ভাঙা_বাড়িপর্বঃ ০৫(শেষ পর্ব)

0
2989

ভাঙা_বাড়িপর্বঃ ০৫(শেষ পর্ব)
– আবির খান

আমি সমানে কান্না করছি। হাত পা সব ভয়ে অবস হয়ে আসছে। কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। তাহলে কি আজ আমার শেষ?? আর বেঁচে থাকা হবে না?? আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।

আমি এসব মনে মনে বলছি ঠিক তখনই আমার গালে কসিয়ে এক থাপ্পড় পরে। থাপ্পড় এর জোর এত্তো বেশি যে আমার কান থেকে রক্ত পরতে শুরু করে। শরীরের সব শক্তি এক করে বললাম,

— দয়া করে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আপনাদের কি ক্ষতি করেছি?? আমাকে ছেড়ে দিন। আল্লাহ আমাকে বাঁচাও। কাঁদতে কাঁদতে।

— তোর কোনো ছাড় নাই। তুই আমার যা ক্ষতি করেছিস। দেখ কি করেছিস।

আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম হঠাৎই বিকট এক শব্দ আর ঝড়ো বাতাসের মধ্যে থেকে অট্টহাসি দিয়ে এমন এক ভয়ংকর কুৎসিত বিকৃত চেহারা আমার সামনে দৃশ্যমান হলো। তার চোখ থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে। কাঁটা-ছিড়া বিভৎস তার মুখ। তার এই দৃশ্য দেখে আমার বমি আসছে, মাথা ঘুরাচ্ছে, আর ভয়ে আমার অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে। হৃদপিন্ড মনে হচ্ছে ফেটেই যাবে। ঠিক তখনই সে আমাকে এমন জোরে এক ধাক্কা দিলো যে আমি আর নিতে পারলাম না। জ্ঞান হারালাম। এরপর কি হলো আমার আর জানি না।

শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করছি। আমি কি বেঁচে আছি??? নাকি শেষ??? আস্তে আস্তে করে চোখটা খুল্লাম। তাকিয়ে দেখি আমার বাবা-মা আমাকে দেখে অঝোরে কাঁদছে। বাবা বললেন,

— বাবা, তুই ঠিক আছিস?? আল্লাহ তোকে বাঁচাইছে বাবা। আল্লাহ তোমার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া। কাঁদতে কাঁদতে বলছে।

পাশ থেকে মাও অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

— রুমেল, বাবা আমার তুই ঠিক আছিস?? আমাদের চিনতে পারছিস??

আমি বুঝতে পারছি না ওনারা এমন করছেন কেন!! কি হয়েছে আমার৷ আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমি হাসপাতালে। আমি আস্তে করে বললাম,

— আমার কি হয়েছে বাবা-মা?? (অামি)

— কি বলিস বাবা, তোর মনে নাই সেদিন রাতের কথা?? তোকে নিয়ে গেছিলো সেই ভাঙা বাড়িতে। (বাবা)

— ভাঙা বাড়ি!!!(অামি)

আমি মনে করতে নিলাম সব। খুব কষ্ট হচ্ছে মনে করতে। হ্যাঁ মনে পরেছে সেই রাতের কথা। সেই বিভৎস চেহারার কথা। আমার এখনও ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি কিভাবে??

— আমি বেঁচে আছি কিভাবে?? (অামি)

— জানিস বাবা, আজ ৫ দিন হলো তুই অজ্ঞান। তোর জ্ঞান কোনো ভাবেই আসছিলো না। তোর মা আর আমি নামাজ পড়তে পড়তে আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চেতে চেতে শেষমেশ আল্লাহ তোকে আমাদের কাছে অাবার ফিরিয়ে দিলেন। আল্লাহ সব পারে বাবা সব।

— কিন্তু আমি বাঁচলাম কিভাবে ওই জ্বিনের হাত থেকে??

— তাহলে শোন, আল্লাহ তায়ালা সঠিক সময়ে শুভ এর ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। ও উঠে তোকে না দেখে আর দরজাও খোলা দেখে দ্রুত আমাদের সবাইকে খবর দিলে তোর দাদি তার জ্বিন লাগিয়ে দিয়ে তোকে খুঁজে বের করে। খুব কষ্টে তোর দাদি এই জ্বিনের কাছ থেকে তোকে ছাড়িয়ে আনছে। ওই খারাপ জ্বিনটা খুব শক্তিশালী ছিলো কিন্তু আল্লাহ তায়ালার রহমতের সামনে কিচ্ছুনা। যেই ফজরের আযান পড়ে আর সাথে সাথেই ওই জ্বিন চলে যায়। তার আগ পর্যন্ত খুব কষ্টে তোকে বাচিঁয়ে রাখছি আমরা। আমরা ৭ জন মিলে তোকে ধরে রাখতে পারিনি। তুই এতোটা শক্তি শালী হয়ে গিয়েছিল। তোর মধ্যে এই জ্বিনটা ঢুকে গিয়েছিলো। আল্লাহ তায়ালা রহমতে শেষমেষ তোকে ছেড়ে চলে গেছে। তোর সেই তাবিজ খুলে ফেলায় ওই জ্বিন তোর এতো বড় ক্ষতি করতে পারলো। সেই তাবিজ তোর দাদি খুঁজে বের করে আবার পরিয়ে দিয়েছে তোকে। তুই সুস্থ হলেই এর শেষ করবে তোর দাদি। একটা বড় হুজুর আসবে এই জ্বিনের মোকাবিলা করতে। সে খুবই পরহেজগার মানুষ।

— এতো কিছু হয়ে গেছে?? মা প্লিজ তুমি অার কেঁদো না। আমি এখন ভালো আছি।

— জানিস বাবা, এই ৫ দিন বিভিন্ন ভাবে ওই জ্বিন এসে এখানে অত্যাচার করছে। জানালায় বাড়ি, বড় বড় পাথার ফিকে মারছে আরো কতো কি। তোর দাদি না থাকলে যে কি হতো। (মা)

— দাদি ভালো অাছেতো??(আমি)

— হ্যাঁ আছে ভালো আছে।

আমি মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। সত্যি আল্লাহ তুমিই পারো সব।

— আমি বুঝছিনা, আমি কি এমন ক্ষতি করলাম ওই জ্বিনের যে সে এভাবে আমার পিছনে উঠে পরে লেগেছে। (আমি)

— সেটা জানতেই হুজুর আসছে। তুই সুস্থ হ বাবা।(বাবা))

এরপর আরো ৫ দিন কেটে গেলো। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ। এখন রাত ১০ টা। আজ সেই হুজুর এসেছে। আমাকে নিয়ে আমার বাবা, আমি আর সেই হুজুর আর তার চারজন সাহায্যকারী আমার পাশে বসেছেন। আর বাড়ির বাকি লোকেরা সবাই পাশের রুমে একসাথে বসে আছে। তাদের সবাইকে বন্ধক দেওয়া হয়েছে। কারণ এই জ্বিন খুবই ভয়ংকর। যেকোনো কোনো সময় যেকোনো কিছু করতে পারে। হুজুর আমার উপর সেই জ্বিনকে হাজির করবেন। আমি প্রচন্ড ভয় পাচ্ছি। কিন্তু তাও আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে শক্ত হয়ে বসে আছি। সবাইকে সব বুঝিয়ে হুজুর এক জায়নামাজে আর আমি আরেক জায়নামাজে বসে আছি। হুজুর পবিত্র কুরআন শরীফ নিয়ে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলেন। উনি এত্তো সুন্দর করে কুরআন পড়ছেন যেন মনে হচ্ছে আমি বেহেশতে আছি। চারদিক ওনার কুরআন শরীফ পড়ার আওয়াজে মুখরিত হয়ে আছে। ঠিক তখনই আমার শরীরের অস্বাভাবিক পরিবর্তন শুরু হয়। আমার গা প্রচন্ড পরিমাণে জ্বলতে শুরু করে। এতোক্ষণ খুব ভালো লাগছিলো হুজুরের কুরআন তেলওয়াত। কিন্তু এখন আমি সহ্যই করতে পারছি না। হুজুরকে আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে। আমার সব অন্ধকার হয়ে আসে। আমি আর কিছু জানি না।

রুমেল তার চেতনা হারানোর সাথে সাথেই জ্বিন এসে হাজির হয়। হুজুরের সেই চারজন সহকারী চারদিক থেকে রুমেলকে চেপে ধরে। অনেক বড় পুরুষের কণ্ঠে ভয়ংকর ভাবে রুমেল কথা বলতে শুরু করে। যেটা রুমেলের কণ্ঠ না।

—- আমাকে ডাকছিস কেন!! আমাকে ছাড়। আমি ওকে মারবো। আমি ওকে মারবো।

হুজুর পড়া থামিয়ে এবার বলতে শুরু করেন,

— কে তুই কোথা থেকে এসেছিস??কেন ওর ক্ষতি করতে চাচ্ছিস??বল?? (হুজুর)

— আমি তোরে কিচ্ছু বলমু না। তুই চলে যা নাহলে আজ সবগুলোকে মেরে ফেলবো।

— আমার আল্লাহ সম্পর্কে তোর ধারণা নাই। তাহলে দেখ।

হুজুর জোরে জোরে কুরআন শরীফ পড়তে শুরু করেন। আর রুমেল ব্যাথায় ছটফট করতে শুরু করে। যেন ওকে কেউ প্রচন্ড ভাবে মারছে। রুমেলের বাবা অঝোর ধারায় কান্না করছে ছেলের কষ্ট দেখে। জ্বিনটা আর সহ্য করতে না পেরে বলে,

— থাম থাম আমি সব বলছি।

— বল।(হুজুর)

— আমি ওই ভাঙা বাড়িতে বহু কাল ধরে থাকি। এই ছেলে গত ৫ বছর আগে আমার গায়ে প্রস্রাব করে। আমি অপবিত্র হয়ে যাই। আমাকে আমার জ্বিন সমাজ থেকে বের করে দেয়। আমি পরিনত হয় খারাপ জ্বিনে। আমার চেহারা দেহ সব ওর জন্য নষ্ট হয়ে যায়। আমি তখনই ওকে শেষ করে দিতাম শুধু ওর দাদির জন্য পারিনি। আমি ওকে এবার ছাড়বো না। আমি ওকে শেষ করে দিবো। ছাড় আমাকে। রাগী আর ভয়ংকর কণ্ঠে বলল।

হুজুর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,

— দেখ, আমি বুঝতে পারছি তোর কষ্ট। কিন্তু ও না জেনেই এটা করছে। তুই ওখানে থাকিস ও জানতো না। না জেনেই ও কাজটা করেছে। ওকে ছেড়ে দে। আমি আমার মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করবো যেন তুই এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাস। ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে যা।

— না না না। কোনোদিন আমি যাবো না। ওকে শেষ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি নাই।

রুমেকের প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। হুজুর এবার রাগী ভাবে বললেন,

— তুই না গেলে আমি এখনই তোকে এখানে শেষ করে দিবো। (হুজুর)

— কিচ্ছু করতে পারবি না আমার। তোকেও শেষ করে দিবো।

হুজুর এবার দ্রুত এবং জোরে আওয়াজ করে কুরআন শরীফ পড়তে শুরু করেন। আর সেই সাথে একসময় জ্বিনটা আর সহ্য করতে না পেরে রুমেলকে ছেড়ে হুজুরের কাছে মাফ চেয়ে চলে যায়। আর বলে যায় সে আর কখনো রুমেলের কাছে আসিবে না। রুমেল এখন বিপদ মুক্ত আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় আর রহমতে।

—> আমাদের মতো জ্বিন সম্প্রদায় রয়েছে এটি বিশ্বাস করা আমাদের মুসলমান হিসেবে কর্তব্য। জ্বিনদের ভিতরেও আমাদের মতো খারাপ কিংবা ভালো রয়েছে। এরা সম্পূর্ণ অদৃশ্য অবস্থায় থাকে। ফলে আমরা এদের দেখতে পারিনা। এরা মানুষের আনাগোনা যেখানে কম বা একেবারেই নেই সেসব স্থানে থাকে। যেমন বলা যাক আমাদের এই ভাঙা বাড়িই। এরা হয়তো সেসব স্থানের কোনো গাছে, কোনো ফুলে বা একটা নিদিষ্ট স্থানে এরা থাকে। তাই এসব স্থানে আমাদের ছোট বাচ্চাদের কিংবা বড়রাও খুব সাবধানে যাওয়া উচিৎ। এবং গেলেও রুমেলের মতো এমন কিছু করা যাবে না যার ফলে তাদের ক্ষতি হয়। অনেকেই গ্রামে বেড়াতে গেলে তাদের ছেলে মেয়েদের যেখানে খুশি সেখানে যেতে দিন। কোনো খেয়াল রাখেন না তারা কোথায় যাচ্ছে কি করছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বন জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে এটা ওটা করছে। ফলে তারা এমন সব জায়গায় চলে যায় যেখানে সচারাচর কেউ যায়না। তার অজান্তেই সামান্য ভুল করে ফেলে। যার ফলে তাদের অবস্থা রুমেলের মতো হয়। এই গল্পটা লেখার মূল উদ্দেশ্যই ছিল এই বিষয়টাই তুলে ধরার জন্য। আপনাদের কিংবা আপনাদের সন্তান কেউই এসব স্থানে ভুলেও যাবেন না। বা গেলেও রুমেলের মতো কোনো প্রকার অস্বাভাবিক আচরণ করবেন না। নাহলে আপনাদের কিংবা আপনার সন্তানের বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে। কোনো প্রশ্ন থাকলে করবেন। কেমন লেগেছে পুরো গল্পটি?? আপনি কি কিছু শিখতে পারলেন?? জানাবেন কিন্তু। ধন্যবাদ সবাইকে এতোটা সময় ধরে সাথে থাকার জন্য।

– সমাপ্ত।
© আবির খান।

– কোনো ভুল হলে মাফ করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে