাং রাতে ফোনের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না আমার।

– আছে ভাবী; খুব প্রয়োজন আছে। তুমি জানো, ওই মেয়েটা আমাকে কত সাহায্য করেছে। আমি জীবনের সব জটিল সমস্যার সমাধান করে দেয় ওই মেয়েটা। শুধু তো আমার না, আমাকে দিয়ে ও অনেকেরই সাহায্য করায়।

ফাতেমা অনুনয়ের কণ্ঠে বলল,
– প্লিজ ভাই, চুপ করো। এগুলো তোমার ভুল ধারণা। আসলে তুমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতে একসময়। একটু বেশিই ভালোবাসতে। ও যখন তোমাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন থেকেই তুমি মানসিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হও। তুমি সবসময় চাইতে, একজন মেয়ে তোমার জীবনে আসুক। তোমার জীবনটা আলোকিত করে দিক। তোমার জীবনে যত সমস্যা আছে, তা সমাধান করে দিক। দিনরাত এইসব ভাবতে তুমি। মনে মনে কল্পনা করতে, একটা খুব সুন্দর মেয়ে তোমার জীবনে এসেছে। তোমাকে জীবনের জটিলতা দূর করছে। মানুষের কল্পনার সাথে তাঁর মস্তিষ্কের একটা কানেকশন আছে। তুমি যা ভাবো, তোমার মস্তিষ্ক তা তোমার চোখের সামনে দৃশ্যমান করে তুলে। সারাদিন তুমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকো। তাই সেভাবে মগ্ন হয়ে সেই মেয়েকে নিয়ে ভাবতে পারো না। কিন্তু রাতে তো তুমি চার দেয়ালের আবদ্ধঘরে একা থাকো। তখন গভীর ভাবে কল্পনা করো, তোমার জীবনে একটা মেয়ে এসেছে। যে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, তোমাকে আনন্দ দিচ্ছে, তোমার জটিলতা দূর করছে। তোমার এই ভাবনাগুলোই তোমার মস্তিষ্ক দৃশ্যমান করছে। তুমি যখন গভীরভাবে কোনোকিছুতে মগ্ন হয়ে পড়ো, তখন তোমার মস্তিষ্কে অন্য দিকে সঞ্চালিত হতে শুরু করে। একদম বাস্তবের মতো কিছু ঘটনা তোমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তুমি নিজের মস্তিষ্ককেই তখন প্রশ্ন করো। আর তোমার মস্তিষ্ক অটোমেটিক উত্তর দিয়ে দেয়। একটা চরিত্র তোমার সামনে তুলে ধরে। যাতে তুমি উত্তরগুলো বিশ্বাস করো। এইরকমটা অনেকের সাথেই হয় ভাই। আমরা একে বলি, হ্যালুসিনেশন।

তাহমিদ এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ফাতেমার কথা শুনছিল। ফাতেমা থেমে যেতেই সে বলে উঠল,
– আর ওই নম্বরটা; ফোন নম্বর ‘009’!

– এটা কোনো ফোন নম্বর না ভাই। তুমি হয়তো এই তিনতে সংখ্যা কোথাও দেখেছ। বা এই সংখ্যা তিনতে নিয়ে কিছু ভেবেছ মনেমনে। তাই তোমার মস্তিষ্ক এই তিনতে সংখ্যাকে কাজে লাগিয়েছে।

তাহমিদ হাসল। রসিক সুরে বলল,
– ভাবী, আমি অতটাও বোকা নই, যে সবকিছু বিশ্বাস করব। অনেক মানুষই হ্যালুসিনেশনে ভুগে। এটা আমি জানি। বাট তুমি যেভাবে বলছ, এই মস্তিষ্ক জিনিসটা যেন আস্ত একটা ক্ষমতাবান লোক। সে নিজের ইচ্ছেমতো আমাকে যা-তা দেখিয়ে দিচ্ছে।

– মস্তিষ্ক তো তোমার মধ্যে আছে। তুমি যা ভাববে, মনে মনে যা কল্পনা করবে, ও তো সেগুলোই তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিবে। আমি বলি কী, তুমি কিছুদিন বিশ্রাম নাও। আমাদের সময় দাও। তৃষ্ণাকেও বলব, কিছুদিন ইউনিভার্সিটি না যেতে। প্রয়োজনে তোমার ভাইয়াকে বলব, কিছুদিনের জন্য অফিস ছুটি নিতে। ওই মেয়েটা চলে যাওয়ায় তুমি যে মানসিক আঘাত পেয়েছ, সেখান থেকে বের হতে আমরা তোমাকে সাহায্য করব। এইসময় তোমার পরিবার তোমাকে সাপোর্ট করবে।

তাহমিদ স্তব্ধ হয়ে গেল। কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– ভাবী, তোমরা কি ভাবছ আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ? মানে, আমি।পাগল।

– ওমা ছি:! এ কেমন কথা। মানসিক চাপে থাকা আর মানসিক অসুস্থতা কী এক?

তাহমিদ কিছু বলল না। তাঁর ভীষণ রাগ হচ্ছে। শরীরটা হিড়হিড় করছে। মস্তিষ্ক মানুষকে ভাবায়, কিন্তু ওইরকম স্পষ্ট এবং বাস্তব ভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে পারে না। সে ভাবল, ভাবী বোকা বোকা কথা বলছে। মস্তিষ্ক একটা ভ্রান্তিমাত্র। আর যে ফোনে কথা বলে, সে একজন মানুষ। এটা ঠিক, প্রথম ভালোবাসা থেকে প্রতারিত হয়ে আমি হতাশ হয়েছি। খুব কষ্টও পেয়েছি। কিন্তু পাগল কিংবা নির্বোধ হয়ে যাইনি।

আর এক লোকমা ভাতও মুখে দিলো না তাহমিদ। সে হাত ধুঁয়ে ফেলল। বাইরে যাওয়ার আগে বলল,
– তুলি আসলে বইলো, ওর প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি।

– কোন প্রশ্নের উত্তর?

ফাতেমা জিজ্ঞেস করল। কিন্তু তাহমিদ কোনো উত্তর দিলো না। হঠাৎ করেই তাঁর মনটা খারাপ হয়ে গেল। দু’টো কারণে তাঁর মুখটা হঠাৎ মলিন হয়ে গেছে। প্রথম কারণ তাঁর ভাবী ভাবছে, সে মানসিক ভাবে অসুস্থ। ভাবী মুখে স্বীকার না করলেও সে বুঝতে পারছে, ভাবী এইরকম কিছুই ভাবছে। আর দ্বিতীয় কারণ, হঠাৎ করেই এমন একজনের প্রসঙ্গ টেনে আনা হলো, যে আস্ত একটা যন্ত্রণার পাহাড়। মুহূর্তের মধ্যেই বুকে যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। আল্লাহ সৃষ্টি করে মানুষ, আর মানুষ সৃষ্টি করে যন্ত্রণা। কী অদ্ভুত সবকিছু!

৫.
সজল গোলগোল চোখ করে দেখছে আসমাকে। শুকিয়ে যাওয়া খালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জনে। সজল এখন পর্যন্ত বারকয়েক আসমাকে বলেছে, আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখতে লাগছে। প্রতিবারই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছে আসমা। ছোটবেলা থেকে তাঁর ধারণা ছিল, গ্রামের মেয়েরা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির হয়। সে এই মনোভাব নিজের মধ্যে বজায় রেখেছে সবসময়। আসমার লাজুকতা সজলের সবচেয়ে বেশি পছন্দের। স্কুল বেশ কিছুটা দূরে। ভ্যান বা রিকশা দিয়ে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। কিন্তু তাঁরা দু’জন ভ্যান বা রিকশা দিয়ে স্কুলে যায় না। গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে দু’জনে হেঁটে যায় দু’জনে।
টাকা-পয়সার দিক দিয়ে উচ্চ পরিবারের ছেলে সজল। ঢাকায় পড়াশোনা করলেও চাকরিবাকরি করে সেখানে স্থায়িত্ব হওয়ার কোনো ইচ্ছে তাঁর মধ্যে ছিল না। আসমা আর সে একই গ্রামের বাসিন্দা। ছোট থেকেই একে অপরকে দেখে বড় হয়েছে তাঁরা। যদিও সেভাবে কখনো কথা বলেনি আগে। হঠাৎ হঠাৎ কখনো মুখোমুখি হয়ে গেলে, সামান্য কুশল বিনিময় হতো দু’জনের মধ্যে। আসমা আগে সজলকে ভাই বলে ডাকলেও সজলের অনুরোধে এখন নাম ধরেই ডাকে। তবে আপনি বলে সম্মোধন করা থেকে সরে আসতে পারেনি। অনার্স শেষ করেই আসমা একটা স্কুলে চাকরি নেয়। সজলের মনে অনেক আগেই থেকেই আসমার প্রতি একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করতো। তাই সে নিজেও আর ঢাকা না গিয়ে আসমার সাথে একই স্কুলে চাকরি নেয়। এরজন্য অবশ্য তাকে পারিবারিক বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মোটামুটি কিছুটা বাধা কাটিয়ে উঠতে পারলেও পুরোপুরি ভাবে সবাইকে মানিয়ে নিতে পারেনি। শিক্ষকতার চাকরি যে খারাপ, তা না। কিন্তু পরিবারের এমন কিছু মানুষ থাকে, যারা চায় তাঁদের সন্তান শহরে গিয়ে একটা বড় পোস্টের চাকরি করুক। ভালো বেতনের চাকরি করে উঁচু পর্যায়ে যাক। গ্রাম-গঞ্জে এইরকম স্বপ্ন দেখা বাবা-মা অসংখ্য আছেন। সজলের বাবা-মা ও চেয়েছিল, ছেলে শহরে গিয়ে একটা বড় চাকরি করুক। ঢাকার অত ভালো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে এখন গ্রামে পড়ে থাকাটা তাঁদের কাছে ভালো লাগেনি। এছাড়াও আসমার সাথে মেলামেশার ব্যাপারটা তাঁর পরিবার সহ গ্রামের অনেকেরই জানা। এটা নিয়েও তাঁর বাবা-মায়ের সাথে, তাঁর মত-দ্বিমতের একটা ঝামেলা হয়েছে। সে বাড়িতে বলেছিল, আসমাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু বাড়ির কেউ রাজি হয়নি। গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ তাঁরা। তাঁর দাদা আগে গ্রামের চেয়ারম্যান ছিল। এইরকম সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষের সাথে, আসমার পরিবারের মতো সাধারণ একটা পরিবারের সম্পর্ক হয় না। এটা খুবই বেমানান। তবে সজল হাল ছাড়েনি। আসমাকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তাঁর মাথায় দু’টো বিষয় সবসময় ঘুরপাক খায়; প্রথমত তাঁর প্রতি আসমার দৃঢ় বিশ্বাস। যা সে কোনোমূল্যেই হারাতে চায় না। দ্বিতীয়ত নিজের পরিবারের সম্মান। কেউ যাতে তাঁর পরিবারের দিকে আঙ্গুল না তুলে, সেদিকটাও ভাবে। দু’টো বিষয়ের পাড় দুই প্রান্তে। পরিস্থিতি এমন যে, একটাকে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিতে হলে অন্যটাকে হারাতে হবে। তবুও সে চেষ্টা করে যাচ্ছে, একসাথে দু’টোকে নিজের আয়ত্তে নিতে। দু’টোর সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা এমন যে, একটা ছাড়া অন্যটা কল্পনা করতে পারে না।

সপ্তাহে তিনদিন আসমার টিউশনি থাকলেও সে বাড়িতে মা’কে বলেছে, তাঁর সপ্তাহে ৬দিনই টিউশনি আছে। মাঝে মাঝে এটাও বলে, শুক্রবারেও পড়াতে যেতে হয় তাকে। তিনদিন ব্যতীত অন্যান্য যে সময়টুকু তাঁর হাতে থাকে, সে প্রিয় মানুষটার সাথে সেই সময়টা কাঁটায়। কখনো পাশাপাশি হাঁটে। কখনো আবার একজায়গায় বসে খোশগল্প শুরু করে দেয়।
আসমার পরণে একটা সবুজ রঙের শাড়ি। সুতি কাপড়ের এই শাড়িটা তাঁর খুব পছন্দের। কিছুদিন আগে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল সে। সজল মাস্টারও একই দিনে স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছিল। এরপর দু’জনে মিলে একসাথে শহরে গিয়েছিল। মাস্টার তাকে এই সবুজ পাতা রঙের শাড়িটা পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল। সেদিন থেকেই তাঁর প্রিয় জিনিসের লিস্টে এটাও যোগ হয়ে গিয়েছিল। সজলের পরণে সাদা রঙের শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। তাঁরা যে পথটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তা বেশ সরু। দু’জনের মাঝে দূরত্ব স্বল্প। তবে দু’জনেই যথাসম্ভব চেষ্টা করছে, যাতে একে অপরের সাথে, শরীরের স্পর্শ না লাগে।
সজল অনেকক্ষণ চুপচাপ পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। আসমাও নিজে থেকে কিছু বলেনি এতক্ষণ। নীরবতা ভেঙে সজল নিজেই এবার মুখ খুলে বলল,
– আসমা, তুমি যে সপ্তাহে তিনদিন বাড়িতে মিথ্যে বলে আমার সাথে দেখা করতে আসো, তোমার কী ভয় করে না? মানে গ্রামের লোকজন তো আমাদের একসাথে অনেকসময়ই দেখে। তাঁরা যদি তোমার বাড়িতে কিছু বলে দেয়?

আসমা মাথা তুলে বলল,
– বললে বলবে। আমরা তো খারাপ কিছু করছি না। তাছাড়া এখনো কী সেই যুগ আছে, যে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেই বদনাম করতে শুরু করে দেবে লোকজন?

– না। আসলে অনেকেই তো আছেন, যারা এখনো এইসব দিকগুলোকে অন্য নজরে দেখে। তাছাড়া আমরা দু’জন একটা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁরা হয়তো আমাদের অন্যভাবে দেখতে চাইবে।

– দেখুন, আমরা এমন কিছু করছি না, যা তাঁদের দেখা-চাওয়ার বাইরে। এমন কোনো নিয়ম নেই যে, একজন শিক্ষিকা বা একজন শিক্ষক, কাউকে পছন্দ করতে পারবে না। আপনি অযথাই এভাবে ভাবছেন। তাছাড়া লোকে কী বলল, বা ভাবল, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আপনি এবং আমি, আমরা দু’জনেই জানি, আমরা কেন এভাবে মিশছি। জানি না?

আসমার কণ্ঠে দৃঢ়তা প্রকাশ পেলো। সে সচরাচর সজলের সামনে এভাবে কথা বলে না। কিন্তু এখন যেহেতু প্রসঙ্গ এসেছে, তাই বলতে বাধ্য হচ্ছে। সজল বলল,
– হুম জানি তো। আমরা একে অপরকে পছন্দ করি। বিয়েও করব আমরা। তবুও ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে আমার কাছে। আমাদের স্কুলের কেউ যদি এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে, তাহলে বেশ বড়সড় একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হবে।

– আপনি কী চাচ্ছেন আমি এভাবে আপনার সাথে আর কখনো দেখা করতে না আসি?

সজল চমকে ওঠে বলল,
– না না। এইসব কী বলছ আসমা?

আসমা করুণ কণ্ঠে বলল,
– ঠিক কথাই তো বলছি। আপনি লোকের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারের ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছেন। অথচ যখন আমরা একে অপরকে ভিন্ন ভাবে বুঝতে শুরু করেছিলাম, তখন এই প্রসঙ্গগুলো হাজার মাইল দূরে ছিল। আমরা তো জানতাম, আমাদের সম্পর্কটা লোকজন কটূ নজরে দেখবে। কারণ আমাদের পরিবারের লেভেল খুব ভিন্ন। এছাড়াও আমরা দু’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এই শব্দদুটি খুবই সম্মানিত। কিন্তু কাউকে পছন্দ করা তো অপরাধের কিছু না। যে কেউ, যাকে ইচ্ছে পছন্দ করতে পারে। আমরা তো আর খারাপ কোনো সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছি না, যে মানুষ বদনাম দিবে। আমি এবং আপনি, আমরা কেউই চাই না আমাদের ভুল কোনো কর্মের ফল আমাদের পরিবার ভোগ করুক। আমার কাছে আমার পরিবার যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ আপনি এবং আপনার পরিবার। যদি কখনো আমাদের বিয়ে হয়, তাহলে আমাকে ওই পরিবারে যেতে হবে। আর আমি চাই না, আমার জন্য ওই পরিবারের কোনো বদনাম হোক।

সজল তীক্ষ্ণ চোখে দেখল আসমাকে। আসমা এইরকম কথা নিয়মিত না বললেও তাঁর সব কথা শুনেই চমকে ওঠে সজল। তাঁর কাছে আসমা মেয়েটা খুব বিচক্ষণ একজন। সে আসমাকে সম্মান করে। সাধারণ দু’জন ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসার সম্পর্ক এই হাফ-আধুনিক জগত মেনে নিলেও একজন শিক্ষক এবং একজন শিক্ষিকার প্রেমের ব্যাপারটা কেউই সহজভাবে নিবে না। অনেকেই টিটকারি মারবে। কটূ কথা বলবে। তবুও তাঁরা এখন পর্যন্ত একে অপরের পাশে আছে।
আসমা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলতে লাগল,
– আপনাকে আমি আগেও বলেছি, আজ আবারও বলছি, আপনি প্লিজ নিজের বাবা-মায়ের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিন এখন। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। যতদিন সম্ভব হবে, ততদিন আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব। আপনি বাবা-মায়ের কথা শুনে ঢাকা যান। ভালো একটা চাকরি নিন। এরপর নিজের বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলবেন আমার কথা।

সজল অসহায় কণ্ঠে বলল,
– আমি তাঁদের বুঝিয়েছি। এটাও বলেছি, তোমার সাথে বিয়ের পর আমি ঢাকায় যাবো। কিন্তু তাঁরা বলেছেন, আমি বিয়ে করতে চাইলে বিয়ে করতে পারি। তবে এমন একটা পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করতে হবে, যে তাঁদের পছন্দ। অর্থাৎ তাঁদের পছন্দ করা কোনো ধনী পরিবারের মেয়ে।

কথাটা বলে সজল নিজেও যেন শূন্যতা অনুভব করল বুকের ভিতরে। একটা হাহাকার বুকে যন্ত্রণা দিতে লাগল। শুরুর আগে জীবন যতটা সহজ মনে হয়েছিল, আদৌতেও ততটা সহজ না। এই মাঝপথে এসে মনে হচ্ছে, জীবনের থেকে কঠিন কিছু এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সম্পর্ক গড়া যতটা সহজ হয়েছিল, সেই সম্পর্ক রক্ষা করা তাঁর থেকে হাজারগুন কঠিন মনে হচ্ছে।

আসমা আর কোনো কথা বলল না। দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে মলিন মুখে হাঁটতে লাগল। যেখানেসেখানে কাঁদতে নেই; এই ভেবে সে চোখের জল কোনোরকমে আটকে রেখেছে। অথচ সেই কখন তাঁর মন কেঁদে চলেছে; নিঃশব্দে, নির্বিকারে! মনের কান্না তো আর সজল দেখতে পাচ্ছে না। তাই সে নিশ্চিন্ত।

৬.
সন্ধ্যার পর তাহমিদ বাড়িতে ফিরল। দরজা খুলে দিলো তৃষ্ণা। তৃষ্ণা দরজা খুলে ভাইকে দেখেই আনন্দে আত্মাহারা হয়ে উঠল। উল্লাসে ভাইয়ের হাত ধরে টেনে ভিতরে নিয়ে এলো। তাহমিদ ক্লান্ত খুব। এ সময় টানাটানি তাঁর সহ্য হলো না। এদিকে বোনের উজ্জ্বল মুখটা দেখে আর রাগটাও প্রকাশ করতে পারল না। শান্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো,
– আস্তে তুলি; এইরকম করছিস কেন?

তৃষ্ণা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
– কেন করছি বুঝতে পারছ না। কাল যে তোমায় একটা প্রশ্ন করেছিলাম, তাঁর উত্তর কই?

– উত্তর আছে। মনের ভিতর যত্ন করে নোট করে রেখেছি। ঘরে চল।

– ওকে।

ঘরে এসে গতদিনের মতো দু’জন বসল। তৃষ্ণা আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের মুখের দিকে। তাহমিদ কেঁশে নিলো কিছুক্ষণ। এরপর বলল,
– তাঁর আগে বল, হঠাৎ তোর মনে এইরকম একটা প্রশ্ন কেন এলো?

তৃষ্ণা থতমত খেয়ে গেল। তাঁর ভাই যে এইরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে, তা ভেবে দেখেনি আগে। এই প্রশ্নের উত্তরটা চট করে দেওয়া যাবে না। উল্টো পাল্টা বলে ফেললেই সর্বনাশ হয়ে যাবে। তাই সে অতি সাবধানে প্রশ্নটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বলল,
– ভাইয়া, আমাকে পড়তে বসতে হবে। তুমি চটপট আমাকে উত্তরটা বলো।

তাহমিদ হেসে বলল,
– আমি জানতাম আমার প্রশ্নটা তুই এড়িয়ে যাবি?

তৃষ্ণা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
– কীকরে জানতে?

– একজন বলেছে আমায়। তোকে বলেছিলাম না, রোজ রাতে একটা মেয়ে আমাকে ফোন দেয়।

তৃষ্ণা মাথা চুলকিয়ে কী যেন মনে করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর ব্যর্থ হয়ে বলল,
– কই, এইরকম কিছু তো আমায় আগে কখনো বলোনি।

তাহমিদের মনে পড়ল; সেই 009 সংখ্যার নম্বর এবং মেয়েটার ব্যাপারে সে শুধুমাত্র ভাবীর সাথে আলোচনা করেছিল। তাঁর ভাবী, তাঁর ভাইকে হয়তো বলেছে। তবে বোন কিছু জানে না।
তাহমিদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
– আচ্ছা বাদ দে। উত্তরটা তাহলে শোন।

– বলো।

তৃষ্ণা নড়েচড়ে বসল। তাহমিদ-ও নড়েচড়ে বসল। এরপর বলতে শুরু করল,
– তুই দু’টো অপশন দিয়েছিলি। তাঁর মধ্যে একটাও পুরোপুরি ভাবে জড়িত না; একটা মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার পিছনে। বাট পরিবার এর সাথে সরাসরি জড়িয়ে আছে। ছোট থেকে যখন একটা মানুষ বেড়ে ওঠে, তখন সে পরিবারের ছায়ার মধ্যে থেকেই বেড়ে ওঠে। সমাজ কিংবা তাঁর নিজস্বতা, জীবনে সেসময় প্রভাব ফেলে না। মুসলিম সন্তান হলে পরিবারের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হয়৷ পরিবারের লোকজন যদি চায়, তাহলে নিজেদের সন্তানকে শুরু থেকেই একটা সঠিক পথ ধরিয়ে দিতে পারে। বাট অনেক বাবা-মা সেটা করে না। সেজন্য একটা সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তাঁর মধ্যে একটা অন্যরকম অস্তিত্ব চলে আসে। সে নিজেকে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে। এর মধ্যে আবার সমাজের খারাপ কিছু মানুষ এসে যায় তাঁর জীবনে। তখন ছেলেটা চাইলেও এইসব থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না। কারণ সে খারাপ কিছুর মধ্যেই নিজের ভালোটা দেখতে পাচ্ছে। ছোট থেকে যদি পরিবারের লোকজন তাকে সঠিক শিক্ষা দিয়ে, একটা সুন্দর পথে চলার অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দিতো, তাহলে বড় হয়েও সে নিজেকে সেই পথেই রাখতো। সুতরাং এখান থেকে স্পষ্ট, একজন মানুষের মন বিকৃত হয় পরিবারের কারণে।

এইটুকু বলে তাহমিদ থামলো। তৃষ্ণা বলল,
– কিন্তু ভাইয়া; অনেক বাবা-মা আছেন, যারা সবসময় মনেপ্রাণে সন্তানের একটা সুন্দর জীবন চেয়ে এসেছে। কিন্তু একটা সময় দেখে, তাঁরা যা চাচ্ছে, তাঁর ঠিক উল্টোটা হচ্ছে। ফলে তাঁরা হতাশ হয়, অসহায় হয়ে পড়ে। সারাদিন চেষ্টা করেও সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে না।

তাহমিদ হাসল। হেসে বলল,
– সেই চেষ্টাটা সঠিক সময় করলে সন্তানের জীবন দেখে আর তাঁদের হতাশ হতে হতো না৷ অসহায় হতো না। কিছু বাবা-মা আছে, যারা সারাজীবন শুধু চেয়েই এসেছে, তাঁর সন্তান যেন একজন ভালো মানুষ হয়। কিন্তু নিজেরা আসলে সন্তানকে সেই পথ তৈরি করে দেয়নি। একটা সময় অসহায় তাঁরাই হয়। একটা ছোট বাচ্চার ব্রেইন খুব মসৃণ হয়। মসৃণ বলতে খুব পরিষ্কার বুঝাচ্ছি। খেয়াল করে দেখবি ছোট বাচ্চারা যা দেখে, তা খুব সহজেই নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিতে পারে। আগেই বলেছি, মুসলিম হলে এই কাজটা আরও সহজ হয়। অন্য কোনো ধর্মের ব্যাপারে আমি জানি না। বাট আমি নিজের ধর্ম থেকে যেটুকু জেনেছি, তাতে স্পষ্ট যে, আমাদের ধর্মে সকল খারাপ কাজে নিষেধাজ্ঞা আছে। সব খারাপ কাজ আল্লাহ নিজে হারাম করে দিয়েছে। ধর, তোর একটা সন্তান হলো। তুই নিজে একজন খুব ধার্মিক মানুষ। তুই নিশ্চয়ই চাইবি সন্তানকেও তোর মতো বা তোর থেকেও ধার্মিক একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করতে। এরজন্য তোকে প্রথমে কী করতে হবে?

তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
– অবশ্যই তাকে প্রথমে ইসলাম এবং ধর্ম কী, তা বুঝাতে হবে।

তাহমিদ মাথা নেড়ে বলল,
– একদম ঠিক। ইসলাম সম্পর্কে তাকে জানাতে হলে, তোকে অবশ্যই কুরআন-হাদিস এর সাহায্য নিতে হবে। আর কুরআনে, হাদিসে এমন কিছু আছে, যা জানতে পারলে একজন মানুষ খুব সহজেই ঠিক-ভুলের পার্থক্য বুঝতে পারবে। তুই যদি ছোট থেকেই নিজের সন্তানকে এই শিক্ষাগুলো দিতে পারিস, তাহলে সে এগুলো সহজেই নিজের আয়ত্তে নিতে পারবে। আমার বিশ্বাস, এগুলোর মধ্যে দিয়ে যে মানুষ বেড়ে ওঠে, সে সারাজীবন নিজের ভালোমন্দ, নিজে বুঝতে পারে। সমাজের খারাপ মানুষ কিংবা তাঁর নিজস্ব খারাপ সত্তা তাকে কাবু করতে পারবে না। কারণ যে খুব ভালো ভাবেই জানে, তাঁর ধর্মে কোনটাকে ঠিক বলা হয়েছে, আর কোনটাকে ভুল বলা হয়েছে। এবার বল, তোর কী মনে হয় না, একটা মানুষের ভালো-খারাপ হওয়ার পিছনে তাঁর পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি? বাবা-মা অসহায় হয় তখনই, যখন সন্তান তাঁর অবাধ্যতা করে। কোনো মানুষই ছোট বয়সে বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে খারাপ পথে যায় না। কারণ সেই ছোট বয়সে ভালো এবং খারাপ, দুই পথটাই তাঁর অজানা থাকে। বাবা-মা যদি নিজ দায়িত্বে তাঁর সন্তানকে একটা সুস্থ এবং সুন্দর পথ দেখিয়ে দিতো, তাহলে প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ার কোনো সম্ভবনাই ছিল না।

তৃষ্ণা মুগ্ধ হয়ে তাহমিদের কথাগুলো শুনছে। কথাগুলো তাঁর বেশ ভালো লাগছে। আফসোসও হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আগে কেন এভাবে ভাবলাম না? তাঁর মনে আরও একটা খটকা আছে। সে আমতাআমতা করে বলল,
– যাদের বাবা-মা তথা পরিবার নেই, তাঁদের কী হবে? পথশিশুদের কথা বলছি আরকি।

– তাঁদের জন্য আল্লাহ এমন একটা বিবেক দিয়েছেন, যার সাহায্যে সে নিজেই নিজের পথ বেছে নিতে পারবে। কোনো পথশিশু যখন বড় হয়ে একটা মাস্তান তৈরি হয়। তখন সে মাঝে মাঝে আল্লাহকে দোষারোপ করতে শুরু করে। যে কেন তাকে পরিবার দেওয়া হলো না? একটা পরিবার পেলে সে অবশ্যই একটা সুস্থ জীবন পেতো। ভালো মানুষ হতো। অথচ সে এটা ভাবে না, এই যে সে ভালো হওয়ার কথা বলছে, এটা নিজের বিবেক থেকেই। অর্থাৎ, সে যদি চায় ভালো হতে, তাহলে নিজের বিবেকের সাহায্যে ভালো হতে পারবে। পরিবার নেই বলে আফসোস করে সারাজীবন কাঁদলেও লাভ হবে না।

তৃষ্ণা পরম তৃপ্তিতে দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়ল। তাঁর মনের সব খটকা দূর হয়ে গেছে। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট সে। তবে একটা বিভ্রান্তিতে আছে এখনো। কেঁশে আবার বলল,
– ভাইয়া আরও একটা প্রশ্ন আছে আমার।

তাহমিদের মুখটা মলিন হয়ে গেল। এ প্রসঙ্গে অনেক তথ্য সে গতকাল রাতেই পেয়েছিল। তাই উত্তর দিতে পেরেছে। এখন যদি আবার তৃষ্ণা তাকে ভিন্ন কোনো প্রশ্ন করে, তাহলে তাঁর পক্ষে তৃষ্ণাকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব হবে না। তাই আপাতত নিশ্চুপ থাকল।
তৃষ্ণা আবার বলল,
– কী হলো ভাইয়া? প্রশ্নটা কী করব?

তাহমিদ ভীত কণ্ঠে বলল,
– কী প্রশ্ন? আমার কিন্তু ক্ষিধে পেয়েছে।

– ছোট্ট একটা প্রশ্ন। মানে তোমার মতো একটা অদ্ভুত প্রাণী এতসব জানলো কীভাবে? মানে, কালকে তোমাকে প্রশ্ন করার পর তোমার যে অবস্থা হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছে ওইরকম ফাঁদে তুমি খুব কমই পড়েছ। অথচ এক রাতের মধ্যে এতসব জেনে গেছ তুমি। কীভাবে সম্ভব?

তাহমিদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকালো তৃষ্ণার দিকে। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে, জোরে তৃষ্ণার গাল টেনে দিলো। তৃষ্ণা ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। বাইরে থেকে ফাতেমা এসে আতঙ্কিত গলায় তাহমিদকে বলল,
– ওমা, বাচ্চা মেয়েটাকে মারছ কেন? তোমায় ভূতে ধরেছে নাকি?

তাহমিদ রাগী রাগী ভাব করে একবার তৃষ্ণার দিকে, আরেকবার ফাতেমার দিকে তাকালো। এরপর তৃষ্ণার গাল ছেড়ে দিয়ে তোয়ালে হাতে চলে গেল ওয়াশরুমে। তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে গেল। গালে হাত বুলিয়ে দরজার দিকে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে ফাতেমাকে বলল,
– বড় ভাইয়া কী এসছে ভাবী?

– হ্যাঁ। এসেছে তো।

তৃষ্ণা কপট রাগী মুখ করে নিজের মনে বলল,
– দাঁড়াও, এর শোধ আমি নিচ্ছি।

ফাতেমা কিছু বুঝল না। সে আর প্রশ্নও করল না। তৃষ্ণার হাত ধরে বলল,
– এসো আমার সাথে।

তৃষ্ণা গালে হাত বুলাতে বুলাতে চলে গেল ফাতেমার সাথে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে