ভৌতিক ভালবাসা

1
3564

ভৌতিক ভালবাসা

•••••লেখক:Soumitra Mandal•••••

উহ্,বড্ড বেশি শীত এখানে।হঠাৎ বাতাসের ঝটকায় শীতে কাঁপতে কাঁপতে বললো মিষ্টি।এর আগে এতটা শীত কখনো টের পায়নি সে।বরাবর ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরেই থেকে এসেছে ।তাই এখন শ্রীমঙ্গলের মতো একটা পাহাড়ি সুনসান এলাকায় এসে শীতটা খুব বেশিই অনুভূত হচ্ছে ওর।

হঠাৎ বাবার একটা কাজ পড়ে গেলো এখানে।আর বাবার কাছে ছোটবেলা থেকেই এই পাহাড়ি এলাকার গল্প শুনেছে সে।তাই বার্ষিক পরিক্ষা শেষে অবসরটা কাঁটাতে বাবার সাথে সেই গল্পের এলাকা দেখার সুযোগটা হাতছাড়া করলো না মিষ্টি।মায়ের বারণ না শুনেই বাবাকে তাকে সাথে নিয়ে যেতে রাজি করিয়ে ফেললো ও।আর তার ঠিক দুদিন পরেই বাবার সাথে ট্রেনে করে একমাসের জন্য শ্রীমঙ্গলে চলে এলো মিষ্টি।জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর।যেমনটা সে ভেবেছিলো তারচেয়েও বেশি।যদিও শীতের প্রকোপ অসহনীয় হয়ে উঠছে,তবুও শীতের সকালের ঘন কুয়াশা এই এলাকাটাকে আরোও বেশি মায়াবী আর রহস্যময় করে তোলে।তাই বেশ ভালো লাগলো জায়গাটা ওর।

কোনো আত্নীয়_স্বজন নেই এখানে ওদের।তাই মিষ্টির বাবা একমাসের জন্য শহরের একপাশে একটা ভাড়াবাড়ি ঠিক করলো।বাড়িটা একটা বাংলো বাড়ি। যদিও বাংলোটা খুব সুন্দর আর বিশাল তবুও দেখেই আন্দাজ করা যায় যে বাংলোটা বেশ পুরোনো।বাংলোর ভেতরটা খুব সাজানো গোছানো।আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই।কেয়ারটেকারের সাথে কথা বলে যতটুকু বোঝা গেলো যে এলাকার বাইরে থেকে আসা পর্যটকরাই সাধারণত এখানে থাকে।আর এবার সৌভাগ্যক্রমে বাংলোটায় মিষ্টিরা উঠেছে।

বাড়িটা পুরোনো হলেও যে অসম্ভব সুন্দর সেটা মানতেই হলো মিষ্টিকে।দোতোলা বাড়িটার দোতলায় রয়েছে বিশাল বড় বারান্দা।আর বাড়িটার ঠিক সামনেই সাজানো ফুলের বাগান।আর মিষ্টির সবচেয়ে বেশি যেটা ভালো লাগলো তা হলো বাগানের ঠিক মাঝখানে একটা দোলনা।খুব সুন্দর দোলনাটা।লাভলী ছুটে গিয়ে দোলনাটায় বসে দোল খেতে খেতে দূরে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলো।ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ ওর বাবা ডাকলো…..

বাবাঃমিষ্টি মা খেতে আয়।

মিষ্টিঃএইতো আসছি বাবা। বলেই মিষ্টি সেদিনের মতো বাংলোবাড়ির ভেতর চলে গেলো। .

ওর বাবা সারাদিন বাইরেই থাকে।সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে।মিষ্টি বলতে গেলে সারাদিন একাই থাকে।তবে মাঝে মাঝে কেয়ারটেকার চাচার মেয়ে সামিয়া এসে গল্প করে ওর সাথে।আবার সন্ধ্যার আগে আগেই চলে যায়।আর একটা কাজের বুয়া এসে ঘর ঝেড়ে মুছে রান্না করে দিয়ে চলে যায়

সারাটা দিন তাই করার মতো তেমন কিছু থাকে না মিষ্টির।এমন এক জায়গায় এসেছে যে ভালো করে নেটওয়ার্কটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।ফেসবুক চালানোর কথা তো দূরে থাক।মাঝে মাঝে তো মিষ্টির রীতিমতো সন্দেহ হয় যে এখানকার মানুষগুলো বেঁচে আছে কী করে।তবুও মনে করে জাফর ইকবালের বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছিলো বলে রক্ষে।দিনের বেশিরভাগ সময় বাগানের দোলনায় বসে বই পড়েই কাটিয়ে দেয় ও। .

প্রতিদিনের মতো একরাতে বাবার সাথে একসাথে ডিনার করেই দোতলায় নিজের বেডরুমে চলে যায় মিষ্টি।তবে সেদিন কেন যেন কিছুতেই ঘুম আসছিলো না ওর।তাই রান্নাঘরে গিয়ে এককাপ কফি বানিয়ে কফির ধোঁয়া ওঠা মগটা আর সাথে একটা বই নিয়ে বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিলো মিষ্টি।রুমে লাইট জ্বলছে।তারই কিছুটা আলো এসে পড়ছে বারান্দায়।আর সে আলোতেই বইটা খুলে গরম কফির মগে চুমুক দিলো।মাঝে মাঝে হঠাৎ দমকা বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে গায়ে।চারিদিকে থমথমে ভাব,বাতাসের শো শো শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না।কেমন একটা ভৌতিক পরিবেশ। থেকে থেকে শিউরে উঠছে মিষ্টি। পাছে ঠান্ডা লেগে যাবে সেই ভয়ে মিষ্টি রুম থেকে একটা শাল এনে গায়ে জড়িয়ে নিলো।তারপর ফের কফির মগে চুমুক দিয়ে বইয়ের দিকে তাকাতেই একটা শব্দ শুনতে পেলো।কে যেন খুব মিষ্টি গলায় গিটার বাজিয়ে গান গাইছে।হাতঘড়িটায় সময় দেখলো মিষ্টি।তখন ঠিক ১২টা বেজে ১০মিনিট।এতো রাতে এখানে কে গান গাইতে পারে? বেশ অবাক হলো মিষ্টি ব্যাপারটায়।তবে ভালোলাগার কাছে এরকম অবান্তর প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে গেলো।উঠে বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো বাগানের ঐ দোলনাটাতে বসে একটা ছেলে গিটার বাজাচ্ছে। শব্দ টা খুব তীব্র না,তবে খুব সুমধুর।ছেলেটা কণ্ঠস্বর যে ভীষণ মিষ্টি সেটা যে কাউকে মানতে হবে।একটু শুনলেই কেমন জানি নেশা ধরে যায়।ইচ্ছে হয় অনন্তকাল এই গান শুনতেই থাকি।কিন্তু,এ কী?কুয়াশার চাদর যেন ছেলেটাকে ঢেকে দিয়েছে।একটা আবছা অবয়ব ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।মিষ্টির কেনো জানি খুব ইচ্ছে হলো ছেলেটার সাথে কথা বলতে,দেখতে যে ছেলেটা কেমন। কিন্তু এতো রাতে একা বাইরে যাওয়াটা কী ঠিক হবে?

নাহ্,প্রতিবারের মতো এবারও কৌতুহলের কাছে সব ভয়,সঙ্কোচ হেরে গেলো।তাই চুপিচুপি সিঁড়ি থেকে নিচতলায় নেমে বাংলোর সদর দরজাটা খুলে শেষমেষ বাইরে চলেই এলো মিষ্টি।এমন একটা ছেলেকে দেখার ইচ্ছেটা কিছুতেই মন থেকে সরানো যাচ্ছিলো না।

ছেলেটা তখনও গান গাইছে।কুয়াশার মধ্যে ছেলেটার দিকে লক্ষ্য করে কাঁপতে কাঁপতে সেদিকে ধীর ধীরে এগিয়ে যেতে লাগলো মিষ্টি।তার শরীর কাঁপছে,কিন্তু সেটা শীতে নাকি ভয়ে সেটা জানেনা সে। .

ছেলেটার পেছনে এসে থামলো মিষ্টি।ভয়ে ভয়ে ছেলেটার কাঁধে হাত রাখলো।সাথে সাথে ছেলেটা গান বন্ধ করে পিছন ফিরে তাকালো মিষ্টির দিকে। .

এবার মিষ্টির আরোও অবাক হবার পালা।ছেলেটা অসম্ভব সুন্দর।চোখদুটো নীল।এর আগে নীল চোখের মানুষ অনেক খুঁজেছে সে।

তবে আজই প্রথম দেখলো।যেমন ফর্সা গায়ের রং ঠিক তেমনই লাল ঠোঁটদুটো।মিষ্টি শুধু অবাক হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো ছেলেটার দিকে। তবে ছেলেটা মানুষ নাকি অন্যকিছু সেটা নিয়ে ওর যথেষ্ট দ্বিধাবোধ আছে।কারণ,একটা মানুষ কী করে এতোটা সুন্দর হতে পারে সেটা ওর জানা নেই।মিষ্টির এই অবস্থা দেখে ছেলেটা মুচকি হাসলো।তাতে ছেলেটার দাঁত দেখা গেলো না ,কিন্তু বাম গালে একটা টোল পড়ে চেহারার সৌন্দর্যটা আরোও কয়েকগুন বেড়ে গেলো।এবার সত্যি মিষ্টিও লজ্জা পেয়ে গেলো।মাথা নিচু করে ফেললো সাথে সাথে।

“ইস্,কী ভুলটাই না করে ফেললাম।এভাবে তাকিয়ে থাকাটা উচিত হয়নি”,মনে মনে ভাবতে লাগলো মিষ্টি।

ছেলেটাঃকিছু বলবেন?

মিষ্টিঃনা,মানে এতো রাতে এখানে…

ছেলেটাঃআসলে এটা আমার খুব পছন্দের জায়গা তো, তাই বারবার ছুটে আসি।আপনার বুঝি খুব ডিস্টার্ব হলো?

মিষ্টিঃমোটেই না,আপনি ভুল ভাবছেন

ছেলেটাঃওহ্,তাই বুঝি? তবে ঠিকটা কি জানতে পারি?

মিষ্টিঃহুম,অবশ্যই।আপ­­­­­নি খুব ভালো গান করেন।

(মিষ্টির কথায় ছেলেটা আবার তার সেই বাঁকানো অসাধারণ হাসিটা দিলো আর বললো…)

ছেলেটাঃধন্যবাদ।

মিষ্টিঃআচ্ছা,আপনার নামটা কী জানতে পারি?

ছেলেটাঃনয়ন…

মিষ্টিঃবাহ্,আর আমার নাম….

নয়নঃমিষ্টি,কী তাই তো?

মিষ্টিঃহ্যা,কিন্তু?আ­­­পনি কী করে…?

নয়নঃআমি সবটাই জানি।ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে।আর হ্যা,আমাকে তুমি করেই বলতে পারো।তাতেই বেশি খুশি হবো।

মিষ্টিঃঠিক আছে,তাই হবে।(একটু হেসে)

নয়নঃআজ তবে আসি।তুমি চাইলে কাল আবার দেখা হবে।

মিষ্টিঃআমি চাইলেই?

নয়নঃহ্যা,তুমি যা চাও তাই তবে।

মিষ্টিঃপ্রতিদিন আসবে তো তবে?

নয়নঃঅবশ্যই আসব।

মিষ্টিঃবেশ,তবে সে প্রতিক্ষাতেই রইলাম।

নয়নঃআমিও।আজ তবে আসি।

(চলে গেলো নয়ন।তবে তার যাওয়ার পথে অবাকদৃষ্টিতে তখনও চেয়ে আছে মিষ্টি)

নয়ন চলে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে মিষ্টিও তার ঘরে চলে এলো।এসে নয়নের কথা ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লো মিষ্টি। সকালে বাবার ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে মিষ্টির।কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলো নয়নকে নিয়ে কিন্তু বাবার জন্যে স্বপ্নের বাকিটুকু আর দেখা হলো না।ধুত্তুরি ছাই! সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে খাবার খেতে খেতেও নয়নের কথাই ভাবতে লাগলো মিষ্টি।ছেলেটা যেনো যাদু করেছে ওকে,কিছুতেই মাথা থেকে এক মুহুর্তের জন্যও নয়নের ব্যাপারটা সরাতে পারছে না।যে মেয়েটা ঢাকা শহরের কোনো ছেলেকে আজ পর্যন্ত পাত্তা দেয় নি।সেই মেয়েটাই কিনা সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গার একটা অচেনা ছেলের প্রতি এভাবে মায়ায় জড়িয়ে যাচ্ছে।ভাবতে ভাবতে নিজেই মুচকি হাসতে লাগলো মিষ্টি।সারাটাদিন আজ গল্পের বই নিয়ে বসে ছিলো মিষ্টি।কিন্তু বইয়ের একটি পাতাও পড়ে শেষ করতে পারে নি।শুধু কাল রাতের স্মৃতিটাই সহস্রবার উল্টে পাল্টে দেখেছে নিজের মনে।আর শুধু অপেক্ষা করেছে কখন রাত আসবে আর নয়নের সাথে দেখা হবে।কিন্তু আজ দিনটা যেনো যেতেই চাইছে না।

অবশেষে রাত ঘনিয়ে আসলো।এখন রাত ১১:৫৫ মিনিট।মিষ্টি বারান্দার রেলিংটা ধরে নিচে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে আর নয়নের জন্য অপেক্ষা করছে।আজ সবকিছুই তার কাছে সুন্দর মনে হচ্ছে।ফুলগুলোও অন্য সময়ের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে যেনো আজ।মিষ্টি শুনেছে প্রেমে পড়লে নাকি সবকিছু সুন্দর লাগে।ওর ও হয়তো সেরকমই কিছু হয়েছে।

নয়নের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এসবই ভাবছিলো মিষ্টি।হঠাৎ খেয়াল করলো বাগানের দোলনাটাতে বসে গিটার বাজাচ্ছে নয়ন।কিন্তু মিষ্টি তো এতক্ষণ নিচের দিকেই তাকিয়ে ছিলো।নয়নকে তো সে আসতে দেখলো না।তবে?

হয়তো অন্যমনষ্ক ছিলো বলে খেয়াল করে নি।এটা ভেবেই ব্যাপারটা উড়িয়ে দিলো মিষ্টি।তারপর আর এক মুহুর্ত দেরি না করে ছুটে গেলো বাগানের দিকে। নয়ন মিষ্টিকে দেখেই মিষ্টি করে একটু হাসলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,

নয়নঃকেমন আছো মিষ্টি?

মিষ্টিঃএইতো ভালোই।তুমি?

নয়নঃআমি?

মিষ্টিঃহ্যা তুমি।

নয়নঃএসব কথা থাক,তুমি আগে বলো আজ আমার সাথে গান গাইবে কি না?

মিষ্টিঃআরে,আমি তো এখন মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিলাম তুমি কি করে বুঝলে বলো তো?

নয়নঃকারণ আমি চোখের ভাষা পড়তে পারি।

মিষ্টিঃতাহলে বলো তো আমি তোমাকে আর কী বলতে চাই?

নয়নঃ(উত্তরে শুধু একটু হেসে তারপর বললো) চলো এখন গান শুরু করা যাক।

তারপর সে রাতে অনেকক্ষন গান গাইলো আর গল্প করলো ওরা।নয়ন মিষ্টিকে গিটার বাজানোও শিখিয়ে দিচ্ছিলো একটু একটু করে।হঠাৎ মিষ্টি নয়নকে জিজ্ঞেস করলো,

মিষ্টিঃনয়ন,তোমাকে একটা কথা বলবো বা সেটাকে তুমি অনুরোধ ও ভাবতে পারো।তবে তোমাকে কথা দিতে হবে যে তুমি রাগ করবে না

নয়নঃঠিক আছে,এবার বলো কি কথা?

মিষ্টিঃতোমার কাঁধে মাথা রেখে শুধুমাত্র একটু সময়ের জন্য বসতে দেবে আমায়?

নয়নঃআচ্ছা,এই কথা।হুম,নিশ্চয়ই দেবো।(বলে মিষ্টিকে ইশারায় তার কাছে আসতে বললো)

মিষ্টি হাসি মুখে নয়নের পাশে গিয়ে বসে ওর বাম কাঁধে মাথা রাখলো।

অস্বাভাবিক ঠান্ডা নয়নের শরীর।কিন্তু তাতে একটুও খারাপ লাগলো না মিষ্টির।কেমন জানো খুব শান্তি লাগছিলো।নয়নও ওর বাম হাত দিয়ে মিষ্টির কাঁধ স্পর্শ করে আরেকটু কাছে নিয়ে আসলো নিজের,যেনো মিষ্টিকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দিতে চাইছে না। চারপাশের বাতাসে অদ্ভূদ একটা মিষ্টি গন্ধ।অনেকক্ষণ কেটে গেলো এভাবে।রাত প্রায় শেষের দিকে।নয়ন বললো,

নয়নঃএবার আমাকে চলে যেতে হবে মিষ্টি।

মিষ্টিঃআরেকটু পরে গেলে হয় না?

নয়নঃনা মিষ্টি,আজ আর সময় নেই।তবে কথা দিচ্ছি কাল রাতে আবার আসবো।

মিষ্টিঃঠিক আছে।তবে তারাতারি এসো।আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

নয়নঃতোমার কথা না রেখে কী পারি বলো? অবশ্যই আসবো।এখন যাচ্ছি।তুমি ঘরে চলে যাও।

নয়ন চলে যাওয়ার পর মিষ্টিও চলে গেলো।তারপর থেকে এভাবেই প্রতিরাতে সবার অলক্ষ্যে দেখা হতো নয়ন আর মিষ্টির।দুজনে কেউ কাউকে মুখ থেকে না বললেও ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না ওদের।এভাবে কেটে গেলো অনেকগুলো দিন।মিষ্টির এখান থেকে চলে যাওয়ার সময়ও এসে গেলো।কীভাবে যে এতগুলো দিন কেটে গেলো,বুঝতেই পারে নি মিষ্টি।বাবাকে কতবার বুঝালো কিন্তু বাবা আগামীকালের ট্রেনে টিকেট কেটে ফেলেছে।তাই কিছুতেই আর যাওয়ার দিনটা পেছাতে পারলো না মিষ্টি।সারা দিন কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে ও।ভাবতেও পারছে না কী করে নয়নকে না দেখে থাকবে ।আজ রাতের পর হয়তো নয়নের সাথে কোনোদিনও দেখা হবে না ওর।এসব দুশ্চিন্তা করতে করতে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে মিষ্টি।দেখতে দেখতে রাত চলে এলো।সময়টা যেনো খুব তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে

মিষ্টি নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে আজ।খুব সুন্দর করে সেজেছে।আর এখন বাগানের সেই দোলনাটাতে বসে আছে নয়নের জন্য পথ চেয়ে।হঠাৎ নয়ন পিছন থেকে ওর চোখদুটো ধরলো,তারপর ওকে খুব সুন্দর একটা লাল গোলাপ দিলো।মিষ্টি এবারেও অবাক হলো না।কারণ ও জানে মনের কথা বুঝতে পারার এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে নয়নের।গোলাপটা মিষ্টির হাতে দিয়ে তারপর দোলনায় মিষ্টির পাশাপাশি গিয়ে বসলো নয়ন অন্যদিনের মতো।কিন্তু আজ কারো মুখে কোনো কথা নেই।অবশেষে নিরবতা ভেঙে নয়নই বললো,

নয়নঃআজ তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে মিষ্টি।

মিষ্টির দিকে তাকাতেই নয়ন লক্ষ্য করলো ওর চোখ থেকে জল পড়ছে।মিষ্টির সামনে হাঁটুগেড়ে বসে ওর চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললো,

নয়নঃএই পাগলী,কাঁদছো কেন?

মিষ্টিঃজানো নয়ন? আমি কালকে চলে যাচ্ছি।

নয়নঃহুম,জানি।

মিষ্টিঃসবকিছু জানার পরেও তুমি…

নয়নঃআজ তোমাকে অনেক কথা বলবো মিষ্টি।আমার জীবনের সব কথা।

মিষ্টিঃহ্যা,শুনব।কিন­­­্তু আমি যে তোমাকে…

নয়নঃকিন্তু আমি চাই যে তুমি আগে সবটা শোনো।

মিষ্টিঃঠিক আছে,বলো তাহলে।

নয়নঃতবে শোনো,আজ থেকে পাঁচ বছর আগে এমনই শীতের সময়ে এই বাড়িটাতে একটা পরিবার এসে উঠেছিলো।সেই ধনী পরিবারের একমাত্র আদরের মেয়ে ছিলো লাভলী।মেয়েটা খুব ভালো ছিলো, বেশ হাসিখুশি আর মিশুক।আমার মা পাশের চা বাগানটাকে কাজ করতো।তাই আমি মাঝে মাঝে এদিকটাতে আসতাম।এভাবেই হঠাৎ একদিন আমার সাথে দেখা হয়ে যায় লাভলীর।ও আমার গান শুনতে খুব ভালোবাসতো।রোজ রাতে ও আর আমি এই বাগানে দেখা করতাম।কীভাবে যেনো ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ি আমরা।খুব ভালোই কাটল কিছুদিন।কিন্তু কিছুদিন পর লাভলীর বাবা জানতে পারে সবটা।একটা চা বাগানে ছোট্ট কাজ করা গরীবের ছেলের সাথে তার একমাত্র আদুরে মেয়ের সম্পর্ক মেনে নেয় নি সে।ব্যাপারটা জানার দুইদিনের মাথায় লাভলীর বাবা লাভলীকে জোর করে নিয়ে এখান থেকে চলে যায়।আর এখানকার স্থানীয় কিছু লোককে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে যায় আমাকে মার খাওয়ানোর জন্য।ওরা আমাকে সেদিন প্রচুর মারধোর করে।যদিও আমাকে একদম জানে মারার ইচ্ছে ছিলো না ওদের,তবুও এক পর্যায়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পাই আমি।তখন ওরা কিছুটা ভয় পেয়ে আমায় রাস্তায় ফেলে চলে যায়।আমার মা আমাকে সেখানে খুঁজে পেয়ে কোনোরকম কাছের একটা মেডিকেলে ভর্তি করে।নিজে খেয়ে না খেয়ে আমার মা আমার জন্য সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে আমাকে বাঁচানোর।কিন্তু পারে না।মাথার আঘাতটা এতটাই গুরুতর ছিলো যে এক সপ্তাহের মাথাতেই আমার মাকে একা করে দেই আমি চিরদিনের মতোl মিষ্টি এতক্ষন চুপ করে সব কথাগুলো শুনছিলো।যদিও এতোদিন সে অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুতে বিশ্বাস করতো না,তবুও এখন সে বুঝতে পারছে কীভাবে নয়ন ওর মনের কথা বুঝতে পারতো,কেন নয়নের শরীর এতো ঠান্ডা,ওর সাথে দেখা হওয়ার পর সেই সুমিষ্ট গন্ধ আর সেদিন বারান্দায় থাকার পরও নয়নকে এখানে আসতে দেখতে না পাওয়ার কারণ।খুব কাঁদছে মিষ্টি।কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগলো,

মিষ্টিঃখুব কষ্ট হয়েছে তোমার তাই না নয়ন?

নয়নঃমার খেয়েছি বলে আমার এতটুকুও কষ্ট নেই।আমার কষ্ট শুধু এটাই যে আমি সেদিন আমার ভালোবাসাকে আটকাতে পারি নি।

এবারে নয়নের গাল বেয়ে অশ্রু টপটপ করে পড়তে লাগলো।মিষ্টির কান্না তা দেখে আরোও বেড়ে গেলো।কিছু বলারও শক্তি নেই যেন।

নয়নঃসেদিন আমার শরীর পৃথিবী ছাড়লেও শান্তি পায় নি আমার এই অতৃপ্ত হৃদয়।একটু,শুধুমাত্র­­ একটু ভালোবাসা পেতে ফিরে এসেছিলাম আমি।আর আজ তুমি আমার এই অতৃপ্ত মনটাকে ভরিয়ে দিয়েছো তোমার ভালোবাসা দিয়ে।যদি সম্ভব হতো তাহলে সারাজীবন তোমার পাশে থাকতাম।কিন্তু আত্মাদের যে সে অধিকার বিধাতা দেয় নি মিষ্টি।দীর্ঘ পাঁচবছর পর আর আমার প্রকৃত মুক্তি হলো।শুধুমাত্র তোমার জন্য।আর আমি জানি মিষ্টি,তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো।আর আমিও ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।

এবারে নয়ন জড়িয়ে ধরলো মিষ্টিকে।অনেকক্ষন দুজন কাটিয়ে দিলো এভাবে।তারপর নয়ন মিষ্টিকে ছেড়ে দিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেল।

নয়নঃআমাকে যে এবার চিরতরে বিদায় নিতে হবে মিষ্টি।রাত প্রায় শেষ হতে চললো।তার আগেই চলে যেতে হবে আমায়।বিদায় দাও আমাকে…

মিষ্টিঃতোমাকে যেতে দেবো না আমি।সারাটা জীবন চাই আমার পাশে।আমি আর কিছু চাই না নয়ন,প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। নয়নঃআমাকে তো যেতেই হবে।তবে আমার এই গিটারটা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি।আমার সবচেয়ে পছন্দের এটা।খুব কষ্ট করে টাকা জমিয়ে কিনেছিলাম।আশা করি যত্নে রাখবে। মিষ্টি জানে যে নয়নকে আটকানোর ক্ষমতা ওর নেই।তাই শেষ বিদায়ের আগে ওর বাহুবন্ধনে শেষবারের মতো নিজেকে আবদ্ধ করলো।

কিন্তু এবার যাওয়ার সময় হয়েছে।নয়ন মিষ্টিকে বিদায় জানিয়ে চলে যাচ্ছিলো।তারপর হঠাৎ একবার পেছন ফিরে তাকালো,পূর্নিমার চাঁদের আলোতে মিষ্টি দেখলো যে নয়নের ওই মুখে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসিটা ফুঁটে উঠেছে।কিছুক্ষনের মধ্যে কুয়াশার সাথে যেনো মিশে গেলো নয়ন চিরদিনের জন্য।

মিষ্টি লাভলীর মতো চলে যায়নি এখান থেকে।অদ্ভূত মায়ার টানে থেকেই গেছে শেষ অব্দি।

এখনও মাঝরাতে মাঝে মাঝে মিষ্টিকে গিটার হাতে দেখা যায় সেই পুরনো বাংলো বাড়িটার বাগানের দোলনাতে।

(সমাপ্ত)

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে