#বৃষ্টির_ছন্দ
পর্ব-৩ ( শেষ পর্ব)
হলুদের অনুষ্ঠানে কী কী হয়েছে সে গল্প শোনানো হচ্ছে দাদীকে। তবে গল্পটি মৃদুল নয় রিধি শোনাচ্ছে। দাদীর ঘরে আজকেও ঘুমাবে তিন্নিকে বলে এসেছে রিধি। হলুদের সাজপোষাকে বসেই হাত নেড়ে জ্বালাতন করা মেয়েগুলির ভার মুখের গল্প বলছে রিধি। দাদী খুব মজা পেয়ে ফোকলা মুখে হাসছে, রিধিও হাসছে। মৃদুল চুপ করে দুজনার কান্ড দেখছে।
দাদী বলে, শাড়ি পাল্টাইবা না রিধি?
– জি দাদী, একবারে গোসল করে ঘুমাবো। গরম লাগছে খুব।
মৃদুল বলে, কিছুক্ষণ পর কিন্তু বিদ্যুৎ চলে যাবে।
-ওহো, তাহলে তো এখনই গোসল সারতে হয়। চট করে উঠে ব্যাগ থেকে কাপড় বের করতে লাগে রিধি।
গতদিনের চেয়ে রিধি আজ বেশ চটপটে। দাদীর সাথে সম্পর্ক জমছে, মৃদুলকে নিয়েও অস্বস্তি নেই যেন। তবু মৃদুল নিজের রুমে চলে আসে রিধির প্রাইভেসির কথা ভেবে।
ঘরে আরেকটা বাথরুম থাকার দরকার ছিল। বাড়তি একটা রুম করাও জরুরি। এতোদিন এসব মাথায় আসেনি, দাদী নাতির সংসারে প্রয়োজনও পড়েনি। আজ মনে হচ্ছে, একটা ড্রইংরুম, অ্যাটাচ বাথসহ দুইটা বেডরুম করা দরকার। রিধি যেন পরবর্তীতে…. কী ভাবছে এসব! চিন্তা পাল্টায় মৃদুল।
রিধি গোসল সেরে বের হলেও মৃদুল আর নিজের রুম হতে বের হয় না। বিদ্যুৎ চলে গেলে চার্জার হাতে আসতে বাধ্য হয়। মৃদু আলোয় ছোট ছোট ভেজা চুলে শ্যামবর্ণের রিধিকে দেখতে অন্যরকম সুন্দর লাগছিল। ঘরে আইপিএসেরও দরকার আছে ভেবেছিল, এখন মনে হচ্ছে মৃদু আলোয় রিধির যে সৌন্দর্য তা আলোর প্রখরতায় জানা হতো না।
ভোরে দরজা খুলে বাইরে বেরোতে নিলে দেখে বারান্দার চেয়ারে বসে আছে রিধি।
– এতো সকালে উঠলে যে?
রিধি হেসে উত্তর দেয়, সকালে ওঠাই অভ্যাস। চলুন নাস্তা করতে যাই।
কিছু চিন্তা মাথায় উঁকি দেয়, তবে তা ঝেড়ে মৃদুল বলে, হুম চলো।
নাস্তায় কেউ নেই। গতরাতের অনুষ্ঠান রাত অবদি চলায় সবাই ঘুমোচ্ছে। স্বপ্নাখালা নাস্তা বেড়ে দিলে চোখ কচলে তিন্নির মা আসেন। লাজুক হেসে বলেন, আজ উঠতে দেরী হয়ে গেল। এতো কাজ ছিল, সকালে ঘুম ভাঙতেই চায়নি।
রিধি হেসে বলে, না আন্টি, পারলে আরেকটু শুয়ে নিন। আজ বিয়েতে দৌড়ঝাঁপ আরো বেশি হবে। শরীরে শক্তি দরকার।
তিন্নির মা বলেন, তা কী কেউ বুঝবে রে মা? মেয়ে মানুষের এতো ঘুমোলে চলে? তাও আবার আমি কনের মা!
মৃদুল বলে, চাচী তিন্নিরা কেউ ওঠে নি? ওদের নদীর পাশ ঘুরিয়ে আনতাম।
– না রে, সব নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে।
রিধিকে জিজ্ঞেস করে মৃদুল, যাবে তুমি?
রিধির আগেই চাচী বলেন, সবাই উঠলে একসাথে যেও।
-না চাচী, আমাকে হাসপাতাল যেতে হবে। তাছাড়া বেলা পড়লে রোদে ঘুরতে ভালো লাগবে না।
রিধি বলে, আমি যেতে চাই, যাবো আন্টি?
এতোশত চিন্তা করতে জানে না সরল মনের তিন্নির মা। মেয়েগুলো কাল চলেই যাবে। যা ঘুরার ঘুরে নিক ভেবে সম্মতি দেন।
আকাশে মেঘ জমছে। সাথে করে ছাতা নিয়ে নেয় মৃদুল। নদীর কিনারে যেতে যেতে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়। ছাতা খুলে রিধিকে ছাতার নিচে ডাকে। দ্বিধা ছাড়াই রিধি মৃদুলের সাথে চলে। হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ঘরে ফিরে যাবার কথা না ভেবে ধীরে ধীরে এগোয় দুজন।
মৃদুল মনে মনে চাইছিল তিন্নি বা ওর বান্ধবীরা না থাকুক। শুধু রিধিকেই প্রিয় জায়গাটি দেখানোর ইচ্ছে। দুই দিনের পরিচয়ে কেন এতো আপন মনে হচ্ছে রিধিকে জানা নেই। হয়তো রিধি আন্তরিক বলে।
বৃষ্টি বেড়ে গেলে নদীর কিনার পর্যন্ত আর যাওয়া হয় না। বট গাছের নীচে দুজন আশ্রয় নেয়। বৃষ্টির দাপুটে হাওয়ায় ছাতাটি দোদুল্যমান। তবু ফিরে যাই কথাটা কেউ বলে না।
বর্ষায় টুইটুম্বর নদীতে নৌকা চলছে। কিনারে একটা বরই গাছ তাকে স্বর্ণলতা গ্রাস করেছে। বৃষ্টির প্রবলতায় নদীর ওপার একেবারে ঝাপসা। শীত শীত বাতাসে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে বাকহারা রিধি মুগ্ধ চোখে অবলোকন করে প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য।
মৃদুল বলে, এ জায়গাটা আমার ভীষণ প্রিয়। ছোট থেকেই একা বড় হয়েছি। প্রায়ই এখানে একা বসে বসে সময় কাটাতাম। বলা যায় এই বিশাল আকাশ, খরোস্রোতা নদী, ওই বরইগাছটি আমার বন্ধু।
রিধির দিকে চাইলে দেখে টপ টপ করে জল পড়ছে গাল বেয়ে। চমকে ওঠে মৃদুল। তুমি কাঁদছো কেন রিধি?
ঠোঁটে হাসি মেখে ভেজা চোখে মৃদুলের দিকে তাকায় রিধি। এতো সুন্দর দৃশ্য আমি জীবনেও দেখিনি! এই দৃশ্য আজীবন আমার মনের কুঠুরিতে বন্দি থাকবে। এই মুহূর্ত, বৃষ্টিতে এমন দাঁড়িয়ে থাকা কখনো ভুলবো না আমি। আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ দিবো, জানা নেই!
মৃদুল সামনে তাকিয়ে হাসে, রিধিও এই প্রকৃতিতে হারিয়ে যেতে চায়।
রিমঝিম বৃষ্টিতে দুজনার শরীরের পাশাপাশি মন ভেজে একত্রে, নব এক অনুভূতিতে সিক্ত হয় দুজনে। একে অন্যের হাত ছোঁয়া হয় না তবু অদৃশ্য গহীন ছোঁয়ায় আবেশিত হয় মন।
বিয়ের আয়োজন মেঘ কাঁদা মিলিয়ে শেষ হয়। বিশাল আয়োজনেও ঘাটতি চোখে পড়ে বরের মামার। তাই নিয়ে রাগারাগি, মান ভাঙ্গানো আরো কতকিছু। হা হয়ে দেখে রিধিসহ ওর বান্ধবীরা। এতো হট্টগোল শেষে আবার মিলেমিশে খাওয়া দাওয়া, গগন বিদারী কান্না করে কনের নতুন জীবনের যাত্রা। পরিশ্রম শেষে ক্লান্ত ভূঁইয়া পরিবারের সকলে। অন্যদিকে রিধিরা ক্লান্ত নানান নাটকীয়তা দেখে। এক বান্ধবী বলেই বসে সারাজীবন শুনলাম গ্রামের মানুষ সোজাসরল হয়, এ বিয়েতে না আসলে জানতামই না কেবল পান সাজিয়ে দেয়নি এমন অযুহাতে এতোবড়ো ঝগড়া বাঁধতে পারে। তিন্নি হেসে বলে, এমন নাটক গ্রামের সব বিয়েতেই হয়। নইলে তারা ইজ্জতদার নয়, বুঝলি?
হায় রে সরলতা…বলে হেসে ওঠে বান্ধবীরা।
গ্রামের গরলতার প্যাঁচে পড়েছে মৃদুল। মনে শংকা জেগেছিল বারবার তবু পাত্তা দেয়নি। মনের ইচ্ছেটাকে আজ ছাড় দিতে চেয়েছিল, তা-ই সইলো না। বিয়ের অনুষ্ঠানে রিধিকে পুরোপুরি এড়িয়ে চললো মৃদুল। রিধি ভেবেছে হট্টগোলের কারণে মৃদুল হয়তো ব্যস্ত। নইলে পুরো বেলা কথা বলা দূর চোখাচোখিও হবে না!
মৃদুল মোবাইলে কথা বলছিল, রিধি এগিয়ে গেলে তিন্নির আম্মা পথ আটকে রিধিকে অন্যপাশে নিয়ে যায়। চাপা কণ্ঠে বলে, কিছু মনে করো না রিধি, আজ ভোরে তোমরা নদীর ধারে গিয়েছিলে তা তোমার ছোট চাচীর চোখে ঠেকেছে। মৃদুলকে কটুকথা শুনিয়েছে। আমি এতো প্যাচ বুঝি না মা, তাই তোমাদের বাধাও দেই নি। কিন্তু গ্রামে বদনাম রটলে… তুমি আমাদের মেহমান, তোমার বদনামী মানে আমাদের বদনামী। তুমি বুঝছো তো ? মৃদুল থেকে দূরে থাকো, কাল তো চলেই যাচ্ছো!
রিধির মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। তিন্নির মা ওর গালে মুখে হাত বুলিয়ে সরে এলে রিধি তাও মৃদুলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। থমথমে মুখে প্রশ্ন করে, আপনি কী ছোট চাচীর কথায় আমাকে এড়িয়ে চলছেন?
মৃদুল একপলক চেয়ে বুঝতে পারে রিধি জেনে গেছে। মুখ গম্ভীর রেখে বলে, আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে একা ওভাবে নিয়ে যাওয়া আমার উচিত হয়নি।
-অন্যরা কী বললো তা আপনি ভয় পান?
– মন চাইলেই তো সব করা উচিত নয়, তাই না?
রিধি আর দাঁড়ায় না সোজা দোতালায় চলে যায়। রিধির চলা যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদুলের সবকিছু শূন্য মনে হয়।
বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কান্না করে রিধি। জীবনের এতো সুন্দর মুহূর্তটি পুরোই মিথ্যে হয়ে গেল! নিজেকে বহুকষ্টে সামলে চোখ মুখ ধুয়ে বের হয়। তিন্নিকে সামনে পেয়ে চোখ নামিয়ে বলে, দাদীর ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসি। আজ এখানেই থাকবো তোদের সাথে।
তিন্নি শুনেছে রিধির সাথে মৃদুল সম্পর্কিত গুঞ্জন। রিধি সেনসেটিভ মেয়ে, ভেঙ্গে পড়লে সর্বনাশ হবে। ঘটনা আর যেন না ছড়ায় তাই বলে, সেটাই ভালো হবে রে..
ব্যাগ গুছিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে অন্ধকার মুখে বিদায় নেয় রিধি। দাদীর অভিজ্ঞ মন ঠিকই আন্দাজ করতে পারে কোথাও জল ঘোলা হয়েছে।
মৃদুল হাসপালাতে ছিল। অসময়ে যাবার দরকার ছিল না, বিয়ে উপলক্ষে আজ ছুটিও নেয়া ছিল। তবু নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্যে যাওয়া।
মন টেকে নি বেশিক্ষণ, আবার বাড়ি ফিরে। দাদীর কাছে শুনতে পায় রিধি ব্যাগসহ বিদায় নিয়ে গেছে। মন আরো বিক্ষিপ্ত হয়, তিন্নিদের বাড়ির নিচে হাঁটাহাটি করলে রিধি একবারো নিচে নামে না। দোতালায় গিয়েও রিধির দেখা মেলে না। রুমবন্দি হয়ে আছে রিধি।
নিজের উপর রাগ হয় মৃদুলের। কী দরকার ছিল রিধিকে ওমন কিছু বলার। কাল তো চলেই যাচ্ছিল, হাসিমুখেই বিদায় দিতো। কানাঘুষা যা হবার মৃদুলকে নিয়ে হতো। এসব আর নতুন কিছু নয় মৃদুলের জীবনে।
উপায় না পেয়ে তিন্নিকে অনুরোধ করে রিধিকে ডেকে দেবার জন্য।
তিন্নি বুঝতে পারে দুইদিক থেকেই দগ্ধ মন। গ্রামের পরিবেশে সহজ জিনিসকেও জটিল করে দেখা হয়। কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারে না তিন্নি। রিধির মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলে, কল করে কথা বলে নাও।
মনের ভেতর ঝড় বইছে, দূরে সরে ব্যস্ত আঙুলে কল দেয় মৃদুল। রিধির কণ্ঠ শুনতেই ভেতরটা যেন শীতল হয়ে পড়ে।
এপাশের নীরবতায় রিধি বোঝে, মানুষটা কে।
সময় কেটে যায় নিঃশব্দে…
-সরি রিধি, আমি বুঝিনি এমন কিছু হবে। ছোট চাচী তোমাকে নিয়ে বাজে কথা বলবে জানলে….
-আমি চাচীর কথায় দুঃখ পাই নি, স্পষ্ট সুরে বলে রিধি।
মৃদুল থামে কিছুক্ষণ আবার বলে, দাদী বলল তুমি ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছো!
-আপনার বদনাম হোক চাই নি।
-আমার বদনাম নিয়ে আমি বিচলিত নই রিধি।
রিধি চুপ করে থাকে।
-একবার নিচে নামবে?
-না।
-খুব দরকার ছিল।
-আমার কাছে যেটা চমৎকার মুহূর্ত আপনার কাছে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত। এরপর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। আপনি ভালো থাকুন। লাইন কেটে দেয় রিধি।
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৃদুল। জীবনে শেষবার কখন চোখের কোণ ভিজেছিল জানা নেই। আজ হঠাৎ চোখ জ্বালা করায় অবাক হয় না। জীবনের ভালো অংশগুলো মৃদুলের পাতে কখনো উঠে নি।
স্বপ্নাখালা দাদীর জন্য খাবার নিয়ে গেলে খাওয়া শেষে ছড়ির খটখট শব্দ তুলে তিন্নিদের ঘরে ঢোকে দাদী। দোতলায় সিড়ি ভেঙে ওঠা কষ্টকর তবু তিনি ওঠেন।
তিন রুম জুড়ে নারীদের আস্তানা। তিন্নির মা, খালা, ছোট চাচী, উনার বোন, মাসহ তিন্নির মামাতো, খালাতো বোনেরাও আছে। দাদীর উপস্থিতিতে নড়েচড়ে বসে সবাই।
তিন্নির মায়ের উদ্দেশ্যে দাদী বলেন, স্বপ্না তো অনেক থাকলো আইজ নিয়া যাই। আমার পা দুইটা মেজমেজ করতেছে, ওর মালিশ দরকার।
স্বপ্নাখালা মোচড় মেরে বলে সারাদিনের খাটাখাটুনি শেষে আবার পা টিপা আমার শইলে দিবো না।
তিন্নির মা বলেন, আজ তো মেহমান আছে আম্মা। আগামীকাল সবাই চইলা যাইবো। আগামীকাল স্বপ্নারে নিয়েন।
-হো, আমি বুড়ি একলা মইরা থাকলেও কারো যায় আসে না। আইজ সারাটা দিন একলা ঘরে আমি। বাঁইচা আছি না মইরা গেছি কেউ একবার চুঁপি দিছো? দরকারে আমার কামের বেটিরেই নিয়া আইছো। দুইবেলা খাবার পাঠাইয়াই দায়িত্ব শেষ!
ছোট চাচী বলেন, বিয়া বাড়িতে একটু ব্যস্ততা থাকেই। কেউ তো বইসা আছিল না।
-তা বইসা নাই, তয় তোমার ভাগেও তেমন কাম পড়ে নাই। তুমি চলো আমার ওখানে, পা টিইপা দিবা।
ছোট চাচী থতমত খেয়ে যায়।
-দুইদিন রিধি মেয়েটা ছিল, রাতে পা পিইপা দিছে দেইখা আরাম করে ঘুমাইছি। নইলে…
তিন্নির মা অবাক সুরে বলেন, আম্মা আপনি মেহমানরে দিয়া পা টিপাইছেন?
-তো কী করমু? এতো গুলো নাতি নকসল একটাও চুপি দিয়া দেখছে বুড়ি দাদী কী করে, কেমন আছে? আমার পেটে পোকা ধরছিল তাই পুলাগুলো বেইমান জন্মাইছে, বেইমানের ঘরের পোলাপান তো আর ভালো মানুষ হইবো না। সবকটাই স্বার্থপর!
ছোট চাচী মুখ বাঁকিয়ে বলে, ঘর ভর্তি মেহমানের সামনে সবসময় তামাশা করেন কেন আপনি?
-অতীত ভুলিনাই ছোট বউ! কে কতটুকু তামাশা করে আমার জানা আছে। এখন কও কে আমার পা টিপতে সাথে যাইবো?
সবাই মুখ বাঁকিয়ে চুপ করে থাকে।
দাদী গলা উঁচিয়ে বলে, কী গো রিধি, দুইদিন পা টিইপাই হাত ভাইঙ্গা গেছে? কোনো সাড়া দেও না কেন?
পাশের রুমে বসা রিধি থ হয়ে আছে দাদীর মিথ্যা কথা শুনে। রিধি একদিনও দাদীর পা টিপে দেয়নি। দাদী কখনো বলেও নি।
দাদী আবার গলা উঁচায়, যাইবা না রিধি?
ওতোশত চিন্তা বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি উত্তর দেয়, আসছি দাদী।
রিধির বান্ধবী ফিসফিস করে বলে, তোকে দিয়ে দাদী পা টেপায় প্রতিদিন? কেন যাচ্ছিস?
তিন্নি ঝটপট বলে, রিধি যেতে চাইলে যা, দাদীর মুখের উপরে কারো কথা চলে না।
রিধি তিন্নির দিকে একনজর তাকায়। দুই বান্ধবীর চোখে বোঝাপড়া হয় যেন।
রুম থেকে বেরিয়ে দাদীর হাত ধরে রিধি। মাথায় হাত বুলিয়ে দাদী বলেন, বাবামায়ের ভালো শিক্ষা এইটারেই কয়!
যেতে যেতে রিধি ভাবে, নিশ্চয়ই দাদীকে দিয়ে এসব মৃদুল করিয়েছে। অথচ ঘরে ঢুকে দেখে মৃদুল নেই। অভিমানী হয়ে ওঠা মন কিছু জিজ্ঞেস করতে চায় না।
বিছানায় শুয়ে দাদী বলেন দরজায় সিটকিনি দিয়া দাও রিধি। যুবতী মেয়ে নিয়া খোলা দরজায় ঘুমানো যাইবো না।
কোনো প্রশ্ন করার আগেই দাদী আবার বলেন, মৃদুলের আইতে রাত হইবো। ঘুমাইয়া পড়ো।
দাদীর পাশে বসে পা টিপতে গেলে দাদী পা সরিয়ে বলেন, ব্যাথা গেছে গা। ঘুমাও তুমি।
বিরস বদনে দাদীর পাশে শুয়ে পড়ে রিধি। কী ভেবে এলো, কী হলো!
বিদ্যুৎ চলে যায় কিছুক্ষণ পরেই। ঘুটঘুটে অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে কান্না আসে। মনের অস্থিরতা নিয়ে কী আর ঘুম আসে!
রাত কয়টা বাজে জানে না। নয়টায় দাদীর সাথে এসেছিল। কতোক্ষণ এভাবে পরে আছে কে জানে। বাইরে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে ঝুমঝুম বৃষ্টির শব্দে কান ফাঁটার উপক্রম।
হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে। রিধির বুক ধক করে ওঠে। দাদী বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মোবাইলে আলো জ্বেলে পা টিপে টিপে দরজা খুলতেই দেখে প্রত্যাশিত মানুষটি কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দিনের আলোয় শেষ দেখা অভিমানী রিধিকে মোটেও আশা করেনি মৃদুল। চেয়ে থাকে অপলক আহত দৃষ্টিতে।
রিধি সরে দাঁড়ালে মৃদুলও এগিয়ে নিজের ঘরে ঢোকে। কাপড় বদলে নিজ বিছানায় বসে কিছু ভাবার আগেই রুমে ঢোকে রিধি। যে মেয়ে মৃদুলের ঘরে একবারো আসার আগ্রহ দেখায় নি সে এমন ঝড়োরাতে মৃদুলের অন্ধকার ঘরে একা দাঁড়িয়ে।
মৃদুল অবাক হয়ে রিধির সামনে এগিয়ে যায়।
-কিছু বলবে?
রিধি চুপ থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, মোমবাতি লাগবে।
কাঁপা হাতে ড্রয়ার খুলে মোমবাতি নিয়ে ফিরে আসে মৃদুল। ভাবে না দেশলাই ছাড়া মোমবাতি নিয়ে কী করবে রিধি।
হাতে মোমবাতি ধরে নত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে রিধি। মৃদুলও নড়ে না সামনে থেকে।
খোলা জানালা ভেদ করে বৃষ্টির মাতাল হাওয়া ঘরের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। রিধির ছোট চুলগুলোও বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে। অন্ধকার ঘরে প্রকৃতির আলোয় রিধিকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতেই মনের শান্তি খুঁজে নিচ্ছে মৃদুল।
রিধি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে, কাল সকালে চলে যাচ্ছি।
মৃদুল কথা খুঁজে পায় না, রিধি অপেক্ষা করে চলে।
অন্ধকারে ছোটশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে মৃদুল বলে
-রিধি শোনো!
থামে রিধি তবে চোখ তুলে তাকায় না।
…. তুমি কি রয়ে যেতে চাও?
কাঁপা ঠোঁটে প্রশ্ন আসে, কিভাবে?
…দাদী বলছিল, তোমার পরিবারের সাথে আলাপ করবে।
-আপনি কী চান?
কিছুসময় থেমে উত্তর আসে, ঘরে ফিরে এলে দরজার ওপাশে রোজ তোমাকে দেখতে চাই।
শান্ত হয় রিধি, ধীরে ধীরে শরীর কাঁপিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মৃদুল তাকিয়ে থাকে সামনে দাঁড়ানো মায়াবতীর মুখপানে, যে কিনা মৃদুলের হতে চেয়ে হাপিত্যেশ কাঁদছে।
নিস্তব্ধ ঘরে টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টির ছন্দ। আলো আধারীর মাঝে দুজনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা।
..রিধি, দাদী ঘুমোচ্ছে …….. আমি কি তোমার অশ্রুগুলো স্পর্শ করতে পারি?
সমাপ্তি।
ঝিনুক চৌধুরী।