ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১১

0
2522

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা শুভ তেড়ে যায় ফারহানার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মারে ফারহানার গালে।

এ ঘটনায় মোটেও প্রস্তুত ছিল না ফারহানা। চমকে যায় সে। ভেঁজা চোখে মাথা তুলে তাকায় শুভর দিকে। আমতাআমতা স্বরে প্রশ্ন করে-
‘ শুভ! তুমি আমায় মারলে?’
প্রশ্নোত্তরে কিচ্ছু বলতে পারেনি শুভ। তার আগেই রুমে প্রবেশ করে ফারহানার মা। মেয়ের প্রশ্নের জবাবটি মা-ই দিয়ে দেয়।
‘ বেশ করেছে মেরেছে….’

বেশ অবাক হয় ফারহানা। মায়ের দিকে তাকিয়ে অনেকটা অভিমানি স্বরে প্রশ্ন করে-
‘ মা তুমি….(….)….???’
পুরো কথা বলতে পারেনি। মা মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে অনেকটা শাসনের স্বরে বলে-
‘ ও তো একটা দিয়েছে! অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আরো কয়টা পরতো গালে…!’
জবাবে কিচ্ছু বলেনি ফারহানা। শুধু জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় মায়ের দিকে। মা তার মেয়ের দৃষ্টির ভাষা বুঝে নেয় অতি সহজেই। জবাব দেয়-
‘ তুই যাকে কাজের মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেছিস সে কে জানিস? একসময়কার সাড়া জাগানো তরুণী ডাক্তার নীলিমা এবং বিশিষ্ট শিল্পপতির নাতনী আদিরা মাহমুদ নুহা। এই মেয়ের বাবা ঢাকা……(…)….কলেজের একজন সুনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে মেয়েটির মা অসুস্থ তাই তার স্ত্রীকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে আছেন….!’

এতটুকু বলে থেমে যায় ফারহানার মা। অনেক কিছু বলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পায়নি শুভ। তাই প্রচন্ড রাগ নিয়ে রুম থেকে বাহির হয়ে যায়।

এতক্ষণে মুখ খুলে ফারহানা। চাপা গলায় প্রশ্ন করে মাকে- ‘সবই তো বুঝলাম মা! কিন্তু ঐ মেয়ে এ বাড়িতে কি করে? মানে ও যেভাবে কাজ করে দৌঁড়াইয়া দৌঁড়াইয়া, দেখে তো মনে হয় না বেড়াতে এসেছে….’
মেয়ের প্রশ্নে মায়ের জবাব, আরে! তোর ফুপু শাশুড়ির পরানের বান্ধবী ছিল ডাক্তার নীলিমা। মায়ের অনুপস্থিতিতে ওনিই মেয়েটিকে মাতৃস্নেহ দিয়ে লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন।
বড়সড় নিশ্বাস নেয় ফারহানা। ‘ওহ, তাই বলো। সমস্যা নেই। ওনাদের যা ইচ্ছে করুক গিয়ে। কি বলো, মা?’
শয়তানি হাসি দেয় ফারহানার মা। জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ, সেটাই! আমাদের এতকিছু জেনে লাভ নেই। আমাদের কাজ নিয়ে ভাবা যাক আপাতত….’

রাতের খাবারের পর ফারহানা গিয়েছিল পাশের রুমে। আসার পর থেকে ছেলেকে একবারও দেখা হয়নি। যদিও তার ছেলেপিলে তে কোন নেশা নেই। তথাপি লোকদেখানোর জন্য উঁকি দেয় পাশের রুমের পর্দা ধরে।
আদনানকে পড়াচ্ছিল নুহা। আদনানও শান্ত বালকের ন্যায় নুহার কথা মতোই পড়ছিল। দরজার ওখান থেকে বলে উঠে ফারহানা- ‘ আসব…?’

দরজার দিকে তাকায় নুহা। ফারহানার মুখটা দেখে বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়। মনে হচ্ছে, কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে দুরমুশ পিটাচ্ছে ভেতরে।

নুহার অনুমতি দিতে হয়নি। তার আগেই রুমে ঢুকে পড়ে ফারহানা। আদনানের ঠিক পাশেই হুইল চেয়ারে বসে আছে ফারহানা। প্রশ্ন করেন ছেলেকে- ‘কেমন আছে আমার বাবা’টা?’
মনোযোগী স্টুডেন্ট আদনান বিজ্ঞদের ন্যায় অনেকটা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় ফারহানার দিকে। ফারহানা আবারো প্রশ্ন করেন ছেলেকে, ‘বাবা! কেমন আছো তুমি?’
ফারহানার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদনান ফিরে তাকায় নুহার দিকে। প্রশ্ন করে নুহাকে, ‘আম্মু! কি হয় ওনি তোমার?’
ঘোর কাটে নুহার। দীর্ঘশ্বাসের সাথে জবাব দেয়, আপু…! ওনি আমার আপু হয় আদনান…
কিছুক্ষণ একমনে কি যেন ভাবলো আদনান। তারপর হঠাৎ করেই প্রশ্ন করে বসে ফারহানাকে, ‘তুমি আমার আন্টি লাগো, তাই না?’

ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় ফারহানা। ভ্রু-কুঁচকে প্রশ্ন করেন ছেলে আদনানকে। ‘মানে? আমি তোমার আন্টি হই মানে? কে বলেছে তোমায় আমি তোমার আন্টি হই?’
হেসে দেয় আদনান। মুরুব্বীদের মতো করে জবাব দেয়, এটা আবার বলে দিতে হবে নাকি? আঁখি আন্টিও তো আমার আম্মুর আপু হয় আর আমার আন্টি হয়। তুমিও তো আম্মুর আপু। আমার তো আন্টি’ই লাগো, ঠিক না?

হো, হো করে হেসে দেয় ফারহানা। কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। ‘ওরে পাকনা বাবাটা আমার! ওনি তোমার মা নয়, আমি তোমার মা। আর আমি তোমার আন্টি নয়, ওনি তোমার আন্টি, নুহা আন্টি। কি নুহা? ঠিক বলছি তো?’
দম আটকে আসছে নুহার। বহু কষ্টে জবাব দেয়, হু…

রাগ উঠে যায় আদনানের। ফারহানার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। নুহার কোলে গিয়ে বসে পড়ে। অতঃপর ছোট্ট বিড়ালের মতো মাথা বের করে ফারহানার দিকে তাকায়। তারপর অনেকটা বিকৃত স্বরে বলে উঠে- ‘এ্যাহে… বললেই হলো। এটা আমার মা। তুমি না। তুমি মিছে কথা বলো….’
বিস্মিত ফারহানা আদনানের দিকে ফিরে তাকায়। প্রথম বার নুহাকে আম্মু ডাকছে এটা শুনেও মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল ফারহানা। কিন্তু পরপর
তিনবার একই ডাক। এটা মনের ভুল হতে পারে না। তাই ফারহানা একরকম জোর করে কাছে টেনে নেয় আদনানকে। প্রশ্ন করে- ‘ওনি তোমার কি হয়?’
এবারো আদনান অকপটে জবাব দেয়, নুহা ওর মা হয়।

নুহার দিকে ফিরে তাকায় ফারহানা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে নুহা। গলাটাও কিরকম শুকিয়ে আসছে। সেই সাথে ভিতরটা হু, হু করে কাঁদছে। অদ্ভুত রকম এক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে নুহার। কেন এই কষ্ট? এরকম লাগতেছে কেন আমার? আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি….! তাহলে এমন কেন লাগছে আমার? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন নুহার মনে। কোনোটার সঠিক জবাব নুহার মন নুহাকে দিতে পারেনি। ফারহানাটাও কিরকম অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল নুহার দিকে। নুহার তখনকার অবস্থা দেখে ফারহানার মনে বিরূপ ধারনার জন্ম নেয়। তবে কিচ্ছু বলেনি নুহাকে। নিঃশব্দে আদনানকে ছেড়ে দিয়ে রুম ছাড়ে ফারহানা।

বাহিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত্রি ১০টার দিকে বাসায় ফিরে শুভ। ড্রয়িংরুমে আদনানকে কোলে নিয়ে বসে কার্টুন দেখছে ফারহানা এবং তার মা। বাবাকে দেখে যেন স্বস্তি ফিরে পেলো ছেলে। দৌঁড়ে গেলো বাবার কাছে। জাপটে ধরলো বাবাকে।
ছেলেকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খায় শুভ।
‘ কি বাবা? কিছু বলবে?’

আদনান সোফার পাশে বসে থাকা মা এবং নানীর দিকে একবার তাকায়।
‘ বাবা আমি তোমাদের সাথে থাকবো আজকে…!’
ছেলের গালের সাথে গাল মেশায় শুভ।
‘ ঠিক আছে বাবা!
এখন বলো সন্ধ্যার পর পড়তে বসছিলা কি না…!’

রাগান্বিত দৃষ্টিতে আদনান ফিরে তাকায় সোফার দিকে। গাল ফুলিয়ে বড়দের ন্যায় জবাব দেয় আদনান, ইনার কারণে তো পড়তেও পারলাম না আজকে… একবার শুধু ফারহানার দিকে ফিরে তাকায় শুভ। তারপর ছেলেকে কোলে নিয়ে উপরে নিজ রুমের দিকে চলে যায়।
পিছু থেকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ফারহানা। মাথা নেড়ে বাঁধা দেয় পাশে বসা মা…

রাত্রে আদনানকে ঘুম পাড়িয়ে বাহির থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দরজা লক করছিল শুভ। দরজা ঠেলে হুইল চেয়ারে করে রুমে প্রবেশ করে ফারহানা।
– তুমি?
— এতগুলো বছর একা থাকলে। আজও একা থাকবে?
– What do you mean?
— আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি সেটা কি তুমি সত্যিই বুঝতে পারনি?
– এতকিছু বুঝার দরকার নেই আমার। বেরিয়ে যাও তুমি…
— চলে যাওয়ার জন্য তো আসিনি…!
– মানে কি?
— দেখো না, কত নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আমাদের ছেলেটা।
– আমাদের নয়। এ শুধু আমার ছেলে।
— আচ্ছা, তোমারই। এখন চলো তো…
– মানে কি?
— মানে আজকে আমরা তিনজন একসাথে ঘুমোবো…
– ইম্পসিবল…

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ফারহানা। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় হিয়া। হিয়া আন্টির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দরজার কাছে চলে যায় শুভ। প্রশ্ন করে, ‘কিছু বলবে আন্টি….?’
হিয়া শুভকে রুম থেকে বাহির করে নিয়ে যায়।

রাত্রি ১১টা বেজে ৩৮মিনিট_
ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হিয়া এবং শুভ। হিয়ার কথা হলো- ‘ এ মেয়ে পাগল হয়ে গেছে শুভ। ব্যাংক ম্যানেজার মনে হয় তাড়িয়ে দিয়েছে কিংবা তার টাকা ফুরিয়েছে। এই জন্য তোর কাছে ছুটে আসছে। সমস্যা নেই। বাপ তুই শুধু আজ রাতটা ঐ রুমে কাটা। তারপর সকালে যা করার করা যাবে…’
কিন্তু আন্টি! ও তো আমায় ডিভোর্স দিয়েছে। ডির্ভোস দিয়েও কোন অধিকারে আমার কাছে আসলো?
শুভর প্রশ্নোত্তরে হিয়ার জবাব, আছে। অধিকার আছে। তুই ডিভোর্স লেটার হাতে পেলেও ও ডিভোর্স লেটার হাতে পায়নি।
চাপা কন্ঠে শুভর জবাব, আমি তো ওকে ডির্ভোস’ই দেইনি আন্টি।
বলে উঠে হিয়া, সেটাই! তুই ওকে ডিভোর্স দিসনি। আর ও সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।
আচ্ছা, বাদ দে। রুমে যা। আজকের রাতটা আপাতত জেগে বসে কাটা। কালকে হবে…
গর্জে উঠে শুভ। ‘কাল কেন? আজই হবে। আমি ওকে আজই ডিভোর্স দেবো।’
পাগলামি করিস না। আমার কথা শুন। রুমে যা। সকালে যা হওয়ার হবে…

অনেক করে বুঝানোর পর তবেই রাজি হয়েছে শুভ।রুমে গিয়ে আদনানকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে শুভ। ফারহানাকে ওর মা বিছানার অপর পাশে শুইয়ে দিয়ে গেছে।

ঘড়ির কাটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। যেন সে এক রাতের জন্য চলার গতি হারিয়ে ফেলেছে। বসা থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করে আবার গিয়ে খাটে হেলান দেয়। সোফায় শুইতে গেলে চিল্লানো শুরু করে ফারহানা। মানসম্মানের ভয়ে আবারো খাটে এসে হেলান দেয় শুভ।

ঘন্টাখানেক পর ফারহানা ঘুমিয়ে যায়। সেই সুযোগে সোফায় গিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে শুভ। মিনিট ত্রিশেকের ভিতর শুভর চোখেও ঘুম চলে আসে।

ঘুমিয়ে পড়ে শুভ। দু’চোখ শুধু এক করতে পারেনি নুহা। ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। অচেনা এক কষ্ট ওর ভেতরটা শেষ করে দিচ্ছে। কাঁথার ভেতর মুখ লুকিয়ে সারারাত কেঁদেছে সে। যদিও কান্নার কারণটা তার অজানা।

শেষ রাত্রে শুভর রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে জানালার পর্দা সরায়। খাটে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে আদনান। এই মুহূর্তে ছোট্ট আদনানকে জড়িয়ে ধরতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে নুহার। মনকে শক্ত করে নুহা। সব ইচ্ছেকে সবসময় প্রশ্রয় দিতে নেই এটা ভেবেই চলে আসছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবেই খাট থেকে দৃষ্টি চলে যায় সোফায়। সোফায় শুয়ে আছে শুভ। শুভর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে ফারহানা। না চাইতেও চোখের কোণে জমে থাকা জলকণাগুলো অশ্রু হয়ে গাল গড়িয়ে ঝরে পরে নিচে…

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে