ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
শুভ্র পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে পরল লাবণ্যর খুঁজে। এখানে সেখানে, অলিতে গলিতে, পথে-ঘাটে, পার্ক, ক্যাফে-রেস্তোরায় সব, সব জায়গায় শুভ্র লাবণ্যর খুঁজ করেছে। কিন্তু কোথাও লাবণ্যকে খুঁজে পায়নি। লাবণ্যর বন্ধুমহলের কেউ লাবণ্যর সন্ধান দিতে পারে নি। সেদিন মনমরা হয়ে চেম্বার থেকে ফিরছিল শুভ্র। পথে দেখা হয় লাবণ্যর বন্ধু সুমনের সাথে। দুর থেকে দেখেই চিনে ফেলে শুভ্র। এ তো সেই ছেলে যাকে আমি ছবিতে লাবণ্যর পাশে দেখেছিলাম। থমকে যায় শুভ্র। পিছন থেকে ডাক দেয় সুমনকে- এই যে শুনছেন?
পিছু ফিরে সুমন। প্রাণের বান্ধবী লাবণ্যর বরের ছবি সুমন আগেও অনেক বার দেখেছে। তাই শুভ্রকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি।
হাসি হাসি মুখে বলে উঠে সুমন-
” শুভ্র ভাইয়া যে! কি অবস্থা আপনার? লাবণ্য কেমন আছে?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র, “আপনি? আপনি আমাকে চিনেন?”
শুভ্রর কথা শুনে হা, হা করে হেসে উঠে সুমন- ” কি যে বলেন না! আপনি হচ্ছেন সেই মেয়ের হাজবেন্ড যে আমাদের কলেজের সেরা রূপবতী ছিল। আর তাছাড়া আপনি হচ্ছেন আমার বেস্টফ্রেন্ডের কলিজা, যার কথা উঠতে বসতে শুনতে হতো আমায়। আপনাকে না চিনে উপায় আছে কি? শুভ্র বলে উঠে-
” আপনি আর লাবণ্য একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করছেন?”
সুমন জবাব দেয়, হ্যাঁ! আমরা একই কলেজের স্টুডেন্ট ছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্র বলে, কথা হয় না লাবণ্যর সাথে?
সুমন বলে, হয়! তবে আগের মত আর হয় না। লাবণ্য আগের থেকে কেমন যেন বদলে গেছে। গম্ভীর হয়ে গেছে। আগে ও এমন ছিল না। ঐতো সেদিন! আন্টির সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল ও। কাকতালীয়ভাবে আমিও আমার বউকে নিয়ে সেখানে হাজির। ওকে সেদিন কত যে প্রশ্ন করলাম, ও শুধু হ্যাঁ, না জবাব দিল। নিজ থেকে একটা প্রশ্নও করেনি আমাদের।
ওহ! আপনি বিয়ে করেছেন?
স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, হ্যাঁ! ২বছর ৬মাস হলো বিয়ে করলাম।
___” Late Congratulation…..”
সুমন অট্টহাসি দিয়ে বলে, tnx… সুমনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল শুভ্র, আচমকা মনে হলো সুমনের বলা সেই কথাটি, ” ঐতো সেদিন আন্টির সাথে ও শপিংয়ে গিয়েছিল….”
পিছু ফিরে তাকাই শুভ্র। প্রশ্ন করে সুমনকে। কি যেন বলছিলেন, লাবণ্য আন্টি মানে আমার মায়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল?”
সুমন ভ্রু কুচকে বলে, হ্যাঁ! আপনার মা’ই তো ছিল। কেন বলুন তো?! হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না। আচ্ছা আসি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।
রাত্রি ১১টা ৩৫মিনিট__
শুভ্র ওদের নতুন বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দাড়োয়ান গেইট খুলে দেয়। বাসার দরজায় কড়া নাড়ে শুভ্র। দু’তিনবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে শুভ্রর বোন। এত রাত্রে ভাইকে এভাবে দেখে চমকে উঠে শিশির। প্রশ্ন করে ভাইকে। ” ভাইয়া! তুই ঠিক আছিস তো?”
ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল শুভ্রর বাবা মা। ওখান থেকে উচু গলায় শুভ্রর মায়ের প্রশ্ন- কে এসেছেরে শিশির? শিশিরের জবাব, তুমি দেখে যাও কে এসেছে? শুভ্রর মা দরজার সামনে এসে মুখ কালো করে ফেললেন। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
” তুই? তোকে না বলে দিয়েছি লাবণ্য এ বাসায় নেই? তো আবারো কেন এসেছিস?”
গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, ” লাবণ্য থাকে না বলে আমি কি এ বাসায় আসতে পারব না? নাকি এ বাসায় আসা আমার বারণ? ”
ড্রয়িংরুম থেকে শুভ্রর বাবা প্রশ্ন করেন, কে এসেছে শুভ্রর মা? কার সাথে কথা বলছ? শুভ্রর মা কোনো কথা না বলে কিচেনের দিকে চলে যান। শুভ্র রুমে প্রবেশ করে বাবাকে সালাম দেয়। মাথা উঁচু করে শুভ্রকে দেখে মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে সালামের জবাব দেন। শুভ্র ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে কিন্তু জবাব পায়নি। তাই চুপ করে রুমে চলে গেছে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে শুভ্র।
রাতটা কোনোমতে পোহাক। তারপর চিৎকার কান্নাকাটি করে হলেও ওদের থেকে লাবণ্যর ব্যাপারে জানতে হবে। কপালে হাত দিয়ে কথাগুলো ভাবছিল শুভ্র। তখনই রুমে প্রবেশ করে শিশির। “ভাইয়া চল! খাবি…”
আমি খাব না বলে বিদায় করে দেয় শুভ্র তার বোনকে। একটু পর রুমে প্রবেশ করে শুভ্রর বাবা। ” কি হলো? তোর মা খাবার নিয়ে বসে আছে। যাচ্ছিস না কেন?”
গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, খিদে নেই আমার। তোমরা খেয়ে নাও। শুভ্রর বাবা কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুভ্র ওর বাবা মাকে লাবণ্যর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ওরা ওকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দেয়। রাগে কষ্টে ব্রেকফাস্ট না করেই রুমে যায় শুভ্র। দুপুর ১২টার দিকে শুভ্রর বাবা শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র তখন জানালার গ্রিল ধরে চুপটি করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুভ্রর বাবা এসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে? হসপিটালে যাবি না?” শুভ্র স্থির গলায় জবাব দেয়, না।
বাবা বুঝতে পারল ছেলের মনের অবস্থা ভালো নই, তাই আর কোনো কথা না বলে রুমে থেকে বের হয়ে গেলেন ওনি। পরদিন শুভ্র আর বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। পড়তে পারেনি ফজরের নামাজ। পড়বে কিভাবে? না খেতে পেয়ে শরীর যে একদম দুর্বল হয়ে গেছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। সারাদিনের ভেতর ছেলেকে একবারও রুমের বাইরে না দেখে ভয় পেয়ে যান রোকসানা বেগম। শুভ্র বিছানায় শুয়ে খিদের অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। একমাত্র ছেলের এমন করুণ অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল মায়ের। শিশিরের সহযোগীতায় ওনি শুভ্রকে জোর করে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। তারপর একদম জোর করেই খাইয়ে দেয়। রাত্রে শুভ্রকে আর ডাকতে হয়নি। শুভ্র নিজেই যাচ্ছিল ডিনার করতে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় দেখা হয় শিশিরের সাথে। হাতে ভাতের প্লেট আর তরকারীর বাটি নিয়ে উপরের রুমের দিকে যাচ্ছে। অবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, ” কিরে? খাবার নিয়ে উপরে কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠে শুভ্র। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে-
” ইয়েমানেনামানেআমি_ আসলে……”
শুভ্র চোখ বড় বড় করে বলে, কাঁপতেছিস কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? শিশির ঢোক গিলে বলে, আমি___ খাব, খাব এগুলো….
বিস্ময়ে হতবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, তুই খাবি? তো নিচে কি হয়ছে? শিশির বার বার আটকে যাচ্ছিল তবুও কাঁপা গলায় বলল, আমার রুমে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই…..
শিশিরের জবাব শুভ্রর কাছে সুবিধার মনে হলো না। তবুও বলল, যা তাহলে…..
শুভ্র নিচে চলে গেল।
শিশির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দু’লাফে রুমে গিয়ে হাত থেকে প্লেট আর বাটি রেখে ছিটকিনি এটে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে শিশির। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে শিশিরকে। ” কি হয়েছে শিশির?”
শিশির ঢোক গিলে বলে, কিছু না ভাবি। তুমি খাও তো….
৭দিন পর_
প্রতিদিনকার মত সেদিনও হসপিটাল থেকে সোজা এ বাসায় চলে আসে শুভ্র। এসেই ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে সে। রোকসানা বেগম প্লেটে খাবার দেওয়া মাত্রই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে পরে শুভ্র। এভাবে প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলি যে? বাবার প্রশ্নের জবাবে ছেলের উত্তর, আজকে শিশিরের সাথে রুমে খাব। শুভ্র সামনের দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে বাবা মায়ের কারো কথা কানে না নিয়ে শুভ্র এক পা দু’পা করে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করছে। উপরে শিশিরের রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় শিশির। ডাক দিতে গিয়েও ডাক দেয়নি বোনকে। কারন, ইতিমধ্যে শুভ্র বুঝে গেছে এ রুমে শিশির ছাড়াও আরো একজন আছে।
আজ শুভ্র ঐ ২য় জনের সাথে পরিচিত হবে। তাই খাবার হাতে নিশ্চুপ শুভ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক পর দরজা খুলে শিশির। দরজার সামনে শুভ্রকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। শিশির চমকে উঠে। কাঁপা গলায় আমতা আমতা করে বলে উঠে-
” তু…..তু……..তু……তুই……?”
কি হয়েছে শিশির? কার সাথে কথা বলছ? বলেই এগিয়ে আসছিল লাবণ্য। শুভ্রকে এখানে এভাবে দেখে চমকে যায় লাবণ্য। শুভ্রর চোখ এতক্ষণে শিশিরের থেকে লাবণ্যর দিকে চলে যায়। লাবণ্য শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।
চলবে…….