শেষ_পর্যন্ত পার্ট: ১৯

0
2396

শেষ_পর্যন্ত

পার্ট: ১৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের মৃদু বাতাস উপভোগ করছি। আলিফা দুমগ কফি নিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো, হাসি মুখে এক মগ কফি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
আলিফা: কিছু কথা ছিল
আমি: হাজার হাজার কথা বলো আমি তোমার কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনবো
আলিফা: কথাগুলো শুনার পর এই মুগ্ধতা হয়তো আর থাকবে না
আমি: মানে, কি কথা বলো তো
আলিফা: রাতে তুমি অনেক বার বলেছ তোমাকে ভালোবাসি কিনা অন্তত একবার যেন বলি
আমি: হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু তুমি তো না বলে উল্টো আমার জায়গাটা আবার সোফাতেই করে দিলে
আলিফা: হুম একদিন বলবো সেদিনটা কবে জানো…?
আমি: কবে
আলিফা: যেদিন রাতুল আমার সামনে দাঁড়ানো থাকবে
আমি: মানে
আলিফা: এখন আমরা যেভাবে বন্ধুর মতো আছি সেভাবেই থাকবো, রাতুল ফিরে আসলে পর তোমাদের দুজনকে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে আমি বলবো কাকে ভালোবাসি কার কাছে থাকতে চাই (ওর কথা শুনে তো আমার মাথা ভনভন করছে, কি বলছে এসব)
আমি: তারমানে তুমি সেদিন আমাকে ভালোবাস বলবে না, সেদিন তুমি সিদ্ধান্ত নিবে কাকে ভালোবাস কার কাছে থাকতে চাও
আলিফা: হুম
আমি: তারমানে আমি যে ভাবতাম তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছ এসব কিছু মিথ্যে
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: কথা বলছ না কেন…? উত্তর দাও আমার সব ভাবনা গুলো কি মিথ্যে ছিল।
কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে চলে যেতে চাইলো। ওর হাত ধরে টেনে আমার সামনে এনে দাঁড় করালাম।
আমি: চলে যাচ্ছ কেন, এতোক্ষণ কি বলেছ বুঝতে পেরেছ
আলিফা: হ্যাঁ আপাতত এই সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া আমার কোনো রাস্তা নেই
আমি: ওহ তারমানে রাতুল ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি….
আলিফা: হ্যাঁ আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই।
আমি: ওকে আমার কথাও শুনে যাও, রাতুলকে আমি খুঁজে আনবোই
আলিফা: অযতা খুঁজতে যেও না ও হয়তো এখনো বাহিরে আছে
আমি: তুমি তো সেদিন একবার দেখেছিলে তাই চেষ্টা করে দেখবো, আমাকে তো জানতেই হবে তুমি আমাকে ভালোবাস কিনা আমার এতো ভালোবাসার তিল পরিমাণ মূল্য তোমার কাছে আছে কিনা
আলিফা: যে ফিরে আসার সে এমনিতেই ফিরে আসবে পাগলামি করো না।
আমি: আর যদি কখনোই ফিরে না আসে
আলিফা: আসবে আজ হউক কাল হউক কিংবা কয়েক বছর পর হলেও ফিরে আসবেই।
আলিফা চলে গেলো কিন্তু ও শেষ কথাটা কি বলে গেলো, কথাটা কি রাতুল ফিরে আসার জন্য বলেছে নাকি ও আমার কাছে ফিরে আসার কথা বলেছে। আচ্ছা রাতুল যদি আদৌ ফিরে না আসে তাহলে কি আলিফাও আমাকে ভালোবাসবে না….?

নাশতাটা কোনো রকমে করে তাড়াতাড়ি রুমে আসলাম, তাড়াহুড়ো করে রেডি হচ্ছি সেই শপিংমলে যাবো আমি। আমাকে তো জানতেই হবে আলিফা আমাকে ভালোবাসে কিনা।
আলিফা: রিফাত এতো তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছ অফিসে নাকি
আমি: না
আলিফা: তো কোথায়
আমি: রাতুলকে খুঁজতে
আলিফা: কেন পাগলামি করছ বলতো, রাতুল যদি দেশে না এসে থাকে তাহলে তুমি পাবে কোথায়
আমি: তাও একবার চেষ্টা করে দেখি
আলিফা: না লাগবে না চেষ্টা করা চুপটি করে এখানে বস কোথাও যেতে হবে না
আমি: সরি আমাকে যেতে হবেই
আলিফা: রিফাত শুনো।
আলিফার কোনো কথা না শুনে বেড়িয়ে পড়লাম।

নাহ পেলাম না রাতুলকে। সারা শপিংমল খুঁজলাম, অবশ্য না পাওয়াটাই স্বাভাবিক রাতুল যদি দেশে না এসে থাকে আবার দেশে এসে থাকলেও যে রোজ একি শপিংমলে আসবে এমন তো না। কিন্তু আমাকে যে রাতুলকে খুঁজে পেতেই হবে। উফফফ কোথায় গেলে, কোথায় খুঁজলে পাবো রাতুলকে, আমি যে আর পারছি না।

বাসায় ফিরে আসলাম। আমি মনে হয় রাতুলকে খুঁজে পাবো না আর ওকে খুঁজে না পেলে তো….
আলিফা: এই তোমার বাসায় ফেরার সময় হয়েছে (আলিফা চিন্তিত হয়ে খাটে বসে আছে। কখন যে রুমে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। আসলে এসব যন্ত্রণায় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি)
আলিফা: কথা বলছ না কেন সারাদিন কোথায় ছিলে
আমি: রাতুলকে খুঁজছিলাম
আলিফা: রিফাত কেন পাগলামি করছ
আমি: আমার এগুলো যখন তোমার পাগলামি মনে হচ্ছে তাহলে বলে দিচ্ছ না কেন তুমি আমাকে ভালোবাস
আলিফা: রিফাত আস্তে, চিৎকার করছ কেন
আমি: তো কি করবো। আমি আর পারছি না আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি
আলিফা: রিফাত।

আলিফার সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তাই সোফায় এসে শুয়ে পড়লাম।
আলিফা: এই সন্ধ্যা বেলায় শুয়ে পড়েছ কেন
আমি: যাও তো আমাকে একা থাকতে দাও
আলিফা: পারবো না
আমি: উফফফ যাবা তুমি
আলিফা: বললাম তো যাবো না (আমার পাশে এসে বসে পড়লো)
আমি: ওকে তুমি বসে থাকো আমি ঘুমাই।
চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। মনে হচ্ছে আলিফা আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ মেলে তাকালাম। যা ভেবেছিলাম তাই, আলিফা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি: কি দেখছ
আলিফা: কিছু না।
আলিফা তাড়াতাড়ি চলে গেলো। হয়তো লজ্জা পেয়েছে নয়তো ভালোবাসে যে এইটা বুঝতে দিতে চাইছে না।

এখন প্রতিদিন একবার হলেও রাতুলকে খুঁজতে যাওয়া আমার রুটিন হয়ে গেছে। জানিনা কিসের জন্য এভাবে ওকে খুঁজি। অনেক সময় ভাবি আর খুঁজবো না কিন্তু আলিফা আমাকে ভালোবাসে কিনা জানার জন্য আবার পাগলের মতো খুঁজতে যাই। ভালোবাসা বুঝি এমনি হয়, ওর মুখে একবার ভালোবাসে কিনা শোনার জন্য পাগলের মতো রোজ রাতুলকে খুঁজতে যাই। রাতুলকে কি আদৌ খুঁজে পাবো আমি…? যদি রাতুলকে খুঁজে পাই তাহলে কি আলিফা আমাকে ভালোবাসে বলবে নাকি ওর রাতুলের কাছে ফিরে যাবে….?

কয়েক মাস পর….

বারান্দায় দাঁড়িয়ে আনমনে হয়ে ভাবছি, এতোগুলো মাস এতোগুলো দিন এতো সময় পার হয়ে গেলো কিন্তু আলিফা আজো আমাকে এতটুকু ভালোবাসতে পারলো না। আর আমি কিনা ওকে পাগলের মতো ভালোবাসি। আলিফা একদিন বলেছিল রাতুলকে সামনে রেখে ও বলবে কাকে ভালোবাসে, সেই থেকে প্রতিটা দিন আমি রাতুলকে খুঁজেছি। কিন্তু এতোগুলো মাস কেটে গেলো আমি রাতুলকে খুঁজে পাই নি। আর আলিফা ও তো যেমন ছিল তেমনি আছে, একবার ভাবেও না আমি যে কষ্ট পাচ্ছি। অবশ্য আমার কষ্টতে ওর কি আসে যায়, ও তো আর আমাকে ভালোবাসে না। তবে হ্যাঁ অনেক দিন আলিফার ইচ্ছেতে চলেছি আর না, এবার আমার কথায় সব হবে আমার কথায় আলিফা চলবে। অনেক হয়েছে আর না এভাবে তো চলতে পারে না। আলিফা নিজেও দুই নৌকায় পা দিয়ে চলছে অন্যদিকে আমাকেও দুটানায় পিষে মারছে। আমি জাস্ট এসব আর নিতে পারছি না, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।
আলিফা: রিফাত এই সন্ধ্যা বেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ কেন
আমি: এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে তাই
আলিফা: রিফাত তুমি কাঁদছ কেন
আমি: আমার কান্না তোমার চোখে পড়ে (ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ও নিশ্চুপ হয়ে আছে)
আমি: আলিফা একটা সুস্থ মানুষকে কখনো পাগল হতে দেখেছ
আলিফা: না কেন
আমি: দেখেছ কিন্তু বুঝতে পারছ না, তোমার চোখের সামনে আমি একটু একটু করে পাগল হয়ে যাচ্ছি আর তুমি সেটা দেখতে পারছ না
আলিফা: কি বলছ এসব
আমি: আলিফা এসব আর আমি নিতে পারছি না আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি প্লিজ আমাকে মুক্তি দাও এসব থেকে
আলিফা: মুক্তি
আমি: হ্যাঁ আমি তোমার মতামত না নিয়ে বিয়ে করে ভুল করেছি মানছি তাই বলে একটা ভুলের শাস্তি এভাবে পেতে হবে। প্রায় একটা বছর কেটে গেছে তুমি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না। কেন আলিফা কেন বলতে পারো আমাকে মেনে নিতে তোমার আপত্তি কোথায়
আলিফা: (নিশ্চুপ)
আমি: তুমি চুপ হয়েই থাকো, তোমাকে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে না। এবার আমি সিদ্ধান্ত নিবো আর তুমি আমার সব সিদ্ধান্ত মেনে নিবে
আলিফা: মানে
আমি: প্রথম আমি তোমাকে সাত মাস সময় দিয়েছিলাম তুমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারোনি। তারপর তোমার আব্বু মারা গেলেন সাথে রাতুলের ফোন বন্ধ। দুজন প্রিয় মানুষকে হারিয়ে তুমি ভেঙে পড়েছিলে তাই আমি তোমাকে জোর করিনি। মাঝে তুমি বলেছিলে রাতুল ফিরে আসলে দুজনকে তোমার সামনে দাঁড় করিয়ে বলবে তুমি কাকে ভালোবাস কার কাছে থাকতে চাও। আমি মেনে নিয়েছিলাম, মেনে নিয়ে আমি এই কয়টা মাস রাতুলকে পাগলের মতো খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। যার ফোন আজ প্রায় চার পাঁচ মাস ধরে বন্ধ সে আদৌ ফিরে আসবে কিনা বলতে পারো।
আলিফা: আমার কথা শু….
আমি: কি বলবে জানি, রাতুল ফিরে আসবে তাই তো। কিন্তু কখন আসবে বলতে পারো
আলিফা: আমাকে বলতে তো দাও
আমি: তোমার আর কিছু বলতে হবে না। এখন থেকে আমি যা বলব তাই হবে
আলিফা: যা বলবে তাই হবে মানে
আমি: আলিফা অবহেলা কি জানো
আলিফা: হঠাৎ এই প্রশ্ন
আমি: আমি কাকে কি প্রশ্ন করি, যে আমাকে প্রায় একটা বছর ধরে অবহেলা করে আসছে তাকে আমি জিজ্ঞেস করি অবহেলা কি চিনে কিনা। সত্যি আমি একটা বোকা।
আলিফা: আমি কখন তোমাকে অবহেলা করলাম
আমি: করেছ আলিফা করেছ, তুমি আমাকে দিনের পর দিন অবহেলা করেছ আর আমি সহ্য করে গেছি, কেন জানো…? শুধু তোমাকে ভালোবাসি বলে তুমি একদিন আমাকে ভালোবাসবে এই আশায়। কিন্তু এবার থেকে তুমি নয় আমি তোমাকে অবহেলা করবো
আলিফা: মানে কি
আমি: হ্যাঁ আমি তোমাকে অবহেলা করবো
আলিফা: পারবে অবহেলা করতে
আমি: একটা কথা মনে রেখো, যে ভালোবাসতে জানে সে প্রয়োজন হলে ঘৃণাও করতে পারে আর আমি তো প্রয়োজন হলে তোমাকে ডিভোর্সও দিবো
আলিফা: রিফাত
আমি: এভাবে তো চলতে পারে না তাই না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাকে আমি ডিভোর্স দিবো। তাতে তুমি তোমার মতো থাকতে পারবে আর আমি আমার মতো।
আলিফা: পারবে
আমি: পারতে তো আমাকে হবেই। তুমি শুধু ভেবে নাও এক সপ্তাহ পর কোথায় যাবে
আলিফা: এক সপ্তাহ পর মানে
আমি: এক সপ্তাহ পর আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো। আর এই এক সপ্তাহ আমি দেখবো বুঝতে চেষ্টা করবো তুমি আমাকে ভালোবাস কিনা
আলিফা: ঠিক যখন করেই নিয়েছ এক সপ্তাহ পর ডিভোর্স দিবে তাহলে আজই চলে যাওয়া ভালো। আমি চলে যাচ্ছি ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিবো ভয় নেই।
আলিফা রুমে চলে গেলো।

রাতের আকাশ দেখছি আর ভাবছি ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন। যাকে আমি ভালোবাসি সে আমাকে ভালোবাসে না আর যে আমাকে ভালোবাসত সে আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। হঠাৎ আলিফার কথা মনে পড়লো সত্যিই চলে যাবে নাকি ও। তাড়াতাড়ি রুমে আসলাম।
এসে দেখি আলিফা কাপড় গুচাচ্ছে। ওর হাত ধরে টান দিয়ে আমার দিকে ফিরালাম।
আলিফা: রিফাত হাত ছাড়ো লাগছে আমার
আমি: কোথায় যাচ্ছ
আলিফা: সেটা তো জানিনা তবে যে আমাকে এক সপ্তাহ পর ডিভোর্স দিয়ে দিবে ভেবে নিয়েছে তার বাসায় আর থাকবো না
আমি: আমার বাসায় তো তোমাকে থাকতে হবেই
আলিফা: কেন থাকবো, এক সপ্তাহ পর ডিভোর্স পেপার সহ যেন আমাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারো সেজন্য (ওকে ঠেলে দেয়ালের কাছে নিলাম, দেয়ালে হেলান দিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ওর একদম কাছে গিয়ে বললাম)
“আমার বাড়িতে তোমাকে থাকতে হবে কারণ তুমি আমাকে এতোদিন যতো অবহেলা করেছ সব তোমাকে ফেরত দিবো, কষ্ট দিবো তোমাকে আমাকে যতোটা কষ্ট দিয়েছ। আজ থেকে অবহেলা শুরু এইটা ভালো করে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে নাও”

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে