ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১০

0
2817

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়ের প্রশ্নের পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে থেমে যায় শুভ্র। কারণ ওর মায়ের মুখ থেকে বখাটে কথাটা শুনার পর থেকে লাবণ্যর খুব হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে উচ্চস্বরে হাসতে কিন্তু সেটা না পেরে মুখে হাত চেপে লাবণ্য হাসতেছে। আর শুভ্র তন্ময় হয়ে সেই হাসি হাসি মুখপানে তাকিয়ে আছে।
আহ্, কি মিষ্টি!
হ্যাঁ, খুব মিষ্টি করে লাবণ্য হাসতে পারে। গালের দুইপাশের টোল যেন সেই হাসির সৌন্দর্য্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ শুভ্র লাবণ্যর হাসিতে বিভোর। ঘোর কাটে মায়ের ডাকে। “পাগল হয়ে গেছিস? মাথাটা কি একেবারে গেছে? এভাবে একা একা হাসছিস কেন? কি হয়ছে তোর?”
একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে যায় শুভ্রর দিকে ওর মা। ইয়ে না মানে আসলে আমার একটু কাজ আছে। আমি আসি বলে শুভ্র প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কোনোরকম কেটে পরে।

রমজানের মাঝামাঝি সময়। সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে শুভ্র। বাসায় ঢুকে দেখে ওর পুরো ফ্যামিলি আলোচনাসভায় বসছে।
আলোচ্য বিষয়- “ঈদ কেনাকাটা”……
শুভ্রর টনক নড়ে। ওহ্, নো! আমি তো ভুলেই গেছিলাম সামনে ঈদ। আচ্ছা, ঈদ উপলক্ষ্যে আমি যদি লাবণ্যকে কিছু দেই, তবে কি সে এটা গ্রহন করবে? নাকি আমার মতই আমার দেওয়া গিফ্টও ছুঁড়ে ফেলে দিবে? না, না ছুঁড়ে কেন ফেলে দিবে? আজ না বাসুক কোনো একসময় তো ও আমায় ভালোবাসতো। শত অবহেলার পরও ভালোবাসতো। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আমার ভালোবাসার দান গ্রহন না করে পারবে না। ও ঠিক গ্রহন করবে। শুভ্র বাসায় এসেও সাথে সাথে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায়। ড্রয়িংরুমে আলোচনাসভায় বসা প্রত্যেকেই অবাক বিস্ময়ে শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলতেছে, এর আবার কি হলো? বাসায় আসতে না আসতেই বের হয়ে গেল?
এদিকে শুভ্র মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে মার্কেটে পৌঁছে যায়। মার্কেটে গিয়ে শুভ্রর মাথা বিগড়ে গেছে প্রায়। হায়রে! এ আমি কোথায় এলাম শপিং করতে? এখানে তো সব কাপড় নজর কাড়া, আমি কোনটা রেখে কোনটা নিব? শুভ্র মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এমন হয় পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে- Any problem, sir?
শুভ্র মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর পাশে একজন অতিকায় সুন্দরী রমনী দাঁড়িয়ে। শুভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে বলল, না, না! তেমন কিছু না। রমনী মিষ্টি হেসে বলল, আপনি না বললেও আমি কিন্তু বুঝতে পেরে গেছি প্রবলেমটা কি? আপনি সঠিক কাপড় নির্বাচনে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছেন? সঠিকটা চোজ করতে পারতেছেন না, তাই তো?!!! মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়ে শুভ্র। রমনী আবারো একটা মিষ্টি হাসি দেয়। তারপর শুভ্রর পাশের একটা চেয়ার টেনে বসে কর্মচারীকে বলে, এই যে ভাইয়া! এই ডিজাইনের মধ্যে কিছু শাড়ি নামান তো! জি, মেডাম নামাচ্ছি বলে অনেকগুলো সুন্দর নিউ ডিজাইনের শাড়ি নামিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রমনী দুইটা শাড়ি শুভ্রর সামনে রাখে। ” আমার মনে হয় এই ডিজাইনের মধ্যে যেকোনো একটা নিলে ভালো হবে। এমনিতে নতুন ডিজাইন, তারপর মিষ্টি একটা কালার। মেডামকে খুব মানাবে। শুভ্র শাড়ির দুইটার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। সত্যিই তো! অনেক সুন্দর! চোখ যেন ফেরানোই যাচ্ছে না। শুভ্র রমনীটির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে, আমি আর কি বাছাই করব? আমার দুটোই পছন্দ হয়েছে। তবে আমার মনে হয় মিষ্টি কালারটা খুব বেশী মানাবে ওকে। শুভ্র লাবণ্যর জন্য মিষ্টি কালারটা বাছাই করে ঐ রমনীটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে ফিরতে রাত্রি সাড়ে ৯টা বেজে গেছে। শুভ্রর বাবা মসজিদে তারাবীহ নামাজ আদায় করতে চলে গেছে। আর বাকিরা যে যার রুমে চলে গেছে। এই সুযোগ শাড়িটা লাবণ্যর হাতে পৌঁছে দেওয়ার। শুভ্র বাসায় ঢুকে সরাসরি লাবণ্যর রুমে চলে যায়। লাবণ্য তখন মোনাজাত করছিল। শুভ্র তাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরল। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজটা তুলে ডানে তাকাতেই চমকে যায় লাবণ্য। আপনি? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? শুভ্র তখনই রুমে প্রবেশ করে। ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে মেলে ধরে লাবণ্যর সামনে। মুগ্ধ নয়নে শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য।। এই মুহূর্তে কোনো কথা’ই যেন ওর মুখ থেকে সরছে না। শুভ্র লাবণ্যর এমন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল,
” নাও! এটা তোমার জন্য…… ”
লাবণ্য তখনও স্টেচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। এটা দেখে শুভ্র’ই লাবণ্যর হাত দুটো উঁচু করে সেই হাতে শাড়িটা তুলে দেয়। শাড়ি হাতে পেয়েও লাবণ্যর কোনো রিয়েক্ট নেই। ওভাবে স্টেচুর মত হাত দুটো উঁচু করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে শুভ্রর মা?!!!
লাবণ্যকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে ডাকতে লাবণ্যর রুমেই পৌঁছে যায়। আচমকা শাশুড়ির রুমে প্রবেশে কিছুটা হকচকিয়ে যায় লাবণ্য। হাতে রাখা শাড়িটা লুকোনোর আগেই দেখে ফেলেন ওনি। শুভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে লাবণ্যর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নেন ওনি।
” এটা? এটা কোথায় থেকে পেয়েছিস?”
নিশ্চুপ লাবণ্য শাশুড়ির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ি জোর গলায় বলেন, কি হলো? চুপ করে আছিস যে?
” মা! এটা আমি এনেছিলাম। লাবণ্যর জন্য।” পিছন থেকে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে উঠে শুভ্র। শুভ্রর মা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকান। তারপর হাত থেকে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে,
” কে বলেছে তোকে শাড়ি দিতে? কে বলেছে? তোর সাহস হলো কিভাবে ওর হাতে শাড়ি তুলে দেওয়ার? আর কখনো যাতে তোকে এ কাজ করতে না দেখি।”
আর লাবণ্য! তোর সাহস হলো কিভাবে একে এ রুমে জায়গা দেওয়ার? লাবণ্য চুপসে গেছে শাশুড়ির রাগী গলার আওয়াজ শুনে। এদিকে শুভ্র?! ওর ইচ্ছে হচ্ছিল মায়ের প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে। বলতে যে, ” আমার বউকে আমি যা ইচ্ছে তা দিব। তার জন্য সাহসের কি দরকার? আর তুমিই বা এমন কেন করতেছ?”
কিন্তু কি মনে করে যেন শুভ্র বলল না।
শুভ্রর মা এবার চেঁচিয়ে উঠল, কি হলো? এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম ত্যাগ করে শুভ্র। লাবণ্যকে খাবার টেবিলে আসতে বলে শাশুড়ি রোকসানা বেগম নিচে চলে যায়। নিচে গিয়ে মনে হলো শাড়িটা তো ঐ রুমেই ফেলে রেখে এসেছি। ওটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসা দরকার ছিল। মেয়ে শিশির খাবার পরিবেশন করছিল। রোকসানা বেগম মেয়েকে বলেন,
” সর! আমি খাবার দিচ্ছি তোর বাবাকে। তুই গিয়ে একটা কাজ করে আয়! লাবণ্যর রুমে যে শাড়িটা পরে আছে, ঐটা আপাতত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে আয়। সকাল হলে না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবি।”
জি, আচ্ছা বলে শিশির লাবণ্যর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় শিশির। দেখতে পায় কিছুক্ষণ আগে যে শাড়িটা ওর মা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, সেই শাড়িটা’ই লাবণ্য বুকে জড়িয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে।
এতকিছুর পরও এত ভালোবাসা মনের ভেতর পুষে রেখেছে? অজান্তেই শিশিরের চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে