ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি পর্ব-০৫(শেষ পর্ব)

0
1101

#ভয়ঙ্কর সেই মেয়েটি
৫ম এবং শেষ পর্ব
লেখা: #Masud_Rana

কুয়োর কতটা গভীরে চলে এসেছেন তিনি বুঝতে পারছেন না। বিস্মিত দৃষ্টিতে নিজের সামনে ভেসে ওঠা নতুন দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন । অবাক হয়ে গেলেন ওগুলোর ভেতর থেকে ভেসে আসা অনেকগুলো স্বরের গুঞ্জন শুনে। চেচাতে চেচাতে একদল লোক একটা বৃদ্ধা মহিলাকে নিয়ে আসছেন এই কুয়োর কাছাকাছি। বৃদ্ধা চিৎকার করে করে লোকগুলোকে অভিশাপ দিচ্ছে। লোকগুলোও ক্ষেপে আছে মহিলার উপরে। চিৎকার করে একজন বলে উঠল, ‘বুড়ি, ডাইনি! পিশাচ! তোর ধড় থেকে মাথা আমি আলাদা করে দেব!’ এতে দা ছিল তার আগে থেকেই। ওটা নিয়ে তেড়ে গেল বৃদ্ধার দিকে।

আশেপাশের লোকগুলো দ্রুত ছুটে গিয়ে লোকটাকে বাধা দিয়ে দা টা ছিনিয়ে নিল। আরেকজন কর্তা শ্রেণীর লোক গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘এত উতলা হয়ো না! রাগ আমাদের সকলেরই আছে! উচিত বিচারই হবে আজ! আর কেউ পাগলামি করবে না!’

বুড়ি দাঁত কটমট করতে করতে লোকগুলোর দিকে তাকালো। চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আমি তোদের সবাইকে খেয়ে ফেলবো! এই দেখ আমার দাঁত! এটা দিয়ে কামড়ে কুঁচিকুঁচি করে ছিড়ে খাব তোদের।’ ভয়ানক লাল দেখাচ্ছে বুড়ির দাঁত। ভালো করে তাকাতেই বোঝা গেল বুড়ির শুধু দাঁত নয়, পুরো মুখটাই রক্তে মেখে রয়েছে। একদম কুয়োর কাছে এনে একটা পিলারের সাথে শক্ত করে বাধা হলো বৃদ্ধাকে। হিসহিস শব্দ করে কামড়াতে চাচ্ছে আশেপাশে যাকে দেখছে তাকেই।

দৃশ্যটা কখনকার সময়ের তা বোঝা যাচ্ছে না এখনো। একজন লোক এগিয়ে এলো বৃদ্ধার কাছে। গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই কুয়োর ভেতর কী চলছে বল! তুই কতজন মানুষকে এই পর্যন্ত খুন করেছিস! বল, তুই!’

বৃদ্ধা এবার খিলখিল করে হাসতে লাগলো। লোকটা রেগে গিয়ে একটা লাথি বসিয়ে দিল বৃদ্ধার বুকে। গুঙিয়ে উঠল সে, ক্রোধে ভরে তাকালো লোকটার দিকে। মুখ ভরে উঠল হিংস্রতায়, বেরিয়ে এলো ফেসফ্যাসে কণ্ঠ বৃদ্ধার গলা দিয়ে, ‘আমি এতগুলো মানুষ মেরেছি তোদের যে তোরা গুণে শেষ করতে পারবি না। কুয়োর ভেতর নেমেই দেখ বিশ্বাস না হলে! আমি কুটনী বুড়ি, না! আমাকে তোরা গ্রাম থেকে তাড়িয়ে না দিলে এসব কিছুই ঘটতো না।’

‘তোকে কী আর সাধে তাড়িয়েছিলাম আমরা! তোর দুই ছেলে এক মেয়ে কেউই তোর দায়িত্ব নিতে চায়নি কূটনামির জন্য।’

লোকগুলোর মধ্যে থাকা কর্তা মতো লোকটা বলল, ‘এই বৃদ্ধা সম্পর্কে সমস্ত কথা খুলে বলো দেখি তুমি। শাস্তি হওয়ার আগে সবাই এই বুড়ির কর্মের কথা আরেকবার শুনুক, যাতে আমরা একে যেই শাস্তি দেব তা যে অন্যায় নয় সকলেই অনুধাবন করতে পারে।’

লোকটা বলা শুরু করলো, এই বৃদ্ধার নাম ফুলরেখা বাণু। তার অল্প বয়স থেকেই অন্যের সংসারে অশান্তি লাগানোর অভ্যাসের কারণে গ্রামের অনেক মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা তাকে দুচোখে দেখতে পেত না। একজনের ঘরে যেয়ে আরেকজনের বদনাম করে বেড়াত। স্বামী বা স্ত্রীর নামে মিথ্যা কুৎসা রটাতো। ফুলরেখার বিয়ে হয়েছিল একজন হয়রা গোছের নেশাখোর লোকের সাথে। যে কিনা অধিকাংশ সময় তাকে একা সংসারে ফেলে রেখে দূর দূর গ্রামে ঘুরে বেড়াত। নিজের সংসারে শান্তি ছিল না বলে কোনো সুখী স্বামী-স্ত্রীকে দেখতে পারতো না সে। এমনও হয়েছে মন্দ কথায়, কু-কথায় কারো সংসারে ভাঙন ধরছে না তখন সে কালো জাদুর আশ্রয় নিত। মানুষকে বাণ মারতো। নিজেও ওসব চর্চা করতো। লোক মুখে শোনা যায় ফুলরেখার পিতা নাকি কালো জাদুর তান্ত্রিক ছিল। তার কাছ থেকেই সে অনেক কিছু শিখেছিল।

এগুলো অবশ্য অনেক পড়ে গ্রামের লোকেরা জানতে পারে। ফুলরেখার বয়স যত বাড়তে থাকে তত গ্রামের পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করতে সে পটু হয়ে উঠে। কখনো দেবর-ভাবীর অবৈধ সম্পর্ক সম্পর্কে ইঙ্গিত করে সে। কখনো কোনো পুরুষ সম্পর্কে বলতো তাকে সে অন্য নারীর ঘর থেকে বের হতে দেখেছে। গ্রামে একজন মহিলা একটা কথা কোনো মতে শুনতে পেলে তা পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়তো। স্বামী-স্ত্রীর পরস্পর সন্দেহ বাতিক তো ছিলই। এভাবে পুরো গ্রামেই ঝগড়া-ঝাটি লাগানোর ওস্তাদ ছিল সে।

ভবঘুরে স্বামীর উপর জমা রাগগুলো ঢালতো নিজের ২ ছেলে এবং এক মেয়ের উপর। সারাক্ষণ তাদের বকাবাজি আর মারধর করতো। প্রতিবেশীরা মায়া অনুভব করে মাঝেমধ্যেই ছোট ছেলে-মেয়েগুলোকে নিজেদের বাড়িতে রেখে দিত। কারো প্রতি ভালোবাসা, মায়া, টান না থাকা তাকে আরও নিষ্ঠুর করে দিল।

একসময় স্বামী মারা গেল। সন্তানেরা বিয়ে করলো। কিন্তু ফুলরেখার মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কুটনামি, জাদু-টোনা করার অভ্যাসটা গেল না। এমনকি নিজের আপন মেয়ে এবং ছেলেদের সংসারেও ঝামেলা সৃষ্টি করতে লাগলো সে। গ্রামের সব মানুষ এতদিন ফুল রেখার সম্পর্কে সমস্ত কিছু জেনে ফেলেছে। সেই যে নারী-পুরুষ সম্পর্কিত নানা কুৎসা রটানোর কারিগর তা জেনে সকলেই তার প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠলো। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল বুড়িকে নির্বাসিত করবে। এরপর থেকেই জঙ্গলের পাশের এই জায়গাটিতে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সন্তানেরাও বাধা দেয়নি কোনো। মাঝেমধ্যে অনেকেই তার খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ে ছিল শুধু।

এরপর কয়েক মাস কেটে যায়। গ্রামে সর্বপ্রথম নিখোঁজ হয় বুড়ির নাতি, এরপর আরও ৪টি বাচ্চা মেয়ে। কোনো হদিস পাওয়া যায় না তাদের। একজন অভিযোগ করে একটা বৃদ্ধা মহিলাকে সে সমস্ত শরীর মুখ কাপড়ে ঢেকে মাঝেমধ্যে গ্রামে ঘুরঘুর করতে দেখে। বুড়ির বর্ণনা শুনে অনেকের মনেই সন্দেহ জাগে ফুলরেখা বাণুর উপর। নিষ্ঠুর ওই মহিলার পক্ষে কিছুই সম্ভব না। তাকে যেখানে নির্বাসিত করা হয়েছে সেখানে নজর রাখার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

গ্রামে নিখোঁজ হলো ৬ষ্ঠ বাচ্চাটি। গ্রামের কিছু লোক নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে হানা দেয় ঘন জঙ্গলের পাশে বুড়ির নির্বাসিত হওয়ার পরের খড়-ছনের আবাসে। ঘরে ঢুকেই তারা দেখতে পান সেই বাচ্চা মেয়েটির থেঁতলানো শরীর। গলা থেকে পৃথক হয়ে ঘরের এক কোণে পরে রয়েছে বাচ্চাটির মাথা। কিছু দিয়ে আঘাত করে ওটার মাথা ফাটিয়ে ঘিলু বের করে নিয়েছিল বুড়ি আগেই। বুড়ির জামা আর মুখ ভর্তি হয়েছিল রক্তে।

কারো বুঝতে বাকি রইলো না আগের ৫টি বাচ্চা মেয়ে কী করে নিখোঁজ হলো। বুড়িকে চেপে ধরলো লোকগুলো। জানতে চাইলো বাকি বাচ্চাগুলো কোথায়! অনেক আঘাত সহ্য করার পর কুয়োর কথাটি বলল সে। বলল, মগজগুলো খেয়ে লাশগুলো ওখানে ফেলেছে সে।

কুয়োটা দেখে সকলেই বিস্মিত হলো। জায়গাটি তাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে না হওয়ায় কারোই অপরিচিত ছিল না। এখানে কখনই কোনো কুয়ো ছিল না। ভালো করেই জানে সবাই। তাও আবার এত গভীর কুয়ো যার তল দুপুর সূর্যের আলোতেও দেখা যায় না!

এরপরই বৃদ্ধাকে লোকগুলো ধরে এনে কুয়োর সাথে থাকা একটা খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলে।

দৃশ্য আর শব্দগুলো এতই স্পষ্ট লাগছে প্রফেসরের কাছে যে মনে হচ্ছে সবকিছু তার সামনে ঘটছে। সে অদৃশ্য কোনো মানুষ, তাই লোকগুলো তাকে দেখতে পাচ্ছে না। দেখতে দেখতে হঠাৎ বৃদ্ধার শরীর মুচড়াতে লাগলো। তার হাতের বাধন আপনা-আপনি খুলে গেল। সব লোকজন বিস্মিত হয়ে দেখল বুড়ির পুরো শরীর কালো রূপ ধারণ করল। মুখ ঢেকে ফেলল গাঢ় একটা ছায়া, অদৃশ্য হয়ে গেল চোখ, কান,নাক,মুখ। চুলগুলো উপরে উঠে শূন্যে ভাসছে যেন। পা ভরে আছে অনেক গুলো সুতোর কুণ্ডলী, হাত থেকে কিলবিল করে নড়ছে ফিতার মতো চ্যাপ্টা অনেকগুলো কালো কুৎসিত বস্তু। সকলে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল।

উঠে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা একটা হাত বাড়িয়ে দিল কর্তা গোছের লোকটার ঘাড়ের পেছনে। লোকটা কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে চারদিকে তাকালো। এরপরই ছুটে ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়োর ভেতরে। বাকি যারা ছিল ভয়ে চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাতে লাগলো। এবার ছায়া অবয়বটাও ঝাঁপিয়ে পড়লো কুয়োয়।

নিজের পাশ দিয়েই বলিষ্ঠ লোকটাকে নীচে নেমে যেতে দেখলেন প্রফেসর। যেন এই মুহূর্তে কুয়োর উপর থেকে লাফিয়ে নেমেছে লোকটা। এরপরই সেই ছায়া অবয়বটা তার পাশে এসে পড়লো। কিন্তু ওটা বাকি দেহগুলোর মতো নীচে নেমে গেল না। উল্টো তার পাশে স্থির হয়ে তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো। পুরো শরীর যেন তার ঠাণ্ডায় জমে গেল। অবয়বটার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো তার কব্জি। আবার চারপাশে অন্ধকার হয়ে এলো সব। আরো নীচে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। গভীর থেকে গভীরে।

কতটা সময় শক্ত হাতটা তাকে চেপে ধরে আছে, কতটা সময় ধরে সে নিচে পড়ছে হিসাব করতে পারলেন না প্রফেসর। কিন্তু এক সময় তার পতনের সমাপ্তি ঘটলো, কব্জি চেপে ধরে রাখা হাতটা সরে গেল কোথাও। অবাক হয়ে তিনি বুঝতে পারলেন তিনি আর শূন্যে ভেসে নেই। তার পা স্পর্শ করেছে শক্ত মাটি। অবশেষে কুয়োটার তলায় পৌঁছেছেন তিনি! চারদিকে সেই লালচে আলোর আভা ফুটতে শুরু করলো। নড়তে গিয়ে প্রফেসর অনুভব করলেন শক্ত মাটিতে তার পা থাকলেও তা শুকনো মাটি নয়। হাটু সমান পানির ভেতর দাড়িয়ে রয়েছেন তিনি।

আলোর ঘনত্ব বাড়লে তিনি পানির দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কুচকুচে কালো পানি। চারপাশে কাউকে দেখতে পেলেন না। কিছুটা দূরে উঁচু শুকনো একটা জায়গা দেখে পানি ঠেলে অনেক কষ্টে এগিয়ে চললেন তিনি সামনের দিকে। উঁচু জায়গাটিতে উঠেই চারপাশে তাকালেন। মনে হলো কিছুটা দূরে যেন একটা বাচ্চা মেয়ের শরীর পরে রয়েছে। ওটার কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি। বৃষ্টি ঘুমিয়ে রয়েছে এখানে! তবে মেয়েটার মুখ এতটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে কেন!

হঠাৎ পেছনে পানি দিয়ে কারো হেটে আসার আওয়াজ পেলেন। অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন একজন বৃদ্ধা উঠে এলো নোংরা কুচকুচে পানি থেকে। বৃদ্ধাকে দেখে তিনি চিনতে পারলেন এই সেই বৃদ্ধা ফুলরেখা। তার দিকে এগিয়ে আসছে বৃদ্ধা। কিন্তু তার চেহারায় কোনো হিংস্রতা নেই। মুহূর্তেই বৃদ্ধার চেহারা বদলে রূপ নিল সেই ছায়া অবয়বটার। পা অসাড় হয়ে এলো প্রফেসরের। বসে পড়লেন ঘুমন্ত বৃষ্টির পাশে। পরমুহূর্তেই সেই ছায়া অবয়বটার চেহারা বদলে রূপ নিল ৭ বছর বয়সী একটি বাচ্চা মেয়ের।

তার কাছাকাছি এখন দুজন বৃষ্টি। একজন তার পাশে শুয়ে আছে আরেকজন তার সামনে। দুজনের চেহারা হুবহু এক। কিন্তু সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে যে বহুরূপী তা বুঝতে দেরি হলো না তার। তিনি কণ্ঠে আতংক নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে তুমি? এসব কেন হচ্ছে? কী চাও তুমি?’

প্রফেসর ভেবেছিলেন বৃষ্টির মুখ থেকে ক্রুর হাসি বেরিয়ে আসবে। কিন্তু না, তাকে বেশ শান্ত , ক্লান্ত আর বিষণ্ণ লাগছে। বৃষ্টিও মেঝেতে বসে পড়লো, তার মিহি কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘ ভয় পেও না, আমাদের দুজনের আজ তোমার সাহায্যের খুব দরকার। আমাদের মুক্তি দিতেই আজ তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি আমি। তোমার সামনে হাজির করেছি এই কুয়োর প্রায় সমস্ত রহস্য!’

‘এর মানে! কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন প্রফেসর

‘ আমি ৩জন। ফুলরেখা, বৃষ্টি, আর একটা পিশাচ।’

মুহূর্তেই বৃষ্টির চেহারা বদলে রূপ নিল সেই বৃদ্ধার চেহারার। ফেসফেসে কণ্ঠে খেই ধরলেন নিজের কথার, ‘আমার আজকের অবস্থার জন্য আমিই দায়ী! তুমি এরমধ্যে দেখেছ আমি কী করে এই কুয়োয় পতিত হলাম, কী করে বৃষ্টির পরিবার আর তাকে সাহায্য করতে আসা পরিবারের লোকগুলোকে হত্যা করেছে আমারই ছায়া অবয়ব। যদিও ওটা আমি নই। না, ওটা বৃষ্টি। এখন তোমাকে শোনাই কী করে এই কুয়োটা সৃষ্ট হলো!

আমাকে যখন গ্রাম থেকে নির্বাসিত করে দেয়া হলো আমি তখন পুরোই উন্মাদ হয়ে গেলাম। আমার জীবনে এত কষ্ট, অথচ মানুষ কত সুখে বাস করে! আমার ছোট্ট বয়সে আমার কুমারী শরীর আমার বাবা ব্যবহার করেছে শয়তান সাধনায়, মায়ের মুখ কখনো দেখিনি, যার সাথে আমার বিয়ে হলো তার সামান্য ভালোবাসা পেলাম না, নিজের সন্তানরাও আমাকে কোনোদিন বোঝেনি। শপথ নিলাম পুরো গ্রামকে শেষ করে দেব।

শয়তান পুজোর পুরোটা আমি জানতাম না। সেটাই ছিল আমার ভুল। আমি আমার নাতনিকে গোপনে গিয়ে তুলে আনলাম। বলি দিলাম শয়তানকে উদ্দেশ্য করে, সাধনার সব নিয়ম মেনে। কিন্তু যে শক্তিশালী পিশাচের সাধনা আমি করলাম ওটা এলো না। সাধনার ভুলের কারণে এলো শরীরহীন এক ছায়া পিশাচ। ওটার বসবাসের জন্য চাই একটা শরীর। কিন্তু আমি ছাড়া ওই ঘরে আর কেউ ছিল না। চিরদিনের জন্য আমার শরীরের ভেতর আশ্রয় নিয়ে ফেললো ওটা। এরপর আমার শরীরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিল ওটা। আমি সবই অনুভব করতে পারি, দেখতে পারি। কিন্তু কোনো কাজে বাধা দিতে পারিনা। ওটা আমাকে ব্যবহার করে শিকার করতে লাগলো একের পর এক বাচ্চা মেয়ে।

ছায়া পিশাচটা কেবল ছিল শয়তানের একটি দূত। সে তার জগতের সাথে এই জগতের বিশাল একটা যোগসূত্র তৈরি করার জন্য নিজের ক্ষমতা আর আমার শরীরকে কাজে লাগিয়ে খুঁড়তে থাকে এই কুয়ো। এরপর একদিন ধরা পড়ে যাই আমি মানে শয়তানটা। ওটা মানুষকে প্রভাবিত করে যেকোনো কাজ করাতে পারে। কিন্তু এতগুলো মানুষ দেখে ঘাবড়ে যায় সে। শুধু গ্রামের মাতবর আর আমার শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুয়োয়।

এরপরই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ে সব জায়গায়। নানান পিশাচ তান্ত্রিক, পিশাচ সাধনার বিরোধী তন্ত্র সাধক এসে উপস্থিত হয় এখানে। কুয়োটার লক্ষ্য পূরণ হলে কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে তা আন্দাজ করে তারা। তন্ত্র সাধনা করে বন্ধ করে দেয় এর মুখ। এরপর থেকে শয়তানটার সাথে একই শরীরে বন্ধি হয়ে আছি প্রায় একশ বছর। যতদিন না মানুষ ভুলে গেল এর কথা আর আপনি খুলে দিলেন এর মুখ!’

হতভম্ব হয়ে বৃদ্ধার দীর্ঘ বক্তব্য শুনে যাচ্ছেন প্রফেসর। অবিশ্বাস্য একটা ছেলে ভোলানো ভুতের গল্পের চরিত্র মনে হচ্ছে তার নিজেকে। তবে কথা বলার জন্য শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

বুড়ি বলা চালিয়ে গেল ‘পিশাচটা এতদিন বন্ধি থাকায় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তাছাড়া আমিও ওটাকে সরিয়ে কী করে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিতে হয় তা আয়ত্ত করে ফেলেছিলাম। পিশাচটার অনেক শক্তিও আমি ব্যবহার করতে পারি। হ্যা, এটা ঠিক, ওটা আমার শরীরে না থাকলে এত বছর আমি বেঁচে থাকতাম না। কিন্তু এও কী বেঁচে থাকা! ছায়া পিশাচটার প্রয়োজন ছিল একটা ছোট শরীর। তাই পেয়ে গেল সে সেদিন। তবে বৃষ্টির শরীরে প্রবেশ করতে পারলো না সে, তাই বৃষ্টির শরীর থেকে আত্মাটা বের করে আমার ভেতর স্থাপন করলো, হয়ে উঠল ওটা বহুরূপী। বৃষ্টির রূপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লো কুয়ো থেকে। আমারও শক্তিও কমে গেল নতুন রূপ পাওয়ার পর। এরপর থেকেই বৃষ্টির আসল শরীর পড়ে রয়েছে এখানে, আর ছায়া পিশাচটা করে চলেছে তার শয়তানি।

তার সম্মোহনে পরে এখন পর্যন্ত যারাই মারা গিয়েছে তাদের শরীর থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গেলেও শরীরগুলো নিস্তার পাবে না। ওইসব গুলো শরীরে ভর করবে আরো অনেক পিশাচ শক্তি। ওগুলোর ক্ষমতাও থাকবে এটার মতো। যার ফলে ওগুলো সম্মহিত করে হত্যা করবে আরও মানুষ। তারা আরও মানুষ। এভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে মহা পিশাচ শক্তি। যার জন্য কিনা শুধু আমিই দায়ী!

বৃষ্টির রূপ ধরে আপনাকে কুয়োর কাছে এনেছিল পিশাচটাই হত্যা করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি তোমাকে রক্ষা করলাম। এবার তুমি আমাদের রক্ষা করো।’

ভয়ানক উত্তেজনা অনুভব করছেন প্রফেসর আমির হোসেন, ‘কিভাবে! কিভাবে আমি তোমাকে আর বৃষ্টিকে মুক্ত করতে পারি! আর শেষ করতে পারি পিশাচটাকে! শেষ করতে পারি এই সমস্ত মৃত্যু খেলা চিরদিনের জন্য?’

‘তোমার পাশে যে বৃষ্টি শুয়ে আছে ওর আত্মা দূরে থাকলেও ও বেঁচে আছে। একশ বছর পর এই বাচ্চাটির সাহায্যেই শক্তি ফিরে পেয়েছে ছায়া পিশাচটা। তোমাকে খুন করতে হবে ওকে। তবেই শেষ হবে সব কিছু।’

প্রফেসরের সামনে এক মুহূর্তে চলে এলো একটি ধারালো ছুরি, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধার শরীর রূপান্তরিত হয়ে হলো বৃষ্টির চেহারায়। বৃষ্টি হাত ইশারা করে দেখাচ্ছে ঘুমন্ত বৃষ্টির দিকে। তিনি ছুরি হাতে তুলে নিলেন, ঘুরে বসলেন ঘুমন্ত ফুটফুটে মেয়েটির দিকে। উন্মুক্ত গলা তার সামনে খোলা। মেয়েটার গলায় চালিয়ে দিতে পারেন ধারালো ছুরিটা। তবেই যদি শেষ হয় সব! মুক্তি পায় ছোট মেয়েটি। এই মেয়েটিকে নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেবেন তিনি আর তার স্ত্রী। শৈশবে মেয়েটা যা হারালো ফিরিয়ে দেবেন সব। ছুরিটা বৃষ্টির গলার কাছাকাছি নিয়ে এলেন তিনি।

এমন সময় একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে তার শরীর মন চমকে উঠল। প্রফেসরের স্ত্রীর অভিমানী কন্ঠস্বর, ‘আচ্ছা রোমান্টিক তো তোমরা দাদা-নাতনি, এই অন্ধকারের মধ্যে এই কুয়োর পাশে হাত ধরাধরি করে বসে আছ, আর আমি দুশ্চিন্তা করে মরছি!’

এক মুহূর্তে সব কিছু উলট-পালট মনে হলো প্রফেসরের কাছে। হচ্ছেটা কী! কোথাও তাকিয়ে নিজের স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলেন সমস্ত কিছু। তিনি এখন প্রাচীন কুয়োটার তল দেশে নয়। বৃষ্টি এখনো শক্ত করে তার হাত ধরে বসে আছে কুয়োটার পাশে। তার এবং বৃষ্টি দুজনের শরীরই রয়েছে কুয়োর উপরে। এতক্ষণ তার সাথে যা কিছু ঘটলো এর পুরোটাই ছলনা। হয়তো ভেসে ওঠা দৃশ্য, আর ফুলরেখার বলা ঘটনা গুলো সত্যি। তবে এইসবই বলা হয়েছে তাকে প্রভাবিত করার জন্য।

সেই পিশাচটা তাকে এমন এক পবিত্র দুনিয়ায় পাঠিয়েছে যেখানে তার প্রভাব শক্তি কাজ করে না। কুয়োর উপরে তার পাশে বসে আছে বৃষ্টির শরীর, যার ভেতর ছায়া পিশাচটার আত্মা ভর করে আছে। আর তার পাশে যে ঘুমন্ত বৃষ্টি রয়েছে এটা বৃষ্টির আসল আত্মা। এটাকে বৃষ্টির শরীর থেকে আলাদা করলেও হত্যা করার ক্ষমতা ওটার নেই। তাই তাকে দিয়ে বৃষ্টির আত্মাকে হত্যা করাতে চাইছে সে। যাতে বৃষ্টির শরীরের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে আজীবনের জন্য শয়তানটা।

সে বৃষ্টির আত্মাকে খুন করার পর তাকে ধাক্কা দিয়ে কুয়োতে ফেলে দেবে শয়তানটা। তার স্ত্রীকে প্রভাবিত করে কুয়োয় ফেলতেও ঝামেলা হবে না ওটার। এরপর থেকে পুরো শক্তিশালী হয়ে একটা শিশুর শরীরের আড়ালে থেকে হত্যার মেলা চালাবে পিশাচটা।

তার মানে সে এখন একটা আত্মা, বৃষ্টিও আত্মা। সে রয়েছে আত্মার দুনিয়ায়। তার সামনে ২য় যে বৃষ্টি দাঁড়িয়ে আছে, যেটা ছায়া পিশাচটার বহুরূপী সত্তা, যা এইসবের পেছনে দায়ী ওটাও আত্মা! এক মুহূর্তে বুদ্ধি খেলে গেল প্রফেসরের মাথায়। ভন করে ঘুরে ছুরিটা বসিয়ে দিল দাঁড়িয়ে থাকা বৃষ্টির হৃদপিণ্ড বরাবর। কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে রইলো সব কিছু যেন। এরপরই আকাশ ফাটানো একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওটার গলা থেকে। দেখতে দেখতে মানুষের গাঢ় ছায়ায় রূপান্তরিত হলো ওটা। পুরো শরীর আগুনে পুড়ছে ওটার। পেছাতে লাগলো অবয়বটা। এক সময় ছাইয়ে রূপান্তরিত হলো। মিশে গেল কুচকুচে কালো পানিতে। শেষ সব কিছুর!

আত্মা দুলে উঠল প্রফেসরের। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘুমন্ত ছোট মেয়েটার আত্মার উপর। শক্ত করে চেপে ধরলেন নিজের শরীরের সাথে। চারপাশে সব কিছু অন্ধকার হয়ে এলো। যখন চোখ খুললেন দেখলেন অসতর্ক ভাবে কুয়োর পাশে বসে আছেন তিনি, তারপাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বৃষ্টি, আতংক ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন তার স্ত্রী।

বৃষ্টিকে কোলে তুলে ঘরের দিকে রওনা হলেন তিনি। এটাকে অনুভব করতে পারছেন তিনি। অশুভ শক্তিটা শেষ হয়ে গেছে। তিনিই শেষ করেছেন ওটাকে। কুয়োটা বন্ধ করে দেবেন চিরদিনের জন্য তিনি। এইতো মিটিমিটি করে চোখ খুলছে ছোট মেয়েটি। এই মুখের মতো পবিত্র মুখ আর কী আছে জগতে! বিড়বিড় করছে মেয়েটি,’ বাবা,মা, কী সুন্দর বিড়াল!’

• * * * * সমাপ্ত * * * *

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে