ভালো থেকো ভালোবাসা পর্ব-১+২

0
1834

#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#১ম পর্ব
লেখনীতে ; নাহার সাইবা

~ আমি আপনাকে খুব কষ্ট দেই তাই না মাস্টারমশাই ?
নিজের স্ত্রী মেঘলার মুখে হঠাৎ করে এমন প্রশ্নে আকাশ প্লেটে ভাত মাখানো বন্ধ করে দিল।পাশের ঔষধপথ্য রাখা ট্রেটাতে প্লেটটা রাখল অতঃপর মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল
~ হঠাৎ এমন প্রশ্নের কারণ জানতে পারি?( আকাশ)
মলিন হাসল মেঘলা,চুলগুলো কাঁধ অবধি উঠে এসেছে যা আগে মেঝেতে গড়াগড়ি খেত।হসপিটালের বেড আর হুইলচেয়ার আজ সঙ্গি এমন চঞ্চলা মেয়েটার।আঁখি দ্বয়ের দৃষ্টি রুগ্ন তবে তার মাঝের আবেদনটি তীব্র। সেই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের চেহারা আজ ভঙ্গুর, উজ্জ্বলতাহীন।ঠোঁটের মিষ্টি হাসির দেখা পাওয়া দুষ্করই বটে।
~ অবশ্যই জানতে পারেন মাস্টারমশাই। আপনাকে আমি প্রচন্ড জ্বালাতন সেই শুরু থেকেই করে আসছি যখন আপনি অতিষ্ঠ হয়ে মাঝেমধ্যে বাড়ি ছেড়েও চলে যেতেন তবে জানেন আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আপনি যেমনটা পছন্দ করেন ঠিক তেমনটাই হয়ে দেখাব।বন্ধ করে দিয়েছিলাম জ্বালানো,আপনার স্বস্তি মিলেছিল।তবে আজ অনিচ্ছার স্বত্বেও সেই আপনাকে নিজের সাথে বেঁধে রাখতে বাধ্য হচ্ছি।আমি জানি আমি আপনার চরম বিরক্তির অন্যতম কারণ তবুও বলব আমার জীবনের অন্তিমসময় পর্যন্ত অন্তত আমাকে সহ্য করুন তারপর নিজের মতো বাঁচবেন নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়ে আমি নামক বাঁধা আর থাকবে না।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অতঃপর আবারো তরকারির বাটি থেকে ঝোল দিয়ে ভাত মাখাতে লাগল। আকাশের উত্তর না পেয়ে মেঘলা হাসল,হাসির মাঝে বেদনা মিশ্রিত।
আপনি কিন্তু আমায় কথা দিয়েছিলেন আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার সব কথা শুনবেন,মানবেন।আমায় মূল্য দিবেন তবে আমি আমার কথা অনুযায়ী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হলেও আপনি আপনার কথা রাখছেন না।( মেঘলা)
_ তার আগে তুমি আমায় বল মেঘলা এত বড় বড় কথা বলা শিখলে কবে,কোথা হতে?( আকাশ)
_ যেদিন থেকে আপনার অবহেলার দহনে দগ্ধ হতে হতে নিজেকে আপনার যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ছিলাম ঠিক সেদিন থেকে।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ কিছু বলল না।ভাত মাখানো প্লেটটা মেঘলার হাতে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল হসপিটালের জেনারেল ওয়ার্ড থেকে।মেঘলা আকাশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিজের রুগ্ন হাতের সাহায্যে ধীরে ধীরে খাওয়া শুরু করল।
আকাশ হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখছে একপানে।এই বুঝি আকাশ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি পড়বে হয়ত।মেঘলার কিছুক্ষণ আগের বলা প্রতিটি কথা আকাশের মনে দাগ কেটে গেছে। যদিওবা মেঘলার সামনে আকাশ কখনোই নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করেনি বা প্রথম প্রথম মেঘলাকে মেনে নেয়নি।তবে একসময় অজান্তেই কাগজে কলমে লিখিত সম্পর্কটা যে কখন হৃদয়ের দলিলে স্বাক্ষরিত হলো আকাশ তা বুঝতেই পারেনি।মেঘলার চঞ্চল, এলেমেলো পদক্ষেপ গুলো প্রথম প্রথম বিরক্তিকর মনে হলেও আজ যেন সে সেসব আচরণ গুলোকেই বড্ড মিস করছে।তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার তার আর মেঘলার বিয়েতে পর্যন্ত তার মত ছিল না সেদিন…

————
আকাশ সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করে একটা ছোটখাটো আইটিফার্মে জব পেয়েছিল সম্প্রতি।একটা ভালো স্থায়ী চাকরি পেলেই সে বিয়ে করে নেবে তার ভালোবাসার মানুষ রোশনিকে।সন্ধ্যা সাতটার দিকে অফিস থেকে বেড়িয়ে লেগুনায় উঠল। পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠলে বিরক্ত হলো এমনিতে গাদাগাদি করে বসেছে আবার ফোনটাও বাজছে।অবশেষে ফোনটা পকেট থেকে বেড় করে দেখল তার মামা দিবাকর বাবু ফোন করেছেন।ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।ফোনটা রিসিভ করতেই সে বলল
~ হ্যালো,মামা কেমন আছ তুমি?হঠাৎ এতদিন পর তোমার ফোন?( আকাশ)
_ আমি আছি রে ভালো পাগলা। বল তোর কী খবর?কোথায় তুই?( দিবাকর বাবু)
_ এইতো মাত্র অফিস থেকে বেড় হয়ে লেগুনায় উঠলাম। কেন মামা তোমার কী কোনোকিছু দরকার আমি ঐ বাড়ি আসব?( আকাশ)
_ আমার তো তোকে দরকার ছিলই রে আকাশ।তুই তোর ম্যাসে না ফিরে আমার বাড়িতে চলে আয়।তোকে নিয়ে এক জায়গায় যাব ভাবছি আর কিছু কথাও আছে।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় আকাশ না করতে পারল না যদিও তার আজ আটটার দিকে রোশনির সঙ্গে দেখা করার কথা তবুও সে সম্মতি জানালো এরপর দিবাকর বাবু ফোন কেটে দিল।সে ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল লেগুনা থেকে ম্যাসের আগেই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রোশনির নাম্বার ডায়াল করল। কিছুক্ষণ বাজার পর রোশনি কলটা পিক করল।আকাশকে কিছু না বলতে দিয়ে নিজেই বিরক্তি মাখা কন্ঠে বলল
_ হেই আকাশ বেব,কোথায় তুমি?আমি রেস্টুরেন্টে সেই কখন থেকে তোমার জন্য ওয়েট করছি এখনো এসে পৌঁছালে না আটটা অলরেডি বেজে গেছে।আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?( রোশনি)
_ একচুয়ালি আ’ম সরি রোশনি।আজকে আমি তোমার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই বেড়িয়ে ছিলাম অফিস থেকে তবে মাঝ রাস্তায় মামা ফোন করে জানালো তার নাকি আমার সাথে জরুরি কথা আছে মামার বাসায় যেতে হবে এখন।তুমি বল আমি কী করব?মামা আর তুমি,তোমাদের কথা আমার কাছে সমান ইম্পর্টেন্ট। তবে আজ মামার সাথে দেখা না করলে মামা প্রচন্ড কষ্ট পাবে।প্লিজ সোনা আজ তুমি বাসায় ফিরে যাও। আমরা কাল মিট করি?( আকাশ অনুনয় করে বলল)
আকাশের কথায় রোশনির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।সে ধীরে স্বরে বলল
_ ওহ্ আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে তুমি তোমার মামার বাড়িতেই যাও।আমিও বরং আমার বাড়ি ফিরে যাই।( রোশনি)
রোশনির যে মনটা খারাপ হয়ে গেছে তা আকাশ বুঝতে পারল তাই বলল
~ রোশনি তুমি রাগ করোনি তো সোনা?জানোই তো এই মামা আমার জন্য কী কী করেছে?এই মামার অবদান আমার জীবনে ভোলার নয়।তাই আমি মামাকে কোনোভাবেই হার্ট করতে চাই না।তুমিও প্লিজ বুঝার চেষ্টা কর,আর রাগ করো না প্লিজ।( আকাশ)
আকাশের কথায় রোশনি হাসার চেষ্টা করল,আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল
_ আরেহ না বাবা আমি রাগ করিনি।তুমি যাও ওখানে দেখো মামা আবার কীসের জন্য তোমায় জরুরি তলব করেছে?আমার কথা ভাবতে হবে না আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। ( রোশনি)
রোশনির কথায় আকাশ স্মিত হাসল অতঃপর কলটা ডিসকানেকটেড করে মামার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
মামার বাড়ি এসে পৌছাতে দেখতে পেলো মামা কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে বসে আছে তাকে দেখে হেঁসে উঠে দাঁড়ালো।
~ আরে ভাগিনা,এসে পড়েছিস সময় মতো।চল বেড়িয়ে পড়ি তাহলে।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবু বেড় হতে উদ্ধত হলে আকাশ পথ আটকালো
~ আরে মামা,কোথায় যাচ্ছ তাইতো বল?( আকাশ)
আকাশের কথায় দিবাকর বাবু খিকখিক করে হেঁসে উঠলেন,উত্তেজিত গলায় বললেন
_ কেন ভাগ্নে তোর বিয়ের পাকা কথা বলতে।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর কথায় আকাশের মাথায় বাজ পড়ল যেন! সে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এমনকিছু শুনবে যেন আশা করেনি। ততক্ষণে আকাশের মামী শ্রীলেখা দেবী এগিয়ে এলেন।আকাশের পিঠে চাপড় মেরে বললেন
~ কী বাবা চমকে গেলি মনে হচ্ছে? আরে আমরা দু’জন মিলেই দেখেশুনে মেয়েটাকে ঠিক করেছি।ভীষণ মিষ্টি আর ভালো স্বভাবের। দুকূলে কেউ নেই,অনাথ।এক মাসির বাড়িতেই বড় হয়েছে তারাও চায় একটা ভালো পাত্র।আর আমাদের কাছে তো তোর থেকে ভালো পাত্র আর কেউই নেই।( শ্রীলেখা দেবী)
শ্রীলেখা দেবীর কথায় আকাশ আরেক দফা অবাক হলো।তার বিস্ময় ভাব যেন ক্রমেই বাড়ছে।এবার দিবাকর বাবু স্ত্রীর কথায় তাল মিলিয়ে বললেন
_ একদমই ঠিক বলেছে শ্রী।মেয়েটার নাম মেঘলা খুব চঞ্চল স্বভাবের। আমার বন্ধুই ওর মেসো। তাই বন্ধুর কথা ফেলতে পারলাম না তোর ছবি আর বায়োডাটা দিয়ে দিলাম। তোকে খুব পছন্দ করেছে।আর আমাদের মেয়েও খুব পছন্দ হয়েছে। আশা করি তোরও এতে দ্বিমত থাকছে না।আজ চল তোকে নিয়ে আমি আর তোর মামি মেয়েটাকে একবার দেখে আসি সব কথা পাকা হলে বিয়েটা একটা শুভ দিনক্ষণ দেখেই দিয়ে ফেলব।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবুর মুখের হাসি ক্রমেই চওড়া হতে লাগল।তবে আকাশ আর মুখ বন্ধ করে থাকতে পারল না।সে সামান্য বাঁধা দিয়ে বলল
~ কিন্তু মামা এ কী করে হয়?বিয়ে করব আমি। আমার মেয়েকে পছন্দ হয় কী না তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আমার যদি ভালোবাসার মানুষ থেকে তাহলে আমি কী জবাব দিব তাকে?তুমি আমায় না জানিয়ে এমন বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ভূল করলে মামা।( আকাশ)
আকাশের কথায় দিবাকর বাবুর ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল,শ্রীলেখা দেবীও সামান্য অবাক হলেন মামার প্রতি প্রচন্ড বাধ্য ছেলের এমন কথায়।দিবাকর বাবুর মুখ কঠোর হয়ে এলো।গম্ভীর কন্ঠে বললেন
~ তার মানে তুমি বলতে চাইছ আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তা ভূল?নাকি আমাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত তোমার জীবনে আর প্রভাব বিস্তার করতে দিবে না তুমি?কোনটা?(দিবাকর বাবু)
~ মামা,তুমি আমায় প্লিজ ভূল বুঝ না।তুমি নিজেও না জানো তুমি আর মামী মা আমার কাছে কী! তোমরা না থাকলে বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর তো আমার জীবনটা এত সুন্দর হত না।তোমরাই আমায় বড় করেছ,আমায় পড়ালেখা করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছ। তোমাদের অবদান কখনো ভূলতে পারব না আমি।তবুও আমিও তো একজনকে ভালোবাসি মামা তাকে কী করে ধোঁকা দেই বুঝার চেষ্টা কর তোমরা।( আকাশ অনুনয় করে বলল)
দিবাকর বাবু হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন আকাশকে।
~ থাক তোমায় আর কিছু বুঝাতে হবে না আকাশ।আমরা যা বুঝার বুঝে নিয়েছি কয়েকদিনের ভালোবাসার আদান – প্রদানে এখন একটা মেয়ে যতটা তোমার প্রিয় হয়ে উঠেছে আমরা এতগুলো বছর তোমায় ভালোবেসে,স্নেহ করে,বড় করেও সেই জায়গাটা অর্জন করতে পারিনি। তবে একটা শেষ কথা শুনে রাখ আকাশ,তুমি যদি ঐ মেয়ের জন্য আমাদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি না হয় তবে আমাদের সাথে তোমার সম্পর্ক ও ছিন্ন করতে হবে।চল শ্রী।( দিবাকর বাবু)
দিবাকর বাবু নিজের স্ত্রীর হাত টেনে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন।আকাশ সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল।

একটা পার্কের বেঞ্চে বসে বাদাম খাচ্ছে রোশনি, তার পাশে উদাস ভঙ্গিতে বসে আকাশ দেখতে ব্যস্ত আকাশ।রোশনি লাগাতার অনেক কথা বললেও আকাশ বিপরীতে একেবারেই নিশ্চুপ।রোশনি এবার বিরক্তি মাখা কন্ঠে আকাশকে উদ্দেশ্য করে বলল
_ কী হলো আকাশ?তখন থেকে আমি একাধারে বলেই যাচ্ছি কথা তুমি শুনেও কিছু বলছ না যে।কিছু হয়েছে তোমার?( রোশনি)
রোশনির প্রশ্নে আকাশ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার দিকে। রোশনি নিজেও আকাশকে নিজের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো কেননা তার চাহনি ছিল অন্যান্য সময়ের থেকে গভীর,হৃদয়স্পর্শী। আকাশ হঠাৎই আনমনে বলে উঠল
~ আচ্ছা, রোশনি আমি যদি তোমার না হয়ে চিরকালের জন্য অন্য কারো হয়ে যায় তুমি কী খুব কষ্ট পাবে তাতে?( আকাশ)
আকাশের প্রশ্নে রোশনির ভেতরটা মোচড় দিলাম উঠল।সে কম্পিত কণ্ঠে বলল
_ এ..এস..সব আজেবাজে কথা কেন বলছ আকাশ?আমার কিন্তু খুব ভয় লাগছে।প্লিজ আর মজা করো না এবার মজা করা বন্ধ কর।( রোশনি)
আকাশ দৃষ্টি সোজা রেখেই মলিন কন্ঠে বলল
~ আমি মিথ্যে বলছি না রোশনি।মামা আমার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে আর তাকেই বিয়ে করতে হবে। তা না হলে মামা-মামীর সঙ্গের এতদিনের সম্পর্ক ভেঙে ফেলতে হবে।আমি কিছুতেই পারব না মামার মনে কষ্ট দিয়ে সুখী হতে সেজন্যই হয়ত তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার বিসর্জন দিতে হবে রোশনি।( আকাশ)
আকাশের কথায় রোশনি স্তম্ভিত হয়ে গেলো তার হাতের বাদামের ঠোঙা টা পড়ে গেলে নিচে।

চলবে কী?

#ভালো_থেকো_ভালোবাসা
#২য়_পর্ব
লেখনীতে; নাহার সাইবা

আকাশ মাত্রা অতিরিক্ত বিরক্তি নিয়ে ফুল সজ্জার ঘরে প্রবেশ করল।ঢুকতেই দেখতে পেলো সকল লাইট অফ কেবল ডিম লাইটের নীল আলো রুম টার অন্ধকার দূরীকরণে ব্যস্ত। নাকে ভেসে আসে রজনীগন্ধা আর গোলাপের সুভাস।যদিও পরিবেশটা খুবই স্নিগ্ধ তবুও তা আকাশের মন ভালো করার জন্য যথেষ্ট নয়। তার এখন মন পড়ে রয়েছে রোশানির মাঝেই।সে কী করছ?কাঁদছে কিনা?খাচ্ছে তো সময় মতো? এসব ভাবনাই যেন মনের অলিগলিতে ঘুরাফেরা করছে।তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল আজ মেয়েটাকে সব সত্যি কথা বলে সে ভারমুক্ত। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো সে ঘরে আর কাউকেই দেখতে পেলো না।বেলকনির দিকে এগিয়ে গেলো দেখতে পেলো লাল বেনারসি পরিহিত নারীর ছায়া।সে দূরে দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ ডাকল তবে নাম ধরে নয়
~ এই যে মিস সরি মিসেস লাল শাড়ি আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছেন?( আকাশ)
আকাশের কথায় বেলকনির রেলিং ঘেঁষে দাড়ানো মেয়েটির মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো না।আকাশ বেশ কয়েকবার ডেকে বিরক্ত হয়ে রুমে চলে গেলো।বসে বসে রোশানির নাম্বারে ট্রাই করতে লাগল তবে প্রত্যেকবারই রোশানির ফোনটা সুইচ অফ বলছে।রোশানি মেয়েটার জন্য আকাশের বড্ড চিন্তা হতে লাগল এভাবেই সেদিন ভীষণ খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিল সে যদিও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তবুও এটাই সত্য যে সে রোশানির ভালোবাসার প্রতিদান যথাযথভাবে দিতে পারেনি।মেয়েটা তাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার পরেও তাকে নিজের বিবাহিত স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেনি শুধুমাত্র মামা-মামীর কারণে আর সেই মেয়েটার জন্য যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে গতকাল মণ্ডপে যার সিঁথি রাঙিয়ে গেছে আকাশের সিঁদুরে। যার সাথে সে সাত পাকের বাঁধনে আবদ্ধ হয়েছে।
হঠাৎ করে মেয়েটা এসে দাঁড়ালো আকাশের সামনে, আকাশ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো মেঘলার দিকে। মেঘলা হাসল ভীষণ মিষ্টি লাগছে তাকে।লাল বেনারসির সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি মুখে প্রসাধনীর হালকা ছাপ সেই সাথে মায়া কাড়া দুটো চোখ। সব মিলিয়ে তথাকথিত সাদা চামড়ার সুন্দরী না হলেও স্নিগ্ধতা রয়েছে তার চেহারার মাঝে বেশ যদিও তা আকাশের আখিতে ধরা পড়ল না।আকাশ রুক্ষ কন্ঠে প্রথমেই বলল
~ আপনি এতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে কী করছিলেন?আমি তখন থেকে আপনাকে ডাকছিলাম আপনি সাড়াও দিচ্ছিলেন না কেন? কানে শুনেন না নাকি?( আকাশ)
আকাশের কথায় মেঘলা হাসল বেশ কিছুক্ষণ যেন আকাশ তাকে কোনো জোক্স শুনালো,আকাশ বিরক্তি সেই সাথে রেগেও গেল মেঘলার এমন আচরণে।সে গলা উঁচিয়ে বলল
_ আশ্চর্য!! আপনি এভাবে হাসছেন কেন?কানের সাথে মাথার ও কী সমস্যা আছে নাকি?( আকাশ)
মেঘলা এবার হাসি থামালো,ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা বজায় রেখেই বলল
_ না আমার মাথায় সমস্যা আর না আমায় কানে।আসলে পুরো সমস্যাটাই হলো আপনার মাঝে।( মেঘলা)
মেঘলা খিলখিলিয়ে হাসল যাতে আকাশের রাগটা আরো বেড়ে গেলো।সে উঠে দাঁড়ালো বসা থেকে তারপর মেঘলার দিকে এগিয়ে গেলো
~ আমার মাঝে সমস্যা বলতে কী বুঝাতে চাইছ তুমি মিসেস লাল শাড়ি? ( আকাশ)
~ আমি তো এটাই বুঝাতে চাইছি যে বেলকনিতে লাল শাড়ি নামের কোনো মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল না।আপনি যদি রাতভর লাল শাড়ি বলে কাউকে ডাকেন তাহলে সাড়া দেবে কে পেতনী? ( মেঘলা)
মেঘলার রসিকতায় আকাশের মেজাজ আরো চটে গেল।সে তেড়েফুঁড়ে গিয়ে বলল
~ তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। সেখানে যে দাঁড়িয়ে ছিল অর্থ্যাৎ আপনার নাম কী?বা আপনাকে কী বলে সম্বোধন করব।আপনাকে ডেকেছিলাম বুঝতে পেরেও উত্তর দেননি কেন তাই বলুন।( আকাশ)
~ আপনি যদি আমার নাম ধরে না ডাকতে পারেন তাহলে আমিও আপনার ডাক না নিতেই পারি।এটাই সাইন্স বুঝলেন?( মেঘলা)
মেঘলার এমন কথায় আকাশের চোখ মুখে পুনরায় বিরক্তি ভর করল। সে মেঘলার দিকে তাকিয়ে বলল
_ দোহাই লাগে এবার এই সম্বোধন পর্বটার সমালোচনা বন্ধ কর।( আকাশ)
~ বন্ধ করতেই পারি যদি আপনি আপনার ভূূলটা স্বীকার করেন তবে।( মেঘলা)
মেঘলার কাঠকাঠ জবাবে আকাশ ছোট্ট শ্বাস ফেলল পুনরায় নিজের চেহারায় কাঠিন্য বজায় রেখে বলল
~ আমি যদিও ভূল করি তবে তোমার কাছে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নই,কেননা তুমি আমার কেউই হও না।( আকাশ)
আকাশের কথায় যেন মেঘলা বিস্মিত হলো এমন একটা ভাব বজায় রেখেই বলল
~ ওমা! সে কী? আমি আপনার কেউ নই কী করে?গতকালই তো অগ্নিকে স্বাক্ষী রেখে সাত পাকে বাঁধার বন্ধনে আবদ্ধ হলাম,আমি সিঁথির সিঁদুর আপনার নামে।আর আপনি বলছেন আমি আপনার কেউ নই!! ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে না? (মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ আরো গম্ভীর হয়ে গেলো
~ ব্যাপারটা হাস্যকর নাকি নয় তা জানার ইচ্ছে আমার নেই।তবে এটাই সত্যি আমার শ্রদ্ধেয় মামা আর মামীর মন রক্ষার্থেই আমি বিয়েটা করেছি।তবে কখনোই তোমায় নিজের স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারব না।কেননা আমি অপর একজনকে ভালোবাসি এবং সেও আমায় ভালোবাসে। তাই দয়া করে আমাদের মাঝে না আসার অনুরোধ রইল। ( আকাশ)
আকাশের কথায় আবারো মেঘলা হাসল এবার উচ্চস্বরেই হাসল, তা দেখে আকাশের কপাল কুঁচকে গেলো।মেঘলা হোহো স্বরে হাসতে হাসতে বলল
~ আরে দাদা,প্লিজ নাটক করা বন্ধ করুন।এসব বিয়ের প্রথম রাতে সব ছেলেরাই ডায়লগটা দেয় খুব করে বলে তারা বিয়েটা মেনে নিবে না তাদের নাকি ভালোবাসার মানুষ আছে।তবে শেষে সেই বিয়ে করা বউয়ের নীড়েই ফিরে।এসব সিনেমা আর গল্পে খুব হয়,পরে নায়ক লাস্টে ঠিকই নায়িকাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।আমি জানি আমার সাথেও ঠিক তেমনটাই হবে।( মেঘলা)
মেঘলার কথায় আকাশ তার কোমল হাত শক্ত করে চেপে দেওয়ালের সাথে চাপিয়ে দাঁড়ালো।হিসহিসিয়ে বলল
~ জীবনটা গল্প বা সিনেমা নয়।আর হ্যা তুমি যদি মনে করে থাক তোমার মতো থার্ড ক্লাস একজন কুশ্রী চেহারার মেয়ের জন্য আমি আমার ভালোবাসার মানুষ স্মার্ট, শিক্ষিত, সুন্দরী প্রেমিকাকে ভূলব তা অসম্ভব!! তাই এসব দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করে।আর নিজের জায়গাটা একটু বুঝার চেষ্টা কর,তুমি কোথা হতে এসেছ আর আমি কোথাকার?( আকাশ)
আকাশের কথা শেষ না হতেই মেঘলা বলে উঠল
~ আপনার আর আমার মাঝে জায়গা নিয়ে পার্থক্য হবে কেন?আমরা দুজনেই দুটো মায়ের কাছ থেকে এসেছি। এবং দু’জনেই অনাথ সেই সাথে দু’জনেই পৃথিবীর বাসিন্দা। এমন তো নয় যে আপনি নেপচুন থেকে এসেছেন আর আমি পৃথিবীর। ( মেঘলা)
মেঘলা এই বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগল। আকাশ ক্ষোভে মেঘলাকে ছেড়ে দাঁড়ালো। রাগে ফুঁসতে লাগল। কিছুক্ষণ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে মেঘলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
~ তুমি কিন্তু আমার সাথে শুধুই মজা করছ না বরং আমার সাথো বেয়াদবি করছ।বেয়াদব মেয়ে,কথা মাটিতে পড়তে না দিয়েই মুখে মুখে কথা বল।অসভ্য আমার সাথে এরপর থেকে মেপে মেপে কথা বলবে।তা না হলে…
~ তা না হলে কী? কী করবেন আমায়?( মেঘলা)
মেঘলা ছলছল নয়নে হাসি মাখা বদনে জিজ্ঞেস করল।
~ তাহলে আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হব।( আকাশ)
~ আমার তাতেও অভ্যাস আছে।( মেঘলা)
মেঘলা চোখে জল,ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বলল।আকাশ আর এবার কিছু বলল না সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মেঘলার দিকে তারপর নিজের ওয়ালেট আর ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে।আকাশের প্রস্থানে মেলার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেলো সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বেলকনির দিকে।আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল
~ কেন মা, কেন বাবা এভাবে হারিয়ে গেলে আমার জীবন থেকে?যদি হারিয়েই যেতে হয় তবে আমায় নিয়ে গেলে না কেন? এভাবে স্বার্থপর পৃথিবীতে যে আমার নিতান্তই পরিচয়হীন অনাথ ব্যতিত অন্যকোনো পরিচয় নেই।আজ শুধুমাত্র আমার মা – বাবা না থাকার কারণে সবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, অবহেলার পাত্রী।ভেবেছিলাম বিয়ে হলে হয়ত স্বামীর ভালোবাসা অর্জন করে নেব।তবে দেখ সেও ভালোবাসে অপরজনকে।আমার ভাগ্যই খারাপ না হলে যার ভালোবাসা চাই সেই কেন আমার জীবনে থাকতে পারে না?হয়ত মেসোর কথা মতো সত্যিই আমি অপয়া!! তবে এই অপয়া মেয়েটার তো একটাই চাহিদা ছিল ভালোবাসার।আমি তো একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে উন্মাদ হয়ে থাকি,মানুষের মন জয়ের জন্য নিজের জীবনটা ব্যয় করে ফেললাম।তবুও পারলাম না জীবনে ভালোবাসার উপস্থিতি স্থির করতে।হয়ত যারা বেশি ভালোবাসা চায় তাদের কপালে কখনোই ভালোবাসা জুটে না কেবল জুটে অবহেলা…
মেঘলার কথাগুলোর সঙ্গে গড়িয়ে পড়তে লাগল চোখের জল অবিরাম ধারায়।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে