যোজন – বিয়োজন পর্ব:০২

0
2624

যোজন – বিয়োজন পর্ব:০২
লেখা: মিশু মনি
.
স্বর্ণ অবাক হওয়ার ভঙ্গী তে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি হাসি চেপে রাখতে পারছি না।হাসতে হাসতেই বললাম,স্বর্ণ তুমি কি আমাকে খুন করবা?
স্বর্ণের চোখে মুখে রাজ্যের বিস্ময়! অবাক হয়ে বলল,
– খুন করবো! কি বলছো এসব? আমি কেন তোমাকে খুন করতে যাবো?
– বয়স্ক মহিলা বলে।যদি খুন করে ফেলো!
– মিশুপু তুমি কি আমার সাথে রসিকতা করছো? এরকম রসিকতা করবে না।কারণ আমি কিন্তু তোমার চেয়েও রসিক।পরে সমস্যা হবে।
আমি হেসে বললাম,বাহ বাহ! দারুণ দারুণ!! কেয়া বাত হ্যায়!
বলেই আবারো অট্টহাসি শুরু করে দিলাম।আমার কখনো এমন হয়না।আজ হঠাৎ এত হাসি আসছে কেন বুঝতে পারছি না।
.
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। স্বর্ণ ই প্রথমে কথা বলল,
– আপু,একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– আমি তোমার ওয়াইফ। সো,ডোন্ট কল মি আপু।ওকে?
– তুমি তো আমার সিনিয়র।
– সো হোয়াট? বাংলার প্রতিটা ঘরেই স্বামীরা স্ত্রীর চেয়ে সিনিয়র। তাই বলে কি বউরা তাদের স্বামীকে ভাইজান বলে ডাকে?
স্বর্ণ কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে।তারপর ফিক করে হেসে ফেললো।
আমি বললাম,নিজের বউয়ের সাথে যেভাবে মিশতে,আমার সাথেও সেভাবে ই মিশতে পারো।আমি তো একটা মেয়ে তাইনা? বয়স কোনো ফ্যাক্ট না।
– হুম।আমারো বড়াপুদের প্রতি দূর্বলতা আছে।
– ইহাহা ইহাহা..
আমি প্রাণ খুলে দাত ফাটানো হাসি দিচ্ছি।আমার পিচ্চি বরটা রসিক বটে!!
স্বর্ণ চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমার হাসি দেখছে নিশ্চয় ই! আমিও রসিকতা করে বললাম,আমার হাসি দেখছো? দ্যাখো দ্যাখো। আমি হাসলে আমাকে নুসরাত ফারিয়ার মত লাগে!
– ওহ নো।নুসরাত ফারিয়াকে আমি জাস্ট সহ্য করতে পারিনা।
– কেন কেন?
– ওর ঠোট একদম অসহ্যকর।আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে,কি দেখলে তোমার বমি আসে? আমি বলবো, নুসরাত ফারিয়ার ঠোট।
স্বর্ণের কথায় আবারো দাত ফাটানো হাসি দিলাম। ছেলেটা তো আমার চেয়েও রসিক!
বললাম,তুমি দেখেছো?
– কি?
– নুসরাত ফারিয়ার ঠোট, দেখেছো?
– শুধু দেখা না।একেবারে জুম করে দেখেছি!
– হা হা হা.. ও হো হো হো..
স্বর্ণ ফিসফিস করে বলল,তোমার হাসিটা সুন্দর!
আমি চমকে উঠলাম কথাটা শুনে।যেন বিদ্যুৎ শক খেলে গেলো মাথার ভিতর দিয়ে।আমার পিচ্চি বর আমার প্রেমে পড়েছে রে! হাসতে গিয়েও হাসলাম না।লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলাম।
স্বর্ণ চুক চুক করে বলল,ইস কি লজ্জা! ডাক্তারদের আবার লজ্জাও থাকে নাকি? জানতাম না তো।
– ডাক্তারদের লজ্জা থাকেনা? তাহলে তারা পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়ায় কেন?
আরেক দফা হেসে উঠলাম দুজনে।যাক,অবশেষে আড্ডা দেয়ার জন্য একজন বন্ধু পাওয়া গেলো!
.
স্বর্ণ একনাগাড়ে অনেক গুলো চকোলেট খেয়ে ফেললো।
তারপর বলল,রাত কত হলো?
– হবে হয়ত সাড়ে ১২ টা।
– ঘুমাবে না?
আমি হেসে বললাম,নাহ।আজ আড্ডা ই চলুক?
– ওকে,নিজের ব্যাপারে শেয়ার করা যাক।
– তুমি শুরু করো।
– আমি না,তুমি।
– আমিনা কে?
– আমিনা আমার এক্স গার্ল ফ্রেন্ড।
– গার্ল ফ্রেন্ড আবার এক্স ওয়াই জেড হয় নাকি? জানতাম না তোহ!
বলেই হেসে উঠলাম। ওরে বাবাহ! আজ এত হাসি কোথায় পেলাম কে জানে!


.
স্বর্ণ হঠাৎ বলল,আচ্ছা তুমি কি আমাকে লোভী ভাবছো? টাকার জন্য তোমাকে বিয়ে করলাম বলে?
আমি বিস্ময় কাটিয়ে বললাম,এটা কখনো ই ভাবিনি।তুমি এখন আমার হাসব্যান্ড।টাকার কথা তুলছো কেন?
– যা সত্যি তাকে তো এড়ানো যাবে না।এটা ই তো সত্যি যে,তোমার টাকার কাছেই নিজেকে বলি দিলাম আমি আর আমার পরিবার।এটা খারাপ লাগলেও সত্যি।কিন্তু বিশ্বাস করো,আমার আর কিছুই করার ছিল না।তোমাকে বিয়ে করলে সবাই খুশি হবে বলে বাধ্য হয়েই বিয়েটা করলাম। কিন্তু তোমার টাকার প্রতি আমার লোভ নেই।আমি আমার ক্যারিয়ারের জন্য যেকোনো কিছু করতে রাজি,কিন্তু বিয়ে নয়।তবুও বাবার ইচ্ছার জন্য বিয়ে করলাম।আমাকে মেরুদণ্ড হীন ভেবোনা প্লিজ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। স্বর্ণের মাথা ঠিক আছে তো? এসব কথা কেন তুলছে ও? শীতল গলায় বললাম,আমাকে কতটা জানো স্বর্ণ?
স্বর্ণ নিশ্চুপ।
বললাম,স্বর্ণ আমার অতীত টা খুব বেদনাদায়ক।অনেক কষ্টে বড় হয়েছি আমি।সাধে কি এত বয়স অব্দি আনম্যারেড ছিলাম? প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যত দিন নিজের লক্ষ্যে পৌছাবো না,তত দিন বিয়ের নাম মুখে আনবো না।আমার লাইফ এ অনেক লং স্ট্রাগল করেছি স্বর্ণ।অনেক কষ্ট করেছি।
স্বর্ণ এগিয়ে এসে বলল,বলো।শুনবো সব।
– জানো,আমি নিজে ইনকাম করে পড়ার খরচ জোগায়েছি।আমার বাবা নেই।আমি জানি অভাবের ভয়াবহতা। মেডিকেল পাশ করার আগ থেকেই আমি বহুদূর হেটে হেটে পেশেন্ট দেখে আসতাম।খুব সামান্য পয়সা নিতাম আর ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতাম। এভাবে আমার অনেক পেশেন্ট হয়ে গেলো।ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েই আমি ছোট একটা রুম ভাড়া নিয়ে চেম্বার খুলে বসি।আমার পরিচিত সকলেই সেখানে আসত।তারপর ৩ টা রুম ভাড়া নিই।সেখানে ই অপারেশন করাতাম। নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সকলেই আমার কাছে আসত।আবার যারা হসপিটালে সিজার করাতে গিয়ে টাকা দিতে পারবে না,তারা ও আমার কাছে আসতো। এভাবে দেখতে দেখতে এক বছরের মধ্যেই অনেক টাকা করে ফেললাম।তারপর ক্লিনিক দিলাম। ডিসপেনসারি দিলাম।বাড়ি,গাড়ি সব করে ফেললাম।এখন বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় একদিনের জন্য বসলেই, ১ লাখ টাকা ইনকাম করার সৌভাগ্য হয়ে গেছে আমার।সৌভাগ্যকে নিজের হাতে তৈরী করতে হয় স্বর্ণ।ইন্টারে পড়ার সময় অনেক বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল।তখন বিয়ে করে ফেললে আজ এতদূর পৌছাতে পারতাম না।
স্বর্ণ অবাক হয়ে বলল,তোমাকে স্যালুট জানাই হে নারী!
আমি চুপ থেকে বললাম,তোমার আর ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা নাই।একজন নামকরা ডাক্তার কে বিয়ে করে ফেলা মানেই ক্যারিয়ার ওকে।তুমি এখন আরামসে বসে খাবা আর আমার সেবা করবা।
– হুহ,আমি তো তোমার গোলাম।
– স্বর্ণ,আমাকে রাগাবা না।
– তুমি ক্যারিয়ারের জন্য বিয়ে করোনি,আর আমি ক্যারিয়ারের জন্য বিয়ে করলাম। আমি তো কাপুরুষ, আর তুমি নন্দিত নন্দিনী! আমার তো তোমার গোলাম হয়েই থাকা উচিৎ।
– স্বর্ণ,রেগে যাচ্ছি কিন্তু।ফাজলামির ছলে নিজেকে ছোট করবা না।
স্বর্ণ চেঁচিয়ে বলল,
– তাহলে কি করবো? আমি মেরুদণ্ড হীন কাপুরুষ, টাকার জন্য বিয়ে করছি তোমাকে। এটা ই তো সত্যি তাইনা?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে স্বর্ণের কলার টেনে ধরে বললাম,ভালোবাসতে পারবা না আমায়? সিনিয়র বলে কি ভালোবাসা যাবেনা? যোগ্যতা নিয়ে আর কিছু বলবা না।এখন আমরা স্বামী স্ত্রী, এটাই সবচেয়ে বড় সত্য।নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসবা,ব্যস।বেশি বেশি বুঝলে খুন করে ফেলবো একদম!
.
এরপর দুজনেই চুপ! ঘটনার আকস্মিকতায় একটু বেশিই মুগ্ধ আর স্তব্ধ হয়েছে স্বর্ণ! আমি নিজেও অবাক নিজের আচরণে।ওর কলার ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সংযত করলাম।
.
মিনিট পাচেক কেউ কোনো কথা বললাম না।
স্বর্ণ এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বলল,আচ্ছা সরি।কিন্তু মাঝেমাঝে রাগাবো তোমাকে।তুমি রেগে গেলে এমন ভয়ংকর সুন্দর রূপ টা দেখতে পারবো!
– তাই না?
– হুম।তুমি একটা জিনিস বটে! আমিতো ভাবছিলাম বুড়ি মহিলাকে বিয়ে করছি,নিন্তাত নির্জীব মহিলা।কিন্তু এ তো দেখছি, একেবারে বারুদ!
আমি স্বর্ণের কান টেনে ধরে বললাম,শয়তান। খুব পাজি দেখছি!
– ডাক্তার বলে কথা!
– হুম।
.
ঘড়িতে এলার্ম বাজলো। তারমানে ১ টা বেজে গেছে।আমি স্বর্ণকে বললাম,এখন আমার ঘুমানোর সময়।ঘুমাতে যাবো?
– না।তুমি ঘুমালে আমি তোমাকে খুন করে ফেলবো।
– হা হা হা,
শব্দ করে হাসছি আমি।স্বর্ণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে